অ-কবির ভুল

দীপ্ত এর ছবি
লিখেছেন দীপ্ত [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৯/০১/২০১৩ - ২:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কঙ্কার বিয়েটা হুট করে হয়ে যাবে কেউ ভাবেনি। ওর সাথে আসাদের সম্পর্ক ছিল, বন্ধুদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া কেউ জানত না সেকথা। যারা জানত তারা একথাও জানত ঝোঁকের মাথায় কিছু করে বসার মেয়ে কঙ্কা নয়। আসাদের পরিবারের অবস্থাও সেসবের পক্ষে অনুকূলে ছিল না।

তবে বন্ধুদের সবাই স্বীকার করে, বিয়ের আসরে ওর হুজুর বরের পাশে কঙ্কাকে পরীর মত লাগছিল। হুজুর নিয়ে অনেক ধরনের রসিকতা ওদের বন্ধুমহলে চালু ছিল, সেসবের অল্প কিছুই লেখার যোগ্য। কঙ্কার খুব ঘনিষ্ঠ তিন বান্ধবী ছাড়া আর কেউই অবশ্য বিয়েতে নিমন্ত্রণ পায়নি। বন্ধুরা বাদেই নিমন্ত্রিতের সংখ্যা প্রায় পাঁচশ ছুঁয়েছিল। বিয়েতে শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল শুধু শিমু আর মালিহা, পরের দিন বিয়ের জমকালো অনুষ্ঠানের কথা মুমুকে রসিয়ে বলতে ওরা ভোলে নি। কথার ফাঁকে শিমু বলেছিল- তবে যাই বলিস, ওই হুজুরের চেয়ে আসাদ ভাই কিন্তু ঢের হ্যান্ডসাম ছিল।

“কম হ্যান্ডসামে কি ক্ষতিটা হল?” মালিহা বলেছিল। “হুজুরের টাকাপয়সা, যোগ্যতা, বংশের কাছে আসাদ ভাই পাত্র হিসেবে দাঁড়াতে পারত? বিয়েতে শাণসৈকতের বহর দেখেছিস?” অভিজাত পাত্রপক্ষের প্রথম দেখাতেই কঙ্কাকে বেশ ভালো লেগেছিল। আসাদের সাথে কঙ্কার সম্পর্কের কথা তাদের জানা ছিল না। জানার উপায়ও ছিল না, কঙ্কার বন্ধুমহলেও দু’চারজনের বেশি সেসব কথা জানত না। বিয়েতে কঙ্কার মত ছিল কিনা জানা যায় নি। পরিবারে তার মতের কখনোই গুরুত্ব ছিল না। বাবার লৌহশাসনে তার মা পর্যন্ত জড়সড় হয়ে থাকতেন, কঙ্কা প্রতিবাদ করলেও তা পাত্তা পায় নি বলাই বাহুল্য।

তাছাড়া আসাদের সাথে নিজের সম্পর্কের ব্যাপারে কঙ্কা সন্দেহমুক্ত ছিল না। ছেলে হিসেবে আসাদ ভালো, বেশ ভালো। ভুলোমোনা, খেয়ালী, নিজের রাজ্যে তার বাস। কবি হওয়ার স্বপ্ন, কঙ্কার সাথে পরিচয় হওয়ার পর সে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লিখে কঙ্কার নোটের ফাঁকে গুঁজে দিয়েছে। সেসব কবিতা পড়ে কঙ্কার হৃদয়ে ঢেউ জেগেছে, একটা বয়সে কবিতা পাওয়াটা বেশ উত্তেজনার। কিন্তু হৃদয় আবেগ চেপে রাখতে না পেরে ঘনিষ্ঠ যে দুচারজনকে সে সেসব কবিতা দেখিয়েছিল, তারা অন্তত বুঝেছিল কবি হওয়া আসাদের কম্ম নয়।

তবে কবি না হলেই যে ভালবাসা যাবে না এই দিব্যি কেউ দেয়নি। এবং আসাদ কবি হিসেবে নাম কুড়াতে না পারলেও প্রেমিক হিসেবে সার্থক হতে পারত। কিন্তু কবিতা লিখতে লিখতে সে নিজেকে উদীয়মান কবি হিসেবে ভাবতে থাকে। ভাবনা পর্যন্ত থেমে থাকলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে সশরীরী কঙ্কার চেয়ে অবয়বহীন কবিতা তার কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শুধু অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকতে কঙ্কারও আপত্তি ছিল না যতদিন না কবিতা লেখার অজুহাতে আসাদ তার সাথে দেখা করা পিছিয়ে দিতে থাকে।

এ অবস্থায় প্রথমেই যা সন্দেহ করা উচিৎ কঙ্কা তাই করে। কিন্তু বন্ধুবান্ধব কোন সূত্রেই আসাদের অন্য কোন মেয়ের সাথে মেলামেশার কোন খবর পাওয়া যায় না। প্রায় এক মাস দেখাসাক্ষাৎ না হওয়ার পরে একদিন সে ঝড়ের গতিতে আসাদের হলের রুমে গিয়ে হাজির হয়। আসাদ সে সময় কি লিখছিল তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু প্রায় দু’যুগ পরে কঙ্কার সামনে সে অপরাধী ভঙ্গিতে বলে যে এক দৈনিক পত্রিকার পাঠাবার জন্য লেখা কবিতার শেষ লাইন হাতড়ে মরছিল সে। শেষ লাইনের আশায় আগের রাত থেকে ঘুমোয়নি সে। এবং কঙ্কা যখন ছেঁড়া কাগজের স্তূপ ঠেলে ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে তার সামনের কবিতার খাতা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে, ঠিক সেই মুহুর্তে আসাদ কাব্যদেবীর আশীর্বাদ খুঁজে পায়। কিন্তু কঙ্কার রুদ্রমূর্তির সামনে কবিতার শেষ লাইন তার মানসপটে দেখা দিয়েও মিলিয়ে যায় এবং মিলিয়ে যাওয়ার আগে বিদ্রূপসূচক হাসি দিয়ে যায়। ফলে সে আত্মবিস্মৃত হয়, তার কবিতা লেখার শুরুটা যে কঙ্কাকে ভালবেসেই তা তার মনে থাকে না। চোখের সামনে আশু কাব্যের এহেন করুণ পরিণতি সে মেনে নিতে পারে না এবং কঙ্কাকে কাব্যের অপমৃত্যুর জন্য দায়ী করে বসে। কঙ্কা গলা উঁচু করে কি বলে তা শুনে কাজ নেই। কিন্তু অল্পসময় পরেই কঙ্কা হনহন করে আসাদের ঘিঞ্জি, মলিন, অপরিষ্কার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এর সাতদিন পর আসাদ মিটমাট করতে কঙ্কাকে ফোন দিলে কঙ্কা শান্ত গলায় নিজের বাগদানের কথা জানায়। ছেলে বিলেত প্রবাসী, প্রভূত অর্থবিত্তের অধিকারী, পরিবার খানদানী এবং কবিতা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। আসাদ শুনে ফোন রেখে অল্প সময় শুয়ে থাকে। তার হয়তো দুঃখ লাগে। কিন্তু এই দুঃখের সুযোগ নিয়ে সে গোটা দুয়েক কবিতা নামিয়ে ফেলে।

পরের কাহিনী দ্রুত আগায়। কঙ্কার বিয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, সে আবিষ্কার করে তার “হুজুর” বরটি বেশ ভালো এবং বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটো ফুটফুটে সন্তান তার কোল আলো করে। আসাদের কথা তার মনে থাকে কিনা বলা কঠিন। কালেভদ্রে মনে পড়তে পারে। সে তো সবারই হয়, ঘুঘু ডাকা অলস দুপুরে তন্দ্রার কবলে পড়ে যখন আমাদের মনের লাগাম ঢিলে হয়ে যায় তখন। কিন্তু সেসব ভাবনা তাকে জেঁকে বসতে পারে, অন্তত তার ভাবভঙ্গিতে তাই মনে হয়। এছাড়া শ্বশুর বাড়ির একান্নবর্তী সংসার তাকে খুব বেশি অলস দুপুর উপহার দেয় না। বিয়ের পরে বান্ধবীদের সাথে বারকয়েক আসাদের কথা উঠলেও সে চুপ করে থাকে। তাই আসাদ হয়তো তলিয়ে যায়, স্মৃতিগুলো তলিয়ে যেতে যেতে হৃদয়ের গভীর তলদেশে গিয়ে জমা পড়ে।

