ভুলে যাবার অধিকার ও সোশ্যাল মিডিয়ার উপর খড়গ

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০৮/২০১৪ - ৮:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"বাক স্বাধীনতা আসলে আপেক্ষিক। আপনি কতোটা নির্ভয়ে বলবেন তা নির্ভর করে আপনার সামাজিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি, আপনার নিরাপত্তা, বা এটাকে ব্যবহার করে সিদ্ধি সাধনের জন্যে আপনার আকাঙ্ক্ষা কতদূর তার উপরে।"

বিশ্বে বর্তমান সময়ের আলোচিত ইন্টারনেট ও ব্যক্তিগত তথ্য সম্পর্কিত একটি আইন হচ্ছে "রাইট টু বি ফরগটেন" বা ভুলে যাবার অধিকার। এটির উদ্ভব হয়েছে কিছু মানুষের অতীতকে ভুলে যাবার (এবং অন্যকে ভোলানোর) ঐকান্তিক ইচ্ছার জন্যে।

সহজ ভাষায় বললে এটি অনেকটা দেউলিয়া আইনের মত যা ব্যবসার ক্ষতির কারনে ব্যবসা করতে অক্ষম মানুষকে দেউলিয়া ঘোষণা করে পাওনাগুলো স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে যতটুক সম্ভব পরিশোধ করে পুনরায় জীবন শুরু করার অধিকার দেয়। ধরুন পূর্বে কেউ একটি অপরাধ করেছিল তার তথ্য রয়ে গেছে ইন্টারনেটে, বা হয়ত কোন ব্লগে ভুল লিখেছিল সেটার পরিস্থিতি এখন বদলে যাবার কারণে এখন সেই তথ্য ইন্টারনেটে থাকুক সেটা সে চায় না। অনেক সময় ফেইক নিক বা পরিচয় নকল করে যে সব কন্টেন্ট ছাড়া হয় সেসব থেকে বাঁচার এটি একটি পন্থা হতে পারে। বিষয়টি আপাতত দৃষ্টিতে একটি ভোক্তা অধিকারের সংরক্ষণ মনে হলেও আসলে বৃহৎ ভাবে চিন্তা করলে এর ঋণাত্মক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

এর উদ্ভবের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৯৯৫ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের অধিকার রক্ষায় একটি ডাটা সুরক্ষা নির্দেশিকার প্রস্তাব করে যাতে এই ধারনা ছিল এবং ২০১০ সালে ফ্রান্সে এই আইন প্রচলন ঘটান হয়। আর্জেন্টিনা ও আমেরিকায় এই আইন নিয়ে কোর্টে কেস হয়েছে।

আপনারা যারা এখনও মনে করছেন যে আমি কি আবোল তাবোল বলছি - তাদের জন্যে সংবাদ হচ্ছে ইন্টারনেট সার্চ এর পুরোধা গুগল "রাইট টু বি ফরগটেন" এর বিরোধিতা করে আসলেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কোর্টের সিদ্ধান্ত মেনে মাস দুই আগে একটি ফরম যোগ করেছে যার মাধ্যমে আপনি আপনার সম্পর্কিত তথ্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সরাতে আবেদন করতে পারবেন। অবশ্য গুগল বলেছে তারা আবেদিত তথ্য সরানোর আগে যাচাই করে দেখবে যে সত্যি তা পুরোনো কিনা বা জনগুরুত্বপূর্ণ কিনা।

বলাই বাহুল্য এই আইন অনেক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ গুগল বা অন্যান্য সার্চ এর মাধ্যমে উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহে বাধা দিতে ইন্টারনেট সেন্সরশিপ তৎপর। চীনে ২০০৬ সাল থেকে গুগল চায়না সরকারের সেন্সরশিপ নীতিমালা মেনে সম্পূর্ণ আলাদা সাইট গুগল চায়না চালাচ্ছে যেখানে এই উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহে বাধা পরেছে। এ ছাড়াও রয়েছে ইতিহাস বিকৃতির আশংকা। ধরুন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে - বিশেষ একটি মহল গুগল এর এই ফরম পেলে এর অপব্যবহার করে ইতিহাস পরিবর্তনে সচেষ্ট হতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় বাক স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে "ভুলে যাবার অধিকার" একটি বিপদ না আশীর্বাদ?

