২০০১ এর জুন থেকে আমি দেশান্তরী। ২০০৭ এর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারিনি। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে জাপান। জাপান থেকে আমেরিকা। আমেরিকা থেকে কানাডা। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। লম্বা জার্নি। জীবনটা কাটছিলো মোটামুটি দৌঁড়ের ওপর। কতো কতো প্রিয় জিনিস যে ফেলতে ফেলতে গেলাম! কতোজন যে আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো! কতোজন যে আমার হাতটি ছেড়ে দিলো! কিন্তু একজনের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার ছিন্ন হলো না। তিনি হুমায়ূন আহমেদ।
আমি যেদিন সন্ধ্যায় দেশ ছাড়ি সেদিন বিমানে আমার সঙ্গে ছিলো হুমায়ূনের বই। টোকিওর একটি হাসপাতালে আমার স্ত্রী শার্লির অপারেশন হলো। প্রতিদিন সকালে হাসপাতালে যাই ফিরে আসি রাত বারোটায়। বারোটার পর আর ওখানে থাকার নিয়ম নেই। কড়া ডোজের পেইন কিলার ইনজেকশন নিয়ে শার্লি হাসপাতালের বেডে ঘুমিয়ে থাকে। আমি ওর পাশে সারাদিন বসে থাকি। আমার সঙ্গে থাকে হুমায়ূনের বই।
কানাডার ইউনিভার্সিটিতে আমার কন্যা নদীর ক্লাশ কিংবা পরীক্ষার কারণে ওকে পৌঁছে দিয়ে ওখানেই গাড়ি পার্ক করে তিন চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আমার একটুও বিরক্তি লাগে না কারণ আমার সঙ্গে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। এখন প্রতি বছর কানাডা থেকে বাংলাদেশে যেতে অটোয়া-হিথ্রো-দুবাই-ঢাকার দীর্ঘ ক্লান্তিকর বিমান যাত্রায় আমার সমস্ত ক্লান্তি মোচনে সঙ্গী হিশেবে উপস্থিত থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। ফিরতি পথেও ধ্রুব এষের অসাধারণ প্রচ্ছদের ভেতর থেকে হুমায়ূন আহমেদ যেনো পরম মমতায় তাঁর হাতটি বাড়িয়ে দেন—এনিমেশন মুভিটা দেখার পরে একটা ব্রেক নাও, তারপর নো চিন্তা, আমি তো আছিই...।
হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া আমাদের ঈদ হয় না। ঈদের রাতে টিভিতে হুমায়ুনের নাটক না দেখলে বাঙালির কি ঈদ পরিপূর্ণ হয়? আমার এক নিত্যশুভার্থীর কল্যাণে ঢাকার ঈদ সংখ্যাগুলো দ্রুতই চলে আসে কানাডায়, আমার হাতে। গত ঈদের আগে আগেও পেয়েছিলাম বিশাল একটা ওজনদার প্যাকেট। প্যাকেটের ভেতর প্রথম আলো, আনন্দ আলো, অন্যদিন, সাপ্তাহিক, আর ইত্তেফাক। অন্যদিনের হিমু, ইত্তেফাকের মিসির আলী, প্রথম আলোর মেঘের ওপর বাড়ি আর আনন্দ আলোর কবি সাহেব পড়েছি সবার আগে। তারপর বাকিদের বাকি লেখাগুলো।
কানাডায় একান্ত পারিবারিক পরিবেশে আমাদের বাড়িতে পালিত হয় প্রিয়জনদের জন্মদিন। সেটাও আবার সপ্তাহ ব্যাপী। যেমন সত্যজিৎ সপ্তাহ। অমিতাভ সপ্তাহ। বিশেষ সেই সপ্তাহে সাতদিন ধরে আমাদের বাড়িতে চলে সত্যজিতের বই পুনঃপাঠ এবং সত্যজিতের ফিল্মগুলোর প্রদর্শনী। প্রতিরাতে একটা করে। হীরক রাজার দেশে দিয়ে শুরু আর শেষ হয় পথের পাঁচালি দিয়ে। অমিতাভের ক্ষেত্রে তাঁর অভিনীত ছবিগুলো দেখি। প্রতিরাতে একটা করে। শোলে দিয়ে যার শুরু হয়। একই পদ্ধতিতে চলে চার্লি চ্যাপলিন আর মিঃ বিন সপ্তাহ। তবে সবচে আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হয় হুমায়ূন সপ্তাহটি। এই সময় আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীও থাকেন দর্শকের আসনে। বাকিদের বেলায় দর্শক আমি একাই।
