স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে একাধিক ছড়া লিখেছি। লিখেছি মানে লিখতে বাধ্য হয়েছি। স্বাধীনতা দিবস এলেই শুরু হয়ে যায় ঘোষক প্রশ্নে অহেতুক তুমুল হট্টগোল। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাসের কোণাকাঞ্চিতেও নেই এমন একজন মেজরকে (জিয়াউর রহমান) ঘোষক বানিয়ে ইতিহাস বিকৃতির অশুভ সূচনা শুরু করেছিলো ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল।(সেই সার্কাস আজো চলছে।) বিশেষ করে ২০০১ সালে জামাতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে চারদলীয় জোট সরকারের ব্যানারে ইতিহাস বিকৃতির ঘৃণ্য খেলায় মেতে ওঠে। জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিশানা মুছে ফেলে তাঁর জায়গায় জিয়াউর রহমানকে প্রতিস্থাপন করতে চায় ওরা। অনেক ছড়া লিখেছি তখন। বেশিরভাগই ছাপা হয়েছিলো দৈনিক জনকন্ঠে। স্বাধীনতার ঘোষক বিষয়ে এই ছড়াটি ২০০৪ সালে লেখা। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামের রচনাটি পুনঃপাঠের সময় ছড়াটির আইডিয়া এবং ফরম্যাট মাথায় এসেছিলো। সেই হিশেবে এই ছড়াটির নেপথ্য প্রেরণা জিয়াউর রহমান স্বয়ং! স্বাধীনতা দিবসের চল্লিশ বছর উদযাপনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সচলায়তনের বন্ধুদের উদ্দেশে নিবেদন করছি সেই ছড়াটি--
-------------
অন বিহাফ অব শেখ মুজিবুর আমি মেজর জিয়া
ইন্টারেস্টিং বিষয় থাকে ছেলের হাতের মোয়াতে
ছেলের হাতের মোয়া খাওয়ার চাইনি সুযোগ খোয়াতে
অস্ত্র ছিলো বোঝাই, খালাস করতে গেলাম সোয়াত-এ
চেয়েছিলাম পাকিস্তানের পক্ষে মাথা নোয়াতে
মুক্তিপাগল মানুষগুলোর অন্যরকম ছোঁয়াতে
বদলে যেতে বাধ্য হলাম, বাবা মায়ের দোয়াতে—
অটোমেটিক ঠাঁই পেয়েছি ইতিহাসে ‘ধোঁয়া’তে!
যদিও জানি স্বাধীনতা ছেলের হাতের মোয়া না
স্বাধীনতা অস্পষ্ট আবছা এবং ধোঁয়া না ।
‘একটি জাতির জন্ম’ লিখে সেটাই বলতে চেয়েছি
আমার যেটুক প্রাপ্য আমি বেঁচে থাকতেই পেয়েছি।
এখন দেখছি মরার পরে ইতিহাসের বিকৃতি!
জবরদস্তি ইতিহাসে করছে আদায় স্বীকৃতি!
স্বাধীনতার দলিলপত্রে মিথ্যা তথ্য ছাপাচ্ছে!
মিথ্যাচারের সমস্ত দায় আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছে!
জীবদ্দশায় ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ নিজকে বলিনি
সুযোগ ছিলো জ্বলে ওঠার, মিথ্যে আলোয় জ্বলিনি।
গ্রেট ন্যাশনাল লিডার ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান
ছাব্বিশে মার্চ তাঁর ঘোষণা ইতিহাসেই বহমান।
উর্দি পরা মেজর ছিলাম, তাঁর তুলনায় নগণ্য
সমকক্ষ নই আমি তাঁর, এইটা ভাবাও জঘন্য!
গ্রিন সিগনাল পেয়েছি তাঁর সাতই মার্চের ভাষণে
আমি থাকবো আমার স্থানে আর তিনি তাঁর আসনে।
ঘোষক এবং পাঠক দুটির অর্থ কিন্তু আলেদা
আমি বুঝলেও বুঝতে চায় না তারেক কিংবা খালেদা।
অন বিহাফ অব শেখ মুজিবুর পাঠ করেছি ঘোষণা
ঐতিহাসিক সত্য এটাই, ওরে মানিক ও সোনা...!
স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছি মার্চ সাতাশে
কী আলোড়ন বাংলাদেশের আকাশে ও বাতাসে!
সাতাশে মার্চ সন্ধ্যা বেলায় পাঠ করেছি বেতারে
ইতিহাসের শক্তি অমোঘ, মুছতে পারে কে তারে?
আমার আগে হান্নানেরা পাঠ করেছে বারংবার
তাঁদের পরে পাঠ করাটাও ঐতিহাসিক অহংকার।
ওঁরা ছিলেন সিভিলিয়ান, নয়কো সেনাবাহিনী
তাই তো আমার ‘ঘোষণা পাঠ’ উদ্দীপনার কাহিনী!
মূল ইতিহাস এই,
এই ইতিহাস মুছে ফেলার কোনোই উপায় নেই!
অন বিহাফ অব শেখ মুজিবুর আমি মেজর জিয়া—
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ‘ঘোষণা পাঠ’ কিয়া.....।
রচনাকালঃ অটোয়া, কানাডা ০১ জুলাই ২০০৪
মন্তব্য
(গুড়) অনবদ্য! অসাধারণ!
এই হলো মোদ্দা কথা!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ছড়াটা দারুন লাগলো !
কিন্তু দুএক'টা ব্যাপারে একটু ধন্দে আছি যদিও। সোয়াতে উনি ঠিক কবে গিয়েছিলেন ? সোয়াতে অস্ত্রখালাস থেকে একেবারে স্বাধীনতার ঘোষনাপাঠ - এই বিশাল ব্যবধানটা উনি কিভাবে পাড়ি দিলেন এত অল্প সময়ে ? এত অল্প সময়ে এত বড় পরিবর্তন, বিশেষ করে ঐ পরিস্থিতিতে - একটু কেমন যেন লাগছে। এই দুই ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে কোন রহস্য আছে নাকি ? আর হ্যাঁ, সোয়াত যদি ৭ই মার্চের পরের ঘটনা হয়ে থাকে - তাহলে তো বলতে হবে ৭ই মার্চের সেই অমর কাব্যের বজ্রনির্ঘোষ তার জন্য গ্রীন সিগন্যাল না -- রেড সিগন্যালই ছিল বরং ! সেই অনুযায়ীই উনি সোয়াতে গিয়েছিলেন। তো সেই রেড সিগন্যাল থেকে উনি কোন মাজেজায় হঠাৎ করে ঘোষনাপাঠের পর্যায়ে পৌঁছালেন ?
--------------------------------
সংযোজনঃ এই মন্তব্যটা করতে করতেই ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে নিচের বিবরনটা পেলামঃ
মনমাঝি
মেজর [অব.] রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের "লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে" বইতে এই গোটা ব্যাপারটার খুবই ডিটেইল্ড বর্ণনা আছে। রফিকুল ইসলাম [তখন ক্যাপ্টেন] ২৪শে মার্চেই বিদ্রোহ করেন, তার নির্দেশে ইপিআরের সীমান্তবর্তী বিওপিগুলোতে বাঙালি ইপিআর সেনারা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের গোপনে এবং ঊর্ধ্বতন অফিসারদের অজান্তে নিরস্ত্র করেছিলো। তারও আগে তিনি আসন্ন ক্র্যাকডাউন নিয়ে ইবিআরসির বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি অফিসার জনৈক লে. কর্নেল [নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না] ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াকে গোপন বৈঠকে ডেকে সতর্ক করেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। দু'জনেই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ২৫শে মার্চ ক্র্যাকডাউনে ইবিআরসিতে সহস্রাধিক বাঙালি অফিসার, সেনা ও তাদের পরিবারকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করা হয় [সেই লে. কর্নেলসহ]। মেজর জিয়া অষ্টম বেঙ্গল বাহিনী নিয়ে ইবিআরসিতে কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে খামাখা কালুরঘাট ব্রিজের অপর প্রান্তে অবস্থান নেন। শুধু তা-ই নয়, সীমান্ত থেকে সরে এসে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের সাথে একীভূত হতে