আমরা মানে আমি, সজীব, সৌমেন আর নিশিত আপু। যাত্রা শুরু হল নিউ ইয়ার্স ইভে, ২০১৩ কে অভ্যর্থনা জানালাম ভ্রমণ দিয়ে।
যাওয়ার বাস যাত্রা তেমন স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়নি। রাতের বাস, চলা শুরু করার খানিক পরেই বাতি নিভিয়ে পুরো বাস অন্ধকার করে দিল, একটু পরেই মানুষের সুখনিদ্রার শব্দ ভেসে আসতে লাগল চারদিক থেকে। আমি ঘুমাই কি করে, ছুটি শুরুতক তো দিনে ঘুমিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। বই নিয়ে গেছি পড়ব বলে- সিট লাইট নেই, কথা বলাও যাবে না, হেডফোন থেকে শব্দ বের হতে পারবে না। বাইরে দৃশ্য দেখব কি? জানালা খোলার উপায় তো নেইই, জানালা পর্দা দিয়ে ঢাকা, যাতে বাইরে থেকে আলো ঢুকতে না পারে। জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করা কি যে যন্ত্রণা তা ভুক্তভোগী মাত্রেরই জানা আছে। পরে যেদিন ফেরত এসেছিলাম, সেদিন ক্লান্ত ছিলাম প্রচণ্ড। তাই বাসে ঘুমিয়েছি মরার মত, তখন অবশ্য মনে হয়েছে এত্তসব নিয়মকানুন হয়তো মন্দ কিছু না।
রাত পোহাতেই অভূতপূর্ব দৃশ্য, চারদিক সাদা চাদরে ঢাকা। তুষার প্রথম দেখছি না, কিন্তু এ তো অন্যরকম সুন্দর। পর্দা খুলতে না পেরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সামনে দেখার চেষ্টা করলাম। ঘরের চালে, সেতুর রেলিঙয়ে, ফসলের মাঠে, পাহাড়ের গায়ে কয়েক ফুট উঁচু তুষারের স্তূপ। টোকিওতেও তুষার পড়ে, তবে এভাবে চারদিক তুষারধবল হয়ে যায় না। তুষারের উপর অরুণোদয়ের আলোকচ্ছটা- নতুন কোন রাজ্যে ঢুকে পড়েছি এই অনুভূতি।
আমরা যেখানে নামলাম, সেই তত্তরি (鳥取) স্টেশনে অবশ্য তুষারের প্রকোপ অত ছিল না। সেখানেই সকালের নাস্তা সারা। নতুন বছরের প্রথম দিন, তাই দোকানে বিশেষ কেউ নেই। একটা ব্যাপার চোখে পড়ল, যে অল্প কজন দোকানে এসেছে সবাই বয়স্ক। এমনকি দোকানের মালিকের বয়সও ষাটের ওপর হবে। জাপানে বয়স্কদের সংখ্যা যে দ্রুত বাড়ছে টোকিওর বাইরে আসলে বোঝা যায়।
তত্তরিতে আমরা দেখব বালিয়াড়ি (砂丘), সেও ট্রেন আর বাসে আরও ঘণ্টা তিনেক মত। ট্রেনের যাত্রা বাসের চেয়ে আরামপ্রদ, জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। রোদ উঠে পড়েছে, নির্ঘুম চোখে রোদ লাগায় হালকা মাথা ব্যথা করছে ঠিকই, কিন্তু চারপাশের দৃশ্য সেই ব্যথাকে ধর্তব্যে আনতে দিচ্ছে না। রাস্তার এক ধারে বহু দূর পর গোটা কয়েক বাড়ি, তা পার হয়ে আরও দূরে সমুদ্র। অন্য ধারে আকাশ ভেদ করে পাহাড় উঠেছে, তার গায়ে ঘন অন্ধকার বনের আস্তর, শাড়ির আঁচলের মত তুষারের আল্পনা তার পরনে। পুরু বরফের উপরের স্তরটা মসৃণ, যেন রোলার চালিয়ে সোজা সুষম করে দেয়া হয়েছে। ট্রেন ছুটে চলেছে, একটা কবরস্থান পেরোলাম। মৃতদের সমাধিস্তম্ভের উপর সাধা বরফ জমে আছে, কি প্রাচীন, শুভ্র, নির্জন। আবার চার-পাঁচটা বরফে ঢাকা ক্ষেতের পরে কোন একটা ক্ষেতে সবুজের ছোঁয়া, মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের প্রতিবাদ যেন।