১৯৯৪ সালে অবসর থেকে প্রকাশিত আমার বই ‘ভূতের জাদু’ আমি উৎসর্গ করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদকে। বইটির প্রকাশক আলমগীর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বইটি তাঁর হাতে অর্পণ করতে গিয়েছিলাম। তিনি তখন হাতিরপুলের ল্যাবএইডসংলগ্ন এপার্টমেন্টে থাকেন। তিনি নিজে ফ্লোরে বসতেন। অতিথিদেরও ফ্লোরেই বসাতেন। আমাদেরও ফ্লোরে বসিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন। উৎসর্গ পাতাটা খুলে মিষ্টি করে হেসেছিলেন। কন্যাদের ডেকে আনন্দ শেয়ার করেছিলেন।
১৯৯৫ সালে আমার সম্পাদিত ছোটদের কাগজ পত্রিকাটিতে ‘কালো জাদুকর’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ূন। আসলে আমাদের সাহিত্যে হুমায়ূন নিজেই একজন জাদুকর। অসামান্য জাদুকর। এমন সম্মোহনী শক্তি নিয়ে আর কেউ আসেননি। আমরা আমাদের সময়ে একজন হুমায়ূন আহমেদকে পেয়েছি। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। (‘কালো জাদুকর’ তিনি শেষ করেননি ছোটদের কাগজে।)
২
কতো স্মৃতি এই মানুষটাকে ঘিরে!
১৯৮৫ সালের শেষ দিকের কথা। তখন দেশে কম্পিউটার আসেনি সুতরাং কম্পিউটার কম্পোজ বলে কোনো জিনিস ছিলো না। ছিলো হ্যান্ড কম্পোজ আর মনো টাইপ। নবাবপুর রোডের মডার্ণ টাইপ ফাউন্ড্রির মালিক নাজমুল হক ‘অনিন্দ্য প্রকাশন’ নামে নতুন একটি প্রকাশনা সংস্থা চালু করেছিলেন। অনিন্দ্য থেকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘এইসব দিনরাত্রি’ বেরুবে। ছোটদের জন্যে আমার প্রথম গল্পের বই ‘নিখোঁজ সংবাদ’ও বেরুবে ওই প্রকাশনা সংস্থা এবং ওই মডার্ণ প্রেস থেকেই। প্রায় সারাদিনই কেটে যায় প্রেসের ভেতরেই। প্রুফ দেখা। মেকাপ করা। অনেক কাজ। রোজ দেখা হয় হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁকে একটা নড়বড়ে হোন্ডায় বসিয়ে ওখানে নিয়ে আসেন দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। পাশাপাশি টেবিলে বসে আমরা কাজ করি। মাঝে মধ্যেই হুমায়ূন ভাই রঙ্গ-তামাশায় মেতে ওঠেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই ঘাড় গুঁজে একটানা লেখেন অথবা প্রুফ সংশোধন করেন বা ফাইনাল প্রিন্টঅর্ডার দেন। অসাধারণ রসিক মানুষ হুমায়ূন ভাই। কাজের ফাঁকে আমরা আড্ডা দেই জম্পেশ। প্রকাশক নাজমুল হকের ছিলো বিশাল বপু। একটা বড় চেয়ারে বসে থাকতেন। আমাদের কথায় নাজমুল হাসতেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে। চেয়ারে বসা অবস্থায় নাজমুল তার হাত দুটি ভাঁজ করে বিশাল ভূঁড়ির ওপর রাখতেন। তার হাসি শুরু হতো পেটের নিচ দিক থেকে। প্রথমে পেটের নিচের অংশে একটা কাঁপুনি তৈরি হতো। তারপর কাঁপুনিটা একটা দুলুনি হয়ে ধিরে ধিরে পেটের ওপর দিকে উঠতে উঠতে প্রায় বুকের কাছে এসে দুলতে থাকতো। পেটের ওপর ভাঁজ করে রাখা দুই হাতের কব্জিতে তখন একটা রিদম তৈরি হতো। নাজমুল ভুট্টা অর্ডার দিতেন। কয়লাপোড়া ভুট্টা খেতে খেতে আমরা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা উপভোগ করতাম। হুমায়ূন ভাই খুব আগ্রহ নিয়ে খেতেন এই ভুট্টাপোড়া। দীর্ঘদিন আমেরিকায় পড়াশুনা ও বসবাসকারী এই নাজমুল আমাদের প্রকাশনা জগতের ইতিহাসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সালেহ চৌধুরীর নড়বড়ে হোন্ডায় হুমায়ুণ ভাইকে আসতে যেতে দেখে তিনি এক কাণ্ড করলেন। হুমায়ূন ভাইকে রয়্যালিটির টাকা দেই-দিচ্ছি দেই-দিচ্ছি করে কিছুদিন ঘুরিয়ে হঠাৎ একদিন শাদা একটা গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন হুমায়ূন ভাইকে। হুমায়ূন ভাই সবাইকে চমকে দেন কিন্তু নাজমুল চমকে দিলেন স্বয়ং হুমায়ূন ভাইকেই! বলেছিলেন--এটাই আপনার রয়্যালিটি! হুমায়ূনের আহমেদের জীবনে সেটাই ছিলো প্রথম গাড়ি। সেই গাড়িতে চড়ে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে রামপুরা টিভি ভবনেও গিয়েছি অনিন্দ্য প্রকাশনীর কাজ সেরে। প্রকাশক কর্তৃক লেখককে গাড়ি দেয়ার ঘটনা আমাদের দেশে সেটাই ছিলো প্রথম এবং শেষ ঘটনা। বাদবাকি প্রকাশকদের চক্ষু উঠেছিলো কপালে। সে অন্য কাহিনি। ঘটনায় ফিরে আসি। এক বিকেলে সেই জম্পেশ আড্ডায় বিটিভি প্রযোজক ও লেখক আলী ইমাম সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিচ্ছি। হুমায়ূন ভাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আলী ইমাম ভাইয়ের অসাধারণ একটা গুণের কথা বললাম। গুণটি হচ্ছে—টাইম ধরে ঘুমানো। আলী ইমাম চাইলে কাজের ফাঁকে দশ কিংবা পনেরো মিনিটের একটা সলিড ঘুম দিতে পারেন। তিনি নিজের ইচ্ছে মাফিক কাজটা করেন। কেউ তাকে জাগিয়ে দেয়না। ঘড়িতে এলার্মও বাজেনা। কিন্তু আলী ইমাম ঠিক ঠিক জেগে ওঠেন সময় মতো। দশ মিনিট চাইলে দশ মিনিট। বারো মিনিট চাইলে বারো। এমনও হয়েছে, সারারাত ছবি দেখেদেখে ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা শুতে গেছি। আলী ইমাম বললেন, সকাল সাতটায় রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম আছে। আমি পৌণে এক ঘন্টা ঘুমাবো। তারপর উঠে গোসল করে রেডিওতে চলে যাবো। তোমরা ঘুমিয়ে থেকোও। এসে নাস্তা করবো একসঙ্গে। এবং ঠিক ঠিক তাই-ই হলো। আমরা(আমি, আমীরুল ইসলাম সহ আরো চার পাঁচজন)ঘুমিয়ে আছে। আর আলী ইমাম টাইমলি জেগে লাইভ রেডিও প্রোগ্রাম শেষ করে আমাদের এসে জাগালেন। তো হুমায়ূন ভাই এই গল্পটাকে বিশ্বাস করলেননা। তিনি বললেন, তোমাদের চমকে দেবার জন্যে এটা হয়তো আলী ইমামের একটা টেকনিক। ও হয়তো ঘুমাতেই যায়নি। সারারাত জেগেই ছিলো। কিংবা দশ মিনিটের কথা বলে ও হয়তো ঘুমায়ইনা। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। তারপর সময় মতো জেগে উঠে চমকে দেয় তোমাদের। এই প্রবণতাটার একটা ইংরেজি নামও বললেন হুমায়ূন ভাই। এই মুহূর্তে নামটা মনে নেই। এর কয়েকদিন পর। সেই মডার্ণ প্রেস। তখন প্রায় সন্ধ্যা। পাশের টেবিলে হুমায়ূন ভাই খসখস করে লিখে চলেছেন। হঠাৎ দেখা গেলো হুমায়ূন ভাইয়ের লেখা বন্ধ। কলম বন্ধ করে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন তিনি। তারপর চশমাটা খুলে চোখ মুছলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার হুমায়ূন ভাই!
হুমায়ূন ভাই চোখ মুছতে মুছতে বললেন, এইসব দিনরাত্রির শেষ লাইনটা এইমাত্র লিখলাম। একটা পরিবারের সঙ্গে এইমাত্র আমার এতোদিনের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলো।
ঘটনাটা আলী ইমামকে বললাম। সব শুনে আলী ইমাম বললেন, ওটা হুমায়ূন ভাইয়ের একটা টেকনিক। তোমাদের চমকে দেবার জন্যে হুমায়ূন ভাই কাজটা করেছেন। ( হেহ্ হেহ্ হে...)
