অবশেষে পল ও জেস ফিরে এলো

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি
লিখেছেন রাতঃস্মরণীয় [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৭/০১/২০১২ - ১২:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[justify]আমার প্রিয় একজন ড্যান বন্ধু পল হেগেন থিস্টেড একজন পেশায় একজন উন্নয়নকর্মী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পল সোমালিয়ায় প্রবীন এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে মবিলাইজ করার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলো। দেড বছর একই সংস্থায় কাজ করেছি। তারপর আমি যখন সোমালিয়া ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন পল আমার জায়গায় আসার চেষ্টা করছিলো এবং সম্ভাবনাও ছিলো। কিন্তু পরে পল সোমালিয়ার গ্যালকাইও শহরে, যেখানে আমি ছিলাম, সেখানেই আমাদের সংস্থার ডি-মাইনিং উইঙে পল যোগ দিলো। সেখানে তার শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজের বেশি সুযোগ ছিলো, সম্ভবত সে জনেই। পল একসময় বেশ কিছুদিন বাংলাদেশে কাজ করেছে তৃণমূল থিয়েটার আন্দোলনে। একবার কোপেনহেগেনে গিয়েছিলাম একসাথে, সেখানে পলই ছিলো আমাদের গাইড। দুষ্টু পাড়ায়ও ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলো। এটিএম মেশিন আমার কার্ড খেয়ে ফেলার পরদিন পল আমাকে নিয়ে গিয়ে কার্ড উদ্ধার করে এনে দিলো। কার্ড খাওয়া থেকে শুরু করে উদ্ধার হওয়ার মাঝের সময়টা পলের কাছ থেকে ক্রোনার ধার করেই চলেছি। দারুন গিটার বাজায়, বাঁ হাতে, দারুন একজন মানুষ।

ছবিতে বাম থেকে ডানে আমরা চার বন্ধু- পল থিস্টেড, রাতঃস্মরণীয়, সিসে আগার্ড ক্রিস্টিয়েনসন ও ইউনিস মোয়ান্ডে। কোপেনহেগেনে তোলা ২০১০ এর শীতে-

৩২ বছর বয়সী জেসিকা বুকাননকে নামে চিনতাম, কখোনো দেখা হয়নি। সম্ভবত কিছুদিন ইউএস আর্মিতে ছিলো। পলের সাথে একই প্রতিষ্ঠানে, একই অফিসে কাজ করে।

ওরা দুজন গত ২৫ অক্টোবর ২০১১ সাউথ গ্যালকাইওতে ফিল্ডের কাজে গিয়েছিলো। সেখান থেকেও এদের দুজনকে এবং ওদের সিকিউরিটি অফিসার আবদি রিজাককে সোমালি জলদস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর এক বা দুদিন পর আবদি রিজাক ফিরে আসে এবং পুলিশ তাকে জলদস্যুদের সহযোগিতা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু গ্রেপ্তারের কয়েকদিনের মধ্যেই সে আবার ছাড়া পেয়ে যায়। লোকমুখে শুনেছি যে সে আসলেই জলদস্যুদের সাথে সহযোগিতা করেছিলো। এই শুয়োরটাকে আমিই নিয়োগ দিয়েছিলাম। জলদস্যুরা প্রথমে দরকষাকষি শুরু করে ৫ মিলিওন ডলার হেঁকে, পরে তা বেড়ে হয় ৯ মিলিওন ডলার। আমার বন্ধু আহমেদ মোহামেদ দালাব (যে নিজেও একবার অপহৃত হয়েছিলো এবং যাকে নিয়ে সচলে লিখেছিলাম) প্রাথমিকভাবে চেষ্টা করছিলো জলদস্যুদের সাথে দরদামের সমঝোতা করার।

গত সোমবার দিবাগত রাতে অপহরনের তিন মাসের মাথায় ওদেরকে বিশেষ পন্থায় উদ্ধার করা হলো। ইউএস নেভির বহুল আলোচিত ‘সিল’ অপারেশনের মাধ্যমে ওদের উদ্ধার করা হলো সোমালিয়ার জলদস্যুদের মূল ঘাঁটি আডাডো থেকে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ‘সিল’ একটা বিশেষ ধরণের অভিযান যার নির্দেশ কেবলমাত্র ইউএসএ-র প্রেসিডেন্টই দিতে পারে, অন্য কেউ নয়। লাদেনকে হত্যার মিশনও ছিলে একটা ‘সিল’। লাদেন হত্যার অভিযানের পর এটাই ছিলো পরবর্তী ‘সিল’ অভিযান, এর মাঝে আর কোনও ‘সিল’ অভিযান হয়নি।

এপি ওয়াশিংটন লিখেছে-

সোমালিয়া থেকে দুজন পশ্চিমা অপহৃতকে উদ্ধারকারী নেভি সিল অভিযান হচ্ছে একটা ছোট ও কর্মতৎপর সামরিক শক্তি গঠনে ওবামা প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি যা প্রতিপক্ষকে বিকলাঙ্গ করে দিতে প্রতি-সন্ত্রাসী (counterterrorist) হামলা চালাতে সক্ষম।

তারা আরও লিখেছে যে লাদেন হত্যার পর সোমালিয়ায় এই সিল-৬ টিমের হামলা ভোটের বছরের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

নাম-পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে দুজন ইউএস আর্মির কর্মকতা জানিয়েছে যে পরিকল্পনা এবং মহড়ার পর সিল-৬ টিম, যা অফিসিয়ালি নেভাল স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডেভলপমেন্ট গ্রুপ নামে পরিচিত, সোমালিয়ায় এই অভিযান পরিচালনা করে। তবে তারা নিশ্চিত নয় যে এই টিমে পাকিস্তানে লাদেন হত্যাকারী টিমের কোনও সদস্য ছিলো কি না।

ইউএস এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে ভূমিতে অবতরণ করে সিল-৬ সদস্যরা পল এবং জেসিকাকে উদ্ধার করে আনে। এই এক থেকে দেড় ঘন্টার অভিযানে তারা অতি সামান্যই প্রতিরোধের সন্মূখীন হয়। একজন মাত্র প্রতিআক্রমনের চেষ্টা চালায় কিন্তু তাও নিষ্ফলতায় পর্যবসিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে যে সেখানে অবস্থানরত জলদস্যুদের সবারই মৃত্যু ঘটেছে। তবে মেঘাচ্ছন্ন অমাবস্যা রাতে জলদস্যুদের কারো পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও তারা নাকচ করে দিচ্ছে না।

এরপর ইউএস আর্মির এমএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ঘটনাস্থলে এসে সিলদের এবং উদ্ধার হওয়া অপহৃতদের জিবুতিতে অবস্থিত ক্যাম্প লেমোনেয়ারে নিয়ে যায়। পেন্টাগনের প্রেস সেক্রেটারি জর্জ লিটল বলেছে যে জলদস্যুরা অস্ত্র ও বিষ্ফোরকে সজ্জিত ছিলো। তবে উপস্থিত সব কয়জন জলদস্যুর নিহত হওয়া ছাড়া লিটল গুলি বিনিময় বা অন্য কোনও বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে।

বিলে হুসেইন নামের এক জলদস্যু ফোনে এপিকে জানিয়েছে যে আক্রমনের সময় প্রায় সব জলদস্যুই কাট সেবন করে নেশার ঘোরে ছিলো এবং সিলরা তাদের সেই অবস্থাতেই ধরে ফেলে। বিলে নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও উপস্থিত একজনের সাথে ফোনে কথা বলে পুরো ঘটনা জেনেছে। তাদের বক্তব্যমতে মোট নয়জন জলদস্যু নিহত হয়েছে এবং আমেরিকানরা তিনজনকে ধরে নিয়ে গেছে। যদিও আমেরিকান কর্তৃপক্ষ জলদস্যু ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা অস্বীকার করেছে। লিটল আরও বলেছে যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে যখনই অপহৃতদের অবস্থান বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলেছে, ঠিক তখনই ওবামা এই অভিযানের অনুমোদন দিয়েছে।

স্টুটগার্টে বসে এই অভিযান পরিচালনা করেছে আফিকা কনান্ডের সর্বাধিনায়ক জেনারেল কার্টার হ্যাম এবং বারাক ওবামার ন্যাশনাল সিকিউরিটি টিম হোয়াইট হাউসে বসে এই অভিযানের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেছে।

