আমজাদ মিয়ার দোকানের সামনে দাঁড়ায়ে থাকার বিষয়টা প্রথম নজরে আসে নিয়মিত কাস্টমার আনোয়ার ব্যাপারীর। আনোয়ার ব্যাপারীর এলাকায় তিনতলা বাড়ি আছে, চারতলা ওঠাতে রাজউকের সাথে তার বোঝাপড়া চলছে। সন্ধ্যায় নামাজের পরে নবাব আলির দোকানে চায়ের কাপে এনার্জি বিস্কুট ডুবাতে ডুবাতে সে বিড়বিড় করে বলে, “পাগল দেখছি, মাগার এমুন পাগল পত্থম দ্যাখলাম।” আশেপাশের সবাই তা শুনতে পায়, তাদের না শোনানো তার উদ্দেশ্য ছিল না। সেদিন চায়ের দোকানের সবাই এবং অল্প কদিনের মধ্যে পুরো মহল্লায় আমজাদ মিয়ার পাগলামির কথা চাউড় হয়ে পড়ে।
পরের কয়েকদিন পাড়ার মানুষকে শহিদুলের দোকানের সামনে ভিড় করতে দেখা যায়। তারা হালকা বাদামি রঙের চেক শার্ট আর বহু ব্যবহারে জীর্ণ লুঙ্গি পরা আমজাদ মিয়াকে প্রতিদিন সকাল থেকে শহিদুলের দোকানের সামনে দাঁড়ায়ে থাকতে দেখে। তারা আরও খেয়াল করে, চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষকে বা তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জীবনস্রোতকে আমজাদ মিয়া খুব একটা আমলে নেয় না। আনোয়ার ব্যাপারীর বড় ছেলে শাহাদাত প্রথম আবিষ্কার করে যে আমজাদ মিয়া দিনের বেশির ভাগ সময় শহিদুলের দোকানের কাচের দরজায় ঝোলানো ফিল্মের হিরোইন কনকবালার পোস্টারের দিকে তাকায়ে থাকে। সে তার হোন্ডা নিয়ে গার্লস কলেজের সামনে গিয়ে বন্ধুদের সাথে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে বলে, “পাগল না হালায়, হিরুইনের লাইগা বেচঈন হইছে।” বলে খিকখিক করে হাসে। এই কথা পাড়ায় রটে যেতে সময় লাগে না। পাড়ার মানুষ এইবার আমজাদ মিয়াকে জ্বালাতনের একটা উপায় খুঁজে পায়। তারা বলে “কি মিয়া, পুস্টারের দিকে চায়া রইছ যে? হিরুইনেরে মনে ধরছে?” আমজাদ মিয়া বোকা বোকা হাসি দিয়ে চোখ ফিরায় নেয়, কিছু বলে না। কিন্তু মানুষের আগ্রহ অসীম, তারা কনকবালাকে নিয়ে টিপ্পনি কেটে আমজাদ মিয়াকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
একদিন শহিদুল তাকে পাকাড়াও করে। বলে, “আইজকা কইতেই হইব তুমি রোজ পুস্টারের দিকে তাকায় থাকো ক্যান।” আমজাদ মিয়া নিঃশব্দে নিচে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে মাটি খুড়ে। এই বেটেখাটো, বেখাপ্পা, অবয়বহীন মানুষটাকে দেখে হয়তো শহিদুলের কিছুটা মমতা হয়। তাই সে নরম স্বরে জিগ্যেস করে, বাড়িতে পরিবার নাই? আমজাদ মিয়া মাথা নাড়ায়। ইস্ত্রি, পুলাপান কেউ নাই? শহিদুল অবাক হয়।
-বউ আছিল।
-আছিল মানে, মইরা গেছে?
-জানি না।
আমজাদ মিয়া চুপ করে থাকে। জানি নার পরেও শহিদুলের আরও কথা জিগ্যেস করার থাকে, কিন্তু আমজাদ মিয়ার ভাবভঙ্গির কোথাও একটা বিষণ্ণতা জড়ান আছে বলে তার মনে হয়। তাই সে ওদিকে আর কথা বাড়ায় না। সে বলে, তুমার দ্যাশ কুনহানে? আমজাদ মিয়া বলে, উইদিকে। বলে কোন অনির্দিষ্ট দিক নির্দেশ করে। ওইদিন দুপুরে দোকানে টিফিন বাটি খুলে শহিদুল আমজাদ মিয়াকে ডেকে বসায়। আমজাদ মিয়া খাওয়ার সময় নিঃশব্দ থাকে কিন্তু প্লেট থেকে শেষ বিন্দু ভাত তাকে আগ্রহ নিয়ে খেতে দেখা যায়।
খাওয়া শেষে শহিদুল একটা বিড়ি আগায়ে দেয়। কিন্তু আমজাদ মিয়া নেয় না, শহিদুলও বেশি সাধাসাধি করে না। গ্রীষ্মের খরখরে রোদের ঝিমমারা দুপুরে তাদের মধ্যে যে নীরবতা বিরাজ করে তা দেখলে মনে হয় দুজনেই কোন গভীর দার্শনিক চিন্তায় মগ্ন। আসলে তারা যা ভাবে তাকে মোটাদাগে স্থূলই বলা চলে। শহিদুল ভাবে কাশেমের দোকানের মত দশ টাকার রিচার্জে এক টাকা বাড়ায়ে রাখলে কেমন হয়, আর আমজাদ মিয়া হয়তো সেই বিকালের কথা ভাবে যখন পরিবানু সাদা মাইক্রোতে ওঠার আগমুহূর্তে তাকে বলে, “তিন মাসের মইদ্যেই ফিইরা আসুম, আমনে চিন্তা কইরেন না” এবং আমজাদ মিয়ার নিজেকে প্রথমবারের মত অসহায় মনে হয়। মির্জাবাড়িতে দেনা বাবদ কত টাকা বাকি পড়ে ছিল তার মনে পড়ে না কিন্তু তরফদার মির্জার হিসাবে গরমিল হয় না। শেষমেশ দেনার দায়ে যখন ভিটেটাও হাতছাড়া হতে চায়, তখন তার বউ সেতু গোয়ালার মেয়ে পরিবানু শহরে গিয়ে কাজের কথা তোলে। বউকে শহরে পাঠাতে তার মোটেও সায় ছিল না, সারাদিন মাঠে খেটে ঘরে ফিরে বউয়ের মুখ না দেখলে তার মন আনচান করে। তার উপরে শহরে মেয়েছেলেদের হাজারো বিপদের কথা রফিক মৌলানার মুখে শুনে শুনে তার অজানা নেই। তার বুক দুরুদুরু করে, দাওয়ায় বসে কয়েকরাত তার নির্ঘুম কাটে।
পরিবানু নিজেও শহরে যেতে আগ্রহী ছিল না। যদিও বিয়ের আগে শহরের স্বপ্ন সে দেখত বটে। তার গ্রামে বড়মিয়ার বাড়িতে ঈদে-পূজায় আত্মীয়রা আসত। শহরের সেসব সুন্দর সুন্দর মানুষ, তাদের সাদা ধবধবে মাইক্রোগাড়ি, ইস্ত্রি করা জামাকাপড় দেখে শহরের সুপুরুষ কোন রাজপুত্রের স্বপ্ন তার মনে জেগেছিল এককালে। কিন্তু সেসব স্বপ্ন পাখা মেলার আগেই আমজাদ মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়। মানুষটাকে তার অপছন্দ হয়নি। সরল সোজা, ভেতরে প্যাঁচঘোঁচ নেই, সারাদিন মোষের মত জোন দেয়, রাতে অঘোরে ঘুমায়, মর্জি ভালো থাকলে খোশগল্পও করে। দুএকবার যে পরিবানুর গায়ে হাত তোলেনি তা না। কিন্তু পুরুষ মানুষের অন্যান্য যেসব বদাভ্যাস থাকে, সেসব নেই। সব মিলে বিয়ের পরে সে অখুশি ছিল না।
