যত্রতত্র কয়েক ছত্র> আমি আমার ভাতিজার রিটন ভাই!

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি
লিখেছেন লুৎফর রহমান রিটন (তারিখ: রবি, ০২/০৯/২০১২ - ১০:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চাচ্চু ওর নাম নয়। কিন্তু আমরা সবাই ওকে চাচ্চু নামেই ডাকি। কারণ সালাম সালাম হাজার সালাম গানের প্রখ্যাত গীতিকার ফজল-এ-খোদার পুত্র সে। ওর বাবা আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ভাই।ভাইয়ের পুত্র হিশেবে ও আমাদের ভাতিজা।আর ভাতিজা আমাদের চাচ্চু ডাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক।কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, গায়ে গতরে উচ্চতায় ভাতিজা আমাদের সমান সমান আকার ধারণ করলেও ওর আচরণ বাবুসোনা টাইপের। বয়স বাড়ছে কিন্তু ভাতিজা আমাদের বড় হচ্ছে না। বড় হচ্ছে কিন্তু ভাতিজার কথাবার্তায় সেটা ফুটে উঠছে না।দামড়া সাইজের একটা ছেলে যদি সারাক্ষণ ন্যাদাবাচ্চার মতো চাচ্চু চাচ্চু করে তাহলে তাকে একটা রাম থাবড়া মারা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।বহুদিন পরিকল্পনা করেছি আজ ভাতিজা যদি ফের চাচ্চু ডাকে তো তার নতিজা ভালো হবে না। কিন্তু ওর নিস্পাপ চেহারা আর সারল্যে ভরা হাসি ওকে বারবার রাম থাবড়ার কবল থেকে রক্ষা করেছে।একদিন ওকে বললাম, ভাতিজা—ওসব চাচ্চু-ফাচ্চু বাদ।এরপর আমাকে আর চাচ্চু ডাকলেই ডিরেক্ট চটকানা।
বিস্মিত ভাতিজা সামান্য তোতলানো উচ্চারণে জিজ্ঞেস করে
--তাহলে আপনাকে আমি কি বলে ডাকবো?
--রিটন ভাই ডাকবে।
তোতলামো বেড়ে যায় ওর
--বলছেন কি চাচ্চাচ্চাচ্চুউউউউ!!
--হ্যাঁ।এখন থেকে আমি তোমার রিটন ভাই।
--কিন্তু বাপী(ভাতিজার বাপ)শুনলে তো আমাকে মেরেই ফেলবে!
--ঠিক আছে, কেবলমাত্র তোমার বাপের সামনে আমাকে চাচ্চু ডাকবে কিন্তু এছাড়া নো চাচ্চু বিজনেস। ঠিক আছে?
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো সে।সেকেন্ডের ব্যাবধানে ভাতিজার আবদার
--কিন্তু চাচীকে আমি চাচীই বলবো।
বইলো মিয়া, যাও এখন ফুটো।
কিন্তু ভাতিজা ‘ফুটে’ না। মানে প্রস্থান করে না--আচ্ছা চাচ্চু সরি আচ্ছা রিটন ভাই ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো?আপনি আমার মাকে তাহলে কি ডাকবেন?
--কেনো ভাবি ডাকবো।
ভাতিজা আমার আউলা-ঝাউলা হয়ে পড়ে—তা কি করে হয়? আপনি আমার মাকে ডাকবেন ভাবি,আমার বাপীকে ডাকবেন ভাই আবার আমিও আপনাকে ডাকবো ভাই—এটা কি করে সম্ভব!?!
আধুনিক দুনিয়া স্মার্টনেস ইনডিভিজ্যুয়ালিটি ইত্যাদি লেকচার ঝেড়ে কঠিন একটা দাবড়ানি দিয়ে বিদেয় করা হলো ওকে।