বালিয়াড়ি পৌঁছতে প্রায় দুপুর। জাপানের বড় বালিয়াড়ি তিনটা, তার মধ্যে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় তত্তরির এই বালিয়াড়ি। বালিয়াড়িতে ঢোকার সিঁড়িতে “বালি নিয়ে যাওয়া নিষেধ” আর “বালিতে আঁকাজোকা করা নিষেধ” লিখে সতর্ক করে দেয়া, মজা লাগল। যতদূর চোখ যায় ধূধূ, হলুদ বালি আর বালি, যেন ক্ষুদ্র মরুভূমি একটা। তবে মরুভুমিতে দুপুরে গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, কিন্তু এখানে দিনদুপুরেও রীতিমত ঠাণ্ডা। ঢাল বেয়ে নামার পর একধারে ছোট্ট এক জলাধার মত, সেখানে পানি জমে আছে। তারপর আবার চড়াই বেয়ে ওঠা। উঁচুতে ওঠার পর হঠাৎ করে দিগন্তে প্রসারিত সমুদ্র, যেন চমকে দিতে বসে ছিল। কিছু জায়গায় বালিতে রাতে জমে থাকা তুষার গলে উঠে পারেনি। সেখানে বালি-তুষার-সমুদ্রে এক অদ্ভুত বিন্যাস। বালিয়াড়ির চূড়া থেকে নামার পথ বেশ খাড়া, নেমে আসলেই পায়ের কাছে জাপান সাগরের বিশাল উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ছে। জাপানে এর আগেও সাগর দেখেছি, কিন্তু এই সমুদ্রের কাছে তাদের সৌন্দর্যের তুলনা নেই। চারপাশে মানুষও বেশি না, শান্ত নীরব এই সাগরের তীরে বসে থেকেই দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। বুঝলাম সাগরের বিশালতার কাছে মাঝেমধ্যে যেতে হয়, নিজেদের ক্ষুদ্রতা বুঝে নিতে।
এই এলাকার বিখ্যাত খাবার হল কাঁকড়া। তাই দুপুরের কাঁকড়া খাওয়া চাই। যেখানে খেতে ঢুকলাম, সেখানকার মেন্যুতেও কাঁকড়ার ছড়াছড়ি। দাম অনেক বেশি না, খাবার পরিমাণেও যথেষ্ট এবং সুস্বাদু। দেশের সাথে এই দিকটা আলাদা - কোন বিশেষ খাবারের কারণে কোন এলাকা বিখ্যাত হলেই সেই খাবারের দাম আকাশচুম্বি হয়ে পড়ে না, সাধ্যের মধ্যেই থাকে।
তত্তরি থেকে সেদিনই আমরা রওনা হলাম ওকায়ামার পথে, যেখানে আমরা ঘাঁটি গড়ব পরের তিনদিনের জন্য।
পরের দিন গেলাম নিইমিতে লাইম পাথরের গুহা (井倉洞) দেখতে। গুহার ভেতরে ঘুরে দেখা এই প্রথম, আগের যা অভিজ্ঞতা সব টেলিভিশনের অবদান। কেন জানি না, গুহা বললে মশাল হাতে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে এমন অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, গুমোট কোন জায়গার কথা মনে হত আমার। আসল অভিজ্ঞতা ঠিক সেরকম হয়নি। জায়গায় জায়গায় মাথা নিচু করে হাঁটতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হামাগুড়ি দেয়া লাগেনি। গুহার ভেতরেও তার টেনে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা। একটু পরপরই বিভিন্ন রঙের আলোর ব্যবস্থা। বিভিন্ন কোণে এমনভাবে বাতি বসানো যাতে লাল, সবুজ, নীল আলো পাথরের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে রহস্যময় আবছায়া সৃষ্টি করে।
গুহার ভেতরের পাথরের গড়ন বিভিন্ন রকমের। প্রকৃতি যখন আপনমনে খেলে তখন কত বিচিত্র আকারেরই না জন্ম দেয় সে- কোনটা দেখে হাতির শুঁড় মনে হল, আবার কোনটা গন্ডারের দাঁত, কোনটা উটপাখির ডিম। কয়েক জায়গায় পাথরের গায়ে আকৃতি অনুযায়ী নাম লেখা। কত মিলিয়ন বছর ধরেই না এগুলো গড়ে উঠেছে। সামনে টিকে থাকবে হয়ত আরও লক্ষাধিক বছর। কিন্তু ততদিন মানুষ থাকবে কি তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে? রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কি হবে তোমার, কাছে কেউ না এলে এবার...।
