কেনিয়ার কবি

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: বুধ, ১৬/০৬/২০১০ - ৯:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব কেনিয়ার নতুন প্রজন্মের এক কবি ও জনপ্রিয় ব্লগারকে। সাথে বোনাস হিসেবে থাকছে তার একটি কবিতার অনুবাদ।

এবার চিলিতে গ্লোবাল ভয়েসেস নাগরিক মিডিয়া সম্মিলনে জড়ো হয়েছিল বিশ্বের ৬০টিরও অধিক দেশের দেড় শতাধিক ব্লগার। এবার কলেবর বিস্তৃত হওয়ায় সম্মিলনের সময় অনেক নতুন মুখের সাথেই সৌজন্য বিনিময়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আলাপ করার তেমন সুযোগ হয়নি। এদের অনেকেরই সাথে পূর্বে ইমেইলে যোগাযোগ রয়েছে - অনেকের লেখাই পড়েছি বা অনুবাদ করেছি আগে - তাই কারও কারও সাথে পরিচিত হবার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এদেরই একজনের কথা বলছি আজ আলাদা করে।

কেনিয়ার কবি এনজেরি ওয়াঙ্গারিকেনিয়ার কবি এনজেরি ওয়াঙ্গারি
একদল লোকের ভীড়ে ২৮ বছর বয়সী কেনিয়ার তরুণী এনজেরি ওয়াঙ্গারিকে আলাদা করে চেনা যায়। পরনে তার আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং মাথায় কাপড় বাঁধা। এনজেরি একজন আইটি গ্রাজুয়েট এবং একটি পাবলিশিং হাউজের সিস্টেম এডমিনিষ্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছে। পেশায় আইটি বিশেষজ্ঞ হলেও তার মূল পরিচয় সে কবি, আবৃত্তিকার এবং ব্লগার। আফ্রিকার ব্লগ এগ্রেগেটর - আফ্রিগেটর অনুযায়ী তার ব্লগ কেনিয়ান পোয়েট কেনিয়া ও সারা আফ্রিকার জনপ্রিয় ব্লগগুলোর একটি। গ্লোবাল ভয়েসেসে সে কেনিয়া এবং আফ্রিকার কাব্যসাহিত্য এবং শিল্প বিষয়ে ব্লগগুলো নিয়ে লিখে থাকে

এনজেরির কবিতার সাথে ভালবাসা ২০০৪ সাল থেকে। তার প্রেমিকের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল - এমন টালমাটাল সময়ে ভাবল সে তার অনুভূতিগুলো লিখে রাখলে কেমন হয়। এভাবেই কবিতা লেখার শুরু। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল যে কবিতার খাতাগুলো নিজের কাছেই রয়ে যাচ্ছিল - সেগুলো প্রকাশ করা হচ্ছিল না তাই অন্য কবি বা পাঠকের কাছে পৌঁছুচ্ছিল না। ২০০৬ সালে শুরু করা তার ব্লগ কেনিয়ান পোয়েট পাঠকদের সাথে সেই দুরত্ব ঘুঁচিয়ে দেয় কিছু পরিমাণে। প্রথমে সে তার কবিতা প্রকাশ করে জানার চেষ্টা করত কিভাবে পাঠকরা সেগুলোকে দেখছেন, সমালোচনা করছেন বা অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। শুধু কবিতাই নয় তার ব্লগে পরবর্তীতে সে শিল্পকলা, সঙ্গীত, সমালোচনা ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়ে লেখা শুরু করে।

এছাড়াও তার রয়েছে একটি শক্তিশালী কণ্ঠ। পারফর্মেন্স পোয়েট্রির চল রয়েছে কেনিয়াতে - এমনকি এখন কর্পোরেট অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ে কবিদের। চারজন কেনিয়ান কবির সঙ্গে এনজেরি গঠন করেন আবৃত্তি দল মেসতারিওয়ান্নে এবং তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত তাদের কবিতা পরিবেশন করছেন বছর দুয়েক ধরে। তার সহকবি মাইক কোয়াম্বোর বিপ্লব নামক কবিতা পড়লে বোঝা যায় তাদের প্রতিভার ছটা। এনজেরিকে এখন কেনিয়ার অন্যতম নতুন প্রজন্মের কবি বলে ধরা হয়।