বিশ্বজুড়ে আর দশটা পেশার মতো উন্নয়নকর্মদের জীবনেও নিরাপত্তাহীনতা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। আজ থেকে আধা দশক আগেও নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি দস্যু বা সন্ত্রাসীরা উন্নয়নকর্মীদের জন্য হুমকি ছিলো না। আচেতে কাজ করতে গিয়ে গ্যামের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতাই পেয়েছি। মালাউইতে কোনওদিন মোজাম্বিকান রেবেলদের হামলার স্বীকার হইনি তাদের অভয়ারণ্যের মধ্যে কাজ করতে গিয়েও। হামলার স্বীকার যেটুকু হয়েছি, তার শুরুটা হয়েছিলো বাংলাদেশে। সরাসরি ধোলাই না খেলেও প্রতিনিয়ত ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের হুমকি ধামকি ছিলো অবধারিত। কিন্তু হঠাৎই যেনো পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করেছে। সোমালিয়াতেই আমি গান পয়েন্টে পড়ে থাকলাম, প্রিয় বন্ধু ফ্রানস বার্নার্ড অপহৃত হলো, কেনিয়া থেকে দুজন স্প্যানিশ নার্স অপহৃত হলো, এই তো সেদিন আমার হাতে গড়া একজন উন্নয়নকর্মী আহমেদ জামা মোহামেদ অজ্ঞ্যাত বন্দুকধারীদের গুলিতে খুন হলো। কতোদিন ওকে রসিকতা করে আহমেদ শার্ট বলে ডেকেছি। গতমাসে পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে অপহৃত হলো বৃটিশ উন্নয়নকর্মী, আমার বন্ধুর বন্ধু খলিল ডেইল।

পল এবং জেস আমাদের মাঝে সুস্থ্ ফিরে এসেছে, আমাদের একটা উদ্বেগের অবসান ঘটলো। আমি জানি, এই তিনমাসের দুঃসহ স্মৃতি সারা জীবন ওদের তাড়িয়ে বেড়াবে। কিন্ত আমি এ’ও জানি যে তারপরও ওরা মানবতার জন্যে কাজ করে যাবে। জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই ওরা নিরবে নিভৃতে কাজ করে যাবে। এটাই প্রকৃত মানবতাবাদীদের চরিত্র।

উদ্ধারাভিযানের তথ্যসূ্ত্রঃ ইয়াহু নিউজ।


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনারা ভালো থাকুন। যারা ফিরে এসেছে ওদের প্রতি রইলো অনেক শুভেচ্ছা। জীবন ঝুঁকির বাজি রেখে এই কাজ সবাই করতে পারেনা। আপনাদের স্যালুট...

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ধন্যবাদ তাপস।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

পল ও জেসিকার প্রতি শুভকামনা রইল ।

এতো ঝুঁকি নিয়েও আপনাদের মতো যারা মানুষের জন্যে কাজ করছেন তাঁদেরকে আমার মতো ইণ্টারনেটে গলা ফাটানো মানবতাবাদী কি প্রশংসা করার যোগ্যতা রাখে ?

জানি না । তবু আপনাদের প্রতি রইল আমার গুরু গুরু

ভালো থাকবেন ।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ধন্যবাদ প্রদীপ্তময় সাহা।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ধন্যবাদ মরুদ্যান।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

সাফি এর ছবি

পল ও জেসের মতন সকল উন্নয়নকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ধন্যবাদ সাফি।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

মন মাঝি এর ছবি

চলুক

এই চ্যালেঞ্জিং মহৎ পেশায় নিযুক্ত আপনাদের সবার জন্যে শুভকামনা এবং প্রশংসা।

****************************************

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ধন্যবাদ মন মাঝি।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

কৌস্তুভ এর ছবি

ওইদিকের খবরগুলো খুব বড় মাপের, খুব ভয়ঙ্কর না হলে মিডিয়ায় কমই আসে। আমাদের দেশী মিডিয়ায় তো আরোই কম। আপনার থেকে নিয়মিত আপডেট পাই, ভালো লাগে।

ভালো খবর নিঃসন্দেহে।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ধন্যবাদ কৌস্তুভ।

মিডিয়ায় অধিকাংশ সময়েই আংশিক বা বিকৃত সংবাদ আসে। উইকির বা অন্যান্য সূত্রের তথ্যগুলোও ভূলে ভরা, মনগড়া এবং বাস্তবতা থেকে বহু দুরে অবস্থিত।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

নির্ঝরা শ্রাবণ এর ছবি

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সকল যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা রইল।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ধন্যবাদ নির্ঝরা শ্রাবণ।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।