৩
তখন বাংলাদেশে কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিলো না। টিভি বলতে বাঙালির ছিলো সবেধন নীলমনি বিটিভি। এবং বিটিভির শাদাকালো আমলে বাঙালির একজন হুমায়ূন আহমেদ ছিলো। সেই হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি খুব সুখি ছিলো। বাঙালি মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনার অপরূপ রূপকার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ উৎসব হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া আনন্দময় হতো না, পরিপূর্ণতা পেতো না। মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ উৎসবে পোলাও-কোর্মা, ফিন্নি-শেমাই এবং নতুন জামা-কাপড়ের সঙ্গে হুমায়ূনের ঈদের নাটকও ছিলো একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ঈদের সারা দিনের নানান সামাজিক-পারিবারিক আমন্ত্রন-নিমন্ত্রন, সৌজন্য-সাক্ষাৎ, ভোজের আয়োজন এবং অতিথি আপ্যায়নের বিচিত্র ঝক্কি-ঝামেলার পর সন্ধ্যায় টিভি সেটের সামনে আয়েস করে বসে বাঙালি অপেক্ষা করতো হুমায়ূনের নাটকের। সন্ধ্যার পর রাস্তায় লোক চলাচল কমে যেতো। একজন হুমায়ূন আহমেদের একটি টিভি নাটক দেখার জন্যে বাঙালির সম্মিলিত অপেক্ষার সেই চিত্রটি ছিলো অকল্পনীয়। না, শুধু রাজধানী ঢাকার চিত্র ছিলো না এটা। পুরো বাংলাদেশেরই ছিলো একই অবস্থা। হুমায়ূন আহমেদের ঈদের নাটকটি ছিলো মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্যতম প্রধান বিনোদন মাধ্যম। ফাঁকা রাস্তা। হুমায়ূনের নাটক চলছে বিটিভিতে। বিভিন্ন বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সম্মিলিত আনন্দময় হাস্যধ্বনি শোনা যেতো। মাঝে মাঝেই অট্টহাসির উল্লাসধ্বনিও জানান দিতো যে হুমায়ূন আহমেদ নামক একজন জাদুকরলেখক-নাট্যকারের ঈদের নাটকটি বাঙালি উপভোগ করছে। একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটেছে বছরের পর বছর।
ঈদের বিশেষ নাটক ছাড়াও হুমায়ূনের কোনো সাপ্তাহিক কিংবা ধারাবাহিক নাটক প্রচারের রাতেও একই পরিস্থিতি। রাস্তা ফাঁকা। বাড়ির অধিকাংশ সদস্যই টিভি সেটের সামনে। শুধু হাসির নাটক নয়, হুমায়ূনের দুঃখের বা কষ্টের নাটকও বাঙালি মধ্যবিত্তের চিত্তকে হরণ করতো অনায়াস দক্ষতায়। বিটিভিতে তাঁর প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তো ইতিহাস সৃষ্টিকারী। এই নাটকের ছোট্ট মেয়েটি—টুনি, ক্যান্সারে যার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু দর্শক সেটা মেনে নিতে পারছে না। ছোট্ট প্রিয় মেয়েটিকে মেরে না ফেলতে দর্শকরা কতো ভাবেই না অনুরোধ জানালো নাট্যকার হুমায়ূনকে! কিন্তু হুমায়ূন জেদী। তিনি টুনিকে মেরেই ফেললেন। ফলে, তাঁর বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও মিছিল হলো। ব্যানারে লেখা—টুনির কেনো মৃত্যু হলো/হুমায়ূন আহমেদ জবাব চাই।
বিটিভিতে হুমায়ূনের আরেকটি ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ প্রচারের সময়েও ঘটেছে একই কাণ্ড। এই নাটকে ‘বাকের ভাই’ নামের চরিত্রটির ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতেও মিছিল হলো। পত্রিকায় সে খবর ছাপাও হলো। জেদী হুমায়ূন বাকের ভাইকেও বাঁচালেন না। নাটকের প্রয়োজনে বাকেরকে মরতেই হবে। হুমায়ূন তাকে মারলেনই। দর্শকদের দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে নাটক বা গল্পের দাবিকেই মিটিয়েছেন নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশে টিভি নাটকের ইতিহাসে এইরকম ঘটনা আর কোনো লেখক-নাট্যকারের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
এরপর বাংলাদেশে প্রাইভেট টিভি চ্যানেল এসেছে। হুমায়ূন আহমেদকে বিভিন্ন চ্যানেল পাকড়াও করেছে। নাটক চাই। তিনিও লিখেছেন।
হুমায়ূনের নাটক ছাড়া তো ঈদের আনন্দ পূর্ণ হবার নয়!
বাঙালির ঈদ বিনোদনের আরেকটি অনুষঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। আর ঈদ সংখ্যারও প্রধান আকর্ষণ সেই একই ব্যাক্তি, হুমায়ূন আহমেদ। কোনো পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাস থাকা মানেই সেটি বিপুল পরিমানে বিক্রি হবার ক্ষেত্রে একটি নিশ্চিন্ত গ্যারান্টিসিল। সুতরাং হুমায়ূনের একটি উপন্যাসের জন্যে পত্রিকার মালিক-সম্পাদকের ছুটোছুটির অন্ত ছিলো না।
হুমায়ূনের উপন্যাস ছাড়া তো ঈদ সংখ্যাও পরিপূর্ণ নয়!
বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলা হুমায়ূন আহমদকে ছাড়া কি কল্পনা করা যায়? একজন হুমায়ূন আহমেদকে সামনা সামনি এক ঝলক দেখতে, তাঁর লেখা একটি বই কিনতে এবং বইতে তাঁর একটি অটোগ্রাফ পেতে বাঙালি ভিড় করেছে বইমেলায়। সেই ভিড় সামাল দিতে কর্তৃপক্ষকে পুলিশি সহায়তা নিতে হয়েছে প্রতিবছর। একবার তো এক মহাপরিচালক(সৈয়দ আনোয়ার হোসেন) হুমায়ূন আহমেদকে নিষেধই করেছিলেন যেনো তিনি বইমেলায় না আসেন! কী হাস্যকর!!
একুশের বইমেলায় বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট বইয়ের স্টলের সামনে আমরা দেখেছি সহস্র পাঠকের জমাট অপেক্ষা। প্রায় প্রতিদিন। উদ্দেশ্য—হুমায়ূনের সাম্প্রতিক বইটি সংগ্রহ করা! বাংলাদেশে আর কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এমনটি কখনোই ঘটেনি।
হুমায়ূনের বই ছাড়া তো একুশের বইমেলাও পরিপূর্ণ নয়!
তাঁর মতো আর কে পেরেছে বাঙালি মধ্যবিত্তের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম অনুভূতিগুলোতে এতোটা মমতার সঙ্গে আলো ফেলতে? তারচে বেশি কে চিনেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির চিরদিনের টানাপোড়েনগুলোকে? বাঙালি মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনা আর হাসি-কান্নার সঙ্গে একজন হুমায়ূন আহমেদ জড়িয়ে আছেন চারটি দশক ধরে একই ধারাবাহিকতায়! সমান দক্ষতায় বাঙালিকে তিনি হাসিয়েছেন। কাঁদিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ নামটা একাকার হয়ে মিশে আছে বাঙালির হাসিতে। বাঙালির অশ্রুতে।
হুমায়ূনহীন ঈদের টিভি, হুমায়ূনহীন ঈদ সংখ্যা আর হুমায়ূনহীন একুশের বইমেলাকে বাঙালি কী ভাবে উদযাপন করবে!
আজ অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানাচ্ছি বাঙালির প্রিয় কথক হুমায়ূন আহমেদকে।
অটোয়া, কানাডা, ২০জুলাই২০১২
ক্যাপশনঃ
১৯৮৫/৮৬ সালের ছবি। বেইলি রোড অফিসার্স ক্লাবে একটি বিয়ের রিসেপসন অনুষ্ঠানে আমরা। ডান দিক থেকে ইমদাদুল হক মিলন, সালেহ চৌধুরী, লিটলম্যাগ অনিন্দ্য সম্পাদাক হাবিব ওয়াহিদ, হুমায়ূন আহমেদ, আমি এবং হাবিবের একজন বন্ধু। আহারে! এই ছবির একজন মানুষ হুমায়ূন ভাই আজ চিরদিনের জন্যে ‘ছবির মানুষ’ হয়ে গেলেন!
মন্তব্য
অনুগ্রহ করে এই পোস্টে কেউ মোমবাতি জ্বালিয়েন না বড় দৃষ্টিকটু লাগে।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
http://www.sachalayatan.com/sites/all/modules/smileys/icons/candle.gif
এর সমস্যা কী?
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ছাগল। একটু ছাগলামী করলো আর কি!
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
অবোধ হিয়া বুঝে না বোঝে,
করে সে এ কী ভুল--
তারার মাঝে কাঁদিয়া খোঁজে
ঝরিয়া-পড়া ফুল।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
আপনার কথা গুলাই বলে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে
এখানে দেখেন
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে শেষ যে লাইনটা হুমায়ূন লিখে যেতে পারলেন না, সেটা কি ছিল?
