বনানী ব্রিজের ওপরে বসে আছি৷
বসে আছি বলতে বাইকের পেছনে বসে আছি। হাতির ঝিল থেকে ১১ নাম্বার রোড পুরোটা জ্যাম। শালা তিনদিনের ছুটিতে পুরো ঢাকা শহর রাস্তায় নেমে গেছে নাকি!
বাইকার ব্যাটা উসখুস করছে। কর, আমার কী! জ্যাম কি আমি লাগাইসি!
ফুরফুরে বাতাস। ভালোই লাগছে। ভাবসিলাম আজকে সকাল সকাল বাসায় ফিরে একটা ঘুম দিব৷ কাল থেকে আবার রোজা, ভোররাতে উঠতে হবে৷
গেল ছাতার ঘুমটা।
ঘুমানো ছাড়া অবশ্য আমার ছুটির দিনে আর কোন কাজ নেই। থাকেও না। থাকি মেসে। মহাখালীর সস্তা এঁদো মেস। সকালে জলখাবারে নাস্তা করি, দুপুরের জন্য ওখান থেকেই রুটি আলুভাজি প্লাস্টিকের ডিব্বায় মুড়ে নিয়ে যাই। রাতে মেসের ঘ্যাঁট। টাকি মাছের ভর্তা আর আলুভাজি, ডাল৷ কিংবা বেগুনভাজি আর ডাল, আলুভর্তা। কিংবা শিমভর্তা আর ডিমচচ্চড়ি।
কোন না কোন একটা ভর্তা আছেই।
জীবনটাই ভর্তা হয়ে আছে, আর খানাদানা৷
জীবন নিয়ে আমার কোন উচ্চাশা নাই৷ কখনো ছিলোও না।
গরিব মাস্টারের ছেলে আমি। বাপ সরকারি চাকরি করতো কমলাপুরে। পাকনামি করে দ্যাশের জমি বেচে বড়লোক হতে গেসিল মালয়েশিয়ায়। অসুখ-বিসুখে শরীর আর সংসার দুটোই শ্যাষ করে ফিরে গ্রামের ইস্কুলে ঢুকেছিল শ্বশুরের সুপারিশে। এরপর থেকে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ওখান থেকেই রিটায়ার করেছে।
মা ছিল চিররুগ্না। আমার দেড় বছরের সময় মরে গেল হুট করে৷ এরপর ফুপু পেলেছে। স্বামী পরিত্যক্তা গ্রামের বোকাসোকা মেয়ে, ভাইয়ের মা মরা ছেলের ওপর অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মতো চেপে বসেছিল৷ নয়ন খা, নয়ন ঘুমা, নয়ন পড় পড়।
ভ্যানভ্যান করে মাথা ধরিয়ে দিতো সারাদিন।
পড়ে বেশিকিছু করতে পারিনি।
মাথা ছিল না, এখন বুঝি৷ খুব ভুগতাম৷ পরীক্ষার আগে পরে জ্বর, পেটখারাপ, বুকে সর্দি বসে হাঁপের টান। ফুপু তেল মালিশ করে করে বুকে ঘষতো, বাপ মুদির দোকান থেকে বাকিতে বার্লি আনতো৷ ফুপুর ঘ্যানঘ্যানানি থামাতে নাক কুঁচকে বার্লি গিলতাম।
এখন যেমন মেসের খালার অখাদ্য লাউয়ের তরকারি গিলি৷
দূরসম্পর্কের চাচার বাড়িতে থেকে পড়ব বলে জেলা শহরের ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছিলাম। চাচির অচ্ছ্যুত বানিয়ে করা মেহমানদারি হজম করে দাঁতে দাঁত চেপে পাশও করেছি৷ এরপর ঢাকায় এসে চাকরির যুদ্ধে নামা।
জুটেছে তো৷ খেয়েপরে তো আছি৷ আবুজফর গিফারি কলেজ থেকে বিবিএস পাশ আর মাথাভাঙা সাইনবোর্ডের ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থেকে কমপিউটারে ডিপ্লোমা করা ছেলের জন্য কে হাইফাই চাকরি নিয়ে বসে থাকবে!
