অপেক্ষা, তাঁর জন্য

রেশনুভা এর ছবি
লিখেছেন রেশনুভা (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/১১/২০০৯ - ৬:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


খুব হালকা লাগছে; একেবারে পালকের মতন। ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসে ক্লান্তি, অবসাদ গুলো দূর হয়ে যেতে চায়। মনে করতে পারছি না এরকম আনন্দময় অনুভূতি শেষ কবে হয়েছিল। আচ্ছা আজ তো কোন নেশা জাগানিয়া তরল পেটে পড়েনি। না কী পড়েছে? তারপর শুরু হয়েছে অস্থির মনটাকে ফুরফুরে করে তোলার জারণ-বিজারণ। ধুর ছাই, কিছুই মনে করতে পারছি না। তার চেয়ে ঢের ভালো আকাশ দেখা। গাঢ় কালচে রঙে ছোপ ছোপ ধূসরতা। মিটমিটে তারাগুলোর জীর্ণ আলোতেই ঐ ধূসরতার সৃষ্টি; একটু আলোর আভা গহীন অন্ধকারের এই কৃষ্ণতিথিতে।

যাহ। এখন এক্কেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার; লোডশেডিং। কিছুটা পথ যেতেই দূরে দেখা যায় একটু আলোকবিন্দু। মোমবাতি হবে হয়ত। উঁকি দেই জানালা দিয়ে। এক কিশোরী তার দুটো বেণী দুলিয়ে পড়ছে। আর একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করি। আলো-আঁধারিতে চাপা পড়ে যায় দৃষ্টিপথের অনেকখানি। যেটুকু পথ যেতে পারে আমার চোখ তাতে ধরা দেয় এক বাবা; পরম মমতায় তাঁকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে। মেয়ের মাথায় তাঁর স্নেহভরা হাতটাকে মনে হয় অপার ভরসার প্রতীক। মেয়েটার চোখদুটো এই অন্ধকার ছাপিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় আমার কাছে। সেই চোখে দেখিনি কোন নিরাশার ছাপ; অনেক দীপ্তিময় ঐ চোখজোড়া।

হঠাৎই সব বাতি জ্বলে উঠে। সরে যাই। আরো এগোতে থাকি আলোমাখা পথ ধরে অজানার দিকে। “এই সিএনজি, যাবা?” – শব্দের উৎসে এক যুবক। সময় দেখার অজুহাতে একটু থমকে দাঁড়াই। চোখ চলে যায় যুবকের পাশে; এক ক্ষীণকায়া তরুণী আর তাঁর কোলের তোয়ালেটার দিকে। তোয়ালের পাশ দিয়ে দেখা যায় ছোট্ট ছোট্ট হাত। আর একটু কাছে গিয়ে দেখি সেই মায়াবতীকে। আহ, কী সুন্দর। ঘন কালো একরাশ চুল; গোলাপী আভা তাঁর গায়ে। চোখের মনিটা ঠিক ঐ যুবকের মতন, হালকা বাদামী। পূর্ণ চোখে দেখছে সে তাঁর নতুন জগৎটাকে; দেখছে তাঁর মাকে। ওর মা মাথা নামিয়ে কী এক দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলে ওকে। হাতের আলতো স্পর্শ মা এর নাকে মুখে মাখিয়ে সাড়া দেয় ও। ওর বাবা চেয়ে থাকে ওদের দিকে; দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। আর আমার মুগ্ধতা নজর এড়িয়ে যায় ওদের।

ঐ মুগ্ধ চোখে আরো দূরে তাকাই। পথ যে এখনও অনেকটা বাকী, সময় ও নেই যে বেশি। যেতে যেতেই শুরু হয়ে যায় বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি। বর্ষণ সিক্ত আলো ঝলমলে নগরীটাকে দেখতে দেখতেই এগোতে থাকি। দেখা হয়ে যায় এক যুগলের সাথে। আমার বেশ কিছুটা সামনেই ওরা। নিজেদের মনের রঙে একে অপরকে রাঙিয়েছে, ভিজিয়েছে; আর এখন ভিজছে অকৃপণভাবে অঝোর ধারায়, একত্রে। ছেলেটা হঠাৎই তাঁর আধখানি হাতার গেঞ্জির উপরের শার্টটা খুলে ফেলে; মেলে ধরে উপরে তাঁর সঙ্গীকে একটু ছায়া দিতে, বৃষ্টি থেকে। মেয়েটা তাঁকায় ছেলেটার দিকে। চোখের হাসি যে এত সুন্দর হতে পারি তা আগে দেখিনি। আর ছেলেটার চোখে দেখি আজীবন ছায়া হয়ে থাকার উদগ্র, অবাধ্য বাসনা।

