দিনের শেষেঃ
এখন কাঁদছি। সশব্দে। নিজের কানেই কিরকম বেসুরো লাগছে। তারপরও কাঁদছি। আর লিখছি। লিখে রাখছি এই দিনটার কথা। বাঙালির আটপৌরে একটা দিনই প্রায়। স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন প্রায় পুরোটা পূরণ হতে গিয়েও হয় না। দিনশেষে প্রাপ্তির খাতা শূন্য। একবারেই শূন্য?
দিনের শুরুঃ
একেবারেই অন্যরকম। সাতটা বাজার আগেই বিছানা ছেড়েছি। ফেসবুকের পাতা আর খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে রেডি। ফুরুফুরে একটা আমেজ। বসন্তকালের সাথে বেশ যায়। আজ বাংলাদেশ ফাইনাল খেলবে। এশিয়া কাপ ফাইনাল। দারুণ খেলেছিল ওরা ভারত, শ্রীলংকার সাথে। পুরো প্রফেশনাল ক্রিকেট। প্রত্যাশা তাই এবার অন্যরকম।
তারপরেঃ
ইউনিতে নিজের রুমে এসে যখন ঢুকি তখনও খেলা শুরু হতে আরও প্রায় ৪৫ মিনিট বাকি। সময়ের ব্যবধানে আমার এখানে খেলা শুরু ৯টায়। কাল রাতের একটা কাজ বাকি ছিল। সেরে ফেললাম চটজলদি। তার আগে ব্রাউজারে ওপেন করে নিলাম ফেসবুক আর ক্রিকইনফো ট্যাব। জানলাম, বাংলাদেশ টসে জিতেছে।
ইনিংস শুরুঃ
একেবারে প্রথম থেকেই দেখেছি। প্রথম বলটা হাফিজ ছেড়ে দিল। সকাল সকাল সিগারেটের তৃষ্ণা পাওয়ায় নিচে গেলাম। রুমে এসে ঢুকতেই দেখি কাভারে রিয়াদ এর ক্যাচ। ১ম উইকেটের পতন। মিউটেড 'ইয়েস' বলেই চেয়ারে বসে পড়লাম আবার। এক মনিটরে খেলা আর অন্য মনিটরে কোড খুলে রাখলাম ক্যামোফ্লেজ হিসেবে।
এরওপরেঃ
মোর্শেদ এসেছিল খানিক পরে। ওর সাথে গল্প আর খেলা দেখতে দেখতেই আরও ২ উইকেট হাপিশ। আমিও খানিক নির্ভার হয়ে ভাবলাম যাই বসের সাথে নিজে থেকেই দেখা দিয়ে আসি। যাতে পরে বিরক্ত না করে।
আধাঘন্টা খানিক পরেঃ
খেলা চলল বাংলাদেশের মত। আর আমার কাজ অনাদরে-অবহেলায় পড়ে রইল ডেস্কটপের এক কোণে। এর ফাঁকে ফাঁকে চলল ফেসবুকিং। যেই বলি 'উইকেট দরকার', আর ওমনি উইকেট। আর কে নেবে? আমাদের সুপারম্যান-আল-হাসান। মাঝে থেকে আফ্রিদি একটু এলোমেলো করে দিল বোলিং। ব্যাপার না। সেও বিদায় নিল ১৮০ এর আগেই।
২০০ তে বুকড?