সেই থেকে আমি আমার ভাতিজার রিটন ভাই।

আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে প্রায়ই আসে ভাতিজা।আমাকে ধরবে বলে ওকে আসতে হয় সকাল সকাল।
আমি ঘুমিয়ে থাকি অধিকাংশ সময়।আমার স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ভাতিজার আগমন সংবাদ দেয়।একদিন হাসতে হাসতে আমার স্ত্রী বললো
--তোমার ভাতিজা তো আমার জন্যে ফুল নিয়ে আসে রেগুলার।
--মানে?
--মানে প্রতিবারই তোমার ভাতিজা আমাকে একটি করে তাজা গোলাপ দেয় দরোজা খোলার সাথে সাথে।
শুনে সদ্য ঘুম ভাঙা আমি হাসতে হাসতে বিছানায় উলোটপালোট গড়াগড়ি খেতে থাকি।
ভাতিজাকে ওর চাচী যত্ন করে ব্রেকফাস্ট করায়। আমিও ভাগ পাই। হঠাৎ করেই ওর চাচী ওকে খানিকটা নসিহত করতে শুরু করলো
--ওয়াসিফ(ভাতিজার নাম ওয়াসিফ-এ-খোদা), তুমি কি আর কাউকে ফুল-টুল দাও? লজ্জায় একেবারে মরে যাওয়া ভঙ্গিতে ভাতিজা বললো
--না চাচী।কক্ষণো না।কাউকে দিই না।(অর্থাৎ,আমি ভদ্রলোকের ছেলে,প্রেম করি না!)
--দেবে।অবশ্যই দেবে।তোমার এই বয়েসে চাচীকে ফুল না দিয়ে ফুল দেয়া উচিৎ কোনো সুন্দর একটা মেয়েকে। যাকে তুমি ভালোবাসো।কেউ নেই ওরকম?
--প্রশ্নই ওঠে না চাচী।
মাটির পানে চেয়ে চেয়ে না সূচক মাথা নাড়ে ভাতিজা।
ভাতিজার চেহারায় লজ্জা আর সঙ্কোচের মিশ্রণে একটা কার্টুন কার্টুন ইফেক্ট তৈরি হয়েছে। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম ভাতিজা উদ্ধার প্রকল্পে
--খামোখা কেনো ওর পেছনে লাগলি? ভাতিজা ওইসব প্রেম-ট্রেম করে না।আর জীবনেও বিয়ে করবে না বলে একটা ফাইনাল ডিসিশান ভাতিজা বহু আগেই নিয়ে রেখেছে। তাইনা ওয়াসিফ? আমি বললাম।
--একদম ঠিক কথা।আমি জীবনেও বিয়ে করবো না।
--কিন্তু তোমার মা যদি বলে যে বিয়ে কর্‌ তাহলে? চাচীর প্রশ্ন।
--তাহলে কি আর করা। মা বললে করতে তো হবেই।
এই হচ্ছে ভাতিজা। মা অন্ত প্রাণ।মা ছাড়া ওর জগতে আর কেউ নেই।উঠতে মা।বসতে মা।সারাক্ষণ শুধু মা মা মা।এই টাইপের ছেলেরা মাকে জিজ্ঞেস না করে টয়লেটেও যায় না। বাড়িতে যতোক্ষণ থাকবে মায়ের পেছন পেছন ঘুরবে।কিচেন ওদের প্রিয় জায়গা। মায়ের সঙ্গে ডাকটিকিটের মতো লেগে থাকা এই টাইপের ছেলেদের ব্যক্তিত্ত্বেও কিছুটা মেয়েলি আচরণ এসে ভর করে অজান্তেই। বাইরে থেকে বাড়ি ফিরে এসেই মায়ের কাছে এরা ডিটেইল রিপোর্ট পেশ করবে কার কার সাথে কি কি হলো আজ।
একদিন ভাতিজাকে বললাম, ভাতিজা তুমি বিয়ে করলেও কি বউয়ের সব কথা মাকে বলবে?
--কেনো বলবো না!
--সব বলবে?
--সব বলবো।
--তাইলে তো মিয়া তোমার বউ তোমার সাথে টিকবে না।
--না টেকার কি আছে! মাকে আমি সব বলবো।
--তাহলে ভাতিজা এই জীবনে তোমার বিয়ে করা উচিৎ হবে না। না পারবে তুমি মাকে সুখী করতে না পারবে বউকে।বউ সুখী হলে মা অসুখী থাকবে আবার মা সুখী থাকলে বউ থাকবে অসুখী।দুইটাকে একই সঙ্গে সামাল দিতে পারবে না তুমি। বলছি না মাকে ভালোবেসো না। কিন্তু বউ-শাশুড়ির চিরন্তন ক্যাচাল বাঘা বাঘা পুরুষরাই ট্যাকল করতে পারে না আর তুমি তো মিয়া ‘আম্মু আম্মু’ টাইপের ছেলে।
শীত নামার আগেই ভাতিজার গায়ে সোয়েটার নাজেল হয়।একই সোয়েটারে তিন চারটে শীত পার করবে সে।একই কোট বা ব্লেজার জারি থাকবে তার বছরের পর বছর।(এটা দারিদ্র্যের কারণে নয়।) বাথরুমে ঢুকে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করবে। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে সঙ্গে একটা ছাতা নেবে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমি আমীরুল মাযহাররা আড্ডা দিই।ভাতিজা আমাদের কাছে আসে।সায়ীদ স্যার কয়েকদিন ব্যাপারটা লক্ষ করলেন। একদিন জানতে চাইলেন ছেলেটা কে?আমরা বললাম ওর পরিচয়।স্যার তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন--কবি ফজল-এ-খোদার ছেলের এই রকম প্রাইমারী স্কুল টিচারের মতো অবস্থা কেনো?বাচ্চা বয়েসেই তো সে বার্ধক্যে আক্রান্ত!স্যারে কথার সারমর্ম হলো--ওকে যদি তোমরা সত্যি সত্যি ভালোইবাসো তো তাকে সম্পাদনা করো।ওর ছাতা কেড়ে নাও।একটা সদ্য তরুণ ছেলেকে আমি বৃদ্ধের বেশে দেখতে চাই না।
আমরা তিনজন মিলে ওকে জানিয়ে দিলাম—কেন্দ্রে আসতে হলে এইসব ছাতা-টাতা চলবে না।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এতো এতো ছেলেমেয়ে আসছে যাচ্ছে কারো বগল তলায় ছাতা আছে? নেই।রোদ কিংবা বৃষ্টি ওদের কিছু না করলে তোমারও করবে না। কেন্দ্রে নেক্সট টাইম তোমার হাতে ছাতা পাওয়া গেলে ওটার ভবলীলা সাংগ করা হবে। আমাদের যৌথ ভাষণে ভাতিজা হতভম্ব। ওর মুখে কথা নেই। কেন্দ্রে আসা ছেলেমেয়েদের হাতে বগল তলায় ছাতা খুঁজে ফেরে ওর ফুললেন্স চশমার ওপাশের প্রবল কৌতূহলী বেদনার্ত নিষ্পাপ চোখজোড়া। নাহ। দেশটার হলোটা কি! একটা ছাতাও তো নেই!!
আমি যুক্ত করলাম উপধারা—শুধু কেন্দ্রেই নয়, বাংলা একাডেমী-শিশু একাডেমী-শিল্পকলা একাডেমী-পত্রিকা অফিসসহ ঢাকার যেখানেই ছাতাসমেত তোমাকে পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
এক বুক বেদনা নিয়ে ভাতিজার আপাত প্রস্থান।

কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রে ভাতিজার আগমন।ওর বডি সার্চ করা হলো।কোথাও কোনো ছাতা নেই!
কেন্দ্রের ছাদে এক বিকেলে আমীরুল ওকে সাবালক করার অভিপ্রায় জানিয়ে ক্রমাগত হুমকি ধামকি সহযোগে একটা সিগারেটে টান দিতে বাধ্য করলো।একটি মাত্র টান দিয়েই ভাতিজা এমন কাশতে শুরু করলো যে যক্ষার রোগীও ফেল! আমীরুলের পরবর্তী প্রকল্প ভাতিজাকে মদ্যপান করিয়ে ওকে আরেকটু বড় করে তোলা।আমার আর মাযহারেরও বিপুল সমর্থন আছে এই প্রকল্পে।এক জীবনে ভাতিজা জানবেই না পৃথিবীতে স্কটল্যান্ডের সোনালি শিশির বলে একটা বস্তু ছিলো এটা কি মেনে নেয়া যায়? যায় না।
আমীরুল ওকে জোর করে ধরে মদ খাওয়াবে শুনে ভাতিজার আর্তচিৎকার--নাআআআ। জীবনেও খাবো না। মরে গেলেও না। ওর সেই রকম সম্ভাব্য দুর্যোগের দিনে আমিও ওকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবো না জেনে ভাতিজা মোটামুটি 'এই জীবন রাইখ্যা কি লাভ' জাতীয় একটা লুক দিলো। মদ্যপানের আগেই ওর চেহারাটা মদ খাওয়া মানুষের প্রায় নেতিয়ে পড়া একটা শেপ নিলো। মদের কথা শুনেই ভাতিজা আমার ঢলে পড়লো বুঝি।

