সাত ভাইয়ের এক বোন চম্পা, ভাইয়েদের চোখের মনি, পিতার আদুরের দুলালী। ছোটো বোনটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে ৭ ভাই, মুখের কথা মাটিতে পড়বার আগেই বোনের আবদার পূরণ করে ফেলে ভাইয়েরা, ভাইদের আদর আর বাবার প্রশ্রয় পেয়ে বেড়ে উঠলো চম্পা, যথাসময়ে তার বিয়েও হলো।
বাবা মেয়েকে দূরে রাখতে চান না তাই কাছেই, ভালো ঘর দেখে এক এতিম ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই করে রাখবেন ছেলেটাকে এমনটাই ঠিক করলেন, আশেপাশের কয়েকগ্রাম খুঁজে এমন পাত্র পাওয়া গেলো, তাদের পাশের গ্রামের কায়েত মোল্লার ভাগিনা, তার মাতাও মরিয়া গিয়াছে কয়েক বছর হলো, মামা মামীর গলগ্রহ হয়ে বেঁচে আছে কায়েক্লেশে।
আমার চম্পার জন্য উপযুক্ত পাত্র, এমনটাই খুঁজছিলাম, মহাসমারোহে কাদেররের সাথে চম্পার বিয়েও হয়ে গেলো। প্রথম কয়েকদিন জামাই আদরে আদরে বেশ তুষ্ট ছিলো কাদের, তবে কয়েক দিন পরেই উশখুশ শুরু করলো।
আকিজ মিয়া ভাবলেন এ কেমনধারা আচরণ জামাইয়ের, ঘরের ভেতরে বসে থাকে, কথাও বলে না ঠিক মতো। মেয়ের মুখটাও মলিন দেখায়।
কি হয়েছে মা, আকিজ মিয়া ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন চম্পাকে।
কাদেইরা তো আমাকে ভালোই বাসে না, খালি জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়া থাকে, আমার সাথে কথাও বলে না ঠিক মতো। কি জামাই আনলা বাজান। আমারে যদিল ভালোই না বাসে তাইলে আমার ঘরে থাকা কি আর আমার গাঙ্গে ভাইস্যা যাওনই বা কি।
সে তো আমার খবরই নেয় না। এই দেখো না গতকাল থেকে সেই জানালার পাশে বসেই আছে, রাতে আলাদা বিছানায় ঘুমাইছে।
আকিজ মিয়া মেয়েকে থামতে বলবেন কি না বুঝছেন না, প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে মেয়ের মনে যা আসে তাহাই বলে ফেলে। এখন কতদুর যেতে পারে আলোচনা এটা ভেবে তিনি বললেন, যাও বিকালে আমার কাছে জামাইকে পাঠাইয়া দিও। আমি দেখবো।
পরিপাটি চুল আঁচড়ে, বাম দিকে সিঁথি করে বিকালের ওয়াক্তে আসিলো কাদের। তাহার মাথার চুল কপালের সাথে লেপ্তে আছে, আর গন্ধ তেলের গন্ধে চারপাশ মৌমৌ করছে। আকিজ মিয়া এসব আশনাই পছন্দ করেন না। তবুও জামাই বলিয়া কথা, পুরুষ মানুষ হইবে পুরুষের মতো, মেয়েদের গন্ধ তেল মাখিলে তাদের চলে না, তাহাদের শরীরে আর চুলে দেওয়ার একটাই তেল, সরিষার তেল, লাঠিতে মাখাবে, লাঠি তেল খেয়ে শক্ত সামর্থ্য হবে, যেখানেই পড়বে, যার মাথায় পড়বে সেই বাপ ডেকে উঠবে, আর গায়েগতরেও মাখবে সরিষার তেল। তাইলে শইলের ভেতরেও সটান ভাব আসবে।
তিনি নাক কুঁচকে বললেন, বাবা কাদের, তুমি একটু পরে আসো বাজান, আমার আসরেও ওয়াক্ত বয়ে যায়, নামাজ শেষে পুকুর পাড়ে আসিও, কথা আছে,
জ্বি আচ্ছা বাবা, আপনে যেমন বলবেন, তাহলে আসি, সালামালিকুম।
আকিজ মিয়া এই সহবতজ্ঞানটা পছন্দ হয়, ছেলে ভালোই, একটু উদাসী থাকে, একটু ভাবের কথা বলে, হাতের সব আঙ্গুল কি আর সমান হয়, কেউ কেউ বৈষয়িক হবে, তারা এ পাড়া ও পাড়ায় যাবে, তাগাদা দিয়ে জান জেরবার করে ফেলবে, ব্যবসা দাঁড়া করাবে বড়। তাহাদের চখের পলক পড়বে না, তারা কঠোর সিদ্ধান্ত নিবে আর সেটা বাস্তবায়ন করবে, কেউ কেউ ম্যান্দামারা হবে তার ছোটো ছেলের মতো, একটু কিছুতেই কষ্ট পেয়ে কেঁদে আকুল হবে, আর কেউ কেউ হবে জামাইয়ের মতো, নিজের ভেতরে চুপচাপ, কখন কখনও এমন কথা বলে উঠবে আশেপাশের সবাই চমকে ভাববে এমন ভাবে আগে তো কখনও ভাবি নাই আমরা।