গুহার প্রবেশপথ থেকে চূড়া প্রায় শ’মিটার মত। চূড়ায় পৌঁছে আমরা যখন নামতে শুরু করলাম, তখন কোত্থেকে সুর ভেসে আসল। গুহার আধো-অন্ধকার পরিবেশে হঠাৎ ভেসে আসা অচেনা সুর, চারপাশে মনোমুগ্ধকর আলোছায়ার খেলা- এই মাত্রা, পরিমিতিবোধ দেখে ভালো লেগেছে। মানুষের আরামের ব্যবস্থা করতে গিয়ে যে কৃত্রিমতার আমদানি, তা যে কখনই প্রকৃতিকে ছাপিয়ে যায় নি তা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
গুহা দেখা শেষ করে বেরিয়েছি যখন তখন আমাদের উদরে ছুঁচো বুক ডন দিচ্ছে। কিন্তু আশপাশে খাবারে দোকান কই? নিইমি প্রায় গ্রাম ধরনের জায়গা, তাতে আবার নববর্ষের সময়। গ্রাম বলছি ঠিকই, কিন্তু এখানে গ্রাম আমাদের গ্রাম থেকে একটু আলাদা। গ্রাম বললে আমার কাঁদামাটির এবড়োখেবড়ো পথ, মাঝেসাঝে দুয়েকটা সাইকেল বা ভ্যান, রাস্তার ধারে খুঁটিতে বেঁধে রাখা গরুর কথা মনে আসে। এখানে রাস্তা পিচ ঢালা, মসৃণ, বিদ্যুতের ব্যবস্থা তো আছেই (এমনকি গুহার মধ্যেও ছিল), ট্রেনও চলছে বহাল তবিয়তে। খালি সবজায়গায় ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট বা ম্যাকডোনাল্ড নেই, ঘরবাড়িগুলো ফাঁকা ফাঁকা, দশ মিনিট হাঁটলে হয়তো মানুষের দেখা মেলে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আমরা অবশেষে এক মুদি দোকানের খোঁজ পেলাম। দেশের মুদি দোকানের সাথে আশ্চর্য সদৃশ- ছাপড়া ধরনের দোকান, চিপস, ড্রিঙ্কস, অল্প সবজি, ব্রেড, এসব রাখা। দোকানের ভেতর আলো নামকাওয়াস্তে, দোকানি কেবল দুপুরের খাওয়া শেষ করে টিভি দেখতে বসল, ত্রিসীমানায় ক্রেতার নামগন্ধ নেই, সন্দেহ হল আমরাই প্রথম ক্রেতা হয়তো। সেখান থেকে ব্রেড আর চিপস কিনে আপাত পেটপূজা সারা হল।
যেখানে তিনদিন ছিলাম সেই ওকায়ামা নিয়ে বলি। বেশ বড় শহর, চারদিন আমরা যেসব এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে জৌলুস বেশি ওকায়ামারই। টোকিওর মতই- বড় বড় শপিং মল, সব ধরনের খাবারের দোকান, মানুষও বেশি। যেহেতু টোকিও থেকে পালাতে এসেছি আমরা, তাই শহরটা আর সেভাবে ঘুরে দেখা হয়নি। মানুষের মুখের আদল কি টোকিও থেকে সামান্য আলাদা? হতে পারে, আমার তাই মনে হল। যে হোটেলে ছিলাম তা চমৎকার, সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত। সকালের নাস্তার কুড়মুড়ে ব্রেডগুলো, আহ....। লিখতে বসলেই খালি খাওয়ার কথা চলে আসে, থাক অন্য প্রসঙ্গে যাই।