ওদিকে আসাদের স্বপ্ন থেকে পতন হয় দ্রুত। কাব্যদেবীর ছলনায় কঙ্কাকে হারানোর পর, একই ছলনায় তার পড়াশনা-ক্যারিয়ার সব উচ্ছন্নে যেতে বসে। ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ানোই তার পরিণতিতে ছিল যদি না কবি আহমেদ শরীফের সাথে তার দেখা হত। বহু বন্ধুর সাথে দেনদরবার করে আসাদ এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে, ততদিনে তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে তাকে দিয়ে হবে। অপেক্ষা শুধু সুযোগের, শুধু সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। আহমেদ শরীফের কবিতার জ্বরে তখন দেশের ব্যথিত বা ব্যথা -পেতে-আগ্রহী প্রেমিক সমাজ পুড়ে চলেছে। সাজ্জাদ তাই কবির সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে অনুমিতভাবেই আকাশে উড়তে থাকে। তার অনাবিষ্কৃত প্রতিভা খনির সন্ধান পেয়ে কবি কেমন বিস্মিত হবেন তা ভেবে রোমাঞ্চিত হয় সে। নিজের প্রতিভা নিয়ে সবসময়ই নিঃসন্দেহ ছিল সে, জনপ্রিয় হওয়ার পরে কি করবে কল্পনা করে রাতে তার ঘুম হয়না।

আহমেদ শরীফ তার কবিতা হাতে নিয়ে এক পলক দেখে সামনের টেবিলে রেখে দেন। তারপর অন্য অতিথিদের সাথে যেমন আড্ডা দিচ্ছিলেন, তেমন দিতে থাকেন। আসাদ অধীর আগ্রহে কবির মতামত শোনার জন্য বসে থাকে, কবি যদি শুনতে চান ভেবে নিয়ে আসা শখানেক কবিতার বাণ্ডিলে হাত বুলায়। পনের মিনিট পরে ভেতরের ঘরে যাওয়ার সময় আহমেদ শরীফ আসাদকে প্রথমবারের মত খেয়াল করেন। আসাদের প্রশ্নসূচক ভঙ্গি দেখেই হয়তো তিনি বুঝতে পারেন কিছু না বললে এই পাগলের দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। বলেন- কবিতার ছন্দ কতো প্রকার, জানো? আসাদ ভ্যবাচেকা খায়। আহমেদ শরীফ মুখে মুচকি হাসি রেখে বলেন- জেনে আবার এসো।

এই ঘটনায় আসাদ বড় আকারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই আঘাতের রেশ কাটিয়ে উঠতে তার দুই বছর লেগে যায়। পরের বার যখন সে কবিতা লেখে তখন তা পেটের দায়ে, এক স্থানীয় পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কলাম ভরাবার দায়িত্ব নিয়েছে সে। ততদিনে সে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে, কবি হওয়ার খায়েশ ঝেড়ে ফেলে পেয়ে দুনিয়াবি কাজে মন লাগিয়েছে। কাব্যদেবীর ছলনা থেকে মুক্তি পাওয়ায় লক্ষ্মীর করুণা অল্প অল্প ফিরে আসছে।

