ক্রুসেড যুগে ইংল্যাণ্ডের রাজা রিচার্ড বলেছিলেন,
একজন রাজা কখোনো ভূল করেনা, কারো কাছ থেকে প্রতিদান প্রত্যাশা করেনা, এবং কারোর দয়া ভিক্ষা করেনা।
আজকের গল্প রাজা রিচার্ডকে নিয়ে নয়, অন্য কাউকে নিয়ে। ধরে নেই তার নাম খবির মিয়া। বয়স হবে সত্তুরের কিছু কম বা কিছু বেশি। পেশায় রিক্সাচালক।
বুড়ো রিক্সাওয়ালাদের এই বাজারে রিক্সা চালানোয় কিছু অসুবিধা। বেশিরভাগ মানুষ বুড়োদের রিক্সায় চড়তে চায় না। কেউ ভাবে যে এই বুড়োর রিক্সায় উঠলে দশ মিনিটের রাস্তা আধাঘন্টা লাগাবে। আবার কেউ কেউ বাপের বয়সী বুড়োর রিক্সায় চড়তে শরম পায়। কেউ ভাবেনা যে এই এই বুড়োরও দুটো ভাত খাওয়া লাগে বা একটু লুঙ্গি কিনে পরা লাগে। ভাগ্যিস বুড়িটা এখনও বাসাবাড়িতে কাজ করে দুটো পয়সা পায় আর একবেলা ভাত পায়। কাজের বাড়িতে ভালোমন্দ কিছু রান্না হলে বেগম সাহেবাকে বলে দু’এক টুকরো বেশি খবির মিয়ার জন্যেও নিয়ে আসে। ছেলে মেয়েরাও তার মতো হতদরিদ্র এবং যার যার মতো থাকে।
খবির মিয়ার একটা করে বিশেষ লুঙ্গি, গেঞ্জি আর গামছা আছে যা সে বছরে মাত্র দুইদিন যত্ন করে ব্যবহার করে। ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর। সেই যে কবে সমাবেশে মশাল নিয়ে সভা হয়েছিলে, সেই সময়ে জলিল ভাই ডেকে নিয়ে গিয়ে সিঙ্গাড়া খাইয়ে এই জিনিসগুলো দিয়েছিলো। খবিরের স্মৃতি সেদিন ফিরে গিয়েছিলো ৭১’এ। ভাঙা গলায় জয় বাংলা বলে চিৎকার করে উঠেছিলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে খবির তাদের ইউনিটের মুক্তিযোদ্ধা দাবীদার এমন কিছু মুখ সেদিন দেখেছিলো, অনেকে ভেবেও ৭১’এ এই মুখগুলোকে খবির তার স্মৃতির আয়নায় দেখতে পেলোনা। “ধুর বাড়া, আমার কি! আমারে তো ডাইকে নিয়ে মাল দিছে। আর কারে কি দেলো তা নিয়ে আমার মাথা নষ্ট কইরে কাজ নেই। দেশের জন্যি যুদ্ধ করিছি, ভালো করিছি। মালের জন্যি তো আর করিনি। তা’ও য্যান্যে দিছে, ভালো হইছে।”
সেই লুঙ্গি, গেঞ্জি আর গামছা খবিরের গর্ব। এগুলো তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ৭১’এর স্মৃতিতে। তাই এই দুটো দিন এলে খবির এগুলো পরেই রিক্সা চালাতে নামে, ঠিক আজ যেমন নেমেছে। সাথে রিক্সার হাতলের সাথে লাগিয়েছে মাঠ সাজানোর ছেলেদের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া একটা কাগজের তৈরী বাংলাদেশের পতাকা।
সকাল থেকে আজ আয় মোটামুটি ভালো। বাচ্চা-বুড়ো সবাই স্টেডিয়ামে, হাদীস পার্কে, জাতিসংঘ পার্কে যাচ্ছে, আসছে। খবির জাতিসংঘ পার্কের গেটের পাশে একটু দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরালো।
‘ও চাচা, পিকচারের মোড় যাবা?’ মাঝবয়সী একজন, সাদা পাঞ্জাবী পাজামা, আর কালো হাতাকাটা একটা কোট পরা, বেশ মেজাজী স্বরে জানতে চাইলো। খবির দ্রুত বিড়িতে টান মেরে ওটা ফেলে দিয়ে বললো ‘ওঠেন।’
‘তুমি এই গেঞ্জি পাইছো কোথায় চাচা?’
