দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: বুধ, ৩০/১২/২০১৫ - ৮:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত? সরকারি তথ্যমতে এটি পাঁচ কোটির উপরে। তবে এই তথ্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে - কারা এই ব্যবহারকারী? কিভাবে ব্যবহার করেন? কতটুকু ব্যবহার করেন। এর সাথে সাথে যেইসব বিষয় জানা দরকার তা হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহার এর কার্যকরী কোন প্রশিক্ষণ হচ্ছে বা প্রয়োজনীয় সহায়তা/গাইড পাওয়া যাচ্ছে - না সবাই গাইতে গাইতে গায়েন।

এই কথাগুলো বলার প্রাসঙ্গিকতা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া সম্পর্কে এই আর্টিকেলটির বিষয়বস্তু যেখানে বলা হচ্ছে যে লাখো লাখো ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শুধু ফেসবুক চিনে এবং ফেসবুকের বাইরে কোন ইন্টারনেট ব্যবহার করেনি। এটি আরও সত্য বাংলাদেশের জন্যে। উদাহরণস্বরূপ সাম্প্রতিক সময়কালে ফেসবুক প্রায় মাসখানেক বন্ধ থাকার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমেছে। এছাড়া অনলাইনে অনেক বাঙ্গালিদের আচরণ ও শব্দচয়ন দৃষ্টিকটু। তারা তাদের নিজেদের গণ্ডি ছাড়া বাইরের কিছু পড়েনা, জানেনা, ভাবতে পারেনা। এটি আলোচনার বিষয় যে এর পেছনে কারণ কি - অশিক্ষা বা কুশিক্ষা, না জাতিগত সমস্যা। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারে এই কুপমুন্ডুকতা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্যতা প্রকাশ করে এবং এটি ফেসবুকের মত আগ্রাসী মিডিয়া বাণিজ্যকে আরও ধনী করতে সাহায্য করছে।

২০১৩ সাল থেকেই ফেসবুক বলে আসছে যে সারা বিশ্বকে ইন্টারনেটের আওতায় আনতে চায় তারা। কিন্তু অনেক ব্যবহারকারী তো ফেসবুক ছাড়া ইন্টারনেট ই চেনেনা। তাদের জন্যেই বিশেষ করে ফেসবুক আরও কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানির সহায়তায় ইন্টারনেট.অরগ/ফ্রি বেসিক নামে একটি উদ্যোগ চালু করে যা বর্তমানে ৩০টির ও অধিক দেশে ছড়িয়েছে। বাংলাদেশেও আছে সেরকম উদ্যোগ ফেসবুক জিরো আর উইকিপিডিয়া জিরো (বাংলা/ইংরেজি) যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা বিনামূল্যে ফেসবুক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আদতে এগুলো থাকে অফলাইন সার্ভারে - এবং আপনি লিঙ্কে ক্লিক করে কোন লাইভ সাইটে গেলেই অপারেটর ইন্টারনেটের জন্যে পয়সা চার্জ করে। ফলে এটি আসলে চতুর বিপণন উদ্ভাবন - বাণিজ্যিক লাভই উদ্দেশ্য।

ভারতে দুই মাস আগে ফেসবুকের ফ্রি বেসিক অ্যাপ আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু হয়। এতে ফেসবুকের বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবা (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি) এবং স্বাস্থ্য, আবহাওয়া, শিক্ষা সম্পর্কে তথ্য বিনামূল্যে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তবে অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে হালনাগাদ তথ্যের জন্যে লাইভ সাইটে যেতে হবে যার জন্যে ইন্টারনেটের মূল্য দিতে হবে - যা অনেক গরীব বা নতুন ব্যবহারকারী পারবে না। অ্যাক্টিভিস্টদের ভাষ্যমতে ফেসবুক যেহেতু নিজেই নির্ধারণ করছে কোন তথ্য বিনামূল্যে দেয়া হবে - কাজেই তারাই নির্ধারণ করবে গরিব ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কি পড়বে বা দেখবে। ইন্টারনেটের লাখ লাখ প্রাসঙ্গিক সাইটের বদলে তারা কয়েক ডজন নিয়ন্ত্রিত সাইটে ঘুরবে।

বিশ্বে এখন দেড় কোটি লোক ফ্রি বেসিক ব্যবহার করে যার মধ্যে ভারতে এর অর্ধেক ব্যবহারকারী আছে। তবে ভারতের ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিস্টরা সোচ্চার হয়েছেন এর বিরুদ্ধে । উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নাভিন পাটনায়েক বলেছেন "গরীবেরা কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে তা যদি আমরা নির্ধারণ করে দেই তাহলে আমরা তাদের নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার কেড়ে নিচ্ছি"। সম্প্রতি ভারতের টেলিকম নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের নেট নিউট্রালিটি সংক্রান্ত পদক্ষেপের কারণে এই অ্যাপ বন্ধ আছে। তবে ফেসবুক পত্রিকার পুরো পাতার বিজ্ঞাপন দিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে।

আর আমরা কোথায় আছি? সরকার ফেসবুক বন্ধও করে দিয়ে আমাদের জিম্মি করার সুযোগ পায় কারণ ফেসবুক ছাড়া আমরা ইন্টারনেট চিনিনা, জানিনা। সেলফি, লাইক, চেকইন, জন্মদিন/বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা আর ছবি শেয়ার করার বাইরেও যে জগৎটা আছে তাকে জানিনা। আমাদের বড় সুবিধা আমাদের এতো লোকসংখ্যা। অথচ ভালো বাংলা কন্টেন্টের বাজার নেই। ইন্টারনেটে একটি ভালো লিটল ম্যাগের চেয়ে হাজারগুণ বেশী শেয়ার হয় রেডিও মুন্না বাশেরকেল্লায় শেয়ার হওয়া রগরগে পোস্ট। আমাদের প্রতিদিনই নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়ছে - আছে কি তাদের জন্যে পর্যাপ্ত গাইড - প্রাতিষ্ঠানিক (যেমন স্কুলে) শিক্ষা বা অন্য উপায়? মানুষ কি পড়ে, কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা না করলে আমরা আরও পিছিয়ে যাব।

"দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুপা ফেলিয়া" - আমরা ইন্টারনেটে (বিশেষ করে ফেসবুকে) দেখা সব কন্টেন্ট সম্পর্কে চোখ মেলে দেখিনা - এ উৎস সম্পর্কে যাচাই বাছাই না করেই শেয়ার করি। এ প্রবণতা বিশ্বব্যপী - কারণ ইন্টারনেটের প্রানভোমড়া যে হাইপারলিঙ্ক - সেটি এই ফেসবুকে, ইন্সটাগ্রামের যুগে অপাংক্তেয়। অনেকেই লিঙ্ক চেপে মূল আর্টিকেল পড়ে না - কোন বিষয়/তথ্যকে গুগল করে দেখে না। ইরানি ব্লগার হোসেইন দেরাকশান লিখেছেন কিভাবে আমরা নিজেদের আলস্যের জন্যে এইসব সেবার কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছি। তারা আমাদের পছন্দ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ক্রয়/বিক্রয়, ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরন ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে আমাদের জন্যে কাস্টমাইজড তথ্য তুলে ধরছে আর আমরা গিলে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে হয়ত মিডিয়াওয়ালারা লোকবুঝে কন্টেন্ট দেখাবে - যেমন আওয়ামী ভক্তদের জন্যে একরকম আর বিএনপি ভক্তদের জন্যে একরকম এবং আমরা তাই নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে চোখ বুজে থাকব। যখন ফেসবুকে আমাদের লাইক, ব্রাউজারে ক্লিক আর শেয়ারের মাধ্যমে আমাদের পিতামাতার চেয়ে বেশী আমাদের চিনবে সরকার এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে প্রত্যাশিত। এভাবেই আমরা অ্যানিম্যাল ফার্মের খাঁচায় বন্দী একেকটি প্রাণী হবো। আমাদের চিন্তা/প্রতিক্রিয়া অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।

কিন্তু মুক্তি কোথায়? আমাদের ওয়েবকে আমরা কিভাবে পুনরুদ্ধার করব? না ভেবে থাকলে শুরু করে দিন এখুনি। আর শুধু অল্প শব্দে শেয়ার আর লাইক দেবেন না - আপনার ভাবনার পূর্ণ প্রকাশ করুন - অক্ষর আর কথামালার মাধ্যমে।

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভবিষ্যতে হয়ত মিডিয়াওয়ালারা লোকবুঝে কন্টেন্ট দেখাবে - যেমন আওয়ামী ভক্তদের জন্যে একরকম আর বিএনপি ভক্তদের জন্যে একরকম এবং আমরা তাই নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে চোখ বুজে থাকব।

- আজ্ঞে, সকল মিডিয়াওয়ালারা বহুকাল যাবত এমন কাস্টমারপসন্দ জিনিস দেখিয়ে আসছেন। ফলে ইঁদুর যখন গাছের গোড়া কেটে ঝুরঝুরে করে দিতে থাকে তখন মিডিয়াওয়ালারা উপরের ফুল-লতা-পাতা-পাখির বাসা দেখিয়ে মন ভুলাতে থাকে। পরে গাছ যখন হুড়মুড় করে পড়ে যায় তখন সেটাকে একটা সেনসেশনাল খবর হিসেবে দেখাতে থাকে আর গাছ কেন পড়লো সেটা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ফাঁদতে থাকে।

হাসিব এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট।
এই ধরণের সুবিধা পাইয়ে দেবার মাধ‍্যমে নেটনিউট্রালিটি ক্ষুন্ন হয়। এটা বাজারে নতুন বিক্রেতা আসতে বাধা দেয় এবং ইতিমধ‍্যে যারা বাজারে আছে কিন্তু এইসব জিরো প্রজেক্টের আওতায় নেই তাদের জন‍্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে শুনতে পাই একগাদা কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা পায়। পুরো তালিকাটা পাওয়া সম্ভব?