আসাদের সংসার নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। কারণ আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে তার এতো বেশি মিল যে, মধ্যবিত্ত পরিবারের মডেল হিসেবে পাঠপুস্তকে ঠাই পেলেও আমাদের অবাক লাগত না। বউ হিসেবে যাকে সে পেয়েছে সে সংসারী, রেগে গেলে কঙ্কার মত হুলুস্থুল করে না এবং আসাদের উদাসীনতা নিয়ে অধিক উদাসীন। আসাদের কবিতা নিয়ে তার খুব উৎসাহ দেখা যায় না, তাকে নিয়ে আসাদ কখনো কবিতাও লেখেনি। লেখেনি নাকি লিখতে পারেনি তা আমরা জানি না, শুধু জানি কঙ্কার কথা চিন্তা করে আসাদ এখন আর আফসোস করে না। বয়সের ভারে ভালোবাসাকে সে নতুন চোখে দেখতে শিখেছে। প্রেয়সীর কপোলের তিলে ভালোবাসা আবিষ্কারের দিন নেই আর। বরং রাতে বাড়ি ফিরে টেবিলে জালি দিয়ে ঢেকে রাখা ঠান্ডা খাবারের মধ্যে এখন ভালোবাসা খুঁজে পায় সে। মাঝেমাঝে এই উত্থান-পতনহীন সম্পর্ককে, বিয়ে নামক এই চুক্তিকে বোঝা মনে হয় তার। কিন্তু এর ভারে এতো বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে, যে অভ্যাসের দায়ে একে নামিয়ে রাখতেও ইচ্ছা করে না। ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতার ঝাপসা সীমারেখার কোন পাশে নিজের অবস্থান তা না জেনেই দিন কাটতে থাকে তার, ধীর-মন্থর গতিতে।

কঙ্কার দিনও সেভাবেই কেটে যেতো হয়তো। কারণ ভালোবাসা নিষিদ্ধ আমাদের এ সমাজে ভালবেসে সমাজের চোখরাঙানি সহ্য করার চেয়ে সমাজস্বীকৃত ভাল-না-বাসার বন্ধনে জড়িয়ে থাকাটাই নিরাপদ। কঙ্কা অসুখী ছিল না, কিন্তু অসুখী না থাকা কি সুখী থাকা কিনা তা আমরা এখনও ঠিক করে বুঝে উঠতে পারিনি। সেই সুখ-অসুখের মাঝমাঝি বয়ে চলা এক দিনে কঙ্কার স্বামী পরপারে রওনা হন কোন পূর্বাভাস না দিয়ে।

এর পরে আমরা দুই বছর এগিয়ে গিয়ে সেই দিনটা দেখব যেদিন কঙ্কার সকাল শুরু হবে খুব সাধারণভাবে এবং দুপুর নাগাদ কোনরূপ পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই সে আসাদকে ফোন করবে বহুদিন আগের নাম্বারে। এই দুই বছর আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না। স্বামী মৃত্যুর শোকোচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে আসলে কঙ্কা দেখতে পায় যে বিরাট সংসারে সে আসলে একা এবং এককালে মানুষের আসা-যাওয়ায় তিল ধারণের জায়গা না থাকা ঘরগুলো গড়ের মাঠের মত খাঁখাঁ করছে। তার দু ছেলেমেয়ে পড়াশোনার খাতিরে আগেই বিলেতে পাড়ি জমিয়েছে, ননদ-দেবরেরা নিজ নিজ সংসারে থিতু হয়েছে, শ্বশুর-শাশুড়ি গত হয়েছেন বছর দুয়েক। বাপের বাড়ীর সাথে সংযোগ ছিন্ন হয়েছে বহুদিন, বন্ধুরা কে কোথায় ছিটিয়ে পড়েছে অজানা। এতো বড় বাড়ির শূন্য শূন্য বিকটাকায় ঘরগুলো যেন তার শ্বাস বন্ধ করে নিয়ে আসে।

এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠেই একদিন অন্যমনস্ক হয়ে সে বহু বছর আগে স্মৃতি থেকে জোর করে মুছে ফেলা এক নাম্বার ডায়াল করে এবং তড়িঘড়ি করে কেটে দেয়ার আগে ওপাশে আসাদের গলা শুনতে পায়।

