সমাজমুখী ছিলেন না উর্দু মহাকবি মির্জা গালিব, কাব্যের উপজীব্য ছিল তার নিজের জীবনের সুখ দুঃখ, প্রেম- ভালবাসা, ভাগ্যের উত্থান পতন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা দিল্লির রেড ফোর্ট আর জামে মসজিদ দখল করে এ দুইয়ের মধ্যকার প্রচুর পুরোনো বিল্ডিং এবং বাজার ধ্বংস করে বিশাল অংশ খালি করে ফেলে। গালিব চোখের সামনে দেখেছেন দিল্লির খাস বাজার, উর্দু বাজার, খরম-কা বাজার মিলিয়ে যেতে।
আমি এবং দিল্লির বন্ধু অমিত যাচ্ছি বর্তমান যুগের গলি কাসিমজান খুঁজতে, যেখানে তার হাভেলি আছে।
স্থানীয় একটি ছোটো ছেলে আমাদের পথ দেখিয়ে সামনে যাচ্ছে। এই এলাকার চিপা গলিগুলি দিয়ে শুধু মানুষ এবং মোটরসাইকেল যাতায়াত করতে পারে। এমনকি রিকশা যাবারও জায়গা নেই। এলাকার বাড়িগুলির মধ্যে সেই মুঘল আমলের কাঠামো বা চরিত্র কমই আছে। অনেকগুলিই বিগত দশকগুলোতে ভেঙ্গে পড়া স্থাপনার উপর যত্ন ছাড়াই তৈরি। গেটে এখনো কাঠের কবাট এবং দরজা দেখা যায় - দেয়ালে অনেকদিন রঙ হয়না। মাথার উপরে কতরকমের বিশ্রী দেখতে তার ঝুলছে। অথচ ১৬৩৯ সালে সম্রাট শাহজাহানের তৈরি ১৫০০ একরের শাহজাহানাবাদের চারদিকে ৬ কিলিমিটার লম্বা দেয়াল ছিল এবং ১৪টি গেট ছিল। এই গেটগুলোর গুটিকয়েক এখনো অবশিস্ট আছে। এই এলাকাকে এখন বলা হয় পুরানি দিল্লি বা দিল্লি -৬ (কারণ এর পোস্টকোড ১১০০০৬)।
কাছাকাছি এসে চিপা গলিটি এক বড় গলিতে এসে মিলল- ছেলেটি গলি কাশিমজানের দিকে পথনির্দেশ করেই এখান থেকে চলে যায়। আমরা এগুতে গিয়ে শোরগোল শুনে থমকে দাঁড়ালাম। তখন সামনে স্থানীয় নির্বাচন তাই বিভিন্ন প্রার্থীর জন্যে স্লোগান দিয়ে মিছিল যাচ্ছে আর লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এগুনোর একটুকুও জায়গা নেই। মিছিলের অগ্রভাগে ছোটো ছোটো ছেলেরা ।
মিছিল পার হয়ে সামনের দিকে আসলাম। বাতাসে কাবাবের দোকান থেকে মসলা, খাবারের গন্ধ আসছে, পাশের দোকানে রাবড়ি বানানো হচ্ছে হাড়িতে। একটি ব্লক প্রিন্টারের দোকান থেকে ব্লক লাগানোর লাগাতার ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। চারপাশে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। এখানকার বাসিন্দারা উর্দুর একটি ডায়ালেক্ট বলে - কারখান্দারি জবান - মূলত এটা ছিল এখানকার বিভিন্ন ধরণের কারখানার কর্মীদের দৈনন্দিন বোল। উর্দু বিশেষজ্ঞ গোপী চান্দ নারাং ১৯৬০ এর দশকে দেখেছিলেন চাঁদনি চক, ফয়েজ বাজার, লাহোরি গেট ইত্যাদি জায়গায় প্রায় ৫০০০০ লোক এই ডায়ালেক্টে কথা বলে।
আমরা বালিমারান রোড ধরে এগিয়ে চরখিওয়ালা গলিতে এসে পড়লাম। সেখানে আবার নির্বাচনী মিছিলের মুখোমুখি হলাম। ঠেলা ও নানা যানবাহনের মধ্যে একটি রিকশাও আটকে পরেছে। তার ভেতর থেকে বোরখা পরে তিন তরুণী উঁকিঝুঁকি মারছে। সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে এক মোড়ে এসে গলি কাসিমজানের সাইনবোর্ড দেখলাম - উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজিতে লেখা। পাশেই একটা মোবাইল ফোনের দোকান যার সামনে তাজা ফলের জ্যুস বেচা হয়।