চাওয়া ইপিআর সৈন্যদেরও তিনি শহরে প্রবেশে বাধা দিয়ে নিজের সাথে কালুরঘাট সেতুতে বসিয়ে রাখেন। ক্যাপ্টেন রফিক চট্টগ্রামে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, জিয়ার কারণে রিইনফোর্সমেন্ট পেতে তিনি বাধা পান বলে সেই প্রতিরোধ তিন দিনের বেশি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। জিয়া স্বতপ্রণোদিত হয়ে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন বলে লিখেছেন রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম।
কর্নেল আজিজুর রেজা চৌধুরী হওয়ার কথা, যিনি এআর চৌধুরী নামে পরিচিত ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর অর্গানোগ্রামে তিন নাম্বার ব্যক্তি। জেনারেল ওসমানি সর্বাধিনায়ক, জেনারেল রব চীফ অফ স্টাফ আর কর্নেল চৌধুরী তারপর।
অটঃ ( তিন ব্যাটাই সিলেটী )
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
সিলেটি এই কর্নেল কিন্তু ২৫শে মার্চ রাতেই নিহত হন। আর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম পরিষ্কার উল্লেখ করেছেন, নিজেদের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করেই কর্নেল চৌধুরী আর মেজর জিয়া প্রিয়েমটিভ অ্যাটাকে যেতে উৎসাহ পাননি।
তাহলে উনি কর্ণেল এমআর চৌধুরী। উনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ আছে আমার। পরে পোষ্টাবো।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
১৮ মার্চ রাতে রফিকুল ইসলাম রেলওয়ের পাহাড়ে মেজর জিয়াউর রহমান এবং লে: কর্নেল এম আর চৌধুরীর সাথে বৈঠক করেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের পর লে: কর্নেল এম আর চৌধুরী ছিলেন ইবিআরসি (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার)-তে সবচেয়ে সিনিয়র বাঙালি অফিসার। হিমু ভাই কি এই বৈঠকের কথা বলছেন?
সোয়াত একটি জাহাজের নাম( যদিও পাকিস্তানেরই একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের নাম সোয়াত )।
শুনেছি জাহাজটি ভরে চট্টগ্রামে অস্ত্র এসেছিল।
একটু আগেই পাঠক-ঘোষক নিয়ে একটা লেখা পড়ার সময় ঠিক আপনার এই ছড়াটির কথাই মনে হইল।এরপরে আসলেই আর কিছু বলার থাকে না!
স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়ে যাবার পরেও যে জাতি সঠিক ইতিহাস জানেনা তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেউ আছে কিনা সন্দেহ থেকে যায় ...
'সঠিক ইতিহাস জানে না' কথাটা কিন্তু ঠিক না। এই যে বিতর্ক, মেনে নিলাম ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু ভেবে দেখেন তো, এটাকে কি কোনোভাবেই 'অন্যরকম' করা গেছে? চেষ্টা চলেছিলো, কিন্তু কামিয়াব হতে পারেনি। সঠিকটা না জানলে এই প্রতিরোধটা কি কখনো আসতো???
আমরা দূর্ভাগা নই, অলস, অক্ষম। নইলে 'ইতিহাস চোখের সামনে খোলা পড়ে থাকবে আর আমরা সবাই দেখে জেনে নেবো' এই জ্ঞানটুকু আমাদের আসে কোথা থেকে? আমরা খুঁজিনা, চোখ বন্ধ করে কেবল বলে দেই যে, এদেশের কোনো সঠিক ইতিহাস নেই। একবার চেষ্টাও করিনা আসলটা জানার। জানার পথে পা বাড়ালেই নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে জেনে নেয়া যায় - কোনটা আসল আর কোনটা নকল।
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
জটিলস্য জটিল ...
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
চমৎকার। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে অর্থহীন বিতর্কের আসলেই মানে হয় না।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আর কী বলার আছে, আর কী বলার থাকে বাকি!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
- আয়নামতি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
অসাধারণ
ধৈবত
এই সত্যি কথাটা স্বীকার করে নিলে কোথায় কোন প্রবলেমটা হয়, আমার মোটামাথায় কখনোই আসে না।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ইতিহাস বদলায় না । একদিন না একদিন সত্য কথা প্রকাশ পাবেই । ছড়া টা মজা লেগেছে
ইতিহাস মুছে ফেলার কোনো উপায় নেই - এটাই আসল কথা। যা সত্যি, তা সবসময় সব অবস্থাতেই সত্যি, মিথ্যা দিয়ে চিরকাল ঢেকে রাখা সম্ভব না। কেন যে এই সহজ সাধারণ কথাগুলো বড় বড় মানুষেরা বোঝে না! ছড়াটা ভাল লেগেছে।
স্যালুট
দারুণ ছড়া।
চমৎকার ছড়া!!
কাদের সিদ্দিকীর পাল্টি-খাওয়া দর্শন বেদনাদায়ক বটে!
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
জিয়া তখন নিশ্চিত ছিল না, ব্যাপারটা স্বাধীনতা যুদ্ধ হতে যাচ্ছে নাকি সেনা বিদ্রোহ। বুদ্ধিমানের মতো দূর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের জন্য কালুর ঘাটের ওপারে চলে যান। পরিস্থিতি তাৎক্ষনিকভাবে পাকিদের নিয়ন্ত্রনে/ অনূকুলে গেলে তিনি বিদ্রোহীদের বিচারের দায়িত্বও পেয়ে যেতেন না এটা বলা মুশকিল। অস্পষ্ট লোকদের নিয়ে কোন বিপ্লব হয় না, এটা মেজর রফিক হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
অস্পষ্ট লোকদের নিয়ে কোন বিপ্লব হয় না, এটা মেজর রফিক হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল।
...এই কথাটা বংগবন্ধুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে উনি বলতেন, আমি তো ছয় দফার মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকার চেয়েছিলাম।ঠিক যেমন আগরতলা ষড়যন্ত্র সত্য হলেও, জীবন বাঁচানোর জন্য তা অস্বীকার করেছেন।
জিয়া রাজনৈতিক নেতৃত্তের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েই মুজিবের নাম নিয়েছেন।অফিসিয়ালি স্বাধীনতা দিবস ২৫/২৬ মার্চ যাই হোক, দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকা দিশাহারা সংগ্রামী বাংলার সন্তানেরা সেই মূহুর্ত থেকেই সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
যতই ব্যংগ করুন, গালি দিন, যুদ্ধের ময়দানে থাকা সৈনিক আর মুক্তিযোদ্ধারা, যারা পেন পেপারের টাইগার নয়, ময়দানের যোদ্ধা তারা সারজীবন ওই ঘোষণাকেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলে মনে রাখবে।
কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের ট্র্যান্সমিটারের সাধ্য ছিলো না চট্টগ্রামের কয়েক বর্গকিলোমিটারের বাইরে ট্র্যান্সমিট করার। জিয়াউর রহমানের ঘোষণার বহু আগেই সারা বাংলাদেশে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলো আক্রমণের শিকার হয়ে অথবা আগাম আক্রমণ করে সেনানিবাস ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।
একটু লেখাপড়া করলে সমস্যা কি ভাই? বিএনপি করলেই কি মূর্খ থাকতে হবে? জিয়াউর রহমানরে জোর কইরা কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের খণ্ডকালীন আরজে না বানাইয়াও তো ১৯৮১ সালের ২৯মে পর্যন্ত লোকজন বিএনপি করছে। করে নাই? যে জিয়াই কোনোদিন নিজেরে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে নাই, তার ইজ্জতটা বারবার ক্যান মারেন?