রেজওয়ান এর ছবি

নিশ্চয়ই কোন বিজিনেস মডেল আছে এইসব কর্পোরেট হাউজের জন্যে। ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস তো একটি রমরমে ব্যবসা। আলাদাভাবে তালিকা আছে কি? ের জন্যে বিটিআরসির অনুমতি লাগে কিনা টাও জানিনা। পত্রিকা ঘেঁটে বের করতে হবে।

হাসিব এর ছবি

তালিকা থাকারই কথা। গুনে গুনে কতোগুলো সাইটকে এই সুবিধা দেয়া হয়েছে। কাদের কাদের এই সুবিধা দেয়া হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই কোথাও লেখা রয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা দারুণ। মাঝেমাঝে আমি নিজেও কেবল ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকি প্রয়োজনীয় অন্যসব খোঁজখবর যোগাড় করা বাদ দিয়ে। ভা্বতে হচ্ছে আবার নতুন করে। লিংকগুলোর জন্য অজস্র ধন্যবাদ।

দেবদ্যুতি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

দময়ন্তী এর ছবি

ভাল লেখা।

ভারতে TRAI রিলায়েন্স জিও'কে এই ফ্রী বেসিক নামক ঢপটি আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছে। TRAI জনগনের মতামত আহ্বান করেছে।

মোদীর পেয়ারের রিলায়েন্স এটার মূল উদ্যোক্তা হলেও এয়ারটেল, আইডিয়া আর ভোডাফোনও নিজেদের জন্য লবিবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকে একটা করে ভার্টিকাল বানানোর চেষ্টা।

এর মধ্যে আবার ঈজিপ্ট দেখলাম ফ্রী বেসিক বন্ধ করেছে।

ফেসবুক ১৯ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যখন হোয়াট্‌স্‌অ্যাপ কেনে তখন অনেক মার্কেট পন্ডিত এমন অসম্বব ভ্যালুয়েশন নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, অনেকে হোয়াট্‌স্‌অ্যাপ-এর নাম সেই তখন প্রথম ভালো করে শুনেছিলেন। তো এখন মার্কবাবুকে কিছু একটা করতে হবে।

গুগল যখন অর্কুট নিয়ে নেয়, এবং পরে বন্ধ করে দেয়, এবং ওদের গুগলপ্লাস পারল না। গুগল ওর্কুট ব্র্যান্ড রাখলে পারত - এমন কথা কিছু অ্যানালিস্ট কয়েছিলেন -- ব্যাড ডিশিসন, ওর্কুট ওয়াজ প্রোভাইডিং এ হেলদি কম্পিটিশন ইন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং স্পেস। গুগল অ্যাকুইজিশন লেফ্‌ট দ্য ফিল্ড মোর ওপেন ফর ফেসবুক।

২০১০-১১ নাগাদ টিনএজাররা যখন ফেসবুক ছেড়ে ইন্স্টাগ্রামে ভিড় করতে লাগল, ফেসবুক এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইন্সট্রাগ্রাম কিনে নিল।

সময় বলতে পারবে কি হবে। তবে শুধু লাইক/সেলফি দিয়ে ফেসবুকের ২৩০ বিলিয়ন মার্কেট ভ্যালুয়েশন রাখা মুশকিল। মার্ক আরো ডেসপারেট হবে ফেসবুক প্লাটফর্ম বানাতে।

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

হাসিব এর ছবি

TRAI জনগনের মতামত আহ্বান করেছে।

এই জিনিসটা একটু অদ্ভুত লাগলো। নরম‍্যাটিভ বিষয়গুলো কেন ভোটাভুটিতে ফেলা হচ্ছে? একটা দেশের লোকজন স্বৈরতন্ত্র চায় এটা কি সেই দেশে স্বৈরতন্ত্র চালু করার পক্ষে যুক্তি হতে পারে?

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভারতের এই বিষয়টা নিয়ে কিছু ইউটিউব ভিডিও দেখলাম। সেখান থেকে যা যা শুনলাম তা হল:
১। TRAI তে অনলাইন পিটিশন করেছিলেন অনেকে। তাদের ১ মিলিয়ন ইমেইল তালিকা ইন্টারনেটে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
২। ফ্রি বেসিক নাম দিয়ে প্রায় একই জিনিস গেলানো হচ্ছে।
৩। ফেসবুক যদি বিনামূল্যে (সীমিত পরিসরে হলেও) ব্যব‌হার করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য কোন সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব অনেক কঠিন হবে। যেমন, অর্কুট যদি বিনামূল্যে ব্যব‌হার করা যেত, তবে ফেসবুক আজকের এই অবস্থায় আসত না। সমাজসেবার আড়ালে ফেসবুক ভবিষ্যতের সকল প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে।
৪। ফেসবুক বলেছে যে তারা আপাতত ব্যব‌হারকারীদের তথ্য কোন কাজে ব্যব‌হার করবে না। তবে, তারা ভবিষ্যতে কোন দিন সেকাজ করবে কিনা বলছে না।

ভিডিও লিংক:
[May contain some explicit language]
AIB : Save The Internet
AIB : Save The Internet ২
AIB : Save The Internet ৩

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।