বার্লিনের কাছে ওরানিয়েনবুর্গে সাক্সেনহাউজেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যে কয়েকবার গিয়েছি সে কয়বারই প্রশ্নটি মাথায় এসেছিল যে এত বড় হত্যাযজ্ঞ -হলোকস্ট সংঘটন তো সম্মিলিত কর্ম। যে লাশ বহন করেছে বা প্রহরী ছিল তারা কখনও বেঁকে বসেনি? মানুষ খুন করতে অস্বীকৃতি জানায় নি? আমরা কিন্তু কম উদাহরণের কথাই জানি যেখানে দেখা যায় যে ইহুদীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে কোন জার্মান নাগরিক। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই শিন্ডলার্স লিস্ট চলচ্চিত্র খ্যাত জার্মান ব্যবসায়ী অসকার শিন্ডলার যিনি বেশ কিছু ইহুদীকে তার কারখানায় কাজ দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তিনিও বিতর্কের উর্ধে নন কারন নাজী পর্টির সদস্য হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে সস্তা শ্রম পাবার জন্যে তিনি ইহুদীদের ব্যবহার করতেন।
সাম্প্রতিকালের দ্য রিডার ছবিতে হানা স্মিৎজ (কেইট উইনস্লেট যার জন্যে অস্কার পেয়েছে) এর বিচার যখন হচ্ছিল তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে এস এস গার্ড হিসেবে তাদের কাছে ৩০০ জন বন্দী যখন বিমান থেকে ফেলা বোমার আগুণে পুড়ছিল তখন সে কেন দরজা খুলে দেয়নি। সে তখন বলেছিল যে "এরা আমার রেসপনসিবিলিটি ছিল তাই কি করে তাদের ছেড়ে দেই?"
ব্যাপারটি যতই বালখিল্য মনে হয় আসলে এটি কিন্তু জার্মান চারিত্রিক বৈশিষ্টের একটি অংশ। তারা নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে এতটাই নির্মম এবং সাধারণত: একচুলও নড়ে না।
নিকোলাস কুলিশ দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসে জার্মান চরিত্রের এই অংশ তুলে ধরেছেন। উনি উদাহরন দিয়েছেন যে রাস্তা ঘাটে কত নিয়ম আছে এবং সেগুলো কঠোরভাবে পালন করা হয়। অথচ মোড়ে মোড়ে পুলিশ নেই বা ভিডিও ক্যামেরা নেই তা পর্যবেক্ষনের জন্যে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতাও তাই। দৈনন্দিন অনেক নিয়মকেই তাদেরকে চোখে চোখে রাখার দরকার হয় না। তারা নিজেরা তা মানে এবং অপরকে স্মরণ করিয়ে দেয় তা সঠিকভাবে পালনের জন্যে। এবং অনেকক্ষেত্রে এইটি খুব অনধিকার চর্চাও মনে হয়। এক অজপাড়াগায়ে একটি খালি পার্কিং লটে গাড়ী রেখে ম্যাপ দেখছি তখন এক বুড়ো এসে বলল এটি ইনভ্যালিড পার্কিং এখানে রাখতে পারবে না তুমি। আমি বললাম পাশে আরও যায়গা আছে ইনভ্যালিডদের জন্যে কাজেই আমি কারও সমস্যা করছি না, আমি একটু পরেই চলে যাব। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা - বলল এখানে রাখা নিষিদ্ধ তোমাকে সরাতেই হবে। নিয়মের বাইরে কোন কিছু সে মানতে রাজী নয়। এভাবেই তারা ছোটকাল থেকে শিক্ষা লাভ করেছে। আমি আমল না দিয়ে ম্যাপের দিকে মনযোগ দেয়ায় বুড়ো গজগজ করতে বাড়ীর দিকে গেল। আমি অবশ্য কিছু পরেই সরে গেলাম কারন না হলে সে হয়ত পুলিশ ডাকত।