এসময়ে গ্রামে নারী উন্নয়ন সংস্থার তিন-চারজন লোক আসে। তিনদিন পরে স্কুলের কাছারিঘরে শহরে কাজ করে গ্রামের বউরা কীভাবে সংসারের ভাগ্য ফিরাচ্ছে সেসবের সচিত্র বর্ণনা দেখে পরিবানু এবং টিপসইএর কাগজ হাতে নিয়ে ঘরে ফেরে। সেদিনই সে আমজাদ মিয়ার কাছে শহরে যাওয়ার কথা তোলে। আমজাদ মিয়া গুম মেরে থাকে। কিন্তু বর্গার এমন আকালের যুগে দুদিন বাদে ভিটেমাটি হারানোর ভয়ে পরিবানুকে সে সরাসরি না করতে পারে না। উন্নয়ন সংস্থার লোকেরা পরিবানুকে তিন মাসের মধ্যে গ্রামে ফেরত দিয়ে যাবে বলে তাকে আশ্বস্ত করে। সপ্তাহান্তেই পরিবানুসহ গ্রামের আরও দুজন মহিলাকে নিয়ে সাদা মাইক্রোতে করে তারা শহরের দিকে রওনা দেয়। পাকা রাস্তায় ওঠার আগ পর্যন্ত ছেলেপুলের দল আধো-ঝুলন্ত অবস্থায় মাইক্রোর পেছনে দৌড়তে থাকে।
কদিন পরে নারী উন্নয়ন সংস্থার পাঁচজনকে নারীপাচারের দায়ে আটক করে পুলিশ। সুদূর ঢাকা থেকে এই খবরের বুদ্বুদ আমদাজ মিয়া পর্যন্ত পৌঁছায় না।
পরিবানু চলে যাওয়ার পরে একটা বর্ষা পার হয়, শরতের শুরুতে আমজাদ মিয়া রফিক মৌলানার ক্ষেতে জোন দেয়ার কাজ পায়। তিন মাসের হিসাব সে রাখতে পারে না, কিন্তু তার মনে হতে থাকে পরিবানু যেন এক বছর হল নাই। তার অস্থির লাগে, পরিবানুর সাথে শহরে যাওয়া বাকি দুজনের বাড়ি খোঁজ করেও বাড়তি কোন খবর সে পায় না। রফিক মৌলানা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, “কামডা ভাল করলি না। বিবিরে শহরে পাঠাইছস রোজগারের লাইগা। জোয়ান মরদ তুই একখান, তোর শরম করে না?” আমজাদ মিয়া এসময় চুপ করে থাকে। দেনা শোধ করার জন্যে মৌলানার কাছে হাত পেতেও এক পয়সা জোটেনি এ কথা সে ভুলে যায় অথবা বলতে তার সাহস হয় না। সে ঘাড় নিচু করে বলে, শহরে যামু মৌলানা সাব, আমারে কয়েকডা দিন ছুটি দ্যান। মৌলানা বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে ফেলে, তারপর বলে, “বউয়ের ইনকাম খাওনের হাউশ হইছিল, না? এহন মজাডা বুইঝা দ্যাখ। তোর বউরে দ্যাখগা কই না কই বেইচা দিছে” বলে মিসওয়াকের ডাল হাতে নিয়ে মসজিদের পেছনে চলে যায়।
বাস থেকে নেমে আমজাদ মিয়ার তালগোল পাকায়ে যায়। বিরাট বিরাট দালান আর দুপাশ দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলা হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে এই শহরে পরিবানুকে খুঁজে পাওয়া কতটা অসম্ভব তাও সে বুঝে ওঠে না। টার্মিনাল থেকে বেরনোর পথে সে হাঁটা ধরে, আধা ঘণ্টা হেঁটে সে নিজেকে একই কাউন্টারের সামনে আবিষ্কার করে। কাউন্টারে বসে থাকা মন্তাজ আলী এ দৃশ্য দেখে মোটেও অনভ্যস্ত নয়, এই আধা-ভ্যাবলা লোক এখানে বেশিদিন টিকবে না তাও তার জানা। তবু অভ্যাসবশত জিগ্যেস করে, আপনে কনে যাবেন? আমজাদ মিয়া সবকিছু শুরু থেকে গুছিয়ে বলতে গিয়ে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে, ফলে সে কিছুই বলে না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মন্তাজ আলীও বেশি কিছু না বলে সামনের দাগটানা রেজিস্ট্রি খাতায় মনোযোগ দেয়।
সন্ধ্যার একটু পরে কাউন্টার বন্ধ করে উঠতে গিয়ে মন্তাজ আলী দেখে লোকটা দুই কাউন্টারের মাঝের চিপায় ঠায় দাঁড়ায়ে আছে। তার কৌতূহল হয়, কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে- ওই মিয়া দুপুর থেইকা দেখতাছি এক জায়গায় খাড়ায়া রইছো। যাবা কই? কার লগে আইছ এইহানে? এ প্রশ্নের উত্তরে আমজাদ মিয়া ভাসাভাসাভাবে কিছু বলে। তাতে মন্তাজ আলীর বিস্ময় বাড়ে, বউ খুঁজবার লাইগা ঢাকা আইছ, পাগল নাহি? আমজাদ মিয়াকে কাউন্টারে ফেলে যেতে তার হয়তো মায়া লাগে। তাই পুরনো টিকাটুলি বাজার পেরিয়ে হাতের বায়ের মায়ের দোয়া মেসে আমজাদ মিয়ার ঠাঁই জোটে।
মন্তাজ আলী আমজাদ মিয়াকে প্রথমে চোখে চোখে রাখে। তবে দু’দিনেই সে বোঝে, লোকটা সরল, নির্ঝঞ্ঝাট, কথা বলে কালেভদ্রে, মোটা দাগে নির্বোধ প্রকৃতির। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়, সারাদিন কোথায় কোথায় কাটায়, রাতে ফিরে আসে। খেতে দিলে খায়, না দিলে শুয়ে পড়ে। মন্তাজ আলী কালেভদ্রে পান করে, সেসময় তার গল্প করার বাতিক চাপে। আমজাদ মিয়াকে সামনে বসিয়ে রেখে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে অনর্গল বকতে থাকে।
প্রতিদিন সকালে আমজাদ মিয়া বেড়িয়ে পড়ে পরিবানুর খোঁজে। এক মাসের মাথায় তার মনে হয় শহরের কোন অলিগলি সে বাদ রাখেনি। অথচ বাস্তবে সে আটকে থাকে মন্তাজ আলীর মেস থেকে দু’চার গলির মধ্যে। সারা বছর বৃষ্টির পানিতে প্যাকপেকে কাঁদা জমে থাকা এই পুরো মহল্লাটা তার কাছে গোলকধাঁধাঁর মত লাগে। এর মানুষগুলো অদ্ভুত, দালানগুলো ছিরিছাঁদহীন, সামনের দিকে ঝুঁকে এসে রাস্তার অনেকটা খেয়ে ফেলেছে, ছাদ থেকে রড বেরিয়ে আছে জায়গায় জায়গায় বেখাপ্পাভাবে। মানুষ, রাস্তা দুইই তার কাছে ঘোলাটে ঠেকে, তার মনে হয় সবকিছু একই ছাঁচে ফেলে বানানো হয়েছে। সে এই অলিগলি থেকে বের হতে চায়, যদিও তার লেজ বা মুড়ো কোনটার হদিসই সে পায় না। মাসখানেক পরে মন্তাজ আলী যখন তাকে জিগ্যেস করে, কি মিয়া, বিবির কোন খোঁজ পাইলা? তখন সে নিরুত্তর হয়ে সিলিং এর দিকে তাকায়ে থাকে।
একদিন শহিদুলের দোকানের সামনে আমজাদ মিয়া একটা পোস্টার দেখে। সেখানে সে থামে, দাঁড়ায়, তারপর প্রতিদিন নিয়মিত দাঁড়াতে থাকে। বেশ কিছুদিন পরে পাড়ার লোকের মুখ ঘুরে মন্তাজ আলীর কানে এই খবর পৌঁছায়। সে রুষ্ট গলায় বলে, খোয়াব দ্যাহ নাহি মিয়া? কনকবালার লগে শাদির খোয়াব দেখ? এলাকার মাইনসে তোমারে লয়া কীসব কইতাছে হুঁশ আছে? আমজাদ মিয়া তখন পোস্টারের মেয়ের নাম জানতে পারে। সে সংক্ষেপে বলে, পরিবানুর বড় হাউশ আছিল। মন্তাজ আলী বুঝে উঠতে পারে না। বলে, কিয়ের হাউশ? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনে যেটুকু সে উদ্ধার করে তা হল- বিয়ের পর পরিবানু আমজাদ মিয়ার কাছে বায়স্কোপ দেখার আবাদার করে। বায়স্কোপ দেখার সাধ বা সাধ্য কোনটাই আমজাদ মিয়ার ছিল না। কিন্তু সদ্য বিয়ে করা বউয়ের আবদার সে ফেলতে পারে না। তাই গ্রাম থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরের বৈশাখী মেলায় বায়স্কোপ দল আসবে শুনে সে বউকে সাথে নিয়ে যায়। পরিবানু মেলায় যা দেখে তাতেই অবাক হয়, সে ঘোমটাটা আরেকটু টেনে দিয়ে স্বামীর হাত শক্ত করে জড়িয়ে মেলায় হাঁটতে থাকে, আমজাদ মিয়ারও সুখী সুখী লাগে। তবে