তিন তারিখে, মানে পরের দিন গিয়েছিলাম শোদোজিমা (小豆島) নামের এক দ্বীপে। যাওয়ার পথের মূল আকর্ষণ ছিল জাহাজ, এই বড় সাদা হাঁসের মত। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল এদিনও, ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বের করতে গিয়ে হাত জমে যাচ্ছিল। চারদিকে নীল জল, তাতে আলো পড়ে চিকচিক করছে। ওই দূরে একটা দ্বীপ, তার পুরোটা জুড়েই একটা টিলার মত পাহাড়, আকাশে শঙ্খচিলের ওড়াউড়ি। কতো দ্বীপ যে এখানে সেখানে, তার বেশিরভাগেই জনমানুষের অস্তিত্ব নেই। আমরা শোদোজিমাতে পৌঁছলাম বারটা নাগাদ। সেখান থেকে গন্তব্য অ্যাঞ্জেল রোড, একটা সরু ফালি করা পথ, জোয়ারের সময় ডুবে যায়, ভাটায় জেগে ওঠে। উপর দিয়ে হেঁটে তখন আরেকটা দ্বীপে যাওয়া যায়। অ্যাঞ্জেল রোড দিয়ে হাত ধরাধরি করে প্রিয়জনের সাথে হেঁটে গেলে সুখী হওয়া যায় এই ধরনের লোককথা আছে। আমরা যখন গেছি তখন ডুবে ছিল, ভাটার অপেক্ষা করার সময়ও হাতে ছিল না, তাই আফসোস নিয়ে ফিরলাম। গতবার দেশে গিয়ে সেন্ট মার্টিন্স গেছিলাম, সেখানেও এরকম ডুবো পথ ছিল।
পরের গন্তব্য রোপওয়ে, কিন্তু বাঁধ সাধলো বাসের অভাব। নববর্ষের সময় বলে বাস কম, দিনে একটাই বাস, তাও পুরোটা যাবে না। মাঝপথ থেকে ট্যাক্সি নেয়ার ধাক্কা। তাই সময়-খরচ-উপযোগ বাছাই বিবেচনা করে রোপওয়ে বাদ গেলো। রোপওয়েতে আগেও চড়েছি, কি আর এমন আহামরি হবে, দড়িতে ঝুলে থাকাই তো- এসব ভেবে সান্ত্বনা খুঁজলাম। রোপওয়ে যাওয়ার মূল আগ্রহ জেগেছিল ট্যুরিস্ট সেন্টারে পাম্ফলেটে উপর থেকে তোলা শরতের লাল পাতার বনের ছবি দেখে। এই শীতে গাছগুলো ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার কথা। তাই এর বদলে গেলাম অলিভ গার্ডেনে। জলপাই-এর জন্য এই দ্বীপ বিখ্যাত। তাই বাগান জুড়ে জলপাই গাছ, দোকানে জলপাই তেল, এমনকি জলপাই ফ্লেভারের আইসক্রিম পর্যন্ত আছে। জলপাইয়ের উৎসস্থল প্রাচীন দিনের গ্রীসের ছাপ বাগানের কারুকাজে স্পষ্ট, এক জায়গায় প্রাচীন গ্রীসের বায়ুকলের মডেল রাখা। দেখে মনে হল, সৌন্দর্য যত না জরুরি, সুন্দরের নান্দনিক প্রকাশ তার চেয়ে দরকার। খুব সাধারণ জিনিসকেও সুন্দর করে তুলে ধরতে কেমন করে তা এদের ভালই জানা আছে।
যেদিন রাতে ফিরব সেদিন গেলাম নারুতো (鳴門)তে, একটা ঘূর্ণিজল (渦潮) দেখতে। সমুদ্রের মাঝে দুই বিপরীতমুখী স্রোতের মিলনস্থলে প্রবল ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়। আমরা যেখানে ছিলাম, সেই ওকায়ামা থেকে বেশ দূর, ঘণ্টা চারেক মত। ওকায়ামা থেকে আমরা গেলাম প্রথম তাকামাৎসূ নামের এক জায়গায়। সমুদ্রের ওপর দিয়ে সেতু, তার ওপর দিয়ে রেললাইন চলে গেছে। সমুদ্রে যে জায়গায় ঘূর্নির সৃষ্টি হয় তার ওপরেও সেতু করে দেয়া, পাশে চার লেনের গাড়ির রাস্তা। শুধু শুধু কি বলা হয় যে জাপানিরা যেখানে পারে, সেখানেই সেতু তুলে ফেলে। প্রায় ৫০ মিটার উপর থেকে পানির যুদ্ধ দেখতে থাকলাম। মার্চ-এপ্রিল হল ঘূর্ণি দেখার শ্রেষ্ঠ সময়। সবচেয়ে ভালো দেখা যায় মাসে দুবার- পূর্নিমায় আর অমাবস্যার পরে যেদিন নতুন চাঁদ ওঠে সেদিন। তাই আমরা যখন গেছি তখন ছবি দেখে যেরকম গভীর ঘূর্ণির কল্পনা করেছিলাম, সেরকম পাই নি। তবে নিচে সবুজাভ নীল, কালচে নীল, গাঢ় নীল, আকাশি কতো রঙের পানিই যে দিশাহারার মত ঘুরতে থাকল। জলের আবর্ত আবার এক জায়গায় সৃষ্টি হয়ে বসে নেই, ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন আকারে গড়ে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে এখানে সেখানে। সেতুতে স্থানে স্থানে মেঝেতে স্বচ্ছ কাঁচের চারকোণা প্লেট করে দেয়া। ওর ওপরে দাঁড়ালে নিচে সরাসরি সমুদ্র, মাঝে বাঁধা হচ্ছে শুধু কাঁচটুকু। কাঁচ খুলে পড়ার কোন সম্ভবনা নেই জেনেও গা শিরশির করে।