চলে যায় ওরা হাতে হাত রেখে অন্য পথে। বৃষ্টিও থেমে যায় একটু পর। সোডিয়াম লাইটের ঘোলাটে আলোতে সদ্য বৃষ্টিভেজা পথটাকে অনেক চকচকে লাগে দেখতে। দূরের সুরম্য ঐ অট্টালিকাগুলোর মতই। এদিকটায় অবশ্য মাটি ছোঁয়া ঘরই বেশি চোখে পড়ে। এমন কোন কোন ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময়ই দেখা যায় এক অভাবী মা তাঁর সন্তানের মুখে তুলে দিচ্ছেন হাড়ির তলানীতে পড়ে থাকা ভাতের শেষ গ্রাসটুকু। কোন এক দিনমজুরী বাবা তাঁর ছোট্ট মেয়েটার হাতে তুলে দেয় কাঠি লজেন্স। কোন এক সক্ষম ভাই নিয়ে আসে বোনের জন্য এক শিশি আলতা। আর কোন এক স্বামী ঘরের দাওয়ায় অপেক্ষা করা বউয়ের গায়ে জড়িয়ে দেন সস্তা জরী পাড়ের লাল শাড়ী। ওরাও এত সুন্দর করে হাসতে পারে! ওদের সবার মুখের ঐ অদ্ভূত দ্যুতি এই কৃষ্ণতিথির অন্ধকার টুকু কে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়।

আর এক ঝলক ওদেরকে দেখে নিয়ে সামনে তাঁকাই। সময় ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ। দূরে পরে থাকে শহরের আলোর ঝলকানি আর লোকজনের ব্যস্ত আনাগোনা। গাড়ীগুলোর ক্রমাগত ভেঁপু শব্দ আর ক্রেতা-বিক্রেতার বচসাও একসময় আর শোনা যায় না। শুধু হৃদয় মাঝে দেখি ঐ দৃশ্যগুলো; হাসিখুশী মানুষগুলো। এক অন্ধকার কানাগলির সামনে এসে দেখি এক একলা মানুষ। দাঁড়িয়ে আছে ঠায়; কোনো অপেক্ষা কী কারো জন্যে? ঐ মানুষটাকে যে বড্ড চেনা মনে হয়।

হঠাৎ করেই অনেক ভারী মনে হয় নিজেকে। আমার পতন হয় দ্রুত; অভিকর্ষজ ত্বরণের থেকেও দ্রুত। আকাশটা দূরে সরে যেতে থাকে, তারাগুলো আরো ম্লান হয়ে যায়। ঐ মানুষটার ভিতরে ঢুকে যাই আমি। সেই তো আমার একমাত্র আশ্রয়। জানা যায়নি আমার আশ্রয়দাতার দেহ থেকে এই আমি, তাঁর অবাধ্য মনটা, কীভাবে মুক্তি পেয়েছিলাম সেই প্রশ্নের উত্তর।
-------------------------------------------------------------------------

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না কী? এখানেই বা কী করে এলাম। এইসব সাতপাঁচ ভাবতেই ভাবতেই উঠে পথ চলা শুরু করি আমি। ক’টা বাজে এখন? জামা-কাপড় তো ভিজে চুপচুপে। বৃষ্টি পড়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কোথায়? রাস্তাঘাট তো সব শুকনো মনে হচ্ছে। মনটা এত ফুরফুরে লাগছে কেন? অনেকদিন পর বুক ভরে বাতাস নিলাম আজ। স্বপ্ন দেখেছিলাম কী? অনেকগুলো স্বপ্ন, হাসিমাখা মুখ। কেন জানি, অঝোর বর্ষায় ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব।

আমি সেই বর্ষণের অপেক্ষায় আছি।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

যেতে যেতে পথে...হুমম,একটু অন্যধাঁচের মনে হলো আপনার অনান্য লেখাগুলোর চাইতে,, পড়তে ভালো লাগলো! *তিথীডোর

রেশনুভা এর ছবি

এটা জানতে পেরে ভালো লাগলো। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

"ওদের সবার মুখের ঐ অদ্ভূত দ্যুতি এই কৃষ্ণতিথির অন্ধকার টুকু কে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়।"----------চমৎকার হয়েছে রেশু ভাই।
এস হোসাইন

---------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"

রেশনুভা এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক ভাই।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

এইরে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। এমন দিনে অফিসে যেতে হবে দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। তবে আপনার লেখা মন খারাপ হয় নাই। লেখা ভালো হৈছে!
..........................................................................

