আমার ইদানিং হয়েছে শনির দশা। পেটের ব্যামো ছিল অনেকদিন ধরেই। সময় মত খাওয়া দাওয়া করে তাকে বাগে এনেছিলাম একরকম। জানুয়ারি মাসে পরিবারের একজনকে ব্যাংকক নিয়ে যেতে হল চিকিৎসার জন্যে। তারই অনুরোধে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ঢেকি গেলার কাজটি ঠিক হয় নি এখন বুঝি। ডাক্তার একগাদা স্বাস্থ্য পরীক্ষা লিখে দিল, আল্ট্রা-সোনো, এন্ডোসকপি আর কত কি! একে একে সব যজ্ঞ সমাধা করে এন্ডোসকপির জন্যে এগুলাম। আমার ধারণা ছিল না যে এটির জন্যে রীতিমত বন্ড সই করে অনুভূতি বিলোপ ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে অজ্ঞান করে মুখের ভিতর নল ঢুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় ও পাকস্থলীর অংশ কেটে পরীক্ষার জন্যে নেয়া হয়। টেবিলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চৈতন্য নাশ হল। জ্ঞান ফিরেই শুনি ডাক্তার বলছেন আমার পাকস্থলীর বৃত্তান্ত। অনেক কথাই ধরতে পারিনি - তবে বুঝলাম মারাত্মক কিছু নয় - কিঞ্চিত আলসার আছে এবং এইচ পাইলোরি নামক একটি মন্দ ব্যাক্টেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে টিস্যু স্যাম্পলে। শেষে তিনি বললেন আমার লিভারের উপর সাদা সাদা কিছু দেখা গেছে এবং তার মতামত হচ্ছে এর জন্যে লিভার বিশেষজ্ঞকে দেখান দরকার। আমি চাইলে এক্ষুণি সেখানে নিয়ে যেতে পারে সে। আমার মাথা তখনও ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আমি বললাম রোসো, পরে দেখাব - আমি এখন পরিবারের কাছে যেতে চাই।
আমাকে দেয়া হল দুটি অ্যান্টিবায়োটিকসহ চারটি ঔষধের কম্বিনেশনে ১০ দিনের ডোজ যা শুরু করলাম সেদিনই। জাকার্তায় ফিরতি ফ্লাইট ছিল একদিন পরে। প্লেনেই শুরু হলো ডায়রিয়া এবং ঘরে ফিরেও তা চলতে লাগল - মনে হয় ঔষধের প্রতিক্রিয়া। সে এক কলিকাল - তার দুদিন পরে আমি পুরো বিছানায়। ডায়রিয়া কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না - সাথে অরুচি, বমি, কাশি - অনেকদিন আমার এমন অসুখ হয়নি। পরিচিত এক ডাক্তারের পরামর্শে ওরস্যালাইন ইত্যাদি পথ্যে হাসপাতালে যাওয়া রোধ করা গেল আপাতত। ব্যাংককের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের উপায় পাওয়া গেল না। মনে হল অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ না করলে মারা যাব। তবে ঔষধ বন্ধ করার পরেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটল না। তারপর অবধারিতভাবে স্থানীয় হাসপাতাল, ডাক্তার - অবশেষে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটল। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হইনি এখনও - অরুচি, ওজন হ্রাস ইত্যাদি বিদ্যমান।
আমি এখন ভাবি - সামান্য এক পেটের অসুখের জন্যে আমি এতটা ভেঙ্গে পরেছিলাম। আর এই বোধটি আরও জাগ্রত হয় বাবাকে দেখার পর।
বাবা এসেছিলেন জাকার্তাতে, ছেলে-বউয়ের সংসার দেখতে; নাতনীর সাথে সময় কাটাতে - যে নাতনী তার কাছে জীবনের প্রথম এক বছর ছিল। উনি তাকে কতটুকু মিস করেন তা তাদের ফোনালাপে বোঝা যায়। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর এই কয়েক বছরে বাবা-মা যেন অনেক বুড়িয়ে গেছেন। ৭২ বছর বয়সী বাবার গালে এখন সাদা দাড়ি। আমার মেয়ে গতবছর দেশে গিয়ে বলে (ছবির স্মৃতিতে) আমার না আরেকটা দাদা আছে যার দাড়ি নেই!