৬ উইকেট পড়ার পরে ৭, ৮ ও পড়ে গেল টপাটপ। আমি যা বুঝি, ২২০ এর নিচে যে কোন স্কোর বাংলাদেশ অনায়াস দক্ষতায় তাড়া করতে পারবে। আশায় বাঁধিলাম বুক, পাকি হইবে আন্ডার ২০০ বুকড।
হলো নাঃ
৯ উইকেট বাংলাদেশ ফেলেছিল মনে হয় ৪৫/৪৬ ওভারের দিকে। রান তখন ২০৬ এর মত। আমি তখন আরাম করে একটা সিগারেট খাবো ঠিক করছি অল-আউট হলেই। হলো না। পাকি অল-আউট হলো না। শেষ ওভারের খেলা দেখার সময় কল্লোল, মোর্শেদ ও রুমে ছিল। ওদের বলছিলাম রান আর কত হবে? ২২৫? নাহ, রান আরো বেশি হল। ৪৯ ওভার বাংলাদেশের মনমতন খেলা হল। আর শেষ ওভারটা পাকিদের ইচ্ছামতন। আরে, ধূর, এইগুলো ব্যাপার হইল? মজা করে তখন বলেছিলাম, ১০ ওভার কেটে রান ২৫ কমায় দিক। টাইগাররা আরো স্বচ্ছন্দে জিতুক।
বিরতিঃ
বেরিয়ে পড়লাম বাসার উদ্দেশ্যে। ক্যাম্পাসেই থাকি। সাইকেলে ৫ মিনিট। বাংলাদেশের ইনিংসে টেনশন বেশি থাকে। তাই বিড়ি টানতে হয় যেটা বাসায় রুমে বসেই করা যায়। এবং, অতঃপর বেরিয়ে পড়া। বেরিয়েই বুঝলাম, প্রেমে পড় আর নাই বা পড়, এখন বসন্ত। তাপমাত্রা ১৮ এর মতন। হালকা বাতাস। রোদে ঝিকিমিকি সোনালি চুল আর কোমল ... আচ্ছা, তাড়াহুড়া আছে। বাসায় যাই আগে।
বাংলাদেশঃ
নাজিম একেবারেই ইজি না। আরেক পাশে তামিম কিন্তু দারুণ। গুলের বলে ঐ আপিশ স্ল্যাশটা আরো দারুণ। ইনিংসের প্রথম চার। নাজিম রান না পেলেও উইকেট কামড়ে ছিল। কিন্তু ১০ ওভার পার হওয়ার পরও ... নাহ, হচ্ছে না। আমারও উশখুশ লাগছে।
১৫-৩০ ওভারঃ
গুরুত্বপূর্ণ সময় ইনিংসের। পাকিরা এই টাইমে রানও চেক দিছে আর উইকেটও নিছে। রান মনে হয় এই ১৫ ওভারে হয়েছে ৩৫ এর মত। ৩০ ওভার শেষে ১০০ এর মত। তবে আশার কথা ৭ উইকেট অক্ষত এখনও, সাকিব অক্ষত এখনও।
আমার গল্পঃ
এর পরের কথা আর বলব না। আমি আমার গল্প করি। আমি বিছানায় শুয়ে আরাম করে খেলা দেখতে পারি না। আজকে চেষ্টা করেছিলাম। কাজ হয়নি। ৩২ ওভারের দিকে দেখি আমার সারা শরীর কাঁপছে। নিজের উপরই বিরক্ত হলাম এই হার্ট দেখে। আমি নিজেকে মনে করতাম আমার হৃদয় অনেক বড়। জড়সড় হয়ে এসে বসলাম চেয়ারে। ৯০ বল, ১০৫ রান, সাকিবসহ ৭ উইকেট। হাতের কাছে কোক নিয়ে বসলাম। কেক দিয়ে উদযাপনটার ছকও কেঁটে রাখলাম।
নাসির গেল ১৭০ এ। ব্যাপার না। মুশফিক আছে তো। সাকিব গেল। একটু মিইয়ে গেলাম। মুশিও গেল ১৯০ এ। ফুলস্ক্রীন ছোট করলাম। হতাশ হয়ে সিগারেট ধরালাম। পাঠক জেনে নিবেন এটা অজুহাত মাত্র। মাশরাফি দারুণ খেললো। ফের স্ট্যাটাস 'পাগলা' কে নিয়ে। এভাবেই ১৫ বলে ১৯। ম্যাশ আউট। পরের দুই বল ডট। আমার ছাইদানী প্রায় পূর্ণ। কিন্তু এখন উঠতে পারবো না। ১২ বলে ১৯।
ঐ ১৯ নিয়েছিল পাকিরা শেষ ওভারে। ওটা হয় ক্রিকেটে, আগে ব্যাটিং করলে আরও বেশি হয়। কিন্তু টাইগাররা তো চেজ করছে। প্রেসার আছে। কোন চার-ছয় ছাড়া ৬ বলে ৯ রান। শেষ ওভার করার আগে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখলাম এইভাবে ... "আমার যেন তোদের মতন ১১ টা ছেলেপুলে থাকে ... "।
এই স্ট্যাটাস টা আমি আর দিতে পারিনি।
কোন স্বপ্ন পূরণের এত কাছে থেকে রিক্ত হাতে ফিরে আসলে কেমন লাগে আমি বলতে পারবো না। সাকিব পারবে। ওকে জিজ্ঞাসা করতে আমার সাহস হয় না। আমি শুধু জানি, আমার আজকের দিনটা একেবারেই অন্যরকম। আজ আমি কেঁদেছি, অনেকদিন পর।
এই কান্নায় অসহায়ত্ব ছিল।
দিনের শেষ ভাগে এসে মনে হচ্ছে, আমি অসহায় নই, আমরা অসহায় নই। আমাদের সাথে ঐ ১১ টা ছেলে আছে যারা প্রায় সবাই আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট কিন্তু তাদের শক্তি, ক্ষমতা অসীম। ওরাই আমাকে আজ বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে।
আবারও অন্যরকম একদিনের অপেক্ষায় রইলাম। কাঁদবো আবারও তবে বিজয়ের কান্না।
শুভ রাত্রি।
মন্তব্য
আজ কেঁদেছি। তবে, আমার দেশ একটু একটু করে পরাশক্তি হচ্ছে দেখে ভাল লাগছে। একদিন সবাইকে ছাপিয়ে যাবে।
টিমমেট ১১ নয়, ১০।
শাহাদাতকে ঘৃণা করি সে খারাপ খেলেছে বলে নয়, তার পাকাগর্জমে আগ্রহ দেখে।
১৯ রানের কথা মনে থাকবে।
পদ্মবাবু আর পাকাগর্জম-প্রেমী মুক্ত হোক বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
পরের টুর্নামেন্টে আরেকটু পরিপক্ক একটা দল চাই, এবারের মতো স্পিরিট চাই। কান্নাকাটির সময় নাই, আমরা বাঘের পিঠে সওয়ার।
ভাইরে মন খারাপ কইরেন না। এই সিরিজ থেকে সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে হয় মানুষের আবেগটা। মানুষের বিশুদ্ধ আবেগ দেখে মনটা ভরে গেছে।
হ
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
শেষ কবে বাংলাদেশের খেলা দেখে এভাবে কেঁদেছিলাম মনে করতে পারছিনা।
এইযে সারা বাংলাদেশ কাঁদছে, এই বিশুদ্ধ আবেগটুকুরই যেন পুনর্জন্ম হল এই এশিয়া কাপে
জানি, এই আবেগটুকুই আমাদের সকল অসাধ্যকে হেতের মুঠোয় নিয়ে আসবে
নির্ঝরা শ্রাবণ
দুইটা আস্ত পাকি সমেত তাদের ইনিংস দেখসিলাম।
এক এক ইউরো বাজি ধরসিলাম।
আফ্রিদির উইকেট যখন পড়ল, তখন তো ওগর একটায় কাইন্দাই দেয়।
তবে দিনের শেষে আমার ইউরো হারসি।
ব্য়াপারনা। বাঘের বাচ্চারা ফাইট দিয়া হারসে। হালুম।
"পুরো প্রফেশনাল ক্রিকেট।"
আমি আপত্তি জানাচ্ছি। এই প্রফেশনাল শব্দটার প্রতিই আমার বিতৃষ্ণা আছে।
চোখের জলেরও যে একটা মূল্য আছে, ভুলে যাবেন না।
লেখায়
নতুন মন্তব্য করুন