অস্ট্রেলিয়ার টিভির সংবাদে প্রায় প্রতিদিনই থাকে প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবটকে সমালোচনা করে নানা সংবাদ। বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদরাও তার পেছনে লাগতে কম যান না এবং মাঝে মধ্যে বেফাঁস মন্তব্যও করেন। এ যেন দেশটির মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রের মধ্যে পরে এবং মনে হয় দেশটি মিডিয়ার প্রতি উদার। তবে যখন সোশ্যাল মিডিয়ার কথা আসে তখন ভিন্ন চিত্র। দেশটির অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেই সোশ্যাল মিডিয়া সংক্রান্ত নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে যা বাক স্বাধীনতার লাগাম টানে। সম্প্রতি এক নির্দেশনায় সরকারি কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে তাদের সহকর্মী সরকার বিরোধী কোন পোস্ট করলে তারা যেন সাথে সাথে রিপোর্ট করে। এরকম পরিস্থিতিতে ব্লগে বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্মে কেউ কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্ট করলে তারা "ভুলে যাবার অধিকার" প্রয়োগ করতে চাইবে।

অথবা ধরুন ফ্রান্স এর এই ব্লগারটির কথা যে একটি রেস্টুরেন্ট রিভিউ তার ব্লগে ছাপানোর জন্যে আদালত কর্তৃক জরিমানার দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। লো ইরেগুলিয়েখ ছদ্মনামে লেখা এই ব্লগার গত বছর আগস্ট মাসে ফ্রান্সের একটি রেস্টুরেন্টে খেয়ে অভিজ্ঞতা তার ব্লগে লিখে "কেপ ফেরেতে যেই রেস্টুরেন্টটি এড়িয়ে চলবেন তা হচ্ছে ঃ ইল জিয়ারদিনো" এই শিরোনামে। এরপর গুগল সার্চে "ইল জিয়ারদিনো" কি ওয়ার্ড দিয়ে খুঁজলে তার ব্লগ পোষ্টটি সার্চ রেজাল্টের উপরের দিকে চলে আসতো। রেস্টুরেন্টের মালিক মনে করল এতে তার ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে তাই গত এপ্রিলে এই ব্লগারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। আদালত ব্লগারকে ২৫০০ ইউরো জরিমানা করে এই অভিযোগ আমলে নিয়ে যে ব্লগপোস্টটির শিরোনাম মানহানিকর। ব্লগারটি কোন আইনজীবী নেয়নি এবং আপিল না করে এই রায় মেনে নিয়েছে কারণ সে ভেবেছে হয়ত এর চেয়ে খারাপ হতে পারত। অথচ এই রায় অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

তাহলে কি আম জনতার সমালোচনার অধিকার নেই? খালি শক্তিশালী মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদরা যা কিছু বলবে তার কিছু হবে না আর ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস বা ব্লগে একটি সমালোচনা মূলক পোষ্টের জন্যে জেল খাটতে হবে বা সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হতে হবে? ইল জিয়ারদিনোর ক্ষেত্রে সমালোচনা রয়েছে যে রেস্টুরেন্টটি গুগলকে জানাতে পারত এই মানহানিকর সংবাদটি সার্চ ইঞ্জিন এর তালিকা থেকে সরিয়ে দিতে, এ সংক্রান্ত গুগল ফরম চালু হবার পরে অনেকেই তা করবে। কিন্তু সেটাকি সত্য গোপন করা বা একটি সত্যিকারের অভিজ্ঞতালদ্ধ ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশে বাধা হয়ে দাড়ায় না?