আমাদের যাত্রার একটা বড় অংশ ছিল ট্রেনে, বিশেষ করে এক শহর থেকে আরেক শহরের মাঝের পথটা। জাপান ট্রেনের জন্য প্রবাদপ্রতিম, গ্রীষ্মের আর শীতের লম্বা ছুটির সময়টাতে এখানকার সরকারী যে রেলওয়ে তারা জু-হাচি নামে এক ধরনের টিকেট ছাড়ে। এক সেটে পাঁচটা করে টিকেট, লম্বা দূরত্বে যাওয়ার সময় বেশ সস্তা পড়ে। কিন্তু লোকাল আর র্যাপিডের চেয়ে দ্রুতগামি কোন ট্রেন ব্যবহার করা যায় না, তাই সময় লাগে কিছু বেশি। মূল ক্রেতা হল ছাত্ররা, যাদের পয়সা ততটা নেই কিন্তু অবিশ্রাম ভ্রমণেও আপত্তি নেই।
জানুয়ারির শুরু এই সময়টা প্রচণ্ড শীত পড়ে, টোকিওতেও ঠাণ্ডা বেশ। দক্ষিণে ভেবেছিলাম শীত কম হবে। তা হয়নি, যেদিন পৌঁছলাম সেদিনের কথা তো বলেছিই, ভোরের আলো ফুটলে বাইরে তাকিয়ে দেখেছিলাম সাদায় ঢাকা বিস্তীর্ণ জনপদ। তবে ঠাণ্ডা আক্ষেপ না, অল্প আক্ষেপ হল সবকিছু প্ল্যান মোতাবেক ঘটায় অ্যাডভেঞ্চার কিছু হয়নি। বাসের টিকেট, ট্রেনের সময়সূচি, ঘোরার পরিকল্পনা কোনটাই ভেস্তে যায়নি। ভেস্তে যায়নি বলে গভীর রাতে মাঝরাস্তায় ট্রেন গোঁগোঁ করে থেমে গেল, চারধারে পুরু কুয়াশার আস্তর, দূরে হুক্কাহুয়া ডাক- এমন গা ছমছমে পরিবেশের মুখে পড়তে হয়নি। বিনিময়ে অবশ্য ঘোরা গেছে মানসিক শান্তি নিয়ে, কোন দুশ্চিন্তা ছিল না, তাড়াহুড়ো করতে হয়নি, সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা গেছে।
ভ্রমণ, সে জাপানে হোক আর দেশেই হোক, প্রধান অনুষঙ্গ হল সঙ্গী। কোথায় পড়েছিলাম, ভ্রমণের সময়ই বন্ধুর আসল দোষগুণ বোঝা যায়। এবার বেরিয়েছিলাম আমরা চারজন, প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছি। এমনকি চার পাঁচ ঘণ্টা ট্রেনের যাত্রাও ক্লান্তিকর মনে হয়নি। তাস খেলে, আড্ডা দিয়ে বা পাগলামি করে এমন সব স্মৃতি জমেছে যা অমূল্য। আবার ঝগড়াঝাটিও করেছি, রান্নায় খালি চিনি দিলে কি আর স্বাদ হয়? ছোট্ট এক ঘটনা বলি। প্রথম দিন বাসের অপেক্ষায় বসে আছি অনেকক্ষণ। বাস আসলে হুড়মুড় করে উঠতে গিয়ে ক্যামেরা ফেলে গেছি ভুলে। পেছন থেকে ডাক দিয়ে এক বুড়ো ক্যামেরা ফেরত দিল। মানুষে বিশ্বাস না করে যাই কোথায়।
ভ্রমণ ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়, হৃদ্যতা জাগিয়ে তোলে। নতুন বছরে নিজেকে কিভাবে বদলাতে চাই, এই ঘোরাঘুরির চেয়ে ভালভাবে শিখতে পারতাম না আর কিছু থেকেই। জীবনকে চেনার, মানুষকে চেনার, সর্বোপরি নিজেকে চেনার এর চেয়ে ভালো কিছু আর নেই।
মন্তব্য
অ্যাঞ্জেল রোড ধরে হাঁটতে মন চায় গো
হরেক রঙের পানি
সবারই হাঁটতে মঞ্চায় রে কিষাণ।
সাথে হাত ধরে হাটার মত কাউরে নিয়া চইলা আয় ।
কয়েকটি ছবি সুন্দর লাগলো। আপনার শিরোনামে কোথাও একটু গণ্ডগোল আছেনা? "বিসমিল্লায় গলদ" দিলেই হত!