মূল সম্মিলনের শেষের দিনে সে একটি কবিতা পড়ে শোনায়। এখানে ভিডিওটি আছে (অ্যামেচার ভিডিও - তাই সাউন্ড একটু জোরে দিতে হবে):

ইংরেজী ভাষায় লেখা 'ডিজিটাল হৃদয়' নামে সেই কবিতাটি এখানে পাওয়া যাবে

আমি এর অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি:

****************************************

'ডিজিটাল হৃদয়'
- এনজেরি ওয়াঙ্গারি

এক সময় ছিল যখন মুখ, চোখ, কান, একটুকু ছোঁয়া
গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি কথোপকথন চালানোর জন্যে,
মানুষেরা একে অপরের বা প্রকৃতির অনেক কাছে ছিল
দেখা, শোনা, ছোঁয়ার মাধ্যমে।

এক ঝাক অতিথি পাখির দেখা পাওয়া মানে ছিল ঝড়ের পূর্বাভাষ,
হয়ত ঋতু পরিবর্তনের চিহ্ন বা কোন বিপদ সংকেত।
বাতাসে উদ্বেলিত বৃক্ষরাজির মৃদু স্বরে ফিসফাস
আমাদের মনে শান্তি এনে দিত।
গাছের ডালের সশব্দে ঝরে পড়া, পাখির কলতান
আমাদের আত্মার সাথে বাস্তবের প্রেমবন্ধন তৈরি করত।

এখন সামনা সামনি দেখা হওয়ার বদলে আমাদের দেখা হয় ফেসবুকে
আমাদের স্বর এখন বোতাম যা থেকে আমরা শব্দ বের করি কীবোর্ডে চেপে
আমাদের হাসি আর আবেগ প্রকাশিত হয় স্মাইলি আর ইমোটিকনের মাধ্যমে
হৃদয় আর আমাদের ঠোঁটকে অস্থির করে তোলে না "ভালবাসি" বলার জন্যে
কারণ হৃদয় ও মনের ভাব প্রকাশ করি আমরা ক্ষুদ্র টেক্সট বার্তার মাধ্যমে
বলে বোঝাতে পারি আমাদের মনের কথা ১৬০ বর্ণের ভেতরে।
দরকার নেই আর হৃদয় দিয়ে আবেগময় কণ্ঠে অগণিত বাক্যে অনুনয়
আমাদের আঙ্গুলগুলো এখন সেইসব আবেগ ধারণে সক্ষম যেগুলো
আমাদের ঠোঁট, আঁখি এবং বদনের মাধ্যমে একটি বইয়ে ধারণ করা যেত না।
এইসব শীতল মেশিন আমাদের আচরণকে যান্ত্রিক করে দেয় রোবটের মত
শুধু এটুকুই প্রভেদ যে রোবটের সামনে থিতু হয়ে বসে থাকি আমরা।

আমরা ডিজিটাল বিশ্বের কাছে আমাদের জীবন, মুহূর্ত এবং আত্মাকে বিকিয়ে দিচ্ছি।
সেইসব অচেনা মানুষ যাদের হয়ত কোনদিনই বাড়িতে আমন্ত্রণ করতাম না,
তারা এখন আমাদের খাটের নীচে উঁকি দেয়, আমাদের বাথরুমের ভেতরে তাকায়
আর আমাদের পোশাক উন্মোচন করে দেখে।
আমাদের নিয়ে কল্পনার ফানুশ ওড়ায়, স্বমৈথুন করে
এবং আমাদের ডিজিটাল পরিচয়কে ক্রমাগত অনুসরণ করে।

মাছিকে মরণ আলিঙ্গনে জড়ায় যেই মাকড়সার জাল তারই মত
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জালে আমরা নিজেদের জড়িয়েছি।
বিট এবং বাইট দ্বারা সংযুক্ত এই পৃথিবীতে আমরা হারিয়েছি আমাদের হৃৎস্পন্দন
আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট দ্বারা।

জিজ্ঞাসি তোমারে,
আমরা কি কাছে আসছি একে অপরের? না প্রযুক্তির?
কারণ এই ডিজিটাল সময়ে শূণ্য এবং একের মাঝখানে
আমাদের হৃদয় হারিয়েছি কোথাও।

