প্রিয় কবিতার ব্যবচ্ছেদ- ০১

রাসেল এর ছবি
লিখেছেন রাসেল (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০৩/২০০৮ - ৫:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জীবনানন্দ কেনো যেনো আমার সবচেয়ে প্রিয় কবির তালিকার উপরের দিকে উঠে আসতে পারলো না কখনই। নিবিষ্ট পঠনের পরও সুচেতনার মত কোনো সুদুরতম দ্বীপের বাসিন্দার মতো শীতল আকর্ষণ হয়ে থাকল।মনোহর আবেশে জড়িয়ে রাখলেও কোনো দিন হাওয়ার মৃদু সুবাসের মতো ফিনফিনে হাওয়ার চারপাশ ভরিয়ে তুললেও কখনও আপন হলো না। এমন কেউ হলো না যাকে নির্দ্বিধায় বলা যায় হৃদয়ের স্বর।

জীবনানন্দের পাঠকের মূল সমস্যা বোধ হয় কবিতা পাঠের প্রথমেই বনলতা সেন পড়ে ফেলা। এর পরে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত ক্যাম্পে পড়ে আট বছর আগের এক দিনের রহস্য ভেদ করতেই তারা খেই হারিয়ে ফেলে। এবং জীবনানন্দ বহুল পঠিত হয়েও অপরিচিত হয়ে থাকেন আমাদের কাছে। আমার জীবনানন্দ পাঠ পাঠ্য বইয়ের কল্যানে- বাংলাদেশের নীতিভ্রষ্ট উচচাভিলাষী বোর্ড কর্মকর্তারা আবার আসিব ফিরে এই বাংলায় কবিতাটা পাঠ্যসূচীর অংশ করে যতটা কৃতিত্ব পাবেন আর কৃতজ্ঞতা পাবেন তার সীমা নেই।

রূপসী বাংলার কবি কিংবা নির্জনতার কবি- নানাবিধ বিশেষণের আড়ালে আদতে কবিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবু আমরা একটা প্রবনতা নির্ধারণের বৃথা চেষ্টা চালিয়েই যাই। সমালোচকের পেটের ভাত এভাবেই জোটে তাই এটাকে নিন্দনীয় বলা যাবে না। তারা নানা রকমের বাক্য গঠন করবেন- একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করবেন, মানদন্ড কিংবা মাপকাঠি তুলে ধরবেন- তবে কবির মত জীবন্ত কোনো সত্তাকে একটা সীমানায় আটকে রাখা ভীষণ কঠিন। যদি সেটা কখনও সম্ভব হয়ে যায় তবে সে কবির কবিত্ব ক্ষমতার বিষয়ে আমার জোড়ালো সংশয় আছে।

জীবনানন্দের প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ঝড়া পালক আমাকে হতাশ করেছিল। ভীষণ রকম আহত হয়ে তাকে তুলে রেখেছিলাম জীবনানন্দ কবিতা সমগ্র। অনেক দিন ধুলো জমেছে সে বইয়ে। কোনো এক অলস দুপুরে নেহায়েত সময় কাটানোর জন্যই আবার হাতে উঠে আসলো কবিতা সমগ্র। ধীরে ধীরে পড়লাম ধুসর পান্ডুলিপি। খুব একটা আপ্লুত হতে পারি নি এ বারও, তবে শেষের কবিতাগুলো পড়ে অন্তত পুনরায় বইটা খুলব এমন একটা ইচ্ছা জেগেছিলো মনে।

যদি খুঁত ধরতে বলা হয় তবে বলতে হবে জীবনানন্দের প্রথম ২তি বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই আসলে নজরুল আর মোহিতলালের রচনার দুর্বল অনুকরণ। ছন্দ কিংবা বাক্য সমাবেশে তেমন অভিনবতব নেই- গিয়েছিনু বলেছিনু, নানা রকম যন্ত্রনাদায়ক বাক্যের ধারাবাহিক সংকলন। রবিন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তি বলে মনে হয় আমার কাছে -যখন কোনো কবি ক্রিয়াপদকে অন্তমিলের কাজে ব্যবহার করেন সেসব কবির কবিতা বিষয়ে রবিন্দ্রনাথের একটা বক্তব্য আছে তার ছন্দ বইয়ে। ব্রাহ্ম সমাজের গুরুদেব রবিন্দ্রনাথের সংঘের অংশ বলেই হয়তো রবিন্দ্রনাথ লিখিত একটি বানীও ছিলো জীবনানন্দের কবিতার বইয়ের সুচনাতে- কোনো একটা আলোচনাও আছে সম্ভবত রবিন্দ্রনাথের জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে।

