ক'দিন আগে লিখেছি রুশদের তথা সোভিয়েতদের পানাসক্তির কথা। আজ তাদের পাঠাসক্তির গল্প
সব ক্ষেত্রেই বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সর্বপ্রথম হিসেবে নিজেদের জাহির করার অলিখিত একটা সরকারী নীতি বা বাতিক সোভিয়েত শাসকদের ছিলো বলেই মনে হয়। সেই দাবিমালার যে কয়টি ছিলো বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, তাদের অন্যতম হচ্ছে: "সোভিয়েতরা পৃথিবীর সবচেয়ে পড়ুয়া জাতি"।
সোভিয়েত দেশে এসে সে-দেশের জনগণের কিংবদন্তিতূল্য পাঠপ্রীতির প্রমাণ দেখেছি নিজের চোখে। তবে আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করেছিল পৃথিবীর বহু বহু ভাষা থেকে অনূদিত অগণ্য বই। রাদুগা আর প্রগতি প্রকাশনার প্রধান কাজ ছিলো পৃথিবীর যাবতীয় ভাষায় রুশ লেখার অনুবাদ করা। তার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক প্রকাশনা সংস্থা চালিয়ে গেছে বিপরীতমুখী অনুবাদের চর্চা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়াও "আধুনিক বাংলা ছোটগল্প" বা "সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা" টাইপের বইও আমার চোখে পড়েছে। সদ্য স্কুল পাস করা বালক-বালিকারা তাদের হজমোপযুক্ত দুনিয়ার তাবৎক্লাসিক সাহিত্য পড়ে হাফেজ - এমনটি দেখেছি হরহামেশাই। একটা ঘটনা মনে পড়লো। কেবল ভাঙা ভাঙা রুশ শিখেছি, সেই সময়ে সহপাঠিনী এক তরুণীর মুখে রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ বলতে শুনে তরুণ-বয়সী আবেগে আর একটু হলে তার প্রেমে পড়েই গিয়েছিলাম আর কি...
সাধারণ লোকজনের বই কেনার নেশাকে মহৎ কাজে লাগিয়েছিল সোভিয়েত শাসকবর্গ। অপ্রয়োজনীয় কাগজ রিসাইক্লিং-এর কাজে উৎসাহ যোগাতে একটা পদ্ধতির প্রচলন ছিলো তখন। কয়েক কেজি পরিত্যাজ্য বা অদরকারি কাগজ নির্দিষ্ট স্থানে জমা দিয়ে পাওয়া যেতো দুর্লভ বা দুষ্প্রাপ্য (যুক্তাক্ষর বানাতে ব্যর্থ হলাম) কোনও বই বা রচনাবলী কেনার একটি টোকেন।
সেই পাঠাসক্তি এখন অনেকটাই নিম্নমুখী। তবে তা হতাশাব্যঞ্জক পর্যায় থেকে বহু যোজন দূরে। ইউক্রেন ছাড়া বাকি প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই বহুদিন কোথাও যাওয়া হয়নি বলে। অতএব কিয়েভ শহরের কথাই বলি।
এখানে-সেখানে ছড়ানো ছোট-বড়ো অনেক বইয়ের দোকান ছাড়াও প্রায় ডাউনটাউনে অতি সহজগম্য এলাকায় (শহরের খোদ কেন্দ্র থেকে মেট্রোয় তিন স্টেশনের পথ) আছে বইয়ের দৈনিক বাজার। সোমবার বাদে প্রতিদিন খোলা। বাংলা একাডেমির বইমেলার চেয়েও বেশি জায়গা জুড়ে এক স্থায়ী বাজার। শনি-রোববারে তো বেশ ভীড় হয়। সেই ভীড় ঠেলে অনেকেই কেনে ব্যাগভর্তি বই। এই বাজার দেখে সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক ইউরোপীয় ব্যক্তিত্বের মুগ্ধতা আর বিস্ময়ের কথা বহুবার পড়েছি পত্রিকায়, দেখেছি টিভিতে।
কিছুদিন আগে শহর কর্তৃপক্ষ পুরনো একটি বইয়ের দোকান তুলে দিয়ে সেই জায়গাটি কোনও এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেবার পরিকল্পনার কথা বলেই ফেঁসে যায়। প্রতিবাদে পত্র-পত্রিকা, টিভি, ইন্টারনেটে এমন শোরগোল ওঠে যে পরদিনই পরিকল্পনাটি বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় তারা।
আমরা, বাঙালিরা, বিপ্লবী জাতি। কিন্তু পাঠবিপ্লব আমাদের দেশে কি আদৌ সম্ভব?
