দেশে হঠাৎ করেই কর্পোরেটের থাবা পড়লো, এর আগে আমরা ভালোই ছিলাম, এখনও হয়তো ভালো আছি- ঠিক বলতে পারি না নিজেই- এই সব বহুজাতিক সংস্থার রকমারি ছলনায় মগ্ন হওয়ার আগে আমরা যেভাবে বাঁচতাম সেটাতে গলদ ছিলো এমনও মনে হয় না।
তবে একটা বিষয় সত্য আমাদের বহুজাতিক কোম্পানির থাবার ঘায়ে মানবিকতা নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটবার আগে আমাদের পারিবারিক বন্ধু এবং বন্ধুর পারিবারিক হয়ে উঠবার প্রক্রিয়াটা সহজ সরল ছিলো,
আমাদের গুরুজনেরা তাদের বন্ধু এবং সহকর্মী ও সহপাঠিদের নিয়ে বাসায় আসতো- গুরুজনের সাথে নির্ধারিত সম্পর্কের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা অমুক খালা, অমুক মামা অমুক চাচার বন্ধু তমুক মামা তমুক চাচা তমুক খালা হিসেবে পরস্পরকে আপন করে নিতে পারতাম-
এরও আগে হয়তো এই সম্পর্কের সামাজিকিকরণের গল্পের শুরু তবে সে সময়ে আমার অস্তিত্ব ছিলো না বলেই আমার জ্ঞাতজীবনের গল্পে এরাই গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধারণ করেছে-
গুরুজনের বাঁধানো পথেই আমরা আমাদের বন্ধুদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করি- বন্ধুর মাকে খালা ডাকি আর বন্ধুর বাবাকে চাচা- যদিও এই বিষম সম্পর্কে তারা মনক্ষুন্ন হন না মোটেও- আমরাও আমাদের গুরুজনদের প্রাপ্য সম্মান দিয়েই বন্ধুর বাবাকে দেখলে হাতের সিগারেট লুকিয়ে সালাম দেই- বন্ধুর মাকে দেখলে হাসিমুখে তার আদেশ নিষেধ মানবার একটা চেষ্টা করি-
কর্পোরেট যুগ আসবার আগে আমরা যারা এই সম্পর্কের জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছি তাদের কাছে হয়তো বন্ধুরা শুধুমাত্র অস্তিতএর সম্প্রসারিত অংশ নয় বরং পরিবারে ঘনিষ্ঠ কেউ-
কলেজে আমার অনেক বন্ধুর ভেতরে সবচেয়ে বোহেমিয়ান বন্ধুটার সাথে যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীন হতে থাকে- দোষটা তারও না আমারও না হয়তো একভাবে বিবেচনা করলে-
বোহেমিয়ান এবং স্বেচ্ছাচারী বন্ধু কোনোদিন পড়াশোনা নিয়ে তেমন মনোযোগী ছিলো না- হাতে নাতে ফল পেলাম এইচ এস সির রেজাল্টের পর- বন্ধুর নাম কোনো তালিকায় নেই- আমরা ১৭ জন বন্ধু এক সাথে বসে আছি মাঝে বিষন্ন সুনাল- বোহেমিয়ান বন্ধু আমার- অবিশ্বাস করে দাঁড়িয়ে আছে-
মন খারাপ হয় আমাদের সবার- হঠাৎ করে সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার আনন্দ, মেলে দেওয়া ডানার উপরে বৃষ্টির ভারি পানি জমে থাকে -আমাদের আনন্দ ডানা মেলে উড়তে পারে না- আমরা কলেজের পেছনের পুকুরে বসে থাকি কিছুক্ষণ- কিছুক্ষন তাকে সাথে নিয়ে হাঁটি- সিগারেটে ঘনঘহন টান দিয়ে হাত ধরে সামনে আগাই-
বন্ধু বিষন্ন- তাই সে রোডে যাবে না- আমরা ঠাট্টা করে বলি ঠিক আছে বন্ধু আমরা রোদে রোদে যাবো না, আমরা ছায়ায় ছায়ায় হেণটে ক্যান্টিনে বসি- চা খাই- তার পর চলো তোমার বিষন্নতা পাণ করবো গেলাসে গেলাসে-
আমরা তখন মফস্বলের মানুষ- উল্লাস বলতে আমাদের কাঞ্চন ব্রীজের নীচে গিয়ে ফেন্সিডিলের বোতল কিনে আনা- তার পর আহা ফিলিংস- আমরা ফিলিংসে মত্ত হয়ে যাওয়ার আগে তাকে সাথে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ-
সময় নিষ্ঠুর- আমাদের ভর্টি পরীক্ষা শুরু হয়- আমাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কৃষি কলেজে কেউ বি আইটি কেউ বুয়েটে ভর্টি হয়ে যাওয়ার পর আমরা সারাদেশে ছড়িয়ে যাই- ঈদের আগে দেখা হয় বন্ধুর সাথে- তার এত দিনের প্রেমিকা আরও এক বন্ধুর হাত ধরে চলে গেছে- আমরা মন খারাপ করে বসে থাকি- আবারও ফিলিংসের রাত আসে- আমরা গুলশান মার্কেটের ছাদে বসে এলোমেলো হাসাহাসি করি-