ইন্টারভিউটা শুনলাম। ধন্যবাদ মাহমুদ।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
সাক্ষাৎকারের লিঙ্কের জন্য ধন্যবাদ, বাকের ভাইয়ের কুলখানি হইছিল নাকি? হাহাহাহহাহা...
স্মৃতিচারণ ছুঁয়ে গেল রিটন ভাই! বিশেষ করে এইসব দিনরাত্রির কথা মনে পড়ে গেল! অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহির ভিড়ে 'এইসব দিনরাত্রি'র কথা ভুলেই গেছিলাম! আমি নাটকটি ভাল করে দেখেছিলাম বিটিভির 'মনের মুকুরে' প্রচারিত হওয়ার সময়! কি অসাধারণ একটা নাটক! মধ্যবিত্তের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের এক অসামান্য কাহিনি!
গতকাল থেকেই অনেক আলোচনা হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে! কেউ কেউ আহমদ ছফার সেই উক্তিকে তুলে আনছেন যে, উনি বাজারের জন্য লিখতেন! কিন্তু যে লোকটির লেখা বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের কয়েক প্রজন্ম ধরে মাতিয়ে রেখেছিল, তাকে কি চাইলেই সাধারণের কাতারে নামিয়ে ফেলা যায়?
মামুন, বাঙালি বড়ই বিচিত্র।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
সাধারণ মানুষের প্রিয়তম লেখক হুমায়ূন। এটাই তা বড় গুণ। এরকম ভাবে আর কেউ পারে নি।
উনার আকর্ষণ আর প্রতিভা ছিল সফল এবং বহুমাত্রিক। উনি একাধারে সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, গীতিকার, পেইন্টার, জাদুকর। এত প্রতিভার অধিকারী মানুষ বিরল।
_____________________
Give Her Freedom!
ঠিক। কেউ পারেনি।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
চাদেরে কে চায় জোছনা সবাই যাচে
গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধুলি মাঝে।
তুমি বুঝিবে না- আলো দিতে পোড়ে কতো, কতো প্রদীপের প্রাণ।
নজরুল সত্যিটা বলে গিয়েছিলেন আগেই। কিন্তু তার সত্যিই শেষ সত্যি নয়। একজন পাঠক আমার কাছে হয়তো হুমায়ূনের স্মৃতি ফিঁকে হতে থাকবে এবং হয়তো কোনও একদিন ভুলেও যাবো তাকে। হয়তো তার জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীগুলোতে মনের দরজায় হুমায়ূনের মুখচ্ছবি একবার উঁকি দিয়ে চলে যাবে- যেমনটি ঘটেছে রুদ্র'দা বা অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই। কিন্তু আপনার মতো যারা তার জীবনে সাথে অথবা তিনি যেভাবে আপনাদের জীবনের সাথে জড়িয়েছিলেন, এই প্রস্থান আপনাদের জন্য একটা দীর্ঘস্থায়ী শুন্যতার সৃষ্টি করলো।
আপনার অশ্রু মোছাতে যাবোনা রিটন ভাই, বুকটা আপনার হালকা হোক।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
ধন্যবাদ আপনার মানবিক মন্তব্যের জন্য।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার স্মৃতিচারনের জন্য, হৃদয়ে গেথে থাকলো এই না বলা কথামালা।
#সাহিত্য বাগানের মূল গোলাপটি হারিয়েছে এখন আর বাগানকে দৃষ্টিকটু লাগবেনা কারন বাকি ফুলগুলোর অবস্থান এখন যে একই কাতারে। প্রিয় হুমায়ূনের জন্য সবসময় মনের প্রকোষ্ঠে একটি আলোকিত ঘর থাকবে।
..............