স্বাধীনতার ঘোষক ব্যপারটার চেয়েতো যেড ফোর্সের অধিনায়ক আরো গৌরবের পরিচয় হওয়া উচিত ছিল। এই স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া ব্যাপারটার শুরু ঠিক কবে থেকে বা কার মাথা থেকে এইটা বলতে পারবেন?
ছড়ায় ৫
দুঃখজনকভাবে, সম্ভবত ঐটাও খুব একটা গৌরবজনক নয়। কথিত আছে, মুজিব বাহিনী মাঠে নামার পর জিয়া সেক্টর কাঠামো থেকে বেরিয়ে নিজের নামে "জিয়া বাহিনী" গঠন করেছিলেন। এতে কর্নেল ওসমানী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং জিয়াকে শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নেন। তাজউদ্দীন তাঁকে নিবৃত্ত করে একইভাবে খালেদ বাহিনী ও সফিউল্লাহ বাহিনী গঠনের আদেশ দেন। এগুলোই জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে পরিচিত হয়। তবে আমি এখন এই তথ্যের কোনো রেফারেন্স দিতে পারছি না।
জিয়াউর রহমান একজন দক্ষ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পদকও পেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার পারফরম্যান্স নিয়ে তার অধীনে লড়াই করা অফিসারদের লেখা বইতেই নানা ক্ষোভের কথা লেখা আছে। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম আর মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম, দু'জনের বইতেই জিয়ার যুদ্ধকালীন অদূরদর্শিতা ও হঠকারী কার্যকলাপের বিবরণ আছে।
জিয়াকে ঠিক কবে থেকে আর কে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বাজারে ছেড়েছে, এ ব্যাপারে একটা গবেষণা করা যেতে পারে।
রিটন সাহেবের মত খ্যাতনামা 'কাল্টিজমের' সুবিধা নিয়ে ইতিহাসকে আরেকবার স্পিন করালেন দেখে খুব খারাপই লাগলো আর তার সাথে সচলের এতগুলা বুদ্ধিমান কাল্টিস্ট সায় দিয়ে গেলেন, বাহ বাহ!!! রিটন সাহেব কতবড় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন জানিনা, তারচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী সম্প্রতি আবারো স্পষ্টভাবে বলেছেন 'যে ঘোষনায় মুক্তিযুদ্ধের কাজ হয়েছিল সেটা হলো জিয়াউর রহমানের'। একজন কে দেখলাম মেজর রফিকের (যিনি একজন আওয়ামী মন্ত্রী ছিলেন পরে) বইয়ের প্রসংগ টেনেছেন, এইরকম কয়েকটা বইতে আবার জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষনার কথাই বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে যে আটজন মেজরকে দিয়ে সেনাকমান্ড তৈরি করা হয়েছিল তাদের মধ্যে এই রফিক সাহেবের নাম নেই। পড়ে দেখতে পারেন 'মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরীর 'এক জেনারেলের নীরব স্বাক্ষ্যঃ স্বাধীনতার প্রথম দশক'। আর মেজর রফিকের কথার যদি এত গুরূত্ব থাকে তাহলে তার এই কথা ভালোভাবে নিতে পারার মানসিকতা আছে কি?
"পাক সামরিক জান্তার ২৫ শে মার্চের হামলার পর একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করার কোন পূর্ব পরিকল্পনা ও পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জনগনকে কামানের গোলার মুখে ফেলে রেখে কলকাতায় পাড়ি জমালেন। অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত নেহেরুর সুযোগ্যা উত্তরাধিকারীন মিসেস গান্ধী এমন একটা মাহেন্দ্রক্ষনের জন্যে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী এই মাহেন্দ্রক্ষনটিকে যথাসময়ে কাজে লাগালেন।"
'পঁচাত্তরের রক্তক্ষরন', মেজর রফিকুল ইসলাম পি এস সি (মুক্তিযোদ্ধা এবং সাবেক আওয়ামী মন্ত্রী), পৃষ্টা-৫২-৫৩"
জিয়াউর রহমানকে ডিমাইজ করার এই নষ্ট খেলার শরিক হওয়া হয়তো আপনাদের কাল্টীয় অধিকার। কিন্তু বিবেক পরিস্কার থাকলে একটু মনে করার চেষ্টা করেন ১৯৮১ সালের ১লা জুন ঢাকা শহরের কথা। 'এক কফিনের পাশে বাংলাদেশ'। সেটাই তার আকাশ সমান জনপ্রিয়তার প্রমান।
এ জন্যই বারবার বলি, পড়াশোনার কোনো বিকল্প নাই। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম আর মেজর রফিকুল ইসলাম পি এস সি এক ব্যক্তি নন। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ইপিআরের ক্যাপ্টেন ছিলেন, তিনি বিশিষ্ট এ-ই কারণে, যে মুক্তিযুদ্ধে তিনি হচ্ছেন একমাত্র সেনা কর্মকর্তা, যিনি প্রিয়েমটিভ অ্যাটাক শুরু করেছিলেন। তার সম্পর্কে আরেকটু খোঁজ নিন, পড়াশোনা করুন। তিনি ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে যে আটজন মেজরকে নিয়ে সেনাকমাণ্ড হয়েছিলো, সেখানে এই বেচারা রফিক সাহেবের নাম নেই কারণ তিনি একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন তখন। সেনাকমাণ্ডে নাম না থাকলেই যে তিনি ফালতু হয়ে গেলেন, এটাই কি আপনার যুক্তি? ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নামও তো ওখানে ছিলো না। আজ কি তাহলে মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরকে বানের পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে?
আজকে গোলাম আ্জম মারা গেলেও প্রচুর লোক তার কফিনের আশেপাশে জড়ো হবে। আশা করি সেটাকেও আপনি এক কফিনের পাশে বাংলাদেশ হিসেবে বেচে দিতে আসবেন।
সংযোজন: মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের প্রতি বিএনপির সবারই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ তিনি চট্টগ্রামে স্বতপ্রণোদিত প্রতিরোধ শুরু না করলে জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগটাও পেতেন না, ঘোষণা দেয়া তো পরের কথা। কালুরঘাট এলাকা দখল করতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিলো, এবং সেটার পুরো কৃতিত্বই সেদিনের ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনে ইপিআর বাহিনীর।
বেশিদিন যাতে ইতিহাসমূর্খ থাকতে না হয়, সেজন্যে সাজেস্ট করছি, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের "লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে"। ইন্টারেস্টিং বই, প্রচুর ডিটেইল পাবেন। পড়ুন, জানুন, শিখুন। আর মেজর জেনারেল চৌধুরীর যে বইটা সাজেস্ট করেছেন, সেটা পুরোটা মন দিয়ে পড়ুন, জিয়াউর রহমান সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য আছে তাতে। কামালপুর অপারেশনে জিয়ার হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্যে বিপুল সংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছিলেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত আছে। জিয়া যখন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসি দিচ্ছিলেন, তখন মেজর জেনারেল চৌধুরী কীভাবে তৎকালীন ডিএফআই [এখন ডিজিএফআই] এর চোখ এড়িয়ে আত্মীয়ের বাড়ির পাঁচিল টপকে জেনারেল ওসমানীর কাছে করজোড়ে তাদের প্রাণভিক্ষা করেছিলেন, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে। মনে হয় পড়েন নাই। বইয়ের নাম রেফার করার আগে একটু মন দিয়ে পড়ে দেখবেন। শাহাদুজ্জামানের মতো শুধু নাম আউড়ে কাজ চালালে হবে না, পড়তে হবে।
...........................