উইকিমিডিয়ার ট্র্যান্সপারেন্সি রিপোর্টে জানা যায় যে গত দুই বছরে এটি ৩০৪টি কন্টেন্ট সরানোর নোটিস পেয়েছে এবং তা মেনে নেয়নি। তবে "ভুলে যাবার অধিকার" আইন ইউরোপে তাদের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা দেখেছি উইকিলিক্স এর স্নোডেন এর বিরুদ্ধে কি করে বিভিন্ন সরকারেরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে।

এরকম আরেকটি সম্ভাব্য আইন নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে তা হল "ডু নট ট্র্যাক" । থার্ড পার্টি ওয়েবসাইট যাতে ইউজারদের ট্র্যাক না করতে পারে তাই এই আইনের প্রতিপাদ্য। এটি আপাত দৃষ্টিতে ব্যবহারকারিবান্ধব হলেও ট্রলরা এর অপব্যবহার করতে পারে বা এর উপর নির্ভরশীল অনেক ওয়েব সার্ভিস অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীদের তাদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সীমার ব্যপারে জ্ঞান রাখতে হবে। না হলে যে কোনদিন উপরের ব্লগারের মত জরিমানা গুনতে হবে বা জেলের ঘানি টানতে হবে। এইসব ব্যাপারে আরও আলোচনা দরকার এবং ব্লগারদের সঙ্ঘবদ্ধতার প্রয়োজন রয়েছে নিজেদের কথা বলার অধিকার সমুন্নত রাখার জন্যে।

ছবিঃ নিউজিয়াম, ওয়াশিংটন ডিসি, ২০১২। স্বত্বঃ লেখক


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

এখন এই কন্টেন্ট অপসারণ পুরোটাই নির্ভর করবে গুগলের উপর তাইনা? গুগল কি আসলেই সঠিক কাজ টা করছে কিনা এটা দেখবে কে?

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

মন মাঝি এর ছবি

জনগন। হাসি

****************************************

মরুদ্যান এর ছবি

তাইলেই সারছে। চিপাচুপা দিয়ে গুগল কি মুছলো না মুছলো ধরতে সময় লাগবো, তার উপর আবার জনগণের যেকোন ইস্যুতে কাইজ্যা তো আছেই।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চিন্তায় ফেলে দিলেন চিন্তিত

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মরুদ্যান এর ছবি

কেন তোমারে গুগল করলে কি উলটা পালটা কিছু দেখা যায়? কী নাম দিয়া সার্চ দিব? চোখ টিপি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

বাক স্বাধীনতার দেশগুলোতে তথ্য মুছে ফেলাটা সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য অনেক বড় ব্যাপার হলেও হতে পারে; কিন্তু আমাদের দেশে যে সোশ্যাল মিডিয়ারই মৃত্যু অচিরেই ঘটতে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহই নেই।

এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বিশ্লেষণের অনুরোধ জানালাম।

তারেক অণু এর ছবি

অনেক দিন পর লিখলেন। আপনার ওদিকে আশার কথা চলছে জানুয়ারিতে-

রেজওয়ান এর ছবি

চলে আসেন। আপনার প্রদর্শনী মিস করলাম।

সজল এর ছবি

ব্যাপারটা "বিস্মৃত হওয়ার অধিকার" হবে না?

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

রেজওয়ান এর ছবি

শব্দটি সমার্থক । সংসদ অভিধানে বিস্মৃত হওয়া = v. to forget oneself আবার আরেকটি অভিধানে বিস্মৃত হওয়া = v. to fall into oblivion; to forget । আমি আসলে সহজভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

খাইছে

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

অতিথি লেখক এর ছবি

ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া

-------------
আশফাক(অধম)

রণদীপম বসু এর ছবি

তাইলে আমাগের কী হবে গো ! হা হা হা ! ব্লগ ইত্যাদি নিয়ে গোটা বিশ্বের তথা তথ্য-প্রযুক্তি দুনিয়ার যে মাথাব্যথা তা ভাবলে সেই কথাটা কিন্তু এখন আর ফানি মনে হয় না যে, ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চলে !
আসলেই কি তাই নয়?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।