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বিদেশী মুভি, সিনেমায় দেখতাম, বাইরে কোন বই প্রকাশ পেলে পাঠকরা লাইন ধরে থাকতো কিনার জন্যে। বাংলাদেশে এটা দেখি নাই। তবে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বই প্রকাশের দিন যদি কতৃপক্ষ লাইন এর ব্যবস্থা করতে পারতো তবে বহুবার আমরা এরকম দৃশ্য দেখতাম। একটা বিশেষ প্রকাশনীর সামনে অসম্ভব ভীড় শুধু দেখেছি দিনের পর দিন।
অনেক টুকরো গল্প জানলাম রিটন ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
আপনিও একজন তারকা, তবুও হুমায়ুন আহমেদকে সেই সময় থেকে দেখছেন ভেবে ঈর্ষিত হলাম।
অনেক ধন্যবাদ রিটন ভাই। স্যারের চলে যাবার প্রাথমিক ধাক্কা মানুষ সামলে উঠার পর থেকে আজ সকাল থেকে খুব বাজে ভাবে তার সমালোচনা করছে। আমি দেখছি আর কষ্ট পাচ্ছি। তার মধ্যে আপনার এই লেখাটা অনেকটাই আমার কষ্ট কমিয়েছে। এইসব দিনরাত্রি নাটক আমার দেখা হয়নি। বহুব্রীহি নাটকটাও আমার জন্মের আগেই হয়ে গেছে। পরে আবার যখন দিয়েছিলো তখন দেখেছিলাম। তাও খুব ছোট ছিলাম। অনেক ভালো কিছু আমরা হয়ত দেখি নি স্যারের। কিন্তু এমন অনেক কিছু পেয়েছি যেটা অন্য কেউ দিতে পারে নি। অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে স্যারকে নিয়ে একটা কিশোরী কে সে কীভাবে রবীন্দ্রনাথ, হাসন রাজা, জোছনা আর প্রেম বুঝিয়ে ছিলো। আর কেউ পারে নি। আর কেউ পারবে না।
স্যার বেঁচে থাকবেন আমাদের মতো পাঠকের মধ্যে থাকবেন।
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
সুন্দর বলেছো।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
অনেক ভালো ভাবে লিখেছেন আপনার স্মৃতি চারণ । এই জাদুকরের সৃষ্টি গুলো আজীবন অমলিন থাক সবার কাছে । তার কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন হোক সে প্রত্যাশায় করি।
হুমায়ূন আহমেদের যে বইটা আমার সবচে বেশি বার পড়া হয়েছে, সেটি হলো 'অনন্ত অম্বরে'। গাঢ় নীল রঙের কাভারে আঁকা বইটা আমার কৈশোরে একটা সময়ের স্মৃতিকে তীব্রভাবে মনে করিয়ে দেয়। কোন উপন্যাস না, নিজের জীবনের ঘটনা নিয়ে লেখা এই বইটাই বোধহয় আমার সবচে প্রিয়।
গতকাল রাতে বাসায় এসেই ঘুমিয়ে পড়ায় আর মৃত্যু সংবাদ শোনা হয়নি। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই শোনামাত্র মনে হলো, অনন্ত অম্বরেই চলে গেলেন হুমায়ূন। বহুদিন বহু সমালোচনা, তর্ক বিতর্ক করেছি তার লেখালিখি নিয়ে- আজ বরং শৈশব কৈশোরের মুগ্ধতাটুকুই থাক। স্মৃতিতে অমলিণ থাকুন হুমায়ূন।
অলমিতি বিস্তারেণ
আমারো প্রিয় একটি বই 'অনন্ত অম্বরে'।
আমারো অন্যতম একটি প্রিয় বই "অনন্ত অম্বরে"। মনে আছে, ক্ষুধার্থ ছেলেগুলোর কথা পড়ে কেঁদেছিলাম।
•
____________________________________________
দেবাশিস মুখার্জি
[db.mukherjee.blog@gmail.com]
অল্পসল্প...কবিতা-গল্প...
ধন্যবাদ, ভাল লাগলো আপনার স্মৃতিচারণ।
অচিনপুর- আমার পড়া বেস্ট একটা লেখা ছিল। পড়া শেষে চোখ থেকে পানি পড়ছিল, আর ভাবছিলাম, মানুষ বাস্তবকে এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে পারে!
রিটন ভাই, মন খুব খারাপ হয়ে আছে। আপনার লেখাটা পড়ে আরো খারাপ হল।
আমার কৈশোর আর যৌবনের স্মৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে এই মানুষটা।
তাকে এমনি করে যেতে দিই কী করে?