বায়স্কোপের টিকেটের দাম দশ টাকা শুনে সে দমে যায়। পরিবানুকে বলে, বেলা পইড়া আইতেছে, লও যাই। কিন্তু পরিবানুর চোখ বায়স্কোপের বাইরের বিশাল এক পোস্টারে আটকে যায়। পোস্টারের ছবি তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, কি সোনদর মাইয়া! সৌন্দর্য নিয়ে আমজাদ মিয়ার কোনকালেই মাথাব্যথা ছিল না। পরিবানু সুন্দর কীনা তা নিয়েও সে কখনো ভাবেনি। সে পোস্টারের দিকে একবার তাকায়ে বলে, রাইত অয়া যাইব, এহন চল। কিন্তু পরিবানু নড়তে চায় না, পোস্টারের ছবির দিকে হাঁ করে তাকায় থাকে। তখন কি নিজের সাজসজ্জার কথা ভেবে তার লজ্জা লাগে, নাকি নায়িকার সাথে নিজের রূপের তুলনা করে সে ঈর্ষান্বিত হয় অথবা স্রেফ কনকবালার সৌন্দর্যে সে অভিভূত হয়ে থাকে তা জানা যায় না।
গ্রামে ফেরার পথে পরিবানু সেদিন কোন কথা বলে না। রাতে বিছানায় শুয়ে সে আমজাদ মিয়াকে একগোছা চুড়ি আর টিপ আনতে বলে, "পোস্টারের মাইয়ার লাহান।" বায়স্কোপের আবদার না মেটাতে পেরে আমজাদ মিয়ার মেজাজ খারাপ ছিল, এই কথা শুনে সে তিরিক্ষি হয়ে বলে, তর বাপেরে কিইনা দিতে কইস।
তাই পরিবানু যখন নিখোঁজ হয় এবং আমজাদ মিয়া সারা শহর ঘুরেও তার হদিস পায়না, তখন একদিন শহিদুলের দোকানের সামনে সে একই পোস্টার দেখতে পায় এবং সেখানে দাঁড়িয়ে পরিবানুর আশায় অপেক্ষা করতে শুরু করে। “হ্যায় ফিলমের হিরোইন আপার পুস্টার বড় ভালা পাইছিল”, মন্তাজ আলীকে সে বলে। মন্তাজ আলী বিস্মিত হয়, “তুমার যা বুদ্ধি। পুরা ঢাহায় এই পুস্টার কী এক পিস নাহি? তাছাড়া তোমার পরিবিবি এই পুস্টারের খবর পাইব ক্যামনে?” এই প্রশ্নের গুরুত্ব আমজাদ মিয়াকে বিচলিত করতে পারে না, সে সিলিঙের ঘুরন্ত পাখার দিকে তাকায়ে থাকে। “যত্তসব পাগল ছাগলের পাল্লায় পড়ছি”, রাগে গজরাতে গজরাতে মন্তাজ আলী ঘুমাতে যায়। পরের দিনও আমজাদ মিয়াকে শহিদুলের দোকানের সামনে দেখা যায়।
নতুনত্ব কমে যেতে থাকলে আমজাদ মিয়ার ঘটনাও আস্তে আস্তে বিবর্ণ হয়ে আসে এলাকার মানুষের মনে। কিন্তু এক স্থানীয় পত্রিকার তৃতীয় পাতায় বামের কলামে একদিন ছোট করে তার কাহিনী ছাপা হয় এবং নামকরা এক দৈনিক পত্রিকার একজন দুঁদে সাংবাদিকের তা চোখে পড়ে। সে তার ভালোবাসা দিবসের সংখ্যায় ‘পরিবানুর অপেক্ষায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপায়। এতে বাস্তব-অবাস্তব ঘটনার মিশেলে সে যা বর্ণনা দেয় তার কতটুকু আমজাদ মিয়ার জীবনে আদপে ঘটেছিল তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। কিন্তু সে গল্প পাঠকদের মনকে প্লাবিত করে দেয়। এর ফলাফল হয় অভাবনীয়।
