সকল সমস্যাই আসলে গভীরতর দার্শনিক সমস্যা, পরিপার্শ্বিকের সাথে নিজের সম্পর্ক স্থাপন এবং নিজের অবস্থান নির্ণয়জনিত সমস্যা, অনেক রকমফের থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঘটনাটা দাঁড়ায়- অর্থনৈতিক গতিবিধি আর নিজস্ব অবস্থানজনিত চাহিদাগুলো পুরণের চেষ্টা এবং ব্যর্থতার গল্প সবকিছু।
কথাটা হঠাৎ করেই মনে হলো এমন না, আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই মাথার ভেতরে কথাটা ঘুরছে, গল্প করছি পেছনে ফেলে আসা বন্ধুত্ব এবং ভুলে যাওয়া বন্ধুদের সাথে- কেউ কেউ হঠাৎ রাস্তায় থামিয়ে বলে - কে ওটা- রাসেল না-
আমি হাসিমুখে এগিয়ে যাই- জড়িয়ে ধরি- এতদিন কি করলি- কি রকম ছিলি- বিয়ে হয়েছে- নানাবিধ ভদ্রতার পর দেখি আসলে এরবেশী কিছু জানবার নেই আমার- এতদিনের পরে দেখা হলে আসলে পারিবারিক খবর জানবার পর বলা হয় না নতুন কিছু ভাবছিস- আমরা এই বয়েসে এসে নতুন কিছুই ভাবছি না-
সম্ভবত বিষয়টা এমন না - সবাই নতুন কিছু হয়তো ভাবছে- হয়তো অর্থনৈতিক বৈতরণী পার হওয়ার নানাবিধ ফন্দিডিকির খুঁজছে- হয়তো না- বলা যায় না কিছুই- তবে সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু পারিবারিক অর্থনীতির চাকা- মেয়েটার নতুন জামা লাগবে ঈদে- ছেলেটার বায়না- বৌয়ের শাড়ী- মায়ের চুড়ি- এসব গল্পে আর পুরোনো দিনের আমেজ নেই- লাগামছাড়া স্বপ্ন নেই- সীমানা ডিঙ্গানো কল্পনা নেই-
আমরা কখনই বলছি না কিরে নতুন কিছু লিখলি আজকে- নাহ আমার বন্ধুদের ভেতরে এমন মানুষ খুব কম যারা নিয়মিত লিখে- খুব বেশী হলে সারাদিনের জমাখরচ লিখতে পারে- কেউ কেউ হয়তো মোবাইলে ম্যাসেজ লিখে- তবে এর বাইরে গিয়ে লেখালেখির জগতে কেউ নেই- কেউ নতুন কোনো দার্শনিক সমসয়াও বোধ করে না - অর্থনীতি- স্থানীয় কিংবা আন্তর্জাতিকতাবাদ- লৌকিক অর্থনীতি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকনীতিতে সোচ্চার মানুষগুলো ক্রমশ আরও বেশী ভারতবিদ্বেষী, হুট করেই কথার মাঝখানে চলে আসে- ভারত দেশটাকে খেয়ে ফেললো- আমার অবাক লাগে সময় সময়-
আমরা আসলে অনেক দিন নতুন কিছু করছি না- এখানে স্রোত স্তব্ধ, জীবন গতিহীন এবং নিরাসক্ত ও বিবর্ণ- তবে এর ভেতরে নিজেকে স্থাপন করা- ভেতরের কথাগুলো জানাবার বাসনা নিয়ে সামনে আগালেই হোঁচট লাগে- কথার ভেতরে আচমকা ঢুকে যায় ভারত- তার সর্বগ্রাসী স্বত্ত্বা। সীমান্তবর্তী শহরে চোরাচালানের সব মানুষকেই সবাই চিনে- যদিও সামাজিক ঘৃনাজনিত কোনো অভ্যুত্থান নেই- তবে শালা ভারত থেকে মাল এনে পয়সা কামিয়ে ফেললো জনিত বিষাদগ্রস্ততা থাকেই।
ভাবছিলাম অন্য কিছু লিখবো, জীবন এবং দার্শনিকতার সংকট নিয়ে কিছু ভাবনা ছিলো- বেশ কয়েক দিন আগে সুমন রহমানের প্রিয় মহিলা গল্পকারের গল্প পড়লাম- যদিও আমার কাছে খুবই সাদামাটা লেগেছে- বলতে পারি তেমন আগ্রহ উদ্দীপনা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে সে লেখা- তবে অনেকেই দেখলাম বেশ আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করেছে-
আলোচনার ভিত্তিতে বলতে পারি সবাই আসলে একটা সম্ভবনা মাথায় নিয়েই মেয়েদের লেখা পড়া শুরু করে- নারী চরিত্র বুঝতে পারা তুমুল সাধনার বিষয়- আমরা আমাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি- এবং সুশীলতা বোধের কারণে এখন তাদের যৌনসঙ্গী এবং যৌনকামনার পরিধির বাইরে তাদের মনস্তত্ব জানতে চাই- মেয়ে লেখকদের লেখার ভেতরে তাদের যৌনকামনার গন্ধ খুঁজি- হয়তো বা- তবে এই সাদামাটা গল্প কিংবা গল্পকারের গল্পের বিষয়বস্তু ছিলো এক মেয়ে তার প্রেমিকের বাসায় পৌঁছানোর পর প্রেমিককতৃক অপমানিত হয়- এই ঘটনার রূপায়নে নতুনত্ব আনা কষ্টকর- তবে এখানে উপরি পাওনা হলো মেয়েটার মানসিক অনুভবের বর্ণনা- সেটাই আসলে এই লেখিকার লেখা ভালো লাগবার কারণ- আমরা জানতে চাই মেয়েরা প্রেম ও যৌনতা বিষয়ে কি ভাবছে- তারাও কি কোনো রাতে করুণ কামনায় জর্জরিত হয়- তারাও কি প্রেমিকের লিঙ্গ খুঁজছে মনে মনে- তারাও কি শক্তিশালী বাহুর আলিঙ্গন চায়-
গল্পের পুরুষ অবলীলায় অপমান করে নায়িকাকে- ভেতরে ভাবনা জাগে আমরা সবাই ভেতরে ভেতরে পুরুষতান্ত্রিক- আমরাও কামনা করি এমন প্রত্যাখানের- আমরাও চাই এভাবে কোনো মেয়ে আমার কাছে ছুটে আসবে আমি কঠোর গলায় তাকে প্রত্যাখান করবো- সে মুখ কাঁচুমাচু করে লজ্জিত হয়ে বিপন্ন হয়ে চলে যাবে- এই বিপন্নতা দেখে কৃত্রিম যৌনসুখ অনুভব করবো- নিজের শক্তিশালী ভাবমুর্তি রচনা করবো-
মেয়েদের ভাবনার জগতে গিয়ে যখন মেয়েটাকে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে দেখি এবং মেয়েটার চাহিদাকে বুঝার চেষ্টা করি তখন নিজেদের মর্ষকামে বিহ্বস্ত হয়ে যাই-
গত কাল এক বন্ধুর সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে হঠাৎই উঠে এসেছিলো কথাটা- আমরা যখন শিল্পের আঙ্গিনায় কিছু নির্মাণ করছি তখন আমরা মানবীয় অনুভবগুলো নিয়ে নিজস্ব রঙএ সাজাচ্ছি- কিছু কিছু অনুভব কিছু কিছু বিষন্নতা বোধ নির্মাণ করছি কল্পনায়- এভাবেই আমরা হয়তো মানুষের ভিতরে চরম অস্থিরতা জাগিয়ে তুলতে পারি- তাকে হতাশ বিষন্ন- বিপন্ন করে কোণঠাসা করে ফেলতে পারি- একটা পর্যায়ে তাকে এমনভাবে ক্ষুব্ধ করে ফেলা সম্ভব যখন সে রাগে অন্ধ-
এমন সময় দুটো পথা খোলা থাকে- তাকে ক্ষোভ প্রশমণের সুযোগ দেওয়া কিংবা সেখানেই তাকে স্তব্ধ করে রাখা- প্রতিক্রিয়া দু রকম হবে= যদি আমি তার ক্ষোভ প্রশমিত করি- তবে সে বিষন্ন হবে= গভীরতর কোনো দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়ে করুনায় সিক্ত হবে-
কিংবা তাকে যদি সেই বিপন্নতার সামনে ছেড়ে দিয়েই চলে আসি- সে নিজের বিপন্নতায় রাগন্বিত হবে- একটা আগুন ধ্বক ধ্বক করে জ্বলবে তার ভেতরে এবং সে প্রতিবাদ করবে কিংবা প্রতিরোধ করবে-
তাকে আরও বিশাল কোনো শক্তির সামনে নতজানু করা যায়- এতে সে নিজেকে ক্ষুদ্র ভাববে এবং ভক্তি রসে আপ্লুত হবে- তবে কোনটা করা উচিত এই দার্শনিক সমস্যার কোনো সমাধান নেই-
আবারও সেই দার্শনিক সমস্যার ভেতরেই ফিরে আসি- কেনো আঞ্চলিকতা- কেনো স্থানীয় অর্থনীতি নিয়ে এত ঝামেলা- একটুকরো উঠানে সবার ঠাঁই হয় না- আমরা সবাই চাই আমাদের পরিচিত মুখগুলোই ঘুরে ফিরে নিয়ন্ত্রন করুক অর্থনীতির চাকা- তাই নোয়াখালী- কুমিল্লা চিটাগাং- সিলটী এত আঞ্চলিক মানুষের ভেতরে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা- কানুইবাজী- আমরা অর্থনীতির সাথে নিজের সম্পর্ক বুঝতে ব্যর্থ বলেই আমাদের পারিপার্শিকের সাথে আমাদের সম্পর্ক আমরা নির্ধারণ করতে পারি না এবং নানাবিধ জটিলতায় ভুগতে থাকি।
মন্তব্য
একটা সত্য,কঠিন সত্য অনুধাবন ।
বহুদিন পরে রাসেলের কলাম পড়লাম। থাক কোথায় আজকাল? লেখালেখির ইস্তফা দিলে কি চলে?
অন্ধকারের উতস হতে উতসারিত আলো
পড়লাম।
--তিথি
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
নতুন মন্তব্য করুন