আসাদের গলা শুনে কেটে দেয়াটাই হত সমীচীন, কারণ পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক বিধবার সুপ্রাচীনকালের ভালোবাসার কথা স্মরণে আসা খুবই অসংগত কাজ এবং স্থবির এ সমাজের স্থিতিশীলতার অন্তরায়। যে সমাজ নবীন তরুণের ভালোবাসা দেখে ভ্রূ কুঁচকায়, সে বিধবার অনাকাঙ্খিত স্মৃতিচারণকে ভালো চোখে দেখবে না এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কঙ্কা লাইন কাটে না, দীর্ঘ দুই মিনিট চুপ করে থাকার পরে সে বলে, হ্যালো?

আসাদ দীর্ঘদিন পরে এক অতিপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে বিস্মিত হয়। এবং বিস্ময় তার বাড়ে যখন সে অনেকদিন পরে নিজের হৃদপিণ্ডের ধুকধুক শব্দ শুনতে পায়। প্রায় দুই যুগ পরে এই ধুকপুকানি তাকে পুরোন সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় যা থেকে সে এতকাল পালিয়ে এসেছে, সে কি কঙ্কাকে কখনই ভুলতে পারবে না? এবং প্রথমবার সে উপলব্ধি করে যে স্মৃতিকে হৃদয়ের তলায় পাথর চাপা দিলেই তা ধূসর হয়ে যায় না।

পরের শনিবার তাদের দেখা হয়। প্রথমবার ফোনে কথা বলেই দেখা করাটা তাদের কৈশোরসুলভ মনে হয় নি। বরং ফোনে কথা বলার চেয়ে সরাসরি দেখা করাটাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয় তাদের কাছে। আসাদের অতীত নিয়ে তার স্ত্রী কখনই আগ্রহ দেখায়নি। বিয়ের অল্প ক’দিন পরেই সে আবিষ্কার করে তার স্বামী ভালবেসে হৃদয় খুলে দিতে অক্ষম। আসাদের আপনভোলা চরিত্রের আত্মকেন্দ্রিক দিকটা তার অজানা ছিল না। তাই হৃদয়ের যেসব প্রকোষ্ঠে অষ্টপ্রহর কড়া নাড়লেও ভিতরে উঁকি দেয়া অসম্ভব, সেসব ঘরে কড়া নাড়ার আগ্রহ তার অল্প দিনেই চলে গিয়েছিল। তাই কঙ্কার সাথে দেখা করতে আসাদ যখন বের তখন সে কিছু জিগ্যেস করে না। উল্টো তাকে কিছু না বলে কঙ্কার সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় আসাদ অকারণ অপরাধবোধে ভোগে।

কঙ্কার সেদিক থেকে কোন পিছুটান ছিল না। কিন্তু মানুষকে গল্পের খোরাক যোগানোর চেয়ে বোরকার আড়ালে যাওয়াটাই তার যথাযথ মনে হয়। ব্যস্ত মূল সড়ক থেকে ডানদিকের গলিটাতে সামান্য এগোলে যে ছিমছাম কফির দোকান, সেখানে বোরকা পরিহিতা কঙ্কাকে চিনতে আসাদের পাঁচ সেকেন্ডের বেশি লাগে না। রাস্তার দিকে মুখ করা এক ছোট্ট টেবিলে তারা বসে।

দু’জনে বসে থাকে চুপচাপ অনেকক্ষণ, অনেকটা সময়। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুকের শব্দ ছাড়া আর শব্দ পাওয়া যায় না। তারপর কঙ্কা ধীরে ধীরে তার কাহিনী বলে- স্বামীর কথা, সংসারের কথা, ভালোবাসা আর প্রাত্যাহিকতার পার্থক্য করতে না পেরে কাটিয়ে দেয়া জীবনের কথা। আসাদ শুনে যায়, শোনার ভান করে। কথার মাঝে যে ক’বার তার চোখ কঙ্কার দিকে যায়, ততবার সে তড়িতাহত হয়। শেষ কবে তার হৃদয়ে এতো ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকেছে, সে মনে করার চেষ্টা করে। তার মত মধ্যবয়সী লোকের পক্ষে এই অনুভূতি স্বীকার করার মত বিড়ম্বনা আর নেই, কিন্তু নিজেকে ফাঁকি দিয়ে দুই যুগ কাটিয়ে দেয়ার পর নিজের থেকে ঝাপসা করে রাখা সত্যটা সে স্পষ্ট দেখতে পায়- সে কঙ্কাকে ভালবেসেছিল একসময়, তারপরে ভালবাসেনি আর কাউকেই।