একরাতে প্রবল ঝগড়ার এক পর্যায়ে শহরের অভিজাত এলাকার মিসেস রেহানা চৌধুরী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে বসেন, “তোমার সাথে ঘর করে আমার কপাল পুড়ল। সারাটা জীবন খালি টাকা আর টাকার চিন্তা। পরিবানুরেও আমার নিজের চেয়ে সুখী মনে হয়।” তার স্বামী জনাব চৌধুরী কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েন, হয় এই ঝগড়ার ঝাল মেটাতে কোন জুয়েলারি কিনে দেয়া লাগবে তা ভেবে না পেয়ে অথবা পরিবানুকে চিনতে না পেরে। তাদের ছেলে রকি ভালোবাসা দিবসে তার সুইটহার্ট লিনাকে নিয়ে ডেটিঙে যায় এবং এক রোমান্টিক ডিনার শেষে লিনা তার উষ্ণ দুহাত ধরে প্রশ্ন করে, “আমজাদ মিয়া যেমন কখনোই পরিবানুকে ভুলেনি, তুমিও সেরকম আমাকে ভুলতে পারবা না। আমি মরে গেলেও না, প্রমিজ?” রকি বলে, “প্রমিজ। কিন্তু আমজাদ মিয়াটা কে?” “ওমাইগড, তুমি আমজাদ মিয়াকে চিনো না?” লিনা আর্তনাদ করে ওঠে, “আর ইউ সিরিয়াস? তুমি কি দুনিয়ার কোন খবরই রাখ না?” রকি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। হকার অসুস্থ বলে তাদের বাড়িতে গত কদিনের পত্রিকা আসছে না এই ধরনের কোন অজুহাত দিয়ে সে পার পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু রাতের রোমান্টিকতাটুকু সেখানেই মারা পড়ে। রকির বোন রেখা সেরাতে সদ্য বাগদত্ত ইভানকে ফোনে আমজাদ মিয়াকে নিয়ে লেখাটা পড়ে শোনাতে থাকে আর ফোঁৎফোঁৎ করে কাঁদে। সারা সন্ধ্যা ওয়ার্ডে ডিউটি করার পরে ইভানের শরীর ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। গল্পের মাঝপথে সে আগপিছ না ভেবে বলে বসে, এতো কান্নাকাটির কি হইল? লোকটা তো আচ্ছা পাগল দেখা যাইতেছে, পোস্টারের সামনে দাঁড়ায়া থাকে। ওপাশ থেকে খট করে ফোন কাটার শব্দ হয়, সেরাতে রেখার অভিমান ভাঙাতে ইভানের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
এভাবে লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখার মত আমজাদ মিয়া-পরিবানু ভালোবাসার কিংবদন্তি হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। এই ঘটনা এতই আলোড়ন তোলে যে লাইভ সম্প্রচারের জন্য টিভি সাংবাদিকেরা শহিদুলের দোকানের সামনে ভিড় জমায়। আমজাদ মিয়া হঠাৎ এতো মানুষ দেখে অবাক হয়। সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরে একের পর এক প্রশ্ন জিগ্যেস করতে থাকে, পরিবানু কোথায় বলে আপনার ধারণা? উনি কি এই পোস্টারের সামনে আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন? বাকি জীবন আপনি কি এই পোস্টারের সামনে কাটিয়ে দিতে চান? পরিবানুকে হারিয়ে আপনার অনুভূতি কি? আমজাদ মিয়া কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না, সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়ে থাকে। পোস্টারের কনকবালার ছবিকে সে আর আলাদা করতে পারে না, তার চোখে ধন্দ লাগে। বেশভূষা, সাজসজ্জা, কপালের টিপ, বাহারি চুড়ির গোছাতে সব মেয়েকেই তার কাছে কনকবালার মত লাগে।
পরের দিন সকালে মন্তাজ আলী আমজাদ মিয়াকে খুঁজে পায় না। আমজাদ মিয়ার হঠাৎ অন্তর্ধানে তার গল্প ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছায়, সেই খবর পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও প্রবল উৎসাহে তা সম্প্রচার করতে থাকে। তারপর এক সপ্তাহ কাটে, আমজাদ মিয়ার নতুন কোন খবর পাওয়া যায় না, সে যেন ভোজবাজির মত নাই হয়ে যায়। নতুন ব্রেকিং নিউজের সন্ধানপ্রার্থী পত্রিকাগুলোর আগ্রহ তাই মরে আসে, টিভি চ্যানেলগুলো নতুন শতাব্দী সেরা ভালোবাসার জুঁটি খুঁজে বের করে, আখন্দ চৌধুরীর পরিবারের ঝগড়াঝাঁটি, অভিমান মিলমিশ হয়ে যায়। শুধু একদিন শহিদুলের দোকানে কনকবালার পুরোন পোস্টারটা আর দেখা যায় না।
