বিচিত্র লাগছে। বাস ছুটে চলছে। চারপাশ ধবধবে সাদা। গাছপালা রাস্তাঘাট কোনটা কি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পাশে বসা শেন জ্যো খুব আগ্রহ নিয়ে ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে নাকি বাংলা ফন্ট খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। সে এক টুকরা কাগজ নিয়ে তার নামের বানান লিখে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। এখন বার বার বাংলায় নামটা লিখে লিখে প্র্যাকটিস করছে। কি আজব!
গরম লাগছে। হাত বরফের মত ঠান্ডা। বাসের ভেতরটাও ঠান্ডা। এসি ছেড়ে বসে আছে জার্মানগুলি। বাস ধরতে ব্যাপক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। ভোর পাঁচটায় উঠলাম মোবাইলে সেট করা এ্যালার্মের অত্যাচারে। গরম একটা শাওয়ার নিলাম। চুলে ভালো করে শ্যাম্পু দিলাম। গত কয়েকদিন সময় হয়ে ওঠে নি। কোনমতে হাতের কাছে যা যা কাপড় পেলাম পড়ে নিয়ে এক কাপ ক্যাপাচিনো গিলে বের হয়ে গেলাম। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক হাটু বরফ। মেজাজটা খিচড়ে গেল। খুব খারাপ একটা গালি আসল মুখে। ঢোক গিলে গালিটা গিলে ফেললাম। অনেকখানি হেঁটে ট্রেন ধরলাম। হেঁটে মানে কি, রীতিমত দৌড় দিয়ে গলদ্ঘর্ম হয়ে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত আসলাম। বাহ! ট্রেন আসবে ১৫ মিনিট পর। কি ভালো লাগলো বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হল স্টেশনের বেঞ্চটা তুলে অনেক দূরে ছুড়ে ফেলি। ইদানীং মেজাজ টেজাজ কেমন পুরুষালি পুরুষালি হয়ে গেছে। এটা ভালো না খারাপ?
বাসে সবাই জার্মান ভাষায় হইহুল্লোড় করছে। এটাই স্বাভাবিক। মাতৃভাষা বলে কথা। কেন যে ইংলিশ বলা কোন দেশে গেলাম না আল্লাহ জানে। মাঝে মাঝে নিজের সিদ্ধান্তের জন্যে নিজের উপর খুব রাগ হয়। অতি মাত্রায় খামকেয়ালি মানুষদেরকে তাদের খামখেয়ালির জন্যে চড়া মাশুল গুনতে হয়। সামনের তিনটা বছর আমাকে মাশুল গুনতে হবে। কি মজা!
মাথা খালি খালি লাগছে। ধ্যাত! গান শুনছি। রেডিওহেড। আমার প্রিয় একটা ব্যান্ড। নো সারপ্রাইজ। বিষন্ন গান। মেজাজ খারাপটাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা আর কি। একটা পারফিউম আনা উচিত ছিল। সুন্দর ঘ্রান মনকে ভালো করে দেয়। নবীজী নাকি আতর লাগাতে পছন্দ করতেন। আতর বা পারফিউম লাগানো কি তাহলে সুন্নত? জানতে হবে।
এখানে সবাই খুব অবাক হল শুনে যে আমি ড্রিঙ্ক করি না। বেচারাদের হতাশ করা ছাড়া উপায় নাই। হাহা...। কয়েকদিন হল সুপার মার্কেটগুলিতে ভালো জুস খুঁজে বেরাচ্ছে। এদের জুস কেমন যেন তিতকুটে। ভালো লাগে না। এই শনিবারে কবিতার সাথে ইন্ডিয়ান দোকানে যাবার কথা। সেকেন্ড থট দিচ্ছি। কারণ ঘরে খাবার দাবার আছে। শুধু শুধু বেশি বেশি কিনে কি লাভ। আবার চাল ডালের জন্যে মনও একটু কেমন কেমন লাগছে। দেখি কি করি। শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখি। শনিবার সকালে ভেতরের বাঙ্গালিত্ব জোর করে বেরিয়ে আসলে ইন্ডিয়ান দোকানে যাওয়া ছাড়া গতি নাই। মোরগ পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে। ইসসসস...।!