কাদের চলে যাওয়ার পরে আকিজ মিয়া পুকুর ঘাটের পাশের মসজিদে গিয়া নামাজ সারিলেন। পুকুর ঘাটে এই বিকাল বেলায় মাছেরা ঘাঁই মারে। তিনিও হাতে রুটির টূকরা কি মুড়ি ছিটেয়ে দেন, মাছেরা খায়, নিয়ম মেনেই এ কাজ চলছে, ঠিক এ সময়টাতেই মাছেদের ভেতরে হুড়াহুড়ি লেগে যায়।
কাদের চুপচাপ বসিয়া ছিলো পুকুরের ঘাটে, তাহার মুখটাতে বিকেল বেলার আলো পড়িয়াছে, চমতকার লাগছে তাকে, খানিকটা বিষন্ন, আকিজ মিয়া পাশে গিয়ে তাহার মাথায় হাত রাখিলেন, কাদের মুখ তুলিয়া তাকাইল।
বাবা এই মাছগুলোকে দেখিছো। এরাও আল্লামিয়ার সৃষ্টি, তবে বেজবান , তাই যাহা পায় তাহাই খায়, এই যে আমি কিছু খাওয়ার দিবো এইটার লোভেই তারা এইখানে ভীড় করে আছে, যদি আমি জাল ফেলে এদের ধরে ভেজে খাই, এরা বোকার মতো সেই ফাঁদেই পড়বে, এদের নিজের ভালোমন্দ বুঝবার ক্ষমতাই নাই। এরা বুঝে জানের তাগিদ।
মানুষ এইরকম বাবা, বুঝলা। মানুষের উচ্ছিস্ট খাইলে নিজের সম্মান বাড়ে না।
কাদের কি বুঝিল বলা মুশকিল, তবে তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিল কিয়দক্ষণ।
বাবা উত্তর পাড়ার ৫ কানি জমি তোমাকে দিলাম, নিজের বুঝে চলবা, নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নিতে হবে তোমাকে।
সেই থেকে উত্তর পাড়ার ৫ কানির মালিক কাদের। নিজের হাতে চাষ করে, পাশের নদী থেকে নালা কেটে এইখানে সেচের যোগান দেয় দোন দিয়ে, তখন তার পেশী ফুলিয়া উঠে, মস্ত পুরূষ লাগে তাকে। আল্লা মিয়া পরিশ্রমী দের বিমুখ করেন না, তাই কাদের জমিতে সোনা ফলে। এই বিকেল বেলায় তার জমিতে ধানের শীষে রোদের ঝিলিক, এক একটা গাছের মুড়া হয়েছে একমুঠা, আর ধানের ভারে নুয়ে আছে গাছগুলা।
এমন সময় চম্পা ছুটিয়া আসিলো।
তাদের ছোট মেয়েটাকে কোলে নিয়া,
আমাগোর সব্বনাশ হয়ে গেলো গো। আমাগোর মাথার ছাত নাই ।
একটু বুঝাই কইবা তো, বোকা মাইয়া মানুষ, কানলে হবে, কি হৈছে খুইলা বলো। না ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কানতিছো।
খানিক কেঁদে খানিক ফুঁপিয়ে, খানিক থেমে যা বলিলো চম্পা তাহার অর্থ দাঁড়ায়, আকিজ মিয়া হঠাৎ করেই মারা গিয়াছে। খবরটা দুঃখের সন্দেহ নাই, এখন ফসলের সময় এই দুঃখের খবরে যদি ফসলের বুকে ধাক্কা লাগে তো ফলন সব বরবাদ হয়ে যাবে।
চলো বাসায় চলো, ভরা ক্ষেতের সামনে কাঁদতি নাই।
আকিজ মিয়ার মারা যাওয়ায় কিঞচিত ধাক্কা লাগলেও কাদের মেনে নিয়েছিলো বিষয়টা। বয়েস হয়েছিলো, এই মধ্যপঞচাশেও মানুষ মারা যেতে পারে। আল্লা মিয়া যখন চাইবেন তখনই বান্দাকে তার কাছে ডাকবেন, কাদের একমুঠি দাড়ি মুঠোয় চেপে বউকে সান্তনা দেয়। চ পাগলি, বাবা কি আর চিরদিন থাকপে।
আকিজ মিয়া নিজের হাতে জমিজিরাত গড়েছেন, মেহনতি মানুষটা হঠাৎ মরে যাওয়ায় সম্পত্তির বিলিবন্দোবস্ত করে যাইতে পারেন নাই, দক্ষিণ খানে ১৫ কানি জমি এক লপ্তে, আর উত্তর পাড়ায় ১০ কানি, মাধব ডাঙায় ৫ কানি জমিতে পুকুর আর বাগান, এই হইলো তার ৩০ কানি জমি, ছেলেরা সবাই নিজের মতো ভাগ্য গড়েছে, ২ জন শহরে থাকে, বাকি সবাই নিজ নিজ পরিবার নিয়েই থাকে গ্রামে। একই বাসায় ছিলো, সবাই বিপর্যস্ত।
জানাযার আগে জমির মোল্লা কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, মরহুমের কাছে কারো যদি কোনো পাওনা থাকে, তাইলে এখনই বলেন, মৃতের পাওনা শোধ না করে কবরে দিলে তার গোর আজাব বাড়বে, আর কারো কাছে যদি কোনো অপরাধ থাকে মরহুমে, তাকে ক্ষমা করি দিয়েন।