গল্পে শহিদুল জহিরের লেখার ভঙ্গি ব্যর্থ অনুকরণের চেষ্টা খুঁজে পেতে পারেন অনেক পাঠক। এই অনুকরণ ইচ্ছাকৃত। শহিদুল জহিরের লেখা প্রথম পড়ি বছর ছয়েক আগে, তখন থেকে মুগ্ধতার রেশ কাটেনি, প্রতিটা লেখা পড়েছি আর নতুন করে মুগ্ধ হয়েছি। তখনও মার্কেজ পড়িনি, জাদুবাস্তবতা শব্দও হয়তো শুনিনি। সেসময় ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প, আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এগুলো এক অনাস্বাদিত, অনাঘ্রাত জগতের সন্ধান দিয়েছিল আমাকে। শুধু মনে হত, এই ভঙ্গিতে মানুষ গল্প বলে কি করে? গল্পের কালানুক্রমিকতা নেই, এক চরিত্র আরেক চরিত্রের সাথে গোত্তা খেয়ে মিশে যাচ্ছে, ঘটনা এখন ঘটছে নাকি অতীতে ঘটেছিল সেটা পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছি না, একী! গল্প নিয়ে বাঁধাধরা সব চিন্তা-ভাবনা ভেঙে দিয়েছিল তার লেখা। বহুদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, পাঠক হয়ে প্রণতি নিবেদনের প্রচেষ্টায় তাই এ লেখা। শহিদুল জহিরের ভঙ্গি অনুকরণের চেষ্টা করে ধৃষ্টতা করেছি মানছি, তিনি বেঁচে থাকলে এই বালখিল্যতা নিশ্চয়ই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন।
মন্তব্য
একটানে পড়ে ফেললাম। গল্পে
ধন্যবাদ পাঠে, জানানোতে।
শহিদুল জহিরের লেখা আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তাঁর লেখার অনুসরণে লেখা যদি এত সুন্দর হয় তবে তাঁর লেখা না জানি কত সুন্দর! আপনার এই ব্লগের বাকি লেখাগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে ফেলতে হবে! আর অপেক্ষায় থাকলাম আপনার পরের লেখার।
- এক লহমা
অনেক ধন্যবাদ নেবেন।
বাকি লেখাগুলোতেও মতামত জানালে কৃতজ্ঞ হব। শহিদুল জহিরও সময় করে পড়ে ফেলবেন, ঠকার কোন সম্ভবনা নেই।
ও আর সময় করে লিখে ফেলুন কিছু নিয়ে।
বড় কাউকে অনুসরণ করা ভুল বা খারাপ কিছু নয়, তবে সেই হোমটাস্কগুলো নিজের কাছেই রাখুন। যে গল্পে অন্যের প্রভাবের চেয়ে আপনার নিজের স্বকীয়তা বেশি স্পষ্ট সেগুলো পাঠকের পাতে দিন।
কয়েকটা ব্যাপার চোখে লাগলোঃ
- লাশ ভেসে ওঠার মতো প্রশস্ত ড্রেন বাংলাদেশের কোন শহরে আছে বলে মনে হয় না। স্টর্ম স্যুইয়েজ লাইন যথেষ্ট প্রশস্ত হয় বটে তবে সেগুলো মাটির নিচে থাকে।
- তরফদার মির্জা কারো নাম হতে পারে না। কারণ, তরফদার ও মির্জা দুটোই ফ্যামেলি নেম। একইভাবে আখন্দ চৌধুরী নামটাও ভুল। এখানেও আখন্দ আর চৌধুরী দুটো আলাদা ফ্যামেলি নেম।