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।

রেশনুভা এর ছবি

হাসি
আপনার মনটা এইবার একটু ভালো করেন বস।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগল পড়ে। সুন্দর শব্দ বিন্যাস। ঘটনা গুলি আমাদের সমাজের খন্ড চিত্র, কিন্তু অনেক পরিচিত এবং ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। ধন্যবাদ রেশনুভা ভাই।

দলছুট।

রেশনুভা এর ছবি

পড়লেন দেখে অনেক ভালো লাগলো দলছুট ভাই।

মৃত্তিকা এর ছবি

লেখাটা চমৎকার হয়েছে! বাকি লেখাগুলোর চেয়ে একদম আলাদা। বেশ ভালো লাগলো!
পড়তে পড়তে আনিসুল হক এর 'ফাঁদ' এর কথা মনে পড়ছিলো।

রেশনুভা এর ছবি
সুহান রিজওয়ান এর ছবি

সহমত। একেবারে শেষে এসে 'ফাঁদে'র কেন্দ্রীয় চরিত্রটার কথা মনে পড়ে গেলো...।

______________________________________________________

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

পড়তে বেশ ভাল্লাগলো হাসি

----------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

রেশনুভা এর ছবি
স্পার্টাকাস [অতিথি] এর ছবি

শুধু হৃদয় মাঝে দেখি ঐ দৃশ্যগুলো; হাসিখুশী মানুষগুলো

আপনার অন্যান্য লেখাগুলো থেকে আলাদা এক টা লেখা। সেইরকম।

রেশনুভা এর ছবি

সত্যি? অনেক ভালো লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা কেমন যেন, বিষন্ন বিষন্ন ভাব। অন্য রকম। ভালো থাকুন।

স্বপ্নদ্রোহ

রেশনুভা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো!

রেশনুভা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

"ঐ অদ্ভুত দ্যুতি এই কৃষ্ণতিথির অন্ধকারটুকুকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়...." দারুণ সুন্দর তো লাইনটা!!

রেশনুভা এর ছবি
তিথীডোর এর ছবি

ভ্রাতঃ হে,
এই প্যারাটার জন্যেই তো 'প্রিয়'তে রেখেছি! খাইছে

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

খুব ভাল্লাগলো লেখাটা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রেশনুভা এর ছবি
ধুসর গোধূলি এর ছবি
রেশনুভা এর ছবি

এইডা তো কমেন্টের কমেন্ট করলেন। মন খারাপ

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

পুরা 'ছচল' হইলে তারা মারতাম, কয়টা মারতাম এইটা এখন কইতামনা।

ভালু পাইলাম, আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়া স্বপ্নের ভুবনে ঘুর-পাক মাইরা আসলো, জুশ লাগলো।

-------------------------------------------------
সকলই চলিয়া যায়,
সকলের যেতে হয় বলে।

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

রেশনুভা এর ছবি
তানবীরা এর ছবি

তোমার অন্যান্য লেখা থেকে একদম অন্যধাচের কিন্তু খুব ভালো লাগলো পড়তে।

মনে হচ্ছে একজন লেখক রেশনুভার আর্বিভাব হচ্ছে

**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

রেশনুভা এর ছবি

দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি
প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে ভালু ভালু কথা শুনতে অনেক ভালু লাগে।

রাহিন হায়দার এর ছবি

বৃষ্টি বৃষ্টি একটা অনুভূতি হচ্ছে লেখাটা পড়ে। চলুক

...............................
অন্ধকারে অন্ধ নদী
ছুটে চলে নিরবধি

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

চলুক
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

ভ্রম এর ছবি

খুব সুন্দর লেখা...

ভণ্ড_মানব এর ছবি

হে হে নিশ্চই আমার মন্তব্যের অপেক্ষাতেই ছিলেন। দেঁতো হাসি
আগেই পড়ছি মোবাইল থেকে...কেন জানি কমেন্টানো হয় নাই।
লেখা স্বাদু হয়েছে বরাবরের মতোই...একটু ভিন্ন বলেই হয়তো ভালোলাগাটা একটু বেড়েই গেছে। খাইছে
ডিসেম্বর আইতাসে...আমি কিন্তু আছি আপনারই অপেক্ষায়। চোখ টিপি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চলুক

রেশনুভাই, আমিও অপেক্ষায় আছি। কবে দেশে আসবেন, সেইটার দেঁতো হাসি

রেশনুভা এর ছবি

রাহিন, সিমন ভাই, ভ্রম, ভণ্ড, অপ্র ...
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ অমূল্য এই উৎসাহটুকু দেওয়ার জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।