-মনি শামিম
ধন্যবাদ।
বিসমিল্লাহয় ভ্রমণ = ২০১৩ এর শুরুতেই ভ্রমণ অর্থে।
পয়লা প্যারাতেই আটকায় গেলাম। দুই সপ্তা ছুটি "ছোটখাট"? আমি তো সারা বচ্ছরে ছুটিই পাই তিন সপ্তা। হায়রে জীবন (ঘনঘন অশ্রুবর্ষণ ও দীর্ঘশ্বাস)।
লেখা ছবি দুইটাই জোস।
..................................................................
#Banshibir.
অনেক নেন।
ছাত্রজীবন = ছুটির মইদ্যে মইদ্যে পড়া।
ভাল লাগলো। তবে দুই এক জায়গায় একটু হোঁচট খেয়েছি। আরেকটু ছোট করে পর্ব আকারে দেওয়া যায় কি না চিন্তা করে দেখতে পারেন।
ধন্যবাদ পাঠে, মন্তব্যে, পরামর্শে।
ধন্যবাদ নিন।
নতুন সব জায়গা সম্পর্কে জানা হল, দারুণ লিখেছেন।
আপনার ছবি তোলার হাত ভালো - কিন্তু কিছু ছবি টাইট ফ্রেম তথা ক্রপের অবকাশ রাখে (যেমন: দেবদূতদের পথ, বালির সাগর)
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ধন্যবাদ ফাহিম ভাই পাঠে এবং উপদেশে।
সত্যি বললে ক্যামেরা খালি শাটার চিপে যাই, কোনটা ভালো ওঠে, কোনটা না। এখানেই কত চমৎকার চমৎকার পোস্ট পড়েছি ছবি তোলার কায়দাকানুন নিয়ে, প্রয়োগের বেলায় শূন্য। পরের বার আরেকটু সচেতন হব।
বেশ লাগল তো।
শুধু নামটা ঠিক পছন্দ হয়নি। একটু অন্যরকম দিতে পারতেন, ছবির নামগুলোর মত মিষ্টি কিছু, তাহলে লেখাটা আকর্ষণীয় হত আরও।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ধন্যবাদ।
নাম মনে হয় ভ্রমণ দিয়ে শুরু দিলেও হত, কি বলেন?
****************************************
শীতের ছুটিতে সবার কাছে শুধু ভ্রমণের গল্প। জাপান নিয়ে আগে তেমন পড়িনি , খুব ভালো লাগলো। পরের বার ভেঙ্গে ভেঙ্গে আরেকটু বিস্তারিত লিখবেন সাথে জাপানকে মিশিয়ে ?
ধন্যবাদ নিন।
সেই, জাপানের সমাজ, মানুষ, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা কতো কিছুই তো লেখার আছে, সময় করে লিখে ফেলা লাগবে।
আহা, আমারো জাপান যাবার ভারি শখ। আপনারা তো বেশ ঘুরেছেন দেখি।
কৌস্তভদা ধন্যবাদ নেন।
ঘোরাঘুরি বেশ হয়েছে অবশ্য। আগের যেসব জায়গায় গিয়েছি সেগুলো তাজা থাকতে থাকতে লিখে রাখিনি, তাই বেশির ভাগ ভোলার পথে অবশ্য।
দারুণ লেখা, সেইসাথে ছবিগুলোও।
ফারাসাত
ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করায়।
নতুন মন্তব্য করুন