মানুষ কেন অন্যকে নির্যাতন করে? নির্যাতনকারীরা অপরের উপর কর্তৃত্ব করা, শক্তি দেখানো বা নিয়ন্ত্রণকারী একটি মনোভাব পোষণ করে এবং মানসিক ও শারীরিক ভাবে দুর্বল লোকেরা তাদের শিকার। এটি সামাজিক এবং মানসিক সমস্যা কারণ নির্যাতনকারীরা কোন একটি "উচ্চ নৈতিক অবস্থানে আছে" বলে মনে করে এবং ভাবে তাদের কিছুই হবে না।
শিশুরা এই দিক থেকে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে থাকে। কারণ প্রথম দিকে তারা নির্যাতনের প্রকার বুঝতে পারে না, নির্যাতন ঠেকাতে পারে না কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেকেরই সারা জীবনে কোন না কোন নির্যাতনের শিকার হওয়া বা নির্যাতন প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। নির্যাতনের ও রয়েছে রকমভেদ - শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন - কোনটাই কোনটার থেকে কম নয় বীভৎসতার দিক থেকে। এ এমন বিষয় যা হয়ত অনেক শিশু বড় হলেও কোনদিনই অন্যকে জানাবে না। আমাদের বাবা-মা এসব বিষয় তাদের মত করে সামাল দিয়েছেন, আমাদের সুরক্ষা দেবার চেষ্টা করেছেন বা ব্যর্থ হয়েছেন । আমাদের উচিত আমাদের সন্তানদের জন্যে একটি স্বচ্ছ, সুন্দর, সুরক্ষিত পরিবেশ উপহার দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। কারণ দেখা গেছে বহু নির্যাতনকারী তাদের প্রাথমিক জীবনে নির্যাতিত হয়েছে এবং তাদের এই নিয়ন্ত্রণকারী ও প্রভাব সৃষ্টিকারী আচরণ পরবর্তীতে আয়ত্ত করেছে। ছোটকালে তারা বিপদ থেকে বাঁচতে পারলে হয়ত তাদের জীবন অন্যরকম হতো - আর অনেকে তাদের শিকার হতো না।
নির্যাতনের পরিবেশ সৃষ্টিকারী শিশুদের দুর্বল জায়গাগুলো হচ্ছেঃ
১) বাসা - কাজের লোকের কাছে ছেড়ে দেওয়া, চেনা-অচেনা আত্মীয়ের সাথে রাতে ঘুমাতে দেওয়া ইত্যাদি
২) শিক্ষক/শিক্ষিকা - আলাদা রুমে পড়তে দেওয়া, অন্যকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদি
৩) খেলাধুলা - জনবহুল নয় এমন জায়গায় অন্য ছেলেদের সাথে খেলতে দেওয়া, পাশের বাসার পরিবেশ সম্পর্কে না জেনে বাচ্চাকে খেলতে দেওয়া।
৪) প্রতিবন্ধী শিশুরা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে হুমকির মুখে থাকে।
বাস্তবে যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে আমাদের ছোট্ট শিশুটিকে ছোট্ট মনে করে অনেক কিছুই ভাবিনা। তাঁকে তার মত ছেড়ে দেই। আরেকটি বিষয় খুবই জরুরি কিন্তু অনেক সংসারেই অনুপস্থিত - তা হচ্ছে মা বাবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে না শিশুদের। ফলে কোন সমস্যা হলে সেটা নিয়ে কথা বলার মত কাউকে পায়না তারা। নির্যাতনকারীরা সাধারণতঃ উচ্চ নৈতিক অবস্থানে থাকা এবং শ্রদ্ধার পাত্র থাকে অনেক সময়। তাদের নিয়ে কিছু বলার ক্ষেত্রেও শিশুরা দ্বিধা বোধ করে।
নির্যাতনকারীদের চরিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তারা
১) নিয়ন্ত্রণকারী
২) স্বেচ্ছাচারী
৩) উচ্চ নৈতিক অবস্থান
৪) কর্তৃত্ব ফলানো
৫) ভালবাসা নিয়ে ভ্রান্ত ধারনা
৬) বিকৃত যৌনতা
৭) ষড়যন্ত্রকারী
৮) দ্বৈততাপূর্ণ মনোভাব
৯) বেপরোয়া ভাব
১০) স্বার্থপর
ইত্যাদি মনোভাব ও চরিত্রের হয়। তবে ভয়ের ব্যপার হচ্ছে অনেকেই এসব চরিত্র লুকাতে পারে এবং বিশেষ মুহূর্তে নিজরুপে আবির্ভূত হয়।
গৃহ ও শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি - এটি মানুষ শিখে তার পরিবার, সংস্কৃতি, পরিবেশ, সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে।
শিশু নির্যাতন থেকে আপনার শিশুদের রক্ষা করার কোন একটি নির্দিষ্ট ম্যানুয়াল নেই, কারণ প্রত্যেকেরই পরিবার, পরিবেশ, স্থান-কাল-পাত্র ভিন্ন। তবে নিন্মলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে আমরা শিশুদের জন্যে একটু ভাল পরিবেশ একটু বেশী সুরক্ষা দিতে পারব আশা করি। মূল বিষয় হচ্ছে নির্যাতনের পরিবেশগুলো এড়িয়ে চলা, শিশুর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে নির্যাতন সম্পর্কে আঁচ পাওয়া, শিশুকে নির্যাতনকারীর হাত থেকে রক্ষা করা অ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে জানানো - যাতে সে আর না করতে পারে।