সে সন্ধ্যায় আসাদ আর কঙ্কা মাঝখানের দুযুগের না বলা সব কথা বলে ফেলে- তার কিছুটা ভাষায়, বেশিটা নীরবতায়। শুধু কবিতা লেখা নিয়ে কোন কথা হয় না। প্রায় দু’যুগ আগে স্রেফ কবিতাকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে কঙ্কার সাথে তার শেষ ঝগড়া হয়েছিল একথা ভেবে আসাদের অদ্ভুত লাগে। বিদায় নেবার সময় কঙ্কা আসাদের চোখে সেই পুরোন জ্যোতি দেখতে পায়, বহুদিন আগের বিস্মৃত এক সময়ে ভালোবাসা, অভিমান, প্রেম, স্বপ্ন মিলে আসাদের চোখে যে আলো খেলা করত তার জ্যোতি। তারও অবাক লাগে- সেদিনের ঝগড়ার পর প্রথমবারের মত আত্মাভিমানী আসাদের জন্য মায়া হয় তার, মায়ার সাথে হয়তো অল্প দুঃখ জড়িয়ে থাকে।

বাসায় ফিরে বহুদিন পর আসাদ কবিতা লিখতে বসে। অনেক দিন পরে পত্রিকাওয়ালাদের তাগিদে না, মাস-চালানোর বাড়তি ক’টা টাকার চিন্তায়ও না, শুধু মনে তাগিদে। সে ভোর পর্যন্ত লেখে। ভোরের নরম কুয়াশা ভেদ করে দু’একটা সূর্যরশ্মি যখন তার ঘরে ঢোকার পথ করে নেয়, তখন ঘুমন্ত বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার অবসন্ন মস্তিষ্কে দুটো ভাবনা আসে। সে বুঝতে পারে, এই একরাতে ঝড়ের গতিতে লিখে ফেলা কবিতাগুলো জীবিকার প্রয়োজনে এযাবৎকাল লিখে আসা সব কবিতার চেয়ে তাকে প্রশান্তি দিয়েছে বেশি। কবিতার ছন্দমাত্রা জ্ঞান এখনও তার শূন্যের কোঠায়, কিন্তু মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা বলে কিছু থাকলে সে কবিতা লিখতে চাইবে। এটুকু বুঝে ওঠার পর দ্বিতীয় উপলব্ধিটা তাকে শিহরিত করে। সে বুঝতে পারে, কঙ্কার সাথে ছাড়াছাড়ির পরের বিক্ষুব্ধ সময়টা কবিতা নিয়ে পড়ে থেকে সে যে সান্ত্বনা খুঁজেছিল তা ছিল নিজেকে ফাঁকি দেয়া। কঙ্কা আর কবিতা অবিচ্ছেদ্য, কঙ্কাকে ছাড়া লেখা গত দুযুগের কবিতাগুলো তার কাছে বৃথা সময়ের অপচয় মনে হয়। জীবনের শেষের শুরুতে দাঁড়িয়ে একদিকে বাঁধাধরা জীবনের সুনিশ্চিত হাতছানি আর অন্যদিকে শুধু একটিবার সমাজ-সংসারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার দুঃসাহস- এ’দুয়ের মাঝে পড়ে আসাদ ভেঙে চুরমার হতে থাকে। তারপর একটা সময় সে বুঝে ফেলে কী করতে হবে।