মন্তব্য
উত্তম জাঝা!
(অমিতের কপিরাইট)
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
ধন্যবাদ।
আপনার অনেক লেখার মন্তব্য হিসেবে জাঝা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পদ্ধতি জানা ছিলো না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
পাঠবিপ্লব অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু তার জন্য আগে বাঙালীদের ১০০% লিটারেসি চাই। ১০০% লিটারেট হলে তার ২০-২৫% লোকে অন্তত বই পড়তে আগ্রহী হবে। পশ্চিমবঙ্গের ৬৫-৭০% লিটারেসি নিয়ে পাঠবিপ্লব ঘটানোর কথা মাথায় না আনাই ভাল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
পোস্টদাতাকে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। ...
পাঠবিপ্লবের প্রসঙ্গে দিগন্তদার সঙ্গে সহমত।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
প্রীত হলাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
@ দিগন্ত
আপনার মতামত সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু কথা হলো, আমাদের দেশে কেবল স্বাক্ষরক্ষম হলেও তাকে সাক্ষর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রথমে এই ধারণাতে পরিবর্তন আনতে হবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
লিটারেসি আইনা খুব এক্টা কাজ হবে বৈলা মনে হয় না । লিটারেট হওয়া আর পাঠে আসক্তি আনা ভিন্ন জিনিস ।
আমি বহুত লিটারেট লোকরে চিনি যাদের ঝাঁচকচকে এ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার, বিশাল চাকরি, অমুক তমুক । এসব সত্ত্বেও তারা এমনকি হুমায়ূন আহমেদের বইও পড়ে দেখেনি কোনদিন । উচ্চশিক্ষাও এমন একটা অবস্থায় এসে দাড়িয়েছে যে সেখানে ভালো করতে গেলে সারাদিন সিলেবাসের মধ্যেই থাকতে হয় । বাইরে নজন দেবার সময় দিন দিন চলে যাচ্ছে ।
(প্রসঙ্গত বলি, এইদিকটায় হুমায়ূন, ইমদাদুল হক মিলন হলো বেসিক রিড ।)
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এক্কেরে সত্যি কথা। আমার জানাশোনা শিক্ষিত লোকজনের অনেকেরই পড়ার অভ্যেস নেই। তাই শিক্ষিত মাত্রই পাঠাসক্ত, এমনটি বলার অবকাশ নেই। আবার অল্পশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত অনেক লোকের (যেমন, আরজ আলী মাতুব্বর) পাঠাসক্তি রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
আমার পিতামহের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিলো সামান্যই। কিন্তু তাঁর মতো পড়ার নেশা আমি আর কারুর মধ্যে দেখিনি। যা পেতেন হাতের সামনে, তা-ই পড়তেন। বাদামের ঠোঙাও পড়তেন তিনি। হকার পত্রিকা দিয়ে গেলে দাদার হতে তা পড়লে আমাদের সবাইকে অপেক্ষা করতে হতো, কখন তাঁর পড়া শেষ হবে। আমাদের ধারণা, তিনি পত্রিকায় ছাপা প্রতিটি অক্ষর পড়তেন। আর পড়ার কিছু না থাকলে মেঘনাদবধ কাব্য ছিলো তাঁর আশ্রয়।
শিক্ষিত লোক কেন পড়বে না, তা আমার মাথায় ঢোকে না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
আমি তো বললামই যে কিছু অংশই সবসময় পড়বে, বাকিরা পড়তে আগ্রহী হবে না। ওই কিছু অংশকে বাড়াতে হলে সাক্ষরতার হার বাড়াতেই হবে। স্বশিক্ষাও সাক্ষরতা বাড়ায় ...