****************************************************

মৃদুভাষী এই কবির সাথে এক ডিনারে আলাপ হলো বেশ অনেকক্ষণ। তার সাথে সামনাসামনি এই মুহূর্তগুলোকে ডিজিটাল যোগাযোগের চেয়ে অনেক মূল্য দেই আমি।

ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা আলেক্সেই সিডোরেন্কো

এনজেরি ওয়াঙ্গারির সাক্ষাৎকার:
* আফ্রিনোভেটর
* কেনিয়া আইসিটি বোর্ড
* গ্লোবাল ভয়েসেস

এনজেরির একমাত্র প্রকাশিত কবিতার বই পাওয়া যাবে এখানে


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ..
চমৎকার..
অনেক অনেক ভাল্লাগলো...
______________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমরা ডিজিটাল বিশ্বের কাছে আমাদের জীবন, মুহূর্ত এবং আত্মাকে বিকিয়ে দিচ্ছি।
সেইসব অচেনা মানুষ যাদের হয়ত কোনদিনই বাড়িতে আমন্ত্রণ করতাম না,
তারা এখন আমাদের খাটের নীচে উঁকি দেয়, আমাদের বাথরুমের ভেতরে তাকায়
আর আমাদের পোশাক উন্মোচন করে দেখে।
আমাদের নিয়ে কল্পনার ফানুশ ওড়ায়, স্বমৈথুন করে
এবং আমাদের ডিজিটাল পরিচয়কে ক্রমাগত অনুসরণ করে।

ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

বিচিত্র বিশ্বের একাংশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ হাসি
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এখন সামনা সামনি দেখা হওয়ার বদলে আমাদের দেখা হয় ফেসবুকে
আমাদের স্বর এখন বোতাম যা থেকে আমরা শব্দ বের করি কীবোর্ডে চেপে
আমাদের হাসি আর আবেগ প্রকাশিত হয় স্মাইলি আর ইমোটিকনের মাধ্যমে
হৃদয় আর আমাদের ঠোঁটকে অস্থির করে তোলে না "ভালবাসি" বলার জন্যে
কারণ হৃদয় ও মনের ভাব প্রকাশ করি আমরা ক্ষুদ্র টেক্সট বার্তার মাধ্যমে
বলে বোঝাতে পারি আমাদের মনের কথা ১৬০ বর্ণের ভেতরে।

বাস্তবতা!

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

আমরা ডিজিটাল বিশ্বের কাছে আমাদের জীবন, মুহূর্ত এবং আত্মাকে বিকিয়ে দিচ্ছি।
সেইসব অচেনা মানুষ যাদের হয়ত কোনদিনই বাড়িতে আমন্ত্রণ করতাম না,
তারা এখন আমাদের খাটের নীচে উঁকি দেয়, আমাদের বাথরুমের ভেতরে তাকায়
আর আমাদের পোশাক উন্মোচন করে দেখে।
আমাদের নিয়ে কল্পনার ফানুশ ওড়ায়, স্বমৈথুন করে
এবং আমাদের ডিজিটাল পরিচয়কে ক্রমাগত অনুসরণ করে

একদম ঠিক!!!

অতিথি লেখক এর ছবি

কেনিয়ায় সাহিত্যচর্চার বড়ই আকাল। নিয়মিত কেনিয়া যাই আসি আর চারপাশে কেনিয়ান মানুষে ভরা, সাহিত্যে তাদের বড়ই নিস্পৃহতা। ভাষা সমস্য একটা বড় সমস্যা। তানজানিয়ানরা কেনিয়ানদের ব্যবহৃত সুহাইলিকে ভ্যাজাল সুহাইলি মনে করে এবং কেনিয়ানদের লিটারেচার পড়তে ঘৃণাবোধ করে। আর উগান্ডানরা ক্রমশঃ সুহাইলি থেসে সরে যাচ্ছে। ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা কেনিয়ায় এখনও মানে পৌঁছতে পারেনি। মোটকথা, কেনিয়ানদের কাছে কেনিয়ান সাহিত্য ক্রমশই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। তার মধ্যে থেকে এই মেয়ের উঠে আসা নিশ্চই তরুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে।

রাতঃস্মরণীয়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।