গলি কাসিমজান। এই গলিতেই কোথাও আছে মির্জা গালিবের হাভেলিটি
বালিমারানের গলি কাসিমজান এর মির্জা গালিবের হাভেলিটি (বাড়ি) প্রায় তিনশত বছর পুরনো। গালিব তার জীবনের শেষ সময় - ১৮৬০ থেকে ১৯৬৯ এখানে কাটিয়েছেন। তবে বাড়িটি মূলত তার নয়। দীর্ঘ ৫৬ বছর তিনি দিল্লিতে বসবাস করেছেন ভাড়া এবং অন্যের বাড়িতে থেকে এবং নিজের জন্য কোনো বাড়ি তৈরি করে যেতে পারেননি। এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন এক হাকিম, যে তার কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। পরে অনেক বছর এটি অবহেলিত ছিল এবং শুধুমাত্র হাকিম মাঝেমধ্যে এসে কিছুক্ষণ বসে গালিবের স্মৃতি রোমন্থন করতেন। দেশভাগের পর এলাকার অনেক বাসিন্দা পাকিস্তানে চলে যান। অনেক বাড়ি খালি পরে থাকে। শত বছর পরে ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার এটিকে দখলে নিয়ে নিলামে উঠিয়ে দেয়। তখন মোহাম্মাদ আলী ফারুকি নামে একজন এটাকে ২২,৪০০ রুপি দিয়ে কিনে নেয়। এর পরে বেশ কয়েক হাত বদল হয়ে নব্বুইয়ের দশকে এটি ছিল একটি কয়লার গুদাম।
কিন্তু দিল্লিবাসীরা কি মনে রেখেছিল গালিবকে? ১৯৮৮ সালে বলিউডের নামকরা গীতিকার ও পরিচালক গুলজার দূরদর্শনের জন্যে মির্জা গালিব সিরিয়ালটি বানান। অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ তার স্বভাবসুলভ অভিনয় দিয়ে গালিবের চরিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেন যা অনেকের মনে দাগ কাটে। এর আগে নতুন প্রজন্মের অনেক দিল্লিবাসী তার নামই হয়ত জানতো না। এর পরে গালিব কে নিয়ে নতুন করে উন্মাদনা শুরু হয়। নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে আগ্রহী হয়।
গালিবের হাভেলিতে রক্ষিত তাকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে বিভিন্ন সময় উন্মুক্ত স্ট্যাম্প
সমাজকর্মী ও এনজিও অ্যাকটিভিস্ট ফিরোজ বখত আহমেদ ও অন্যান্যরা নব্বুইয়ের দশকের প্রথম থেকেই এই ৪০০ বর্গগজের এই বাড়িটিকে ঐতিহ্য ঘোষণার জন্যে আন্দোলন করে আসছেন। ১৯৯৭ সালে দিল্লীর হাইকোর্টে একটি পাবলিক ইন্টারেস্ট মামলা ঠুকে দেন তিনি। একই বছর হাইকোর্ট রায় দেয় এটির ১৩০ বর্গগজ অংশকে আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক একটি ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এর পরে ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার সেই হাভেলিটির উল্লিখিত অংশটুকু অধিগ্রহণ করে এর সংস্কার করে এটিকে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরিত করে ফেলে।