জ্বর আসছে নাকি। কেমন যেন লাগছে। রাতে ঘুম হয় নাই ভালো। কফি খেয়ে শুতে যাওয়া তৃতীয় পর্যায়ের ভুল হয়েছে। আধো ঘুম আধো জেগে থাকার মাঝে না হলেও বার তিনেক ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খুলেছি। অনেক জরুরি কাজের ভেতর এটা একটা। টেনশনে থাকলে জরুরি কাজগুলি মাথায় ঘুরপাক খায়। শুক্রবারে ল্যাবে যাওয়া যাবে না। এ্যকাউন্ট খুল্ব, হেলথ ইন্সুরেন্স করব আর গ্যামান্ডিতে যাবো। গ্যামান্ডি একটা এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস যেখানে আমাকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। আর মারগারিটার বাসা দেখতে তো যেতেই হবে। অনেক কাজ!! জীবন তামা তামা হয়ে গেল। খুব অল্প বয়সে জীবনের প্রতি বীতশ্রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।
ভাল্লাগছে না। হাত পা কামড়াতে ইচ্ছা করছে। এর প্রতিকার কি? মাথা ভোঁ ভোঁ। আমার তো মোশন সিকনেস নাই। তাহলে এমন লাগার কারণ কি? বুঝলাম না।
(চলবে...)
মন্তব্য
বাংলা নিয়ে একই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমিও হয়েছি। আমার কয়েকজন বন্ধু তাদের নামও লিখে নিয়েছে বাংলায়।
কবে এলেন? জার্মানিতে স্বাগতম
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
তাও ভালো জার্মানিতে সবাই জার্মান ভাষা বলে. সুইজারল্যান্ড আসলে বুজতেন ভাষা কাহাকে বলে: কেউ বলে বনজুর কেউ বলে গুটেন মরগেন. এক দেশে তিনটা জাতীয় ভাষা. আপনার লেখাটা পরে খুব মনে পরে গেল ইউরোপে আসার পর প্রথম দিন গুলোর কথা
ভাল লাগল। পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
ধৈবত
মোশন সিকনেস না হয় নাই, কিন্তু হোম সিকনেস? পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম...
কুটুমবাড়ি
তুমি সাফট কিনে দেখতে পারো। পানিতে মিশিয়ে খেয়ো >)
আর লিডল এর কিছু জ়ুস তো বেশ!!স্পেশালি আঙ্গুর !! আর কমলার ঘন জুস সবসময়ই তেতো।
ঊষ্ণ শুভকামনা
সন্ধি
স্টকহোম
শনিবার তো বন্ধ সবকিছু। ভেতরের বাঙালীত্ব জেগে উঠলে সেটা মেটানোর সুযোগ পাবেন শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত। তারপর একেবারে সোমবার পর্যন্ত যতোই আপনার বাঙালীত্ব মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে, বিলাপ পেড়ে কাঁদুক, কোনোই লাভ নেই।
জ্যুস তিঁতকুটে হওয়ার কারণ হচ্ছে, এখানে বেশিরভাগ জ্যুসই ছালবাকল শুদ্ধা পিষে ফ্যালে। বিশেষ করে কমলা। এটা নাকি ফ্রেশ হয়। আমি বুঝি না, চোকলা মোকলা খাওয়ার মধ্যে ফ্রেশনেস এর কী আছে!
গ্যামান্ডি না, গেমাইন্ডে (মিউনিসিপ্যালটি)। বড় শহরে এটাই হয়ে যায় রাট-হাউজ (টাউন হল), স্টাড-হাউজ (সিটি হল)।
রেজিস্ট্রেশন ছাড়া ঘুমের মধ্যেই ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হবে। বাস্তবে কোনো ব্যাংক খুলতে দিবে না, এরা বহুত বদ আছে।
সুন্নত-নফল যা যা আছে সব পালন করতে থাকেন। হা-হুতাশও যা করার করে নেন। কারণ ইতিহাস বলে, শুরুতে জর্মন্দেশে মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরলেও পরে ছেড়ে যাওয়ার সময় জনগণ কান্নাকাটি করে। সুতরাং, আপনিও সেইদিকেই যাচ্ছেন, নিশ্চিন্তে।
আর কী, যেই ঠাণ্ডা পড়ছে, উষ্ণ অভিনন্দন জানানো ছাড়া আর কী করার আছে। দাঁত কিড়মিড়াইয়া পড়ে থাকেন। এই তো আর মোটে তিনটা মাস!