১) মা-বাবার সচেতনতা নিশ্চিত করতে পারে আপনার সন্তানের সঠিক মানসিক গঠন - তাদের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন হোন, তাদের সাথে বিভিন্ন দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে কথা বলুন - এমন পরিবেশ তৈরি করুন যাতে তারা নির্ভয়ে তাদের কথা বলতে পারে - বলতে পারে তাদের কি ভাল লাগে বা ভাল লাগে না ।
২) বাচ্চাকে অবহেলা করবেন না। তাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন নির্যাতনের দাগ বা আচরণগত কোন পরিবর্তন আছে কিনা দেখার জন্যে। লক্ষ্য করুন কোন আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে যেতে চাচ্ছে না কেন। বড়দের মত যৌনতা বা সম্পর্ক নিয়ে কথা বলছে কিনা।
৩) বাচ্চাদের মানসিক দিকটা খেয়াল রাখবেন - বিষণ্ণ থাকে কিনা - স্কুলে যেতে অনীহা - খাবারে অনিয়ম করে কিনা - অন্যের সাথে খারাপ আচরণ করে কিনা ইত্যাদি। এগুলো নির্যাতন পরবর্তী মানসিক বিপর্যস্ততার লক্ষণ ।
৪) বাচ্চাদের যৌনতা ও সম্পর্কের ব্যপারে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেবেন - সাথে আরও শেখাবেন অন্যজন কর্তৃক শরীরের কোন অংশ স্পর্শ করা আদর - আর কোনটা না।
৫) নিজে উদাহরণ সৃষ্টি করুন - খারাপ কথা বলবেন না - কাজের লোক - বা বাইরের কোন লোককে নির্যাতন করবেন না - ঝগড়াঝাটি বাচ্চাদের আড়ালে করুন।
৬) টিভিতে বা পাড়াতে নির্যাতনের দৃশ্য দেখালে সেটা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলুন - ভাল - খারাপের উদাহরণ সৃষ্টি করুন
৭) বাচ্চাকে একা রাখবেন না - কাজের লোক বা পরিবার/ বাইরের কোন লোকের কাছে নিরুপায় হয়ে রাখতে হলে পর্যবেক্ষণ করুন দুর থেকে। মাঝে মাঝে খবর নেবেন এবং বাচ্চাকে পরে জিজ্ঞেস করবেন সেই সময় তারা কি করেছে। নির্ভরতা থাকা ভাল তবে কখনোই অন্ধভাবে বিশ্বাস করবেন না, বিশেষ করে পরিবারের কাছের মানুষের ক্ষেত্রে।
৮) শিশু নির্যাতন ও এর প্রতিকার এর সংবাদ থেকে ধারনা নিন। আপনি হয়ত এমন কিছু জানতে পারবেন যা আপনি কল্পনা করেন নি।
৯) সাবধানে থাকা ভাল - তবে অতিরিক্ত সাবধানী না হওয়া বা অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবন না হওয়া ভাল - সেটি আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি করবে।
১০) শিশুদের শাসন করবেন তবে সেটা শারীরিক না হওয়াই কাম্য। বাবা মার মধ্যে একজনকে আদর করা - একজনকে শাসন করার দায়িত্ব নিলে কার্যকরী হয় বেশী। তাহলে তাদের বোঝানো যায় যে দেখ আমিও তোমার মত এই নিয়ম ভাঙতে চাই কিন্তু মা এসে বকা দেবে। তাদেরকে শাস্তির কারণ বুঝাতে হবে - মেরে নিজের ঝাল ঝাড়লে হবে না। অন্যরকম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে - প্রিয় জিনিষ (যেমন টিভি দেখা) থেকে বিরত রাখাও কার্যকরী শাস্তি।
১১) শিশুরা তাদের উপর কোন নির্যাতনের কথা বললে - অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। ভাল করে শুনুন, সমালোচনা করবেন না, প্রবোধ দিন, সহমর্মিতা দেখান। বলুন এটা জীবনের শেষ নয় - তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান - নিরাপত্তা দিন, সাথে থাকুন।
১২) নির্যাতনকারীর মুখোশ খুলে দিন - তার পরিবার- কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলুন - যাতে তার বিচার হয় বা সে এরকম আর কোনদিন না করে।
সামাজিক জীব হিসেবে শুধু আপনার সন্তানের দিকে তাকালেই হবে না। আপনার আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী - বা সমাজের যে কোন শিশুর বিরুদ্ধে নির্যাতন দেখলে রুখে দাড়ান - সোচ্চার হোন। প্রত্যক্ষদর্শীরা থামালে বা পুলিশে সংবাদ দিলে শিশু রাজনের মৃত্যু হতো না। যে কোন শিশুর প্রতি আপনার সুরক্ষার ছাতা বাড়িয়ে দিন।
কিছু রিসোর্সঃ
১) Educating children on child abuse
২) Preventing Child Abuse - Teaching children about Bad Touch and How to react in such a situation
মন্তব্য
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ভালো লাগল।
_________________
[খোমাখাতা]
সাজেশনের ২ নাম্বারে একটা জিনিস যোগ করতে চাই।
বাচ্চা শুধু কোন আত্মীয়ের কাছে যেতে না চাইলেই নয়, তার থেকে বয়সে বড় কারো কাছে বেশি যেতে চাইলেও এই বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত। অনেক সময় বাচ্চা নির্যাতন বিশেষ করে যৌন নির্যাতনকে মজার আনন্দের কিছু ভেবে সমর্থন করে।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন