গানটি প্রথমে গেয়েছিলেন স্বপ্না রায় (তথ্যটি স্মৃতিনির্ভর, তাই ভুলও হতে পারে)। এই শিল্পীর গান পরে আর কখনও কোথাও শুনেছি বলে মনে পড়ে না।
আর মূল গানটি অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না কোত্থাও।
কথা: গোবিন্দ হালদার
সুর: আপেল মাহমুদ
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলবো না
আমরা তোমাদের ভুলবো না
দুঃসহ বেদনার কণ্টক-পথ বেয়ে
শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা
আমরা তোমাদের ভুলবো না
আমরা তোমাদের ভুলবো না
যুগের এ নিষ্ঠুর বন্ধন হতে
মুক্তির এ বারতা আনলে যারা
যুগের এ নিষ্ঠুর বন্ধন হতে
মুক্তির এ বারতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলবো না
ভুলবো না ভুলবো না
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলবো না
আমরা তোমাদের ভুলবো না
কিষাণ-কিষাণীর গানে গানে
পদ্মা-মেঘনার কলতানে
বাউলের একতারাতে
বাউলের একতারাতে
আনন্দ ঝংকারে আনন্দ ঝংকারে
তোমাদের নাম ঝংকৃত হবে
ঝংকৃত হবে ঝংকৃত হবে ঝংকৃত হবে
নতুন স্বদেশ গড়ার পথে
তোমরা চিরদিন দিশারী রবে
নতুন স্বদেশ গড়ার পথে
তোমরা চিরদিন দিশারী রবে
আমরা তোমাদের ভুলবো না
ভুলবো না ভুলবো না
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলবো না
আমরা তোমাদের ভুলবো না
Ek sagor rokter bi... |
মন্তব্য
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। দেশ ছেড়ে লাখো মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটে আসছে কলকাতায়। আকাশবাণী রেডিও আর খবরের কাগজের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা। তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়ান কলকাতার সর্বস্তরের মানুষ। কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা কলম ধরেন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে।
সেই একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকে সাড়া দেন কলকাতার এক গীতিকবি। তখন তাঁর বয়স ৪১ বছর। নাম গোবিন্দ হালদার। তিনি আয়কর দপ্তরের একজন কর্মী। কাজের ফাঁকে লেখেন কবিতা আর গান। তাঁর গান আকাশবাণীতে নিয়মিত প্রচার করা হতো। তাঁর এক বন্ধুর অনুরোধে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখে ফেলেন বেশ কিছু গান। তাঁর গানগুলো এক এক করে প্রচার করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। তাঁর গানে আরও উজ্জীবিত হন মুক্তিযোদ্ধারা।
গোবিন্দ হালদারের লেখা সেই অবিস্মরণীয় গানগুলো হলো−
১) ”মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে”,
২) “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে”,
৩) “পূর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে”,
৪) “লেফট রাইট লেফট রাইট”,
৫) “হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার”,
৬) “পদ্মা মেঘনা যমুনা”,
৭) “চল বীর সৈনিক”,
“হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার বাংলার মাটি” প্রভৃতি।
২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। গোবিন্দ হালদার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানিয়ে আরেকটি মাস্টারপিস লিখে ফেললেন – 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে'। গানটি আপেল মাহমুদের অনুরোধে লেখা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন করতে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি গানের প্রয়োজন ছিল। এই কিংবদন্তি গানটি লিখতে গোবিন্দ হালদার মাত্র একদিন সময় নিয়েছিলেন।
গানটি হাতে পেয়ে আপেল মাহমুদ ও গোবিন্দ হালদার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি ছোট্ট রুমে বসেছিলেন। আপেল মাহমুদ বেশ উৎসাহ নিয়ে গানের কথায় সুর দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আপেল মাহমুদ হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গানের প্রথম তিনটি লাইন ভালোভাবেই সুর করে ফেললেন। কিন্তু পরের লাইনগুলোতে সুর করা তার জন্য কঠিন হয়ে উঠছিল। লাইনগুলোও বেশ দীর্ঘ ছিল। তাই আপেল মাহমুদ-এর বিনীত অনুরোধে, গোবিন্দ হালদার-কে লাইনগুলো থেকে কিছু কিছু শব্দ সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল তার সুর করার কাজটা একটু সহজ করে দেওয়ার জন্য। পুরো গানটির সুর চূড়ান্ত করতে দুই দিন সময় লেগেছিল। সুরারোপ করার পরপরই, আপেল মাহমুদ গানটির লিডিং ভয়েস স্বপ্না রায়ের সাথে বসে গানটির রিহার্সাল শুরু করেছিলেন।
গানটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আপেল মাহমুদ বলেন, “এটার সুর করতে গিয়ে আমি লক্ষ শহীদের কথা ভেবেছি। যেহেতু এই গানটি শহীদদের স্মরণে, আমাকে খেয়াল রাখতে হলো, মেলোডির যেন কোনো কমতি না হয়, সুরের যেন বৈচিত্র থাকে। সুরের যেন একটা অ্যাট্রাকশন থাকে, একটা ম্যাগনেটিক পাওয়ার থাকে।”
গোবিন্দ হালদার এ গানের কথা বলতে গিয়ে বললেন,
“আপেল মাহমুদ তখন শিয়ালদহ স্টেশনের পূরবী সিনেমার পাশে মহাত্মা গান্ধী রোডের শ্রীনিকেতন বোর্ডিংয়ে থাকতেন। এখন অবশ্য ওই বোর্ডিংয়ের নাম বদলে গেছে। আপেল মাহমুদ সে সময় আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন। মনে আছে, আমি ২১ ডিসেম্বরের দিকে আপেল মাহমুদের সেই বোর্ডিংয়ে যাই। তখন তিনি গানটি আমাকে সুর করে গেয়ে শোনান। দারুণ লেগেছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে, একাত্তরের ২৩ কিংবা ২৪ ডিসেম্বর গানটি প্রথম প্রচারিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারে। গানটির লিডিং ভয়েস ছিল স্বপ্না রায়ের। আর কন্ঠ দিয়েছিলেন আপেল মাহমুদ ও সহশিল্পীরা। এখন স্বপ্না রায় কোথায় আছেন জানি না। স্বপ্না রায়ের বাড়ি ছিল ঠাকুরপাড়া, কুমিল্লায়। তখন স্বপ্না রায়ের বয়স ছিল ২১-২২ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় মা-বাবাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই ছিলেন স্বপ্না রায়। পাশের রুমে বসে গানের রেওয়াজ করতেন।”
.
》গীতিকার গোবিন্দ হালদার
গোবিন্দ হালদার ১৯৩০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। চাকরি সূত্রে প্রায় ৫০ বছর আগে কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। তিনি একজন গীতিকার ও কবি। তাঁর রচিত প্রথম কবিতা ছিল ‘আর কতদিন’। তিনি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কবিতা ও গান লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূর দিগন্ত’। তাঁর মেয়ে গোপা হালদার জানান যে তার বাবার প্রায় ৩,০০০ গান এখনো প্রকাশ করা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের একজন বিদেশী বন্ধু হিসেবে ভূষিত করে। বাংলাদেশপ্রেমী এই মহান গীতিকার দীর্ঘদিন ধরে কিডনি সমস্যায় ভোগার পর ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি কোলকাতার মানিকতলার জিতেন্দ্রনাথ রায় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
.
২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা তাঁদের বিচারে সেরা যে পাঁচটি গান মনোনয়ন করেছেন, তার ভিত্তিতে বিবিসি বাংলা তৈরি করেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকা। এর মধ্যে “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’’ গানটি ২০ সেরা গানের মধ্যে ৫ম অবস্থানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
নতুন মন্তব্য করুন