এর সাতদিন পরে আসাদের সাথে কঙ্কার দেখা হয়, একই জায়গায়। সেদিন আসাদ শুধু বলে, কঙ্কা শোনে। শুনে যায়।

তারও এক সপ্তাহ পরে আসাদের নামে পার্সেল আসে। প্রেরকের নাম-ঠিকানাবিহীন পার্সেলটা খুলে আসাদ সারি সারি লম্বা খাম খুঁজে পায়। একটা খাম তুলে নেয় সে। ওপরে লেখা- ১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই। সাবধানে খাম খুলে ভেতরে বহু পুরোন লালচে হয়ে যাওয়া পত্রিকার কটা কাটিং খুঁজে পায় সে। কাটিংগুলো পড়তে শুরু করলে প্রেরক কে তা নিয়ে তার সন্দেহ থাকে না।

গত বিশ বছরে বিভিন্ন সময়ে আসাদ যেসব কবিতা লিখেছে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকা, সাময়িকী বা ত্রৈমাসিকে তার প্রত্যেকটার খবর কঙ্কা কি করে পেল তা নিয়ে সে বিস্মিত হয়। কঙ্কার সাথে কবিতা নিয়ে দু’যুগ আগের সেই ঘটনার পর সে নিজেও পত্রিকায় ছাপা হওয়া নিজের লেখা পড়ে দেখেনি, কাটিং জমানো দূরে থাক। মোট প্রকাশিত কবিতা পাঁচশ ছাড়িয়ে গেলেও দেশের কবিসমাজে তার নামডাক নেই, কাব্য প্রতিভাহীন তাকে চিনে নিতে কবি আহমেদ শরীফ ভুল করেন নি। তাই কেউ একজন যত্ন করে তার সব কবিতা আগলে রাখছে, এবং সেই একজন কঙ্কা- একথা ভুলেও চিন্তা করেনি আসাদ। কিন্তু খামের নিচে কঙ্কার মোটা মোটা অক্ষরে লেখা পাঁচ বাক্যের চিঠি পেয়ে সে নিঃসন্দেহ হয়।

গতদিন তুমি যা বলেছ তা ভুলে যাও আসাদ। সমাজ নিয়ে আমি ভাবি না, জীবন থেকে যদি একটা শিক্ষা পাই, তা হল সমাজকে আঁকড়ে ধরার চেয়ে হৃদয়কে আঁকড়ে ধরা শ্রেয়। কিন্তু ভয় করি, দুযুগ আগে যে কবিতা নেশার ডাক শুনে তুমি আমাকে ফিরিয়েছিলে, দুযুগ পরে সেই একই নেশায় ভুলে তুমি এতদিনের সংসারকে তুচ্ছ করছ না তো? কবিতার চেয়ে মানুষের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিও।
আমার সাথে আর যোগাযোগ করো না, আমাদের যোগাযোগ না হওয়াই ভালো।
কঙ্কা।

আসাদ চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে, বহুক্ষণ। তারপর সবকিছু গুছিয়ে রেখে বউকে ডাক দেয়, একটু এদিকে শুনবে? তার কিছুটা লজ্জা হয়, তারপরও বিয়ের বিশ বছরে যা সে বলেনি কোনদিন তা বলে ফেলে- একটা কবিতা লিখেছিলাম। শুনবে?


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

ছেলেদের হলের রুমে কি মেয়েরা এইভাবে হানা দিতে পারে?

অবশ্য মিজানের কথা আলাদা।

দীপ্ত এর ছবি

পারে না হিমু ভাই। যারা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন তারা যে গল্পে কতো অসংগতি খুঁজে পাবেন ভেবে লজ্জা বোধ করছি।
আপনি মন্তব্য করেছেন, অনেক প্রেরণা পেলাম।

আলতাইর এর ছবি

এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম। অতি উত্তম!!!