ডায়েরি জারি থাকুক। ইয়া হাবিবি।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
'স্পারকাসে' ইদানিং মনে হয় এই নিয়মের ব্যতিক্রম করতেছে ধুগো'দা। আমি রেজিস্ট্রেশনের আগেই একাউন্ট খুলছিলাম। অামি অবশ্য তখন জানতাম না যে রেজিষ্ট্রেশন ছাড়া একাউন্ট খুলতে দেয়ার কথা না।
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আহারে! ভাষার কষ্ট বড় কষ্ট।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
বেশ।
ভ্রমণকাহিনী! আমি ভাবলাম দিনপঞ্জি।
সিরিজ চলুক।
মাত্রই তো আসলেন।বছরখানেক পরে দেশ থেকে ঘুরে আসুন।যখন পার্থক্যগুলো চোখে পড়বে, তখনই বুঝতে পারবেন।
চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ক্লাস নোট বা এখানে সেখানে বাংলায় নোট লিখে আমার অভ্যাস। এক চৈনিক ছেলে সেই বাংলা লেখা দেখে পুরোপুরি মুগ্ধ। এতো আর্টিস্টিক বর্নমালা সে নাকি আগে দেখেনি। বাংলা কথা শুনে আমাকে দুইজন (কোন দেশি মানুষ জানিনা) বলেছে আমাদের ভাষা খুবই কোমল এবং শ্রুতিমধুর।
-রু
বেশ লাগলো। ধীরে ধীরে ছবিও যোগ করবেন আশা করি। সিরিজ চলুক।
কিছু কিছু ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। যেমন, গলদঘর্ম হয়ে দৌঁড়ে ট্রেনস্টেশনে গিয়ে বাসে চড়ার ব্যাপারটা। ঠান্ডা গরমের সাইকেলও যেন কেমন মিলছে না। হাঁটুতক বরফ ভাঙ্গা শীতের দিনে গরম লাগে! আবার বাসের ভেতরটা ঠান্ডা! জার্মানগুলি এসি ছেড়ে বসে আছে! এসির কাজ যদি বাসকে আরো ঠান্ডা করা হয়, তাহলে বিরাট প্রবলেম! জার্মানদেরকে এতোটা অদ্ভূত রকমের বোকামি কখনো করতে দেখি নাই।
ড্রিংক না করার ব্যাপারটাও সবাই সাধারণত স্বাভাবিকভাবে নেয়। আপনি অ্যালকোহল পান করেন না, সরাসরি বললেই হলো। অনেক জার্মানও অ্যালকোহল অ্যাভয়েড করে।
প্রবাসজীবনের প্রথমটা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। একটু মানিয়ে নেন, দেখবেন এই জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, এটাকেই ভালো লাগছে। ভাষার ব্যাপারে একটু নমনীয় হোন, অন্তত দৈনন্দিন আলাপ চালানোর মতো ভাষা শিখে ফেলুন। জীবন সহজতর হবে।
উপদেশ আর লেখার দোষ ধরা বাদে বলি, আপনার লেখা যথেষ্ট সাবলীল। পরের কিস্তির অপেক্ষায়।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
সবার মূল্যবান মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। বিশেষ করে জার্মানবাসীদের কথাগুলি আমার খুব কাজে দিবে। দোয়া করবেন জেন ভালভাবে বেঁচেবর্তে থাকি এই নতুন দেশে। জ্যান্ত না থাকলে লিখব কি করে। জ্যান্ত থাকা দরকার।
নতুন মন্তব্য করুন