এয়ারপোর্টে দাড়িয়ে আছি বেশ কিছুক্ষণ - প্লেন আসতে দেরী করছে। অবশেষে তিনি এলেন - পড়নে স্যুট। কিন্তু একি? বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ - হাতে ভারি এক ঝোলা। সাথে ফুফাতো ভাই ছিল। বলল - শরীরটা ভাল নেই - মালয়েশিয়ায় লম্বা ট্রানজিটে কষ্ট হয়েছে অনেক। তারপরও মনের জোরে এসেছেন - হাতে ছেলের বউয়ের আবদারের বইয়ের ঝোলাটি বোনপোকে দেননি পর্যন্ত। বাড়ি ফিরে ঘোষণা দিলেন দুদিন বিশ্রাম নেবেন।
এরপর তাকে ঘুরিয়ে দেখানোর আমাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছিল। নাতনী সাফারি দেখাবে বলে এতদিন প্রলোভন দেখিয়েছে। সেই সাফারিতে যেতে তার কষ্ট হল। বুড়ো বয়সে অনেক কষ্ট - টয়লেটের চাপ ধরে রাখা - বেশিক্ষণ হাঁটতে না পারা। মনে হল নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস নেই। অথচ তার এই অক্ষমতার কথা স্বীকারও করছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছেন - না ঠিক আছি। ফলস্বরূপ কষ্টও পেয়েছেন।
এরপর সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া হল যোগজাকার্তা। বিমানে ওঠার আগে হুইল চেয়ারে উঠতে বলাতে তার ভয়ানক আপত্তি। তবে আমাদের পাল্লায় পড়ে তাকে সেটাতে উঠতেই হল। সেখানে হোটেলে উঠে তার জন্যে বরাদ্দ রইল বিশ্রাম। পরদিন বরবুদুর বৌদ্ধমঠ দেখতে পারলেও পারামবালান মন্দিরে ঢুকে তার শরীর খারাপ হয়ে গেল। আমরা দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে এর পরদিন তাকে আবার জাকার্তা নিয়ে এলাম।
এখন চিন্তা হল তিনি কিভাবে দেশে ফেরত যাবেন। যাবার পথে মালয়েশিয়ায় কয়েকদিন স্টপওভার আছে - তার বিশাল পরিকল্পনা ছিল পেনাঙ্গ যাবেন ইত্যাদি। আমরা বললাম সেই পরিকল্পনা বাদ দিন আর টিকেট করে দিচ্ছি - দ্রুত ঢাকা চলে যান। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, সেই শরীর নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া গেলেন এবং সীমিত পর্যটনের পর এখন গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছেন। তবে এই কয়েকদিন আমাদের বেশ উদ্বিগ্ন করে রেখেছিলেন।
আমি এখনও বাবার ক্ষীণকায় শরীর, সেই বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ, সিঁড়িতে কষ্ট করে ওঠা ইত্যাদি ভুলতে পারিনা। অথচ এই বাবাই এই কয়েক বছর আগেও নিজেই অনেক পরিশ্রমের কাজ করতেন।
আর যখনই ভাবি এই বার্ধক্যকে জয় করার তার প্রচণ্ড মনোবলের কথা তখন নিজের ছোটখাট অসুখের জন্যে চিন্তাকে খেলো মনে হয়। আর মনে হয় আমাদের ও একসময় সেই দিন আসবে। তার জন্যে কি আমরা তৈরি?
ফ্লিকার থেকে নেয়া উপরের ছবিটি জন্যে শহরবন্দীর কাছে রইল কৃতজ্ঞতা।
মন্তব্য
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
বুড়ো হচ্ছি। পুরানো হচ্ছি।
লেখা খুব ভাল লাগল।
আপনার বাংলা তো বেশ ভাল!! বেশ যত্ন নিয়ে ইংরেজী টার্ম পাশ কাটিয়েছেন, না?
বার্ধক্য আর একে জয় করার প্রাণান্ত চেষ্টা খুব ছুঁইয়ে গেল। আমরা অসহায় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি কেবল।
আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি ভাল। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য কথায় এত ইংরেজী ব্যবহার করি যে এড়াতে শ্রম দিতে হয়।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
...........................................
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আর মনে হয় আমাদের ও একসময় সেই দিন আসবে। তার জন্যে কি আমরা তৈরি?