আপনার লেখাটা বড্ড ভাল, কিন্তু বড্ড বেশি স্মৃতিকাতর করে দিয়ে গেল
শুভেচ্ছা জানবেন
১৯৮৮ সালের দিকে বোধহয় চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরীতে একটা বইমেলা হচ্ছিল। লাইব্রেরী তখন নতুন চারতলা দালানটিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। আমরা কয়েক বন্ধু বইমেলায় ঢোকার আগে পাশের মুসলিম হলের সামনের দেয়ালের উপর বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম এক সন্ধ্যায়। হঠাৎ খেয়াল করি লাইব্রেরীর একটা জানালার সামনে শত শত মানুষ গিজগিজ করছে। উঁকিঝুকি মেরে ভেতরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। রীতিমত ধাক্কাধাক্কি চলছে। সিনেমার স্যুটিং দেখার জন্য লোকজন যেরকম করে এটাও সেরকম মনে হলো। কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম লাইব্রেরীর একটা কক্ষে চশমপরা সাদামাটা চেহারার একটা লোক বসে আছে যাকে ঘিরে রেখেছে অনেক মানুষ। জানলাম উনি হুমায়ূন আহমেদ, যাকে এক পলক দেখার জন্যই এত ভীড়। অবাক হয়ে ভাবছিলাম বই পড়ে মুগ্ধ হতে পারে যে কোন লেখকের, কিন্তু তাকে দেখার জন্য এত হুড়োহুড়ি করার কি আছে। এমন রূপবান কোন পুরুষতো না। আসলে হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে কোন একটা ক্ষমতা ছিল মানুষকে আকৃষ্ঠ করার।
নাগরিক মধ্যবিত্ত পাঠক দর্শকদের বিনোদন দেবার এত বড় যাদুকর বাংলা সাহিত্যে আর ছিল কিনা আমার জানা নেই। অনেক বছর হুমায়ূন পড়িনি, কিন্তু আমার পুরোনো স্মৃতিতে এক দেড় যুগ আগের যে হুমায়ূনকে দেখি সে হুমায়ূনের দখলে ছিল আমাদের আনন্দ বেদনার অনেকখানি। বিটিভি নাটকে হুমায়ূন আহমেদের কোন প্রতিযোগী ছিল না। আর কোন নাট্যকার দর্শককে এতখানি আনন্দ দিতে পারনো না। সিরিজগুলো বাদেও এক খণ্ডের কতগুলো অসাধারণ নাটক তৈরী হয়েছিল, যার একটি 'একদিন হঠাৎ'। সেই নাটকে আরেক কিংবদন্তী হুমায়ূন ফরিদীর সেই অভিনয় কে ভুলতে পারবে? এই নাটকটির মতো হাস্যরসের নাটক দ্বিতীয়টি তৈরী হয়নি। অথচ এই নাটকগুলো বিটিভির অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয় এদ্দিনে। ব্যক্তিগতভাবে সব মিলিয়ে আমি আশির দশকের হুমায়ূন আহমেদকে খুব বেশী মিস করবো।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার কাছে হুমায়ূন আহমেদ নামটা মনে পড়লেই আরেকটা নাম মনে পড়ে। মিশির আলি।
একেবারে অন্যধরনের এই চরিত্রটা আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে আজও।
আপনার লেখাটা খুবই সুন্দর। কিন্তু মনকে আরেকটু ভারি করে দিল।
বিতর্ক যেরকম ছিল, প্রাথমিক শোকের আবহ কেটে গেলে তেমন ভাবেই থাকবে কিন্তু তাঁর লেখাগুলোও থেকে যাবে যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে।
অনেক কথাই বলার ছিল, তবে এই বিষণ্ণ সময়ে আর বলতে ইচ্ছে করছে না।
যাঁরা তাঁর সত্তর দশকে লেখা অচিনপুর উপন্যাসটা পড়েন নি বা আশির দশকে বিটিভির ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি দেখেন নি, তাঁদের জন্য সমবেদনা রইল।
আমি তখন ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ি, নব্বই দশকের কথা, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকতাম সেখানে তখন ২৫ বৎসর পূর্তি (প্লাস পূনর্মিলনী) চলছিল, তার একটা ইভেন্ট ছিল "কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রদর্শনী" টাইপের কি একটা (ঠিক মনে নাই, তখন কম্পিউটার ছিল জাদুর বাক্স টাইপের জিনিস আরকি), তো সেই প্রদর্শনী উদ্ভোদনে আসলেন হুমায়ুন আহমেদ।
উদ্ভোদনীর সময় উনি বললেন "আমি তো কম্পিউটার বিষয়ে প্রায় অজ্ঞ, কি আর বলব? তবে যেহেতু আমাকে টিপি দেওয়ার জন্যই আনা হয়েছে, আমি তাহলে একটা টিপি দিয়েই চলে যাই" -- উনি ডায়াস থেকে নেমে কম্পিউটারের কি-বোর্ডে "টিপি" দিয়ে প্রদর্শনী উদ্ভোদন করে চলে গেলেন। এরকম নির্লিপ্ত রসিকতা মনে হয় শুধু মাত্র উনার পক্ষেই সম্ভব।
নস্টালজিক পোস্ট। ভাল লাগল
জর্জিস
আপনার কাছ থেকে এরকমই একটা লেখা আশা করেছিলাম, রিটন ভাই ।
ভাল থাকবেন আপনি ।
নতুন মন্তব্য করুন