বড়ছেলে সবার কাছে হাতজোড় করে বললো আব্বাহুজুরের কাছে যদি আপনাদের কোনো পাওনা থাকে তাইলে এখনই বলেন, তার সমস্ত পাওনা শোধের ভার নিলাম আমি। আর কারো মনে যদি আব্বা কখনও দুঃখ দিয়া থাকেন ,কাউকে যদি কখনো ঠকায়, কারো উপরে যদি অন্যায় করে তাহলে আমি তার হয়ে আপনাদের কাছে হাত জোড় করে মাপ চাই। আব্বারে আপনারা মাপ করে দিয়েন। হাতের উলটা পিঠে চোখ মুছে গ্রামের কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হলো আকিজ মোল্লাকে।
এমন সৌভাগ্যবান আর কেউ না।
ছেলেরা সবাই সম্মান করে, সবাই প্রতিষ্ঠিত, গ্রামে আলাদা একটা সম্মান আছে এই পরিবারের।
এমন অবস্থায় তুলে নিয়ো আমাদের ।গ্রামের অনেক বৃদ্ধের প্রার্থনা ছিলো এমনই।
চল্লিশা পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো। এর পরে আসলো সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারার প্রশ্ন, জমির মোল্লাই এখানে সম্পত্তি ভাগের হিসাব কিতাব করেন।
তিনি গম্ভীর মুখে বলিলেন, চম্পার স্বামীকে দেওয়া ৫ কানি জমি আসলে চম্পার পাওনা না। ইসলামী শরিয়া আইন বলে ছেলেদের প্রাপ্য সম্পত্তির অর্ধেক পাইবে মেয়েরা। আকিজ মিয়ার সম্পত্তি ভাগ হবে ১৫টা, এর একভাগ পাবে চম্পা। ৩০ কানি জমির ২ কানি পাবে চম্পা, আর বাকি সব ছেলেরা পাবে ৪ কানি করে। বসতভিটার ভাগের বদলে কেউ যদি চম্পাকে কিছু দেয় এইটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু আল্লা মিয়া লাখোশ হবে যদি এইভাবে সম্পত্তি ভাগ না করা হয়।
কাদের সোনা ধানের শীষ মুঠিতে ভরে আদর করে।
যাই হোক না কেনো ফসলের ৩ ভাগ হবে, ২ ভাগ পাবে ও আর সামনের খন্দে কোনার ২ কানি চাষ করবে ও, আর বাকিটা করবে ফৈজু। আকিজ মিয়ার ভাববিলাসী ছোট ছেলে, একটুতে কেঁদে বুক ভাসালেও বাবার মৃত্যুর পরে তার বৈষয়িক রুপটাও সামনে এসেছে,
সাত ভাইয়ের আদরের বোন চম্পার আদর কমে নি তবে নিজের ৪ কানির প্রতি সবারই সমান টান।
আল্লা মিয়া মাঝে মাঝে বান্দাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন-
কাদের পড়ন্ত বিকেলে পুকুর পাড়ে বসে মাছেদের মুড়ি ছুড়ে দেয় শ্বশুড়ের মতোই
মন্তব্য
ভাল লিখেছেন। ইসলামী নিয়মে ভাগ না করা হলে কি গুনাহ হয়? নাকি শুধু মৃত ব্যাক্তি উইল না করে গেলে বাংলাদেশে ইসলামী নিয়ম ফলো করা হয়?
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি ভাগ নিয়েই সমস্যা ঘটে বেশি, জীবিত ব্যক্তির উইল কারো মনের মতো না হলে কি ঘটে জানি না, তবে বাংলাদেশে এখনও এ রীতিটা প্রচলিত না, সাধারণত সম্পত্তির উত্তরাধিকারি নির্ধারণ করে রেখে যায় না কেউই। মরবার পরে ইসলামী আইনে এটার ভাগবাটোয়ারা হয়।
-------------------------------------------------------
বাংলায় হাগি, মুতি, বাঁচি
------------------------------------
আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।
আম্রিকায় কি হয়?
বিলাতে কি হয়?
জানতে মন চায়?
সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা একটা হাবিজাবি জিনিস।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
খুবই গেঞ্জামের বিষয়। বেচারা ঘর জামাই হইতে গেলি কেন?
-নিরিবিলি
জটিল বিষয়ের সরল পাঠ ।
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আল্লা মিয়া মাঝে মাঝে বান্দাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন -
নতুন মন্তব্য করুন