সময় যায়- আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে যাই- আমাদের যে বন্ধু সুনালের প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলো তারও ছেলে হয়- আমাদের বন্ধু পরিবারের প্রথম সদস্য- আমরা দলবেধে সেই মানুষটাকে দেখতে যাই-
আসবার পথে সুনালের সাথে দেখা- ও বললো দোস্তো আগে বুঝি নাই- এখন দেখি ওর দুধ ছোটো দোষ্টো - ওর দুধ ছোটো হয়ে গেছে- শালা তুি একটা ইতর বলে আমরা ওর পিঠ চাপড়ে হাঁটি- আবারও ফিলিংসের রাত আসে-
আমাদের মফস্বলে তখন সীমান্ত পেরিয়ে ব্ল্যাক লেবেল আর ম্যাক ডোয়েল আসে- আমরা কয়েক বোতল কিনে এনে চানরাইতে মাতাল হয়ে বমি করি সিনেমা হলের ছাদে-
সময় গড়ায় আমাদের ব্যস্ততা বাড়ে- একে একে বন্ধুরা ক্রমশ আরও আরও দুরে সরে যায়- ঈদের সকালে ঈদের বিকালে পুরানো আড্ডার জায়গায় গিয়ে বসে থাকি- কেউ কেউ আসে- কেউ আসে না- সবারই নিজস্ব জীবনের গন্ডী তাদের সীমানাচ্যুত করেছে-
আমি মাঝে বেশ কিছু দিন সরাসরি যোগাযোগ করতে পারি নি- বোহেমিয়ানিজমের সুত্র মেনেই যাবতীয় সম্পর্ককে চাক্ষুষ করবার বাসনায় বন্ধু মোবাইল নামের যন্ত্রনা নেয় নি- আমরাও তখন সরাসরি যাওয়ার চেয়ে মোবাইলে হাই হ্যালো করে দিব্যি আনন্দিত- দেখা না হোক কথাতো শুনতে পারি- আরও ক্ষীনকায়া হয় আমাদের আড্ডার শরীর-
অনেক দিন পর সুনালের সাথে দেখা- আমার ছেলেকে নিয়ে দেখা করতে গেলাম ওর সাথে- ওর সাথে গল্পের ফাঁকে শুনলাম- ওর প্রথম ছেলেটা ৭ মাসে জন্ম নিয়ে মরে গিয়েছে- আমি দেখা করবার কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা- আমার ভেতরটা শিউড়ে উঠে- আবারও বিষন্নতার গ্রাস- তবে আমরা বড় হয়ে উঠেছি- আর ফিলিংসের ধান্দায় থাকি না- বরং পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে এই দুঃখ ভাগাভাগি করি-
তার স্ত্রীর ওভারিতে ক্যান্সার- এমন দুঃসংবাদ শুনে শহর ছেড়েছিলাম- মাঝে আমার সাথে যোগাযোগ ছিলো না সুনালের-
একটু আগে এক বন্ধু জানালো ওর মেয়ে হয়েছে গতকাল রাতে- ওর মোবাইল উঠেছে হাতে- আমি ফোন করলাম- নতুন শিশুকে অভিনন্দন- অভিনন্দন সেই মাকে যে শরীরে ক্যান্সার নিয়েও ঝুঁকি নিয়ে জীবনের একটা সন্তানের জন্ম দিয়েছে- আমাদের পরিবারের নতুন সংযোজন-
আমার উপরে দায়িত্ব এসেছে সেই শিশুর নাম দেওয়ার- এখন আনন্দিত চিত্তে ভাবছি এই অগ্নিশিখার নাম কি রাখবো- আমার বন্ধুর জীবনে অনেক আলো নিয়ে আসুক এই সন্তান-
মন্তব্য
পরম করুণাময় সেই সন্তান আর তার পরিবারকে ভালো রাখুন,এই কামনা।
অভিনন্দন আপনার বন্ধু আর বন্ধুপত্নীকে ... আর পিচ্চির জন্য অনেক আদর ... ভাল থাকুক সবাই ...
অগ্নিশিখা নামটাও কিন্তু খারাপ না
খুব ভালো লাগল গুরু...
ভাল থাকুন আপনি...ভাল থাকুক আপনাদের বন্ধু পরিবার...ভাল থাকুক সেই পরিবারের প্রতিটি নতুন সদস্য।
দৃশা
নাম ঠিক করছি একটা এখনও নিশ্চিত করি নাই
স্নিগ্ধা সুহাসিনী
------------------------------------
আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।
নস্টালজিক হয়ে গেলাম।
"স্নিগ্ধ অরণ্যানী"
হলে কেমন হয়?
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
অনেকদিন পরে আপনার অসাধারণ লেখনীর সামনে এলাম। কেমন জানি চোখটা ভেজা ভেজা লাগে...কি আশ্চর্য নষ্টালজিক...
--তিথি
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
ভাল থাকুক আপনার বন্ধুটি তাঁর পরিবার নিয়ে।
নতুন মুখকে আমার ভালবাসা!
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...
নতুন মন্তব্য করুন