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
সুপোস্ট।
সুচিন্তিত মতামত
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
প্রগতি বা রাদুগা-র কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম! তাদের কল্যাণেই নিজ ভাষায় মহান রুশ কথাসাহিত্য পড়ার সুযোগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা ইতিহাস শেয়ার করি: প্রগতি প্রকাশন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রচারণার অংশ হিসেবেই বিভিন্ন ভাষায় (বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের) তাদের প্রকাশনা বিনামূল্যে সরবরাহ করত। বাংলাদেশেও এটাই হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশকদের বদান্যতায় (!) সেসব বই আমাদের কিনেই পড়তে হয়েছে। মনে পড়ে, ঢাকা স্টেডিয়ামের দোতলায় বইয়ের দোকান স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স, থরে থরে সাজানো রাশান বই, বিনামূল্যের উপঢৌকন থেকে কিভাবে পণ্য হয়ে গেল!
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
সহমত। তবু বলি, উপঢৌকনের বই কিনে পড়তে হলেও স্বীকার করতেই হবে, সুন্দর কাগজে ছাপা চমৎকার মলাটের অসাধারণ ইলাস্ট্রেশনের সেই বইগুলোর দাম কিন্তু ছিলো তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ভালো লাগলো।
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
ভালো লাগলো জেনে ভালো লাগলো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সন্ন্যাসী উপগুপ্ত, আপনার না কিছু বিশেষ ছড়া লেখার কথা ছিলো?
হাঁটুপানির জলদস্যু
দেশের এই দুর্দিনে তেমন কিছু করতে না পারার অক্ষমতায় এমনিতেই বড্ড মর্মপীড়ায় ভুগছি। তাই এই সময়ে ছড়া-টড়া প্রকাশে মন সরছে না। জানি, বিবেকের দংশন, শোক, মর্মযাতনা - কোনওকিছুই স্থায়ী নয়। তবু মনে হচ্ছে, কিছুদিন যাক। তারপরে ছাড়তে শুরু করবো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ভাল পোস্ট, কিন্তু অতৃপ্তি থেকে গেল, অসম্পূর্ণ মনে হলো। মনে হলো, চাইলে আপনি আরো অনেক কিছু তুলে ধরতে পারতেন, আরেকটু ভেতরে গিয়ে দেখিয়ে দিতে পারতেন পাঠাসক্তির রকমফের।
আমার এক পোস্টে আমি উল্লেখ করেছিলাম, আমার পাঠজীবনের একদম শুরুতে আমি বেশ কিছু রুশ বইয়ের বাংলা অনুবাদ পেয়েছিলাম। শক্ত মলাট, মোটা কাগজ, চমৎকার ছাপা, প্রতিটা গল্পের শুরুতে লেখকের পাতা জুড়ে একটা ছবি। আব্বু কিনে আনতেন, অফিস থেকে ফেরার পথে, রেলস্টেশনের ছোট্ট বুকস্টল থেকে। সেসবের বেশিরভাগই হারিয়েছি, অন্যদের ধার দিয়ে। নিজের মনে করে তারা রেখে দিয়েছে সেগুলো!
পাঠোভ্যাস আসলে কেন বা কিভাবে গড়ে ওঠে জানি না। তবে এটা মানি, শিক্ষিত হলেই বই পড়বে, এটা সাধারণত ঠিক না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বরং তা হয় না। আমরা দুই ভাইবোনই প্রচুর বই পড়ি, কিন্তু এমন না যে আব্বু-আম্মাকে দেখে শিখেছি। তবে ছোটবেলায় ওই বইগুলো না পেলে বলা মুশকিল আদৌ এই অবস্থায় আসতে পারতাম কি না।
কিয়েভের বইয়ের বাজারের কথা পড়ে খুব লোভ জাগছে। আমি বইয়ের দোকানে কাটিয়ে দিতে পারি ঘন্টার পর ঘন্টা। সামান্যতম ক্লান্তি ছাড়াই!
_______________
বোকা মানুষ
নতুন মন্তব্য করুন