‘ওই যে মুক্তিযোদ্ধাগে মশাল মিটিং হইছিলো রূপসা ঘাটে, ওই যায়গাত্থে দিছে।’
‘তা তোমারে দেলো ক্যান, তুমি কি মুক্তিযোদ্ধা?’
‘মুক্তিযুদ্ধ তো করিলাম ৭১ সালে।’
‘কোথায় করিছিলে?’
‘করিলাম তো কচুয়ায়।’
‘তোমার বাড়ি কচুয়ায়? তুমি আমারে চেনো না?’
‘বাড়ি কচুয়ায় তয় মুক্তিযুদ্ধের পরেত্তে আর যাওয়া হইনি বিশেষ। আপনার বাড়ি কোনডা?’
‘আমার খান বাড়ি, ধলু খান আমার বাপ। তোমার নাম কি?’
‘আমার নাম খবির। আপনার আব্বারে তো চেনতাম। ভালো লোক ছিলেন।’
‘কিন্তু খবির নামে আমাগে এলাকায় কেউ মুক্তিযুদ্ধ করিছে বলে তো শুনিনি।’
‘আপনি না শুনলি আমি কি করবো! আপনি না শুনিছেন বইলে আমি যুদ্ধ করিছি তা তো আর বাতিল হইয়ে যাতিছে না।’
‘আরে কি যা তা বলতিছো, আমি নিজি’ই তো ওই কচুয়া ইউনিটে যুদ্ধ করিছি। তুমি যুদ্ধ করলি তোমারে চেনতাম না! যাক গরিব মানুষ, লুঙ্গি, গেঞ্জি আর গামছা পাইছো, তোমার উপকারই হইছে। না হয় এক দিনির জন্যি এট্টু মুক্তিযোদ্ধা সাইজলেই। ওতে কিছু হয়না। তাছাড়া রাজাকার তো আর ছিলেনা। রাজাকার হলি তোমার ঠিকই চেনতাম।’
খবিরের দুচোখে হাজার তারার ঝলকানি আসে, শিরশির করে ওঠে সারা শরীর। নিস্পন্দন হয়ে পড়তে থাকে গোড়ালি, হাঁটু, কব্জী, কনুই থেকে শুরু করে সারা শরীর। কিছু বুঝি ওঠার আগেই রিক্সাটা কাত হয়ে গিয়ে দড়াম করে বাড়ি খায় রাস্তার পাশের দেয়ালে।
রিক্সা উল্টানোর ঠিক আগের মুহুর্তে হাতাকাটা কালো কোটধারী এক লাফে রিক্সা থেকে নেমে পড়ে। ধাক্কা খাওয়া রিক্সা থেকে খুলে পড়ে ছোট্ট কাগজের পতাকাটা বুক যার রক্তলাল। গালি দিতে দিতে দ্রুত চলে যাওয়া হাতাকাটা কালো কোটধারীর পদতলে দুমড়ে-মুচড়ে যায় ছোট্ট বাংলাদেশের মানচিত্র।
খবির জানেনে সে কতক্ষণ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে ছিলো। জ্ঞ্যান ফিরতেই সে দেখতে পায় সে এবং তার রিক্সাটা একই ভঙ্গিতে ড্রেনের পাশে পড়ে আছে। খবিরের চারপাশে বেশ কিছু এক টাকা, দুই টাকার নোট আর কয়েন, দু’একটা পাঁচ টাকার নোট আর কয়েনও আছে। উৎসুক খবিরের চোখের সামনেই দু’একজন পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেলো। কিন্তু খবিরের মনে যেনো সেই চল্লিশ বছর আগের সেই আলোটাই আবার জ্বলে উঠলো।
খবির উঠে দাঁড়ায়, গামছা দিয়ে কেটে যাওয়া জায়গার জমাট রক্ত মোছে। প্রাণপন চেষ্টা করে রিক্সাটা টেনে তুলতে। দু’একজন সহৃদয় এসে হাত লাগালে রিক্সাটা তোলা একটু সহজ হয়। একটা চাকা একটু টাল খেয়ে গেছে, কয়েকটা স্পোকও কেটে গেছে তবে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়।
তীব্র ক্রোধে খবির পড়ে থাকা টাকাগুলোর দিকে তাকায়। তারপর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রিক্সাটাকে টেনে নিয়ে গ্যারেজের দিকে যেতে থাকে।
খবির রাজা রিচার্ডকে চেনেনা। রাজা রিচার্ড কি বলেছিলো তা’ও খবির জানেনা। তবে তারও বুক চিরে বেরোতে চায়,
মুক্তিযুদ্ধ কইরে আমি কোনো ভূল করিছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধ করিছি বইলে আমারে কিছু দিতিও হবেনা। আর মুক্তিযুদ্ধ করিছি বইলে কেউ আমার জন্যি দয়া চোদাবেন না।
মন্তব্য
অসাধারন...দ্য়া নয় দায় পরিশোধ করা চাই।
একজন দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কিছুটা দায় শোধ করার একটি বিনীত প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম এবং সফল হয়েছি। মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসাটা মোটেই কঠিন কিছু নয়। দরকার কেবল এক্টুখানি সদিচ্ছা। সদিচ্ছা আনাটাও কঠিন নয়। কেবল চোখ দুটো খুলে আশেপাশে তাকালেই হয়।
আপনার লেখাটা খুব মর্মস্পর্শী।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
ডাকঘর | ছবিঘর
- এবং লেখাটা ভীষণ ভাবে ছুঁয়ে গেলো। একটা চাপা বেদনা।
ডাকঘর | ছবিঘর
খবির মিয়াদের জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা। রাতঃস্মরণীয়দাকে ধন্যবাদ দারুণ লেখাটির জন্য।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ভাই, এমন হৃদয়ছোঁয়া লেখা অনেকদিন পড়িনি। কমেন্ট লিখতেও পারছিনা; এতটাই বিহ্বল হয়ে আছি। অথচ বলার ছিল অনেক কিছু। কোনদিন সাক্ষাতে চিন্তাগুলো শেয়ার করা যাবে।
আপনাকে ধন্যবাদ। শোধ না হবার ঋণ কিছুটা হলেও লাঘব করার জন্য মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।
শেষটা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ওস্তাদ লেখকের মাইর শেষ রাতে !
facebook
অনন্য সমাপ্তি। তুলনাহীন।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
ধন্যবাদ আপনাকে, লেখাটার জন্যে। নতুন প্রজন্মের অবশ্যই উচিৎ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের দায় নেওয়া।
অসাধারন
স্থির বিদ্যুৎ, হাবাছেলে, উচ্ছলা, তাপস শর্মা, সুমাদ্রী, তৌফিক, শ্যামল, অণু, অন্যকেউ, প্রৌঢ় ভাবনা, সপ্তর্ষি- আপনাদের সবাইকে পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্যে ধন্যবাদ।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
বাবা মায়ের ঋণ যেমন শোধ হয়না তেমনি এই ঋণ শোধ হবার নয়।
ভালো লাগল
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
## আমার মনে হয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে অনেক অনেক অভিমান জমাটবদ্ধ হয়ে আছে। ঐ সময় যে স্ফুলিঙ্গ সাড়া শরীরে রসদ যুগিয়েছিল পরবর্তীতে নানা কারনে তা একস্থানে লুকিয়ে বসে গিয়েছে। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কোন কিছুই করতে পারেনা। কার কাচে বলা যায়, সবাই শুধু শোনে আর হতাশা ভুলানো দুয়েকটি কথাবার্তা বলে। কাজের কাজ কিচ্ছু হয়না।
>খবিড় মিয়ার জন্য খুব খারাপ লেগেছে তবে পরবর্তীতে যে তেজোদীপ্ত ভাব সে দেখিয়েছে তার জন্য বাহবা, সত্যিই অসাধারন...
>ভাল থাকুন সবসময়, এ সুন্দর কামনায়..
দারুন লিখেছেন নানা, একেবারে বুকের আসল যায়গায় খোঁচা দিলেন।
জানি তাদের ঋণ শোধ হবার নয়, তবু প্রচেষ্টা টা থাকুক চিরকাল।
খবির মিয়ার কি সার্টিফিকেট আছে? মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে মুক্তিযুদ্ধ করবার চাইতে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট থাকাটা যে বেশি জরুরি!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
পদ্মজা, রিশাদ, আশরাফুল কবীর, জাকির এবং রোমেল ভাই- আপনাদের সবাইকে পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্যে ধন্যবাদ।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
শেষ লাইনটার ভেতরের যে চেতনা সেটাই ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি। সর্বশেষ সংযুক্তি’র জায়গাটা’র জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ তানিম।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
নতুন মন্তব্য করুন