Every Picture Tells a Story
খুব ভালো লাগল। মূলধারা ৭১ বইটা পড়ে এই ভীষণভাবে স্পষ্ট কিন্তু ঘোলাটে বানানো অধ্যায়টা আরো স্পষ্ট হয়েছে । ধন্যবাদ
মাহবুব বাবুই
দারুণ এই ছড়ার জন্য লুৎফর রহমান রিটনকে অভিনন্দন। ২০০৪ সালে লেখা হয়েছে যে ছড়া এত সময় কেন লাগল সেটা আমাদের কাছে পৌঁছতে, ভেবে আক্ষেপ জাগে। নিশ্চয়ই পত্রিকাঅলারা ছাপতে সাহস পায়নি। ইতিহাসেরও একই অবস্থা। তেমনভাবে তুলে ধরার জন্য কোনও কাগজ বা ব্যক্তি এগিয়ে আসেনি। সেজন্যই ছড়ার প্রথমদিকেরই একজনের প্রশ্ন এমন ধারার : "সোয়াতে অস্ত্রখালাস থেকে একেবারে স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ - এই বিশাল ব্যবধানটা উনি কিভাবে পাড়ি দিলেন এত অল্প সময়ে ?" তবে অত ইতিহাস না জেনেও একটু খোঁজখবর জানা থাকলেই প্রশ্নকর্তা বুঝতে পারতেন যে, অস্ত্র খালাসের ব্যাপারটিই জিয়ার পক্ষে স্বাভাবিক ও মানানসই, পরবর্তী ভূমিকা অনন্যোপায়জনিত বা কোনও যড়যন্ত্রে জড়িত থাকার ফল, কারণ অল্পসময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেই তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে তাঁর পশ্চাৎযাত্রার হীন চক্রান্ত বাস্তবায়নে নেমে পড়েন। এটা কেন আমরা ভুলে যাই?
জিয়াউর রহমানের ভক্তরা, আপনারা আশা করি ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের সল্ট লেক সিটি থেকে প্রকাশিত ডেজার্ট নিউজ পত্রিকার সংবাদকে অবিশ্বাস করবেন না। ঐ পত্রিকায় তো আওয়ামী লীগের কেউ ছিলো না, তাই না? এই পত্রিকায় দেখি তারা আমাদের মেজর জিয়াকে দুই পয়সা দাম না দিয়ে কোথাকার এক শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাপিয়ে দিয়ে বলছে, SHEIKH MUJIBUR RAHMAN PROCLAIMS INDEPENDENCE । এদের কী করা উচিত বলেন তো? শফিক রেহমান আর মাহমুদুর রহমানের কাছে সাংবাদিকতা শেখানোর জন্য পাঠানো উচিত না কানে ধরে? আপনারাই বলেন? শালার মুরুক্ষুগুলি, মানী লুকের মান রাক্তে জানে না।
হিমু ভাইয়ের শেষের কথাটি আসলেই ভেবে দেখার মতো। নিজেদের চোখে যখন সত্যিটা ধরা পড়ে না, বিদেশির চোখ দিয়েই নাহয় দেখুন। বস্তুতঃ জিয়া ছিলেন একজন সুবিধাবাদী সামরিক অফিসার, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে ছিল একটা 'লাকি ডাক'। শুধু শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
আজ জাতি হিসেবে যে আমরা এতটা বিপর্যস্ত ও দ্বিধাবিভক্ত, তার কারন তো এই যে- যে মানুষটি আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন, তাকেসহ তার প্রায় পুরো পরিবারকে আমরা বুলেট দিয়ে ঝাঁজরা করে দিলাম। তাঁর যদি ভুল থাকতোই, তাহলে সেটার বিচার হতে পারতো- এতগুলো নিষ্পাপ মানুষকে মেরে তো নয়! আজ সেই জিয়ার ছেলেরা দেশকে যখন চুষে ছিবড়ে করে দিলো, কোন সামরিক অফিসার এসে কি তারেক, কোকো আর খালেদাকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলেছে? একটা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশকে আবার গড়ে তোলার জন্য দরকারি সময় কি আমরা তাকে দিয়েছি? তিনি কিন্তু ঠিকই একটা দক্ষ মন্ত্রিসভা আর সরকার কাঠামো তৈরি করছিলেন, পররাষ্ট্র বিষয়ে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। কিছু লোভী মানুষ আমাদের জাতির কপালে অকৃতজ্ঞতার কালিমা লেপে দিয়েছে- এ কালি কি কখনো মোছার নয়?
নতুন মন্তব্য করুন