নিয়মের প্রতি বাধা থাকা এই চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারনে এজন্যেই জার্মানদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে বেশ রবোটিক মনে হয়। এবং কারো সাথে ভালভাবে না মিশলে ভেতরের মানবিক দিকগুলো জানা যায় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার তাদের নির্লিপ্ততার কারন কি নিয়ম মানার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট ছিল কি না সেটা বিতর্কের বিষয়। জার্মানিতে নুরেমবুর্গ আইন (১৯৩৫) করে ইহুদীদের সমাজচ্যুত করা হয় এবং ইহুদীদের বিবাহ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়। ইহুদীদের নিধনের ফাইনাল সল্যুশনও লিখিতভাবে প্রণীত হয়েছিল। কাজেই অনেকের যুক্তি হতে পারে যে সাধারণ লোক নির্দেশ মেনেছে শুধু।
জার্মানদের নিয়্ম সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হচ্ছে যে মানুষের ভালোর জন্যেই তা তৈরি। তবে নিয়ম মানতে গিয়ে মানুষের ক্ষতি করা কি উচিৎ কিনা এবং এ নিয়ে তারা ভাবে কি না জানার আগ্রহ আছে।
মন্তব্য
লেখাটা ভালো হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি নিয়ম রক্ষার জন্য নিরপরাধ মানুষ খুনকে বৈধতা দেয় তাকে আমাদের মানুষের কাতারে না ফেলাই ভালো, নতুবা আমাদের মস্তিকের বিবেচনাবোধের কোন প্রয়োজন থাকে না।
বর্বরতার নাম নিয়মের মধ্যে থাকা হতে পারেনা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
একমত।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, জার্মানরা দু'টি গুণের কারণে এতদূর যেতে পেরেছে।
১. এরা ভয়াবহ রকমের সুশৃঙ্খল।
২. এরা দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সাথে যে কোন ধরনের যোগাযোগ করে অনেক ভেবে চিন্তে।
এ কথা সত্য যে এর ব্যতিক্রম চোখে পড়বে, কিন্তু তা ব্যতিক্রম হিসেবেই। একেবারে ছোট্ট বাচ্চাদেরও দেখেছি কোন রকমের বিবাদ কলহ ছাড়া পটাপট কিউ ধরে দাঁড়িয়ে যেতে। বাসে দুই সীট দখল করে নির্বিকার বসে আছে কেউ একজন, হয়তো বাসভর্তি লোক দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কোন হাউকাউ নেই। কেউ কাউকে তর্জনী উঁচিয়ে চোখ রাঙাচ্ছে না। বাংলাদেশে আমরা জার্মানদের চেয়ে কোন অংশে কম পরিশ্রম করি বলে মনে হয় না, কিন্তু আমরা সহজে অধৈর্য হয়ে যাই, এবং গলার জোরে অন্যদের চেয়ে কিছু সুবিধা আদায়ে বেশিরভাগ সময়ে সচেষ্ট থাকি। এতে করে আমাদের সময় আর শক্তি দুই-ই অপচিত হয়, খামাখা। এরা সেই সময়টা বিশ্রাম নেয়, আর শক্তিটা কোন কাজে লাগায়।
আরেকটা জিনিস মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও খুবই কাজের, সেটি হচ্ছে পেপারওয়ার্কস। দলিলবাজিতে জার্মানরা ঈর্ষণীয় রকমের দক্ষ। খুঁটিনাটি সব হাবিজাবির "প্রোটোকোল" তারা রাখে। এটা তাদের শিক্ষার অংশ। যে কোন পরিস্থিতিতে একগাদা কাগজপত্র বার করে ব্যাপারটাকে দাপ্তরিক অ্যাপ্রোচ নিয়ে দেখার চর্চা তাদের মধ্যে আছে। উদাহরণ দিই, চৌধুরীর ভোনহাইমে একবার হালকা ঝগড়া হয়েছে একটা কিছু নিয়ে। স্ফেয়া নামের মেয়েটি গলা না চড়িয়ে চুপচাপ ইন্টারনেট থেকে ভোনহাইমের নিয়মকানুন প্রিন্ট আউট করে ফ্রিজের ওপর চুম্বক দিয়ে আটকে রেখেছে বাকিদের জন্য, বিশেষ বিশেষ অংশ হাইলাইট করে। সবাই চুপ করতে বাধ্য হয়েছে। শক্তিশালী আইনী কাঠামোর ভেতরে যখন সবকিছু থাকে, তখন মানুষের আসলেই গলা চড়াতে হয় না। এর যে একটি কালো দিক থাকতে পারে, তা আমরা তিরিশের দশকে দেখেছি, কিন্তু সেই একই জিনিসের সদ্ব্যবহার করে একটি বিচূর্ণ দেশকে এরা অনেক ওপরে ঠেলে তুলতে পেরেছে, সেটিও ভুলে যাবার মত কিছু নয়।
নতুন মন্তব্য করুন