বুদাপেস্টে গ্লোবাল ভয়েসেস সামিটের একটি সেশনে তুলে ধরা হয়েছিল যে ব্লগিং কিভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরছে। সেখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাইজিং ভয়েসেসের কার্যক্রম যা বিশ্বব্যাপী প্রান্তীক ও দরিদ্র-সুযোগবিহীন সমাজকে ওয়েব ২.০ (ব্লগিং, চিত্র, ভিডিও, পডকাস্ট) ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের সুখ-দু:খের কাহিনী প্রকাশ করার কাজে রত বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষূদ্র অনুদান ও প্রশিক্ষন ইত্যাদি সাহায্য প্রদান করে।
গ্লোবাল ভয়েসেসের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের (পশ্চিমা দেশগুলো বাদ দিয়ে) ব্লগারদের কন্ঠ ও তাদের মতামত তুলে ধরা যা প্রচলিত প্রচার মাধ্যম ছাড়া আরেকটি পরিপ্রক্ষিত দেবে ঐসব অঞ্চল সম্পর্কে জানার জন্যে। কিন্তু কিছূ দিন পরে দেখা গেল যে উন্নয়নশীল বিশ্বে সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরাই বেশী ব্লগিং করে। ফলে বিশ্ব যেন তাদের কন্ঠই বেশী শুনতে পায়। বিপুল পরিমাণ যে সুবিধাহীন জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া এইসব কথপোকথন অর্থহীন। সে অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যেই রাইজিং ভয়েসেস গত এক বছর ধরে কাজ করছে এবং ইতিমধ্যে এর ১৬টি প্রকল্প সফল ভাবে কাজ করছে।
এই প্রকল্পগুলোর এক একটি বিষয় বৈচিত্রে অভূতপূর্ব। নেইবারহুড ডায়রিজ কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের (পতিতাপল্লীর) শিশূদের সিটিজেন জার্নালিস্ট হওয়া শেখাচ্ছে। বাংলাদেশের নারী জীবন ঢাকার কর্মজীবি নারীদের কারিগরী প্রশিক্ষনের পাশাপাশি ব্লগিংও শেখাচ্ছে এবং তারা আজ গল্প, কবিতা, রিপোর্টের মাধ্যমে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো, তাদের ভাললাগাগুলো প্রকাশ করতে পারছে।
জামাইকার প্রিজন ডায়রিজ জেলের কয়েদিদের ব্লগিংয় শেখাচ্ছে ও তাদের কথা প্রকাশ করতে সাহায্য করছে - কোন পরিস্থিতিতে তারা এখানে আসলো, কেন অপরাধ করল, ভবিষ্যতে কি করবে ইত্যাদি। কেনিয়ার রিপ্যাক্টেড অগাস্তো বোয়ালের ইনভিজিবল থিয়েটার বা থিয়েটার অফ দ্যা অপ্রেসড এর আদলে অংশগ্রহণমূলক ম্যাগনেট থিয়েটার এবং আইসিটি ব্যবহার করে স্থানীয় ক্যাম্পের তরুণ-তরুণীদের বিহেভিয়ার চেন্জ সংক্রান্ত কাজ করছে।
এরকম প্রতিটি প্রকল্পই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। এই প্রকল্পগুলো নিয়ে বানানো একটি ভিডিও ট্রেইলার দেখুন।
সামিটে রাইজিং ভয়েসেসের প্রকল্পগুলো থেকে যে কয়েকজন এসেছিল (বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত নারী জীবনের তসলিমা ভিসা জটিলতার জন্যে আসতে পারে নি) তার মধ্যে একজনের কথাই বলব, ক্রিস্টিনা কিসবার্ট বলিভিয়ার প্রত্যন্ত অন্চলে থাকা একজন আদিবাসী মেয়ে যার নিকটবর্তী এল আল্টো শহরে যেতে ৫ ঘন্টা লাগে। সে তার ব্লগের মাধ্যমে আদিবাসী সমাজের সুখ, দু:খ ও সমস্যার কথা তুলে ধরছে। বলিভিয়ার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী প্রায় ত্রিশটি আদীবাসী সমাজ নিয়ে গঠিত অথচ সেদেশের প্রচার মাধ্যম তাদের গুরুত্ব দেয়না - কারন প্রচার মাধ্যম তো শিক্ষিত এলিটদের।
এই পরিস্থিতি আমাদের দেশেও বিদ্যমান আমাদের দেশেও অনেক আদিবাসী আছে, আছে অনেক গরীব লোক। তাদের সম্পর্কে আমাদের জানতে হচ্ছে বড়লোকদের, রাজনীতির মুখপাত্র প্রচার মাধ্যমের মাধ্যমে। তাদের বলার কোন প্লাটফর্ম আমরা দিচ্ছি না।
সামহোয়্যার ইন ব্লগে আমি গুটিকয়েক আদিবাসী ব্লগার দেখেছিলাম যাদের একজন মার্মা ভাষায় কবিতা প্রকাশের জন্যে কটুক্তির শিকার হয়েছিল। সেও ব্লগ পলিটিক্সেরই স্বীকার। হ্যা শব্দটি ইদানিং বেশ শোনা যাচ্ছে। আমরা রাস্তার সস্তা পলিটিক্সকেও ব্লগে টেনে আনছি।
যে কোন গণতান্ত্রিক পরিবেশের মূল বিষয়টি যেটি দরকার সেটি হচ্ছে সমাজের প্রতিটি মানুষের বাক স্বাধীনতার অধিকার। যে কোন কিছূতে একমত হবার জন্যে দরকার মুক্ত আলোচনা ও উন্মুক্ত তথ্য প্রবাহ. দরকার ভিন্নমতকে সম্মান করা। সেটি যত্ক্ষণ না করতে পারছি ততক্ষণ আমরা সুষ্ঠু গণতন্ত্র পাব না।
বাংলাদেশের গরিব লোকেরা ব্লগিং করে মনের ভাব প্রকাশ করবে এমনটি এখনও সায়েন্স ফিকশন শোনালেও নিশ্চয়ই ফকিরের হাতে মোবাইল থাকবে এটি দশ বছর আগে এমনই শোনাত। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে আমাদের বিপুল সংখক এনজিও ব্যাস্ত ও এ নিয়ে নাম নিজেরাই কামাচ্ছে। তবে যাদের জন্যে এ উদ্যোগ তারা কেমন আছে, তাদের ফিডব্যাক কি এসব কিন্তু গণমাধ্যমে আসে না (আসে হয়ত শেষ পর্যায়ে তারা সর্বসান্ত হলে বা সাফল্যমন্ডিত হলে)। তাদেরওকি মুক্তভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দিতে পারে না এইসব এনজিওগুলো ব্লগিং বা অন্য কোন ভাবে?
কিন্তু এই অপাংতেয়দের দাবিয়ে রাখতে পারলেই তো সুশীল সমাজের লাভ। আমরাতো এমনই দেখে আসছি। এ অবস্থার পরিবর্তন কি হবে?
মন্তব্য
এই জিনিসটা কয়দিন ধরে ভাবতেছিলাম। সুশীল সমাজের সার্টিফিকেটধারী অশিক্ষিত সুবিধাবাদী ধুরন্ধরদের নেট-দৌরাত্মই যদি বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র হয়, তাইলে দেশ নিয়ে আশা করার কিছু নাই। কিন্তু এরকমটা হওয়া অসম্ভব। জনগণের সচেতনতাকে যেভাবে সুশীল সমাজ নাক সিঁটকানো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ভরা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে, প্রকৃত চিত্র এমন হলে আর যা-ই হোক, একটা স্বাধীন দেশ আমরা কখনোই পেতাম না।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার একেবারেই সীমাবদ্ধ। আমজনতার কথা বলার সামর্থ এবং সদিচ্ছাওয়ালা লোকের সংখ্যা আঙুলের করে গোণা যায়। আর এটা কখনোই ফার্স্টহ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সের অনুভূতি হিসেবে প্রকাশিত হওয়া সম্ভব নয়। যার কথা তাকেই বলতে হবে। বলার সুযোগ করে দেয়ার দায়িত্ব সরকারের।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অন্তত, এই উত্তর হ্যা বোধক।
আর কিছু না হোক, ইন্টারনেট সংযোগ ( ব্লগিং যোগ্য ) বস্তুটি যে পরিমান দুষ্প্রাপ্য এদেশে, তাতে মনে হয় না, ব্লগিং এ আমরা গণমানুষের অংশগ্রহণ এ মূহুর্তেই আশা করতে পারি।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
এরকম হয়ত আমরা দশ বছর পরে আশা করতে পারি। কিন্তু শুরুটাতো করতে হবে কোথাও। এই দুটি রিপোর্ট কিন্তু আমাদের আশার আলোই দেখায়:
* Bangladesh makes Internet use free for primary schools.