জ্যাম ছেড়েছে। মেসে ঢুকতে এখনো চল্লিশ মিনিটের ধাক্কা। আস্তে-ধীরে গেলেও হয়।
কেউ তো আর লেবুর শরবত করে বসে নেই।
বিয়ে করিনি৷ করার খায়েশও নেই। ফুপু মরেছে গতবছর, এখন শুধু বাপের খরচ টানতে হয়৷ প্রতিমাসের বাঁধা মানিঅর্ডারের পাশে যোগ হয় কোন না কোন একটা ওষুধ, বাড়তি। হাঁসফাঁস লাগে৷ বাপটাও টেঁশে গেলে আমি হালকা হয়ে যেতাম।
আমি অমানুষ না রে ভাই, অসহায়। বেতনের টায় টায় পয়সায় দিন চালাই৷ আজ ব্লাড টেস্ট, পরশু ইউরিন। সদরের ডাক্তার ত লিখে দেয়, পয়সা কইত্তে আসে! আসমান ফেঁড়ে?
অবশ্য কলেজের মতিন বলতো আমায় মায়া-দয়া জিনিসটাই এমনিতে কম। তুই হইলি সীমার টাইপের পুলা। বুঝছস বন্দু?
সস্তা ক্যাপ্সটান টানতো আর ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে এসব বলতো৷
হারামজাদা বাসের নিচে চাপা পড়ে মরে গেল গতবছর। নারায়নগঞ্জ সদরে। রাস্তা পার হতে গিয়ে কেউ এভাবে মরে!
শালা গিদর!
মতিনের বউটা আবার বিয়ে বসছে শুনলাম, ওর চাচাতো ভাইয়ের কাছে৷ অল্প বয়স, ছোট্ট দুধের বাচ্চা কোলে।
উপায় কী আর!
ধলেশ্বরী নদীতীরে পিসিদের গ্রাম।
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল–
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
মেয়েটা তো রক্ষে পেলে, আমি তথৈবচ।
আমি বিয়ের কথা দু:স্বপ্নেও ভাবিনা। বউ তো বাতাস খেয়ে বাঁচবেনা৷
ভাত- কাপড় লাগবে৷ চান্দের আলোর কসম দিয়া কেউ ভালোবাসা রাখতে পারেনা। ঈদে শাড়ি লাগে, স্যান্ডেলও।
আমি হাসেম এন্টারপ্রাইজের এসিস্ট্যান্ট এডমিন স্টাফ৷ বউ পালার মুরোদ নাই৷ এইই ভাল আছি৷
ল্যাদানো পীরিতি, পুতুপুতু পেমের সংসার আল্লাহ আমার জন্য রাখে নাই৷
সুতরাং মার্চের সন্ধ্যায়, সারাদিনের তীব্র লু ধুয়ে দেওয়া হঠাৎ হিমেল বাতাসের তোড়ে আমি আবদুশ শাকুর, বয়স ২৯, সাকিন মাইজদি, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালি, ব্লাড গ্রুপ বি পজিটিভ শখের ঝোঁকে ওঠা বাইক থেকে মুন্নু সিরামিকের চকচকানো শো-রুমের সামনে নেমে বলি, আমারে এখানেই ছেড়ে দ্যান ভাই৷ আর বলেন, কত দিব?
এরপর বাটার রিডাকশনে কেনা সস্তা শু ছেঁচড়ে হাই তুলে তুলে স্লথপায়ে হাঁটি৷ কারণ সত্যিকার অর্থে আমার কোন তাড়া নেই।
ফিরব বলে কেউ কোথাও অপেক্ষায়-ও নেই৷
ফিরব কোথায়, কোথায় এমন ঘর!
মন্তব্য
একটি উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছদ লেখা হ'ল, কেমন?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হতি পারে, হতি পারে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন