আইনস্টাইন এবং তাঁর স্পেশাল ও জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা

রিসালাত বারী এর ছবি
লিখেছেন রিসালাত বারী [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৬/০২/২০১৬ - ৯:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ আবিস্কারের পর থেকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সব খানেই নানান হৈ চৈ শুরু হয়েছে। সঙ্গত কারণেই তার একটা ধাক্কা বাংলাদেশেও এসে লেগেছে। পাড়া-মহল্লা থেকে অফিস আদালতে অনেকেই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ নিয়ে কথা বলেন এবং সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকজন তাদের ইন্টারমিডিয়েটে পড়া আইনস্টাইনের স্পেশাল থিউরি অব রিলেটিভিটি সংক্রান্ত জ্ঞানের কথা দুয়েক লাইনে তুলে ধরেন। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। আমি নিজেও এমন কোন দাবী করি না যে আইনস্টাইন বুড়োর জেনারেল রিলেটিভিটি, স্পেশাল রিলেটিভিটি দুইটাই বুঝি। কিন্তু এই নিয়ে কোন ধরনের আলোচনায় সাধারণত তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ঝুলাই না। "বিবর্তন শুধুই একটা থিওরি" বলার মত "জেনারেল রিলেটিভিটি" বা "স্পেশাল রিলেটিভিটি"ও শুধুই থিওরি - এরকম ভাবার মত লোকজন প্রচুর। আশ্চর্যের ব্যাপার তারা মোটামুটি সবাই সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের। তাদের ধারণা, খুব দ্রুত কোন কিছু দৌড়াতে শুরু করলে সময় তার জন্য মন্থর হয়ে যাবে এইটা একটা গাঁজাখুরি কথা। দুয়েকটা ইকুয়েশন আছে ঠিকি কিন্তু এর কোন বাস্তব প্রয়োগ নাই। দুঃখিত স্যার, আপনার ধারণা ভুল। এর বাস্তব প্রয়োগ আছে! সেটা নিয়েই আজকের জ্ঞানের আসর।

আপনি যখন প্লেনে চেপে হনুলুলু বা মাদাগাস্কার বেড়াতে যান তখন ঐ প্লেনটা সর্বক্ষণ নিজের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য জিপিএসের উপর নির্ভর করে। আপনার পকেটের স্মার্টফোনটা একেবারে সস্তা কিছু না হলে তাতেও নিশ্চিত ভাবে একটা জিপিএস রিসিভার আছে। এবং এই জিপিএস রিসিভার দিয়ে মোটামুটি নিখুঁত ভাবে একজনের অবস্থান পৃথিবীতে কোথায় তা বের করা যায়। সেলফোনের জিপিএস দিয়েই মোটামুটি দশ মিটার ভুলের সীমা রেখে কারও অবস্থান বের করা সম্ভব। এই যে জিপিএস রিসিভার গুলি, এরা যোগাযোগ করে জিপিএস স্যাটেলাইটের সাথে। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২০ হাজার কিলোমিটার উপরে ২৪ টা জিপিএস স্যাটেলাইট এমন একটা বিন্যাস বজায় রেখে ঘুরছে যাতে দুনিয়ার যেকোন চিপা থেকে সর্বনিম্ন চারটা থেকে সর্বোচ্চ বারটা স্যাটেলাইট সবসময় দেখা যায় বা জিপিএস রিসিভারের সাহায্যে যোগাযোগ করা যায়। এই জিপিএস স্যাটেলাইটগুলির প্রত্যেকটিতে একটা করে এটমিক ঘড়ি আছে যার সূক্ষ্ণতা ১ ন্যানোসেকেন্ড। মানে এক সেকেন্ডের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত নির্ভুল সময় দিতে পারে এই ঘড়ি। প্লেনের রিসিভার যখন এই স্যাটেলাইটগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তখন সে মূলত ঐ স্যাটেলাইটগুলোর সময়ের তুলনা করে নিজের অবস্থান বের করে। যে পদ্ধতিতে এই কাজটা করা হয় তাকে বলে ট্রাইলেটারেশন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে উইকির পেজটা দেখতে পারেন। মোটামুটি বেসিক জ্যামিতি বুঝলেই আপনি বুঝতে পারবেন প্রক্রিয়াটি। চলন্ত গাড়িতে বসেও জিপিএস রিসিভারের সাহায্যে গাড়ির অবস্থান, গতি এবং কোনদিকে গাড়ি যাচ্ছে তা নিখুঁত ভাবে বের করে ফেলা যায়।

এই লেভেলের নিখুঁত হিসাবের জন্য জিপিএস স্যাটেলাইটের ঘড়ির নির্ভুলতা ২০-৩০ ন্যানোসেকেন্ডের মাঝে হওয়া দরকার। এবার আসা যাক প্রথমে স্পেশাল রিলেটিভিটিতে। একেকটা জিপিএস স্যাটেলাইট ২০ হাজার কিলোমিটার উপরে বসে পৃথিবীকে ঘন্টায় ১৪ হাজার কিলোমিটার গতিতে প্রদক্ষিণ করছে। স্পেশাল রিলেটিভিটি অনুযায়ী একজন পর্যবেক্ষক পৃথিবীতে বসে পৃথিবীর সাপেক্ষে ১৪ হাজার কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় ছুটন্ত একটা জিনিসের ঘড়িকে তার নিজের ঘড়ির তুলনায় ধীরে চলতে দেখবে। এই ধীরে চলাটা কতটুকু? ইন্টারমিডিয়েটের পদার্থ বিজ্ঞান বইয়ের সূত্র বসিয়ে হিসাব করলে পাওয়া যাবে এই ধীরে চলার পরিমাণ হচ্ছে একদিনে প্রায় ৭ মাইক্রোসেকেন্ড।

এবার আসা যাক জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে। জেনারেল রিলেটিভিটি অনুযায়ী পৃথিবী বা যেকোন ভারী গ্রহ নক্ষত্র তার ভরের কারণে সেই স্থান-কাল (টাইমস্পেস) এ একটা বক্রতা (কার্ভেচার) তৈরি করে। ত্রিমাত্রিক বক্রতার ব্যাপারটা কল্পনা করতে কষ্ট হলে একটা দিমাত্রিক চাদরের কথা চিন্তা করুন। এই চাদর টান টান করে বেঁধে রাখার পর এর উপর একটা ভারি লোহার বল গড়িয়ে দিলে যেমন একটা বক্রতা তৈরি করবে পৃথিবী, সূর্য, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদিও তার স্পেসটাইমে সেরকম একটা ত্রিমাত্রিক বক্রতা তৈরি করে। জেনারেল রিলেটিভিটির বক্তব্য অনুযায়ী এইরকম ভারী জিনিসের যত কাছে থাকবেন সেখানে সময় তত ধীরে চলবে। তারমানে জিপিএস স্যাটেলাইটের ঘড়ি দুনিয়ার ঘড়ি থেকে দ্রুত দৌড়াবে! জেনারেল রিলেটিভিটির সূত্র বসিয়ে এই দ্রুত চলার মান পাওয়া যায় ৪৫ মাইক্রোসেকেন্ড!

তো স্পেশাল রিলেটিভিটি থেকে পাওয়া গেল সময় ৭ মাইক্রোসেকেন্ড ধীর হয়ে যাচ্ছে। আর জেনারেল রিলেটিভিটি থেকে পেলাম ৪৫ মাইক্রোসেকেন্ড দ্রুত সময় চলে যাচ্ছে জিপিএস স্যাটেলাইটে। নেট ফলাফল ৩৮ মাইক্রোসেকেন্ড এর একটা পার্থক্য। কিন্তু আমাদের দরকার ন্যানোসেকেন্ড লেভেলের অ্যাকুরেসি। আর আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী এখানে ৩৮০০০ ন্যানোসেকেন্ডের (১ মাইক্রোসেকেন্ড = ১০০০ ন্যানোসেকেন্ড) একটা ঘাপলা হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এই ৩৮ মাইক্রোসেকেন্ডের ঘাপলাটা এমন যে এটাকে ঠিক না করলে আমাদের যাবতীয় জিপিএস রিসিভারে দিনে ১০ কিলোমিটার করে ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। আজকে আপনার জিপিএস আপনার অবস্থান মহাখালি দেখালে কাল দেখাবে গাজীপুর। এদিকে আপনি মহাখালিতেই বসে আছেন! আপনার জন্য সেটা সমস্যা না হলেও হনুলুলু গামী প্লেনের জন্য কিন্তু বিরাট বিপদ। সূতরাং আইনস্টাইনের জেনারেল বা স্পেশাল কোন রিলেটিভিটিকেই উপেক্ষা করার উপায় নাই। এই সূত্র অনুযায়ী সময় সংশোধন করে নিয়েই জিপিএস স্যাটেলাইট গুলোকে কাজ করতে হবে।

বিজ্ঞানীরা ঠিক সেই কাজটিই করেছেন জিপিএস স্যাটেলাইট গুলোতে। প্রথমত জেনারেল রিলেটিভিটির ৪৫ মাইক্রোসেকেন্ড অ্যাডজাস্ট করার জন্য তারা জিপিএসের ঘড়িগুলো পৃথিবীতেই ৪৫ মাইক্রোসেকেন্ড ধীর করে তারপর স্যাটেলাইটে পাঠান। পৃথিবীর ভর থেকে বিশ হাজার কিলোমিটার দূরে যেয়ে যখন তারা ঘুরতে থাকে তখন একদম ঠিক ঠিক তাদের ঘড়ি ৪৫ মাইক্রোসেকেন্ড দ্রুত চলতে শুরু করে! এই ঘড়িটা একটা মাইক্রোকম্পিউটারের সাথে যুক্ত থাকে যেটা স্পেশাল রিলেটিভিটির জন্য সময়ের যে ত্রুটি হয় তা অ্যাডজাস্ট করে। জিপিএস স্যাটেলাইটের এই সার্ভিসটা একেবারেই ফ্রি, যে কেউ যখন খুশি নিজের অবস্থান বের করার জন্য তার রিসিভার দিয়ে তিন বা ততোধিক জিপিএস স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। সূতরাং এর পরের বার যখনই আপনি বিমানে চেপে কোথাও যাবেন, আপনার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আইনস্টাইন এবং তার রিলেটিভিটি থিওরির প্রতি মনে মনে কিছুটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আজকে আপনার জিপিএস আপনার অবস্থান মহাখালি দেখালে কাল দেখাবে গাজীপুর

বুঝছি। ক্রসফায়ার থিউরি। মরব এক জায়গায় কিন্তু পাব্লিকে জানব মরছে অন্য কোথাও

রিসালাত বারী এর ছবি

দেঁতো হাসি সঠিক

সত্যপীর এর ছবি

সাব্বাস হাততালি

..................................................................
#Banshibir.

রিসালাত বারী এর ছবি

দেঁতো হাসি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ভালো হইছে লেখা।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

রিসালাত বারী এর ছবি

ধন্যবাদ কবি।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

কী চমৎকার সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন জটিল ব্যাপারটা চলুক

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রিসালাত বারী এর ছবি

হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আশ্চর্যের ব্যাপার তারা মোটামুটি সবাই সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের।

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

জিপিএস সিস্টেমে রিলেটিভিটি-র প্রয়োগ আছে জানতাম কিন্তু ঠিক কিভাবে কাজ করে এটা জানা ছিলো না। ধন্যবাদ লেখককে।
- নুভান

বাজপাখি এর ছবি

স্পেশাল থিউরি অনুযায়ী উপগ্রহের সময় ৭ মাঃ সেঃ ধীর।
জেনারেল থিউরি অনুযায়ী উপগ্রহের সময় ৪৫ মাঃ সেঃ দ্রুত।
লব্দি ফলাফল উপগ্রহের সময় ভূপৃষ্ঠের তুলনায় ৩৮ মাঃ সেঃ দ্রুত।
তাহলে উপগ্রহের সময় পৃথিবী থেকে ৩৮ মাঃ সেঃ এ্যাডজাস্ট করলেই কি সমাধান হয়ে যেত না?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।