* Bringing Bangladesh into the Internet age.
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
জি ইন্টারনেট পুরোপুরি সুশীলদের দখলে, এই অবস্থা পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা দেখছি না।
খুব বেশি সত্যি কথাগুলো। লিংকগুলোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!
ব্লগিং কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্যে একটি অমিত সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক উপকরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
উদাহরণ দেয়া যেতে পারে ভবদহের, যেখানে মানুষ কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে দিনাতিপাত করছে। আজ যদি ভবদহের অধিবাসীদের সুযোগ থাকতো, অন্তত একটি ডিজিটাল ক্যামেরা আর একটি ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার ব্যবহার করার, তাহলে তাঁরা নিশ্চিতভাবে তাঁদের অচলাবস্থার কথা মানুষের কাছে আরো জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। একই কথা খাটে উপদ্রুত মানুষের ক্ষেত্রে, হোক তা বন্যা, হোক তা জলোচ্ছ্বাস, হোক ভূমিকম্প বা ভূমিধ্বস। যিনি আক্রান্ত, যিনি উপদ্রুত, যিনি ভুগছেন এখন এই মূহুর্তে, তাঁর কাছ থেকে সমস্যার যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানগুলো আসবে, তা রাজধানীর নিরাপদ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের কোমল গদ্দিনশীন কর্তাদের কাছ থেকে কখনো আসবে না। সরজমিন পরিদর্শনের নামে তারা যা করেন তা প্রমোদভ্রমণেরই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত। সিডরে আক্রান্ত একজন ঘরহারা মানুষ, যিনি আশ্রয় নিয়েছেন কোন এক অচেনা জায়গায়, তাঁর মুখ থেকে উঠে আসা বর্ণনার বিকল্প হয় না। তিনি আমাদের জানাতে পারেন, কী প্রয়োজন, ব্যবস্থার নামে কী কী অব্যবস্থাপনা চলছে, কে সাধু, কে শয়তান।
একই উদাহরণ টানা যায় সারা বাংলাদেশ জুড়ে। যেসব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, এবং যা বাস্তবায়নের পথে অর্ধেক দৌড়ে শেষে মুখ থুবড়ে পড়ে, তা নিয়ে লিখতে পারেন সাধারণ মানুষেরা, যাঁদের নিংড়েই এসব উন্নয়নের খরচ বহুলাংশে যোগানো হয়। লিখতে পারেন দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশকে নিয়ে, অসৎ আমলাকে নিয়ে, অযোগ্য শিক্ষককে নিয়ে, অসাধু ব্যবসায়ীকে নিয়ে, গৃহপরিচারকনির্যাতনকারী প্রতিবেশীকে নিয়ে। ব্লগিং সাধারণ মানুষের চিৎকার করার শেষ ঠিকানাটা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যে চিৎকার মুখে কষি বেঁধে প্রতিনিয়ত বন্ধ করে দেয়া হয়।
হাঁটুপানির জলদস্যু
বাংলাদেশের প্রক্ষিতে অবশ্যই, ইন্টারনেট সুশীলদের দখলে। তবে আস্তে আস্তে মানুষ হয়তো ইন্টারনেটের মাধ্যনে নিজেদের সুবিধা অসুবিধা তুলে ধরতে পারেবেন-- যেমনটা হিমুর বলেছেন।
চিন্তার বিষয় বটে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
।। আপনার ধারণাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে ।। এবঙ বিষয়টা আরো দীর্ঘদিন অটুট থাকার লক্ষণই তো দ্যাখা যাচ্ছে ।।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
নতুন মন্তব্য করুন