বার্লিন শহরে কিছু যায়গা আছে, যেগুলো অনেকের কাছে এত পরিচিত যে তারা শুধু দর্শনীয় স্থান হিসেবে নয় আরও বিশাল পরিসরে উপস্থাপিত। এদের কোনটি ইতিহাসের পর ইতিহাসের সাক্ষী, কোনটি সিনেমার লোকেশন, কোনটি মিউজিয়াম, কোনটি বা ঐতিহ্যগত বা আধুনিক স্থাপনার নিদর্শন হিসেবে লোকের মুখে মুখে ফিরে। এসব জায়গায় শহরটি নিজেই একেকটি গল্প হয়ে যায়। পর্যটকরা এই স্থানগুলিকে জানেন: ব্রান্ডেনবুর্গার গেট, উন্টার ডেন লিন্ডেন, রাইখসটাগ, পটসডামার প্লাৎস, আলেক্জান্ডার প্লাৎস ইত্যাদি। কিন্তু গল্পগুলো পুরোপুরি তাদের জানা নেই। এ শহরের বাসিন্দাদের কাছে এ স্থানগুলোর গল্পগুলো পরিচিত, অথবা নিজেরাই হয়ে যায় গল্পের একেকটি চরিত্র, নতুন নতুন গল্পের জন্ম দেয়।
বেবেলপ্লাৎসের গল্প
ব্রান্ডেনবুর্গ গেট থেকে পূবের দিকে নামকরা রাস্তা 'উন্টার ডেন লিন্ডেন' ধরে ৫০০ মিটারের মত গেলে হামবোল্ডট বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকে পড়বে বেবেলপ্লাৎস, একটি বিশাল চত্বর। একে ঘিরে রয়েছে পুরনো লাইব্রেরী, একটি ক্যাথেড্রাল ও স্টেট অপেরা যা আসলে একটি প্রাসাদ যা ১৭৪৩ সালে প্রুসিয়ার হোহেনজোলার্ন রাজবংশের রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এটি ওপার্ন প্লাৎস নামে পরিচিত ছিল এবং ১৯৪৭ সালে সোস্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা অগাস্ট বেবেলের নামে এর বর্তমান নামকরণ করা হয়।
এখানে নামকরা আন্তর্জাতিক এক্সিবিশন ও অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
ছবি: উইকি পিডিয়ার সৌজন্যে
এখানে প্যানোরামাতে বেবেল প্লাৎসকে দেখতে পাবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বিল্ডিংগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যা দেখছেন তা পরে সংস্কার করা।
বেবেলপ্লাৎসের একটি কলন্কময় ইতিহাস আছে। ১৯৩৩ সালের দশই মে হিটলারের ছাত্র-ছাত্রীদের এসোসিয়েসন (এস এ) এবং নাৎসী ইয়থ গ্রুপের সদস্যরা এখানে প্রপাগান্ডা মন্ত্রী গোবেলস এর উস্কানীতে মূলত ইহুদী লেখক, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের প্রায় ২০,০০০ বই পুরিয়ে দেয়। তাদের ঘোষিত অজার্মান চেতনার বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের মূল মন্ত্র ছিল ইহুদী বুদ্ধিজীবিদের হাত থেকে জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা। কার্ল মার্কস, সিগমন্ড ফ্রয়েড, ম্যাক্সিম গোর্কি, হাইনরিশ হাইনে প্রভৃতি ইহুদী লেখকের বই তার মধ্যে ছিল এবং অন্যান্য ধর্মীয় জার্মান নাগরিক যেমন থমাস মান, এরিক মারিয়া রেমার্ক এবং বিদেশী (আমেরিকান) লেখক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে এবং হেলেন কেলারের বইও বাদ যায়নি। সেখানে এখন বেদবাক্যের মত হাইনরিশ হাইনের একটি উক্তি (১৮২০ সালে করা) বাঁধানো আছে “তারা যেখানে বই পোড়ায়, শেষে তারা মানুষও পোড়াবে”।
রাস্তার অপরপাশে হামবোল্ডট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুরোন বই নিয়ে বসে থাকে লোকে বিক্রি করার জন্যে। এই অঞ্চলে এই বই পোড়ানো বিভিন্ন ভাবে স্মরণ করা হয়।
আমার ক্যামেরায় বেবেলপ্লাৎসের সামনে আধুনিক বই প্রকাশনার চিন্তাধারার রুপকার গুটেনবার্গের স্মরণে স্কাল্পচার (২০০৬ সালের বিশ্বকাপের সময় তোলা)
বই পোড়ানোর ৭৫ বছর পরের বেবেল প্লাৎস: আমার গল্প
বিএমডাব্লিউ কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় বেবেল প্লাটসে উন্মুক্ত ক্লাসিকাল সঙ্গীত পরিবেশিত হবে শুনে ৩০শে আগস্ট বিকেল পাঁচটার দিকে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। স্টেজের মাইক্রোফোন ঠিক করা হচ্ছে আর গুটিকয়েক দর্শক দেখে ভাবনায় পরে গেলাম। সামনের এক খাবার দোকানে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম ৭টায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। সাথে এক সিনিয়র ভাই যিনি আবার পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তেমন আগ্রহী নন তবে আমাকে ভালই সঙ্গ দিচ্ছেন। তাকে নিয়ে হাটতে হাটতে 'উন্টার যেন লিন্ডেন' ধরে মিউজিয়াম আইল্যান্ডের পাশ দিয়ে হাকেশার মার্কট চত্বরে চলে গেলাম সময় কাটানোর জন্যে।
সেদিন আবার লং নাইট অফ মিউজিয়ামস শুরু হয়েছে তাই সেই অঞ্চলে লোকে গিজগিজ করছে। বছরের একটি দিন সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা থাকে। এক টিকেটে প্রায় ১০০টি যাদুঘর, আর্কাইভ, মেমোরিয়াল, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান দেখার ব্যবস্থা আছে। আলাদা এক বাসের বহর চালু করা হয়েছে দর্শনার্থীদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছানোর জন্যে। ৮ ঘন্টায় আর মানুষ কত দেখবে যেখানে একটি যাদুঘরেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো যায়।
আমরা ফিরে এলাম বেবেল প্লাৎসে পৌঁনে সাতটায়। চত্বরে ঢোকার আগে স্টেট অপেরার সামনে ভিড় দেখে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়ীতে করে কেউ এসেছে এবং তাকে ঘিরে প্লেন ক্লথের সিকিউরিটি দেখে ভাবলাম কোন শিল্পী হয়ত। পরে গাড়ীর নম্বর দেখলাম ০-১ অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট এসেছেন। উনি কনসার্ট দেখতে এসেছেন বউ সাথে নিয়ে। সবাইকে হাত নাড়িয়ে অপেরা হাউজে ঢুকে গেলেন। এত কম সিকিউরিটি দেখে বিস্মিত হলাম।
জায়গা পাওয়া নিয়ে যার পরনাই সমস্যা হল। চেয়ারের ব্যবস্থা নেই। সবাই নিজের মত বাসা থেকে টুল নিয়ে এসেছে অথবা চাদর বিছিয়ে বসেছে। কেউ কেউ আরাম করে গ্লাসে শ্যাম্পেন হাতে নিয়ে বসেছে। ক্লাসিকাল সঙ্গীত এখানে খুবই উচ্চ মার্গের একটি ব্যাপার। আমরা কোনার একদিকে একটু দাড়ানোর জায়গা পেলাম। আমার সঙ্গীটি জায়গা না পেয়ে বেশ বিরক্ত তাই ভাবলাম বেশীক্ষণ থাকা যাবে না।
সাতটার সময় বার্লিনের গে মেয়র আর বিএমডাব্লিউর প্রধান অনুষ্ঠান উদ্বোধন করলেন মঞ্চে। তবে মন খারাপ হয়ে গেল যখন ঘোষনা হল যে আজকের পরিবেশনা হবে স্টেট অপেরার ভেতরে (আমন্ত্রিত দর্শকদের সামনে) এবং বিশাল টিভি স্ক্রিনে বেবেল প্লাৎসের দর্শকরা দেখবেন। আগামী কাল হবে বেথোফেনের নাইন্থ সিম্ফোনী সেটা মঞ্চে লাইভ হবে বিনামূল্যের দর্শকদের জন্যে।
প্রায় ১০০০০ লোক উপভোগ করলেন স্টেট অপেরার নামকরা মিউজিক ডিরেক্টর ডানিয়েল বারেনবইম (একজন ইহুদি) এর পরিচালনায় বেথোফেনের অপেরা ফিডেলিও। পিন পতন নিস্তব্ধতা না হলেও কম লোকেই ফিসফিস করে কথা বলছিল আর সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল। আমার অবশ্যি বেশীক্ষণ থাকা হলো না সঙ্গীর কথা ভেবে।
৭৫ বছর আগে জার্মান জাতীয়তাবাদের যে পন্কিল অধ্যায় এখানে রচিত হয়েছিল তার ফল অনেক আগেই তারা ভোগ করেছে। আজ যেন একটি 'পোয়েটিক জাস্টিস' হলো এক ইহুদী সঙ্গীতজ্ঞ এখানে ১০০০০ জার্মান নাগরিককে বিমোহিত করার মাধ্যমে।
মন্তব্য
পোস্টে এ্যাড করে রাখলাম। সময় মতো পড়তে হবে।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
বই পুড়ানোর কথা শুনলেই কেমন জানি লাগে! লাইব্রেরি অভ আলেকজান্দ্রিয়া, যাকে ধরা হতো একসময়ের সর্ব্বৃহৎ লাইব্রেরি, তার বই একাধিকবার পুড়িয়ে ফেলার উল্লেখ আছে।
হাউ আয়রনিক!
সুন্দর ঝরঝরে লেখা। কি সুন্দর বর্ণনা
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
ভ্রমণকাহিনী পড়বার চেয়ে আমার যেন ছবি দেখতেই বেশি ভাল লাগে কিন্তু এত্তো সুন্দর বর্ণনাকে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারলাম না। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম সবটুকু।
--------------------------------------------------------
খুব ভালো লাগলো।
রেজওয়ান ভাই, এরকম সচিত্র লেখা আরো বেশি বেশি চাই।
আধুনিক বই প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট ছবিটা আমার মনটা কেঁড়ে নিয়েছে। অতএব আমিও ওটার ছায়া কেঁড়ে নিলাম, আপনার আপত্তি নেই নিশ্চয়।
অনেক শুভেচ্ছা।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
দারুন পোস্ট। ভয়ে ভয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব ভাল লাগল। *****
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
ধন্যবাদ সবাইকে মন্তব্যের জন্যে।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
ভাল লাগলো। ছবিগুলো বেশী ভাল লেগেছে। এইধরনের লিখা লিখতে থাকুন।
পোস্টে অ্যাড করে ক্যাম্নে?
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
লেখা ও ছবি দুই'ই ভালো লাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
নতুন মন্তব্য করুন