- শব্দটা 'জোন দেয়া' নয়, 'জন দেয়া' বা 'কামলা দেয়া' বা 'দিনমজুরী করা'। জন দেয়া লোকের ছুটি চেয়ে নেবার দরকার পড়ে না, কারণ সে চুক্তিবদ্ধ নয়। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে 'মুনিস' বলা হয়। সুতরাং আমজাদ মিয়া রফিক মৌলানার জন হলে তার ছুটি চাওয়ার কিছু নেই।
- যে ব্যক্তি "আপনে কনে যাবেন" বলে সেই একই ব্যক্তি "যাবা কই" বলে না। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করার সময় তার শুদ্ধতা রক্ষা করা উচিত, ইউনিফর্ম রাখা উচিত। এই গল্পে তা একেবারেই রক্ষিত হয়নি।
- শহরে আমজাদ মিয়ার অন্ন সংস্থানের উপায় বর্ণিত হয়নি। মন্তাজের সাথে তার থাকাটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটি গল্পের একটি বড় ত্রুটি। এই ত্রুটি দূর করা না গেলে আমজাদ মিয়ার 'সিনেমা প্যারাডিসো' স্টাইলে অপেক্ষা করার গল্পটি হালে পানি পায় না।
- বৈশাখী মেলায় আসা বায়োস্কোপের দলের আনা বায়োস্কোপটা কী জিনিস? যার টিকিটের দাম আবার দশ টাকা! গল্পের শেষাংশে দেখা যাচ্ছে ঘটনা একেবারেই সমসাময়িক কালের। দশ বছর আগেও সারা বাংলার কোথাও টিনের বাক্সে ছবির রিল হাতে ঘুরিয়ে দেখানো বায়োস্কোপের অস্তিত্ত্ব ছিল না। যে গ্রামে এনজিও'র অস্তিত্ত্ব আছে সেখানে বহুকাল আগে থেকেই টেলিভিশনে ভিডিও ক্যাসেট/ ভিসিডি/ ডিভিডি চালিয়ে সিনেমা/ ডকুমেন্টারি দেখানো হচ্ছে। বেড়ার ঘরে কমার্শিয়ালি ভিসিআর চালানোও এক যুগের আগের ঘটনা।
- ঢাকা থেকে কোন স্থানীয় পত্রিকা কি বের হওয়া সম্ভব? অখ্যাত অনেক ট্যাবলয়েড বের হয় বটে তবে সেগুলোকে স্থানীয় পত্রিকা বলার উপায় নেই।
আরও হয়তো বলা যেতো, কিন্তু এখানেই থেমে যাওয়াটা শ্রেয় বলে মনে হলো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ডিটেইলসে আর বেশি মনোযোগ উচিত ছিল বলে মনে হচ্ছে। অনেক বিষয়ই চোখ এড়িয়ে গেছে, যার কয়েকটা আপনি ধরিয়ে দিলেন। যারা মনোযোগ দিয়ে পড়বেন তাদের হয়ত অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হচ্ছে।
যেসব পয়েন্ট ধরিয়ে দিয়েছেন সেগুলো মনে থাকবে। অনেক ধন্যবাদ। বাস্তবকে আরেকটু কাছ থেকে দেখে লিখলে কিছু ভুল এড়াতে পারতাম বলে মনে করি।
যে গল্পে অন্যের প্রভাবের চেয়ে আপনার নিজের স্বকীয়তা বেশি স্পষ্ট সেগুলো পাঠকের পাতে দিন। দুই লাইনেই মার্কেজ বা শহিদুল জহিরের লেখার ছাপ খেয়াল করলাম
facebook
কাহিনিচয়ন ভালো লাগলো। যেমনটা আগের মন্তব্যে বলা হয়েছে তেমনি ডিটেইলিং এর দিকে নজর দিলে নি:সন্দেহে গল্পের মান অনেক উপরে উঠতো।
আপনার লেখার ধরন ভালো লাগলো।
সবচেয়ে বড় কথা, গল্পটা পড়ার পরে আমজাদ মিয়া আর পরিবানুর জন্য বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠলো - এখানেই হয়তো লেখার স্বার্থকতা।
লিখতে থাকুন।
অনেক ধন্যবাদ।
এই যে লিখে জানালেন, এর মূল্য অনেক, অন্তত আমার কাছে। আমি নিজে নীরব পাঠকের দলে, কোন লেখা পড়ে ভালো লাগলেও আলস্যের বশে জানানো হয় না অনেক সময়। কিন্তু লেখকের জন্য পাঠকের ভালো লাগা জানতে পারা কত বড় অনুপ্রেরণা, তা মনে হচ্ছিল কমেন্ট পড়ে।
ভুলত্রুটি শুধরে নেয়ার চেষ্টা থাকবে।
নতুন মন্তব্য করুন