গালিবের একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর ভেবে এখানে আসলে হতাশই হবেন। পুরোনো বাড়িটার আগের চরিত্র এবং জৌলুশ তেমন অবশিষ্ট নেই - রয়েছে আলোর প্রচণ্ড অভাব। হাভেলিটির পাশেই পানের পিক ফেলা দেয়াল সমৃদ্ধ একটি আধুনিক উঁচু বাড়ি আর আশেপাশে প্রচুর দোকান। তবে এখানে আসলে দেখতে পাবেন গালিবের কিছু বড় বড় ছবি, তার চিঠির প্রদর্শন, কিছু থালা, তার খাদ্যাভ্যাসের তালিকা (ভুনা গোসত এবং হালুয়া), বাসন- চামচ, তার জন্ম ঠিকুজি এবং ২০১০ সালে দিল্লীর চিফ মিনিস্টার শিলা দীক্ষিত কর্তৃক উন্মুক্ত আবক্ষ একটি ভাস্কর্য (শিল্পী শ্রী ভগবান রামপুরের তৈরী)। দেয়ালে বিভিন্ন লেখায় বর্ণিত রয়েছে সুরার প্রতি আসক্ততা, জুয়া খেলা ও পতঙ্গবাজিতে (ঘুরি ওড়ানো) তার আগ্রহ, আম খেতে তার পছন্দের কথা। এখানে এসে তার জীবনী ও কর্ম সম্পর্কে বেশ কিছু বর্ণনা পরে এই মহারথীর স্মৃতি রোমন্থন করা যায়, তার সম্পর্কে আরও জানার ইচ্ছা জাগে মনে।
গালিবের নারিপ্রেম ও ঈশ্বরপ্রেমের মধ্যে দূরত্ব কিছু নয়। তার লেখায় গুরুগম্ভীর ভাবের সাথে হাল্কা কৌতুকরসের আমেজ তিনি অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সাথে মিলিয়েছেন। তার কাজের মধ্যে ছিল অনবদমিত, অনবগুণ্ঠিত, আত্মপ্রকাশ। তার মন ছিল নৈরাশ্যবাদের ছাচে ঢালাই। দুঃখসাধনায় তিনি অবচেতন আনন্দ পেতেনঃ
কেই-বা জানতো আমার হৃদয়ের ব্যাপার,
কোন কুক্ষণে যে কবি হতে গেলাম, মান-মর্যাদা সবই গেলো।
অথবা তার সেই বিখ্যাত শায়েরীটি "হাজারো খোয়ায়সি এইসি"
হাজারো বাসনা হৃদয়-গভীরে, যার প্রতিটিই প্রাণহরা
যদিও মিটেছে অনেক বাসনা, রয়ে গেছে কত অধরা
গালিবের হাভেলিতে পুরো দেয়াল জুড়ে জীবনের শেষ সময়ের আঁকা গালিবের বিশাল ছবি
প্রতি বছর ২৭শে ডিসেম্বর গালিবের জন্মদিন পালনের জন্যে তার ভক্ত-আশেকরা মোমবাতি জ্বালিয়ে শাহজাহানাবাদের এই গালিবের হাভেলিতে আসে। তাদের উপর সংবাদ করতে গিয়ে হয়ত মিডিয়ারও মনে পরে গালিবের কথা।
দিল্লী যাবো শুনে সচল তারেক অণু আমাকে বলেছিল মির্জা গালিবের সমাধিতে যেতে - যেটা আর হয়ে ওঠেনি। মাজার-ই-মির্জা নামে তার সমাধিটি প্রায় দশ কিলোমিটার দুরে নিজামউদ্দিন বস্তিতে, হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের কাছে। এর কাছাকাছি মোঘল সম্রাট হুমায়ুনেরও সমাধি রয়েছে। তার কবরটি শান বাধানো মার্বেলে ঢাকা। তার সমাধির কাছাকাছিই রয়েছে ১৯৬৯ সালে উদ্বোধন করা গালিব একাডেমি, যেখানে রয়েছে একটি মিউজিয়াম, লাইব্রেরী, আর্ট গ্যালারি এবং অডিটোরিয়াম। লাইব্রেরিটিতে দুস্পাপ্য উর্দু বইয়ের কালেকশন আছে। আর মিউজিয়ামে আছে তার পরিধেয় কাপড়, অনেক ছবি ও চিঠির দুষ্প্রাপ্য কালেকশন।
কর্জ করে মদ খাই, বোঝা যাবে ঠিকই
ভুখা থাকার মজা একদিন রং ছড়াবে ঘরে।
কিছু প্রেমিকার রঙিন ছবি, কিছু সুন্দরীর পত্রলিপি
আমার মৃত্যুর পর এই সব সম্পদ পাওয়া যাবে আমার ঘর থেকে।
মন্তব্য
দারুণ।
হাভেলি শুনলেই মনে হয় অমরিশ পুরির অমর ডায়লগ, আও কাভি হাভেলি পে। আপনি সেই হাভেলি গিয়েই দেখালেন
অন টপিক, গদরের সময় গালিবের কী ভূমিকা ছিল? দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে ছিল পাড়া?
..................................................................
#Banshibir.
গালিবের সে সময়কার ভূমিকা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। তার ‘দাস্ত আম্বুহ (ফুলের তোড়া) ’ গ্রন্থের উক্তিঃ “১১ই মে ১৮৫৭ তারিখে যেদিন দিল্লির হাঙ্গামা শুরু হল সেদিনই আমি আমাদের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দিতে বললাম এবং বাইরে যাওয়া আসা একেবারে ছেড়ে দিলাম।” এ নিয়ে একটি রিসার্চ পেপার আছে - কেউ ডাউনলোড করতে পারলে আমাকে একটু পড়তে দিয়েন - http://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/01440350903157043?src=recsys&journalCode=fprs20
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
১৮৫৭ সালের অবস্থান কি আমরা এখনকার মানদণ্ডে মাপবো?
ফাইলটা এখানে পাবেন।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
প্রশ্নটা মনে ধরায় একটু নাক গলাই। কোন মানদণ্ড? ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততা, ফিউডাল-লয়ালটি জাতীয় বিশ্বস্ততা, গোষ্ঠিগত (এথনিক) বিশ্বস্ততা, শ্রেণীগত বিশ্বস্ততা, ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিশ্বস্ততা, নাকি আধুনিক "দেশপ্রেম"* টাইপের কোনো বিশ্বস্ততা বা আনুগত্যের মানদণ্ডে? আমার মনে হয় এই বা এই রকম প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভর করে আমরা তাকে এবং তার মতো ঐতিহাসিক চরিত্রদের এখনকার না তখনকার বা কখনকার মানদণ্ডে মাপবো।
-------------------
* বিশেষ কোনো ব্যক্তি-বংশ-শ্রেণী-গোষ্ঠী-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদির উর্ধ্বে কোনো যথাসম্ভব অল-এনকম্পাসিং "দেশ"-সংক্রান্ত আইডিয়া-ভিত্তিক?
****************************************
সেটাই। দূর অতীত বর্তমানের মরাল কম্পাস দিয়ে মাপার বিপদ অনেক। এটা করাকে ইংরেজিতে প্রেজেন্টিজম বলে। বর্ণনায় মরালিটি না আনা ইতিহাস আলোচনার কোর্স ১০১।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
পেপারটা পড়ে বুঝলাম সবই চূড়ান্ত বিচারে টেকাটুকার ব্যাপার! গালিব কোম্পানি তথা ব্রিটিশের ভাতাভোগী ছিলেন - এই ডাইরীর মাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি "নিমকহালালি"-র পরিচয় দিলেন।
Emran
আমার ভালো ধারনা নেই। ট্রিপ অ্যাডভাইজার দেখতে পারেন। তবে ভারতে এখন অ্যাপের বেশ চল। ২০১৫ সালে মুম্বাইতে অয়ো (OYO) নামের এক অ্যাপ ব্যাবহার করে রুম ভাড়া করেছিলাম। লোকাল সিম না থাকায় (এখন সাথে সাথে অ্যাক্টিভেট হয় না) বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল খুঁজে পেতে। সেটা আসলে এক গেটেড কমিউনিটির অ্যাপার্টমেন্ট ছিল (এয়ারবিএনবির মত)। গেটের দারোয়ানকে যতই বলি হোটেলে যাবো - সে বলে কিসের হোটেল (বুকিঙের সময় ভেঙ্গে বলেনি)।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পুরনো দিল্লিতে থাকার জায়গার কোন পরামর্শ আছে?
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
নতুন মন্তব্য করুন