দীপ্ত এর ছবি

প্রশংসায় আনন্দিত হলাম। হাসি
ভুলভাল যা আছে তা শুধরে আরও ভালো গল্প উপহার দিতে চাই।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

প্লটটা ভালোই ছিল। কিন্তু চরিত্রগুলো কেমন যেন নির্জীব। কিছু জিনিষ গল্পে কোন কিছু সংযোজন করেনি। যেমন কঙ্কার স্বামীর হুজুর হওয়ার বিষয়টি। তার হুজুর হওয়ার তথ্যটি কি কোন গুরুত্ব বহন করে? এখানে সে ব্যবসায়ী হলে কি চরিত্রটার আচরণ বা কার্যকলাপ বদলে যেত? যে তথ্য বা বর্ণনা গল্পে কিছু যোগ করে না তার কোন প্রয়োজন আছে কি? শুভকামনা। লিখে যান।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

একজাক্টলি! প্লটটা ভালো। কিন্তু গল্পটা বর্ণনা (ডেসক্রিপশন) হয়েছে মূলতঃ, গল্প (ন্যারেটিভ) হয়ে উঠতে পারেনি। এটা দেখতে পারেন: http://joanwz.hubpages.com/hub/Descriptive-vs-Narrative-Essays

দীপ্ত এর ছবি

লিঙ্কটা পড়ে শিখলাম অনেক কিছু মুর্শেদ ভাই। গল্পে যে অনেক ফাঁকফোকর আছে তাও দেখতে পাচ্ছি। এমন অনেক কিছুই কাটছাঁট করা যেত যা গল্পের সাথে বেমানান।
পাঠে, মন্তব্যে, লিঙ্কে অনেক ধন্যবাদ।

দীপ্ত এর ছবি

পাঠে এবং মন্তব্যে ধন্যবাদ।
হুজুর এই গল্পে আলাদা তাৎপর্য বহন করে না, বাদ দিলেও চলত। চরিত্রগুলোও আরেকটু খোলতাই করা দরকার ছিল, কিন্তু তাড়াহুড়ার জন্যেই হয়তো সেদিকে নজর দেয়া হয়নি।

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক। হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বড় বড় অসঙ্গতি আছে। সেগুলো নিয়ে হয়তো বলা যেতো। তবে আমি চাই আপনি নিজেই সেগুলো খুঁজে বার করুন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দীপ্ত এর ছবি

কত যে ভুল। উপরের হিমু ভাই, মুর্শেদ ভাই, রাজীব মাহমুদ ভাই বলে দিয়েছেন। নিজেও কিছু খুঁজে বের করেছি- কোন কোন জায়গায় বর্ণনার আধিক্য, বিশ্লেষণের দাবি রাখে এমন জায়গা এক বাক্যে শেষ করে ফেলা... পরের গল্পগুলো আশা করি কিছু শুধরাতে পারব।
পাঠে ধন্যবাদ নেবেন।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

গল্পের প্লট ভালোই। কিন্তু পড়তে গিয়ে টানল না। লিখতে থাকুন। হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

দীপ্ত এর ছবি

পরেরবার আরেকটু ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা থাকবে। ধন্যবাদ। হাসি

তিথীডোর এর ছবি

প্লটটা ভালই ছিল।
গল্পটাও আরো ভাল হতে পারত।

আরো লিখুন। নিয়মিত। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

দীপ্ত এর ছবি

প্লটে এবং গল্প দুটোই পরেরবার ভালো করার চেষ্টা করব।
পাঠে ধন্যবাদ। হাসি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

আপনার গল্প লেখার হাত বেশ ভাল, প্লটটাও বেশ ভাল। কাহিনীবিন্যাসে কিছু লজিক্যাল অসঙ্গতি আছে যেটা চাইলেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন। তারপরেও আমার বেশ ভাল লেগেছে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

দীপ্ত এর ছবি

ভালো লাগা জানানোতে অনেক ধন্যবাদ। হাসি
ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নিতে পারব আশা রাখি।

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশি সেরা!

আমি বেশি মিল খুজে পাইসি!

আমি খুবই খুশি! ^_^

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পের থিম টা ভাল। আরও সময় দিলে অনেক সুন্দর হত। ধন্যবাদ।

>> সুরথ সরকার।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।