আসবে আবার কী, এসে গেছে! আর তার জন্য প্রস্তুতি? কিছুই নেই। না শরীরে, না মনে, না ট্যাঁকে।
আমি এখনও বাবার ক্ষীণকায় শরীর, সেই বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ, সিঁড়িতে কষ্ট করে ওঠা ইত্যাদি ভুলতে পারিনা। অথচ এই বাবাই এই কয়েক বছর আগেও নিজেই অনেক পরিশ্রমের কাজ করতেন।
তবুতো উনি আছেন, ঢাকা থেকে ইন্দোনেশিয়া যাবার মত সুস্থ্য আছেন। আর আমাদের মত যারা, তাদেরতো এই গল্পটুকু করার মত মানুষটাও নেই।
আপনার মত প্লেন ভ্রমণ করতে পারুন আর নাই পারুন; আপনার মত হেঁটে পাহাড়-জঙ্গল বেড়াতে পারুন আর নাই পারুন; আপনার বাবা সুস্থ্য-সবল হয়ে বেঁচে থাকুন আরো বহু বহু বছর। প্রতিদিন আপনাদের কন্যার সাথে তাঁর ফোনালাপ চলুক। ছুটি-ছাটায় এদিক-ওদিক বেড়ানো চলুক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে। আপনার জন্যে সহমর্মিতা রইল।
আমরা অভিভাবকদের মর্ম বুঝি না সময় মত। তার এই অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি এই সময় তার পাশে থাকা দরকার।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
এই একটা জিনিসকে খুব ভয় পাই
কেনো জানি মনে হয় মৃত্যুর থেকেও বেশি।
আপনাকে যেই কম্বিনেশনের ওষুধগুলো দিয়েছিলো সেগুলো আসলেই এইচ পাইলোরি ইনফেকশনের জন্য খুব ভালো কাজ করে- কিন্তু মাঝে মাঝে অল্প কিছু লোকজনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । তাই সমস্যা হলে সাথে সাথে বন্ধ করে দেয়াই ভালো। একজন ভালো কোন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টকে একবার নাহয় সময় করে দেখায় নিয়েন।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ধন্যবাদ পরামর্শের জন্যে। ওষুধ বন্ধ করে দেয়ায় চিকিতসা সফল হয়নি। কাজেই আবার দেখাতেই হবে।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
শিগগিরই পুরোপুরি সেরে উঠবেন, এই প্রার্থনা রইলো!
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
খুব চিন্তায় ফেলে দিলেন, আমার বাবাও অনেক দিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিছুদিন থেকে দেখছি একদম নরম হয়ে গেছেন, কথা-বার্তা, চলাফেরায় সব কিছুতেই কেমন এলোমেলো ভাব।
আপনার বাবার আশু রোগমুক্তি কামনা করছি।
লেখা পড়ে মনটা খারাপ হলো। নিজের বাবার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
দোয়া থাকলো আপনার বাবা যেনো সুস্থ সবল থাকেন আরও অনেক অনেকদিন।
ধন্যবাদ। সব বাবা-মারাই যেন সুস্থ থাকে। মাথার উপর ছাতার মত থাকে।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
প্রকৃতিপ্রেমিক ও তীথিডোর - আপনাদের প্রার্থনার জন্যে ধন্যবাদ।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
তীথি!!
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
কি আর করা!
ভাল থাকবেন..
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
দুঃখিত! আর ভুল হবে না তিথী।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
আশৈশব নানীকে দেখেছি ছুটে বেড়াতে। ছেলেমেয়েরা একেকজন একেকদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। নানার মৃত্যুর পর বিশাল সংসার, জমি-জিরাত একাই সামলেছেন। সেই নানী আজ বয়সের ভারে ন্যূজ হয়ে পড়েছেন। বিছানায় শুয়ে থাকতে বললেও শুনতে চান না। ভয় পান এই বুঝি অথর্ব হয়ে গেলেন। মানুষের সাহস মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। সেই সাহসটুকুও নানী হারিয়ে ফেলছেন ক্রমশ। মৃতুভয়ে কান্নাকাটি করেন। আমরা দেখা করতে যাই। সাহস যোগাতে চাই। বার্ধক্যের ভীতি তাতে লাঘব হয় কি আদৌ?
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
ছবিটি প্রাণকে স্পর্শ করেছে। ধন্যবাদ।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
নতুন মন্তব্য করুন