যাই হোক এতকিছু আমার মন টানলো না জীবনানন্দের প্রথম ২টা প্রকাশিত কবিতার বই- যা উদ্যোগী হয়ে ছেপেছিলেন তার ভাই। অবশ্য ২য় কবিতার বইয়ের শেষের অংশটাতেই জীবনানন্দের শুঁয়ো পোকা থেকে প্রজাপতিতে রূপান্তরের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। যদিও অন্তমিলের প্রবনতা রদ হয় নি তবে উপমা আর রূপকের ব্যবহার ক্রমশ বদলে যাচ্ছে তার। একেবারে শেষের কবিতাগুলো গুণে মানে অনেক পরিনত আর স্বকীয় না হলেও স্বকীয়তার উষা বলা যায়। ধারাবাহিকতা কবিতাসূচির তবে জীবনানন্দের প্রবনতা বিচার করলে এটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন যে সূচির শেষের কবিতাগুলো আসলে পরে লিখিত। এমন কি রূপসী বাংলার কবিতাগুলোও ১৯৩৪-১৯৩৫এর রচনা।
বার বার লেখা সংশোধনের বিশ্রী বাতিক ছিলো তার। একই কবিতা অনেকবার পুণলিখিত হয়েই একটা আকার পেতো- তবে সেটাই যে অবিকৃত ছিলো সবসময় এমনও না- বরং প্রকাশিত বইয়ের পুনরমুদ্রণের সময়ও কবিতার বাক্য বিন্যাস বদলেছে। জীবনানন্দ বিষয়ে এটাই লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
পরবর্তী প্রকাশিত বইয়ে আমরা সম্পূর্ণ রূপান্তরিত জীবনানন্দের দেখা পাই- যে জীবনানন্দকে আবিস্কারের কৃতিত্ব অনেকাংশে বুদ্ধদেব বসুর। এই জীবনানন্দের রূপই আমাদের পরিচিত।আমরাই তাকে মহান আধুনিক শিরস্ত্রান পড়িয়ে পূজা করি। এই জীবনানন্দই আধুনিক কবিতার স্বর তৈরে করেছে- যার প্রভাব থেকে বাংলাদেশের অনেক উঠতি এবং প্রতিষ্ঠিত কবি বের হয়ে আসতে পারে নি। শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বইতে জীবনানন্দের প্রকট প্রভাব দেখা যায়। উত্তরাধুনিকতামত্ত কবিকূলের ভেতরের জীবনানন্দের শব থেকে যায়।
কবিতার আকাশকে এমন গ্রহণে ধাকতে পারে নি কোনো কবিই জীবনানন্দের মতো। কবিতার আধুনিকতাও কতটা মর্মান্তিক জিঘাংসু হতে পারে তার নিদর্শন জীবনানন্দের অনেক কবিতা। পাঠকে মায়াজালে বধ করে ফেলে, বশ করে ফেলে- বনলতা সেনের প্রকাশ বাংলা কবিতার জগতে একটা স্বরনীয় দিন- ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে কলিকাতার মর্ডান ইন্ডিয়া প্রেস থেকে ছাপা হয় এই বই। এবং প্রকাশক বরিশালের জীবনানন্দ দাশ।
তবে আমাকে বিবশ করে রাখে বনলতা সেনের বিড়াল কবিতা- চৈত্র ১৩৪৩ এ লিখিত কবিতায় তেমন বহুমাত্রিক কিছু নেই। এমন কি মুগ্ধ হবার মতো উপাদান এখানে বিদ্যমান কি না এটা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়- মনন্তরের ভয়ংক্র নাগরিক চিত্র হাইড্রান্ট থেকে কুষ্ঠ রোগীর জল চেটে খাওয়ার নির্মম ইতিহাস কবিতা হিসেবে উঠে আসে- তবে বেড়াল সব সময়ই সমসাময়িক। জীবনানন্দের বাক্য গঠনের বৈশিষ্ট্যি এমন- সহজ ভাবেই অনুসরণ করা যায়- এমন কি একটু অন্যমনস্ক হলে অনুকরণও করা যায়-
সারা দিন একটা বেড়ালের সাথে ঘুরে ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়ঃ
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে- বাদামি পাতার ভীড়ে
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর সাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি
কিন্তু তবুও কৃষ্ণচুড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে
সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলছে সে
একবার তাকে দেখা যায়
একবার হারিয়ে যায় কোথায়
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরাণ রং্যের সূর্যের নরম শরীরে
সাদা থাবা বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে
তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে
সমস্ত পৃথীবির ভিতর ছড়িয়ে দিল।

বেড়ালের জীবনযাপনের গল্পের ভেতরে তেমন বৈচিত্র নেই। বরং এটাকে সেভাবে রূপক কবিতাও বলা যায় না- এটা একেবারে স্থিরলক্ষ্য তীরের মতো, বেড়াল এখানে আদতেই বেড়াল- উচ্ছিস্ট ভক্ষণ এবং নিজেই নিজের ভেতরে লীন মনোভাবে বিশ্বাসী সরল বেড়াল-
তবুও পড়তে পড়তে কেমন অদ্ভুত লাগে বর্ননা-
শেষের ৪ পংক্তি মুগ্ধ করে ফেলে-

সূর্যের গায়ে থাবা দিয়ে খেলতে থাকা বৈকালিক বেড়াল সেই থাবাতেই অন্ধকার লুফে আনে- এই উপমাগুলোর চমক আমাকে ছেড়ে যায় না- আমি বার বার মুগ্ধ হয়ে পড়ি- অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনলো সে-


মন্তব্য

গৌতম এর ছবি

জনপ্রিয় কিছু প্রতির একটা মোহ আছে। ফলে জনপ্রিয় কবিতাগুলোই পড়া হয়, কবিদের সম্পর্কে জনপ্রিয় উক্তি বা ধারণাগুলোই মনের মাঝে গেঁথে থাকে। জনপ্রিয় কবিতাগুলো তাই মনে দাগ কাটে বেশি।

...আলোচনা চলুক।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ঝরা পাতা না পড়াই ভালো। কবি তখনো জন্মান নি। ওগুলোকে ক্রিকেটের পরিভাষায় অতিপ্রাথমিক পর্যায়ের নকিং বলা যেতে পারে। প্রকৃত জীবনানন্দ স্পষ্ট হতে শুরু করেন রূপসী বাংলা আর বনলতা সেনে। পরিণত জীবনানন্দকে পাওয়া যায় ধূসর পান্ডুলিপি, সাতটি তারার তিমির আর বেলা অবেলা কালবেলায়। এটা অবশ্য নিতান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।