আমার প্রতি ভাতিজার শ্রদ্ধা ভালোবাসা কিংবা মুগ্ধতার কোনো সীমা পরিসীমা নেই।পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আমার বিপক্ষে দাঁড়ালেও ভাতিজা আমার পক্ষ ত্যাগ করবে না।আমার লেখালেখি সম্পর্কে ওর খোঁজ খবর এক কথায় অবিশ্বাস্য।
বাংলাদেশের যে কোনো সংকলনে পত্রিকায় প্রকাশিত আমার যে কোনো লেখা ওর সংগ্রহে আছে।আমি খুব এলোমেলো ধরণের মানুষ।নিজের লেখাগুলোও ঠিক মতো নিজের কাছে রাখতে পারি না। কিন্তু ভাতিজা ঠিক ঠিক সেগুলো কেমন কেমন করে যেনো চাইলেই হাজির করে দেয় আমার সামনে।এমনও হয়েছে, একটি লেখার কথা ভাতিজারও মনে আছে আমারও মনে আছে কিন্তু দুজনার কারো কাছেই নেই।সেটাও সে দুএকদিনের মধ্যেই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে আমার কাছে।পরে জেনেছি, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তিন-চার ঘন্টা ধুলোমাখা পত্রিকার বান্ডিল ঘেঁটে ভাতিজা আমার জন্যে উদ্ধার করে এনেছে আমার কাঙ্খিত লেখাটি।সমস্যা হলো, এইসব কাজে ভাতিজাকে কনভেন্সটাও কনভিন্সড করা যায় না।আমার হারিয়ে যাওয়া কতো ছড়া যে আমি ভাতিজার কাছ থেকে পেয়েছি তার হিশেব নেই। ভাতিজার কাছে আমার অনেক ঋণ।ওর ঋণ শোধ করার কোনো চেষ্টা আমি কখনোই করিনি।উলটো ওকে বকাঝকা করি।ওর স্লো মোসান দেখে ওকে লুথা বলে ধমক লাগাই।কিন্তু ভাতিজা কোনোদিন আমার ওপর রাগ করে না।আমি ধমক দিলে বা গালাগাল দিলে ভাতিজা হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যায়।কিন্তু রাগ করে না।আমার সব কথায় আচরণে ভাতিজা বিপুল বিনোদন খুঁজে পায়। আমিও নিষ্ঠার সঙ্গে ভাতিজাকে বিনোদন সরবরাহ করি।আমার কোনো কথাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ভাতিজার নেই। ওর মায়েরও একই অভিমত। এমনও হয়েছে ওর মা আমাকেই অনুরোধ করেছেন—তুমি সবুজকে এটা বলো, তোমার কথা ও শুনবেই।আমার শতকরা নিরানব্বুইটা কথা বা অনুরোধ বা নির্দেশই ভাতিজা পালন করে।

আমার এই জীবনে কুড়িয়ে পাওয়া সেরা একটি উপহার আমার এই ভাতিজা। রাত জেগে জেগে আমার বইয়ের প্রুফ ভাতিজাই দেখে দেয়।গত পনেরো কুড়ি বছরে প্রকাশিত আমার সমস্ত বইতেই ভাতিজার মমতার স্পর্শ মাখানো। আমি নিশ্চিত, আমার বইয়ের পাতায় পাতায় মুদ্রিত ছড়াগুলো ভাতিজাকে চেনে।আমার যে কোনো বইয়ের পরিকল্পনা বিষয়ে নেপথ্য উপদেষ্টা হচ্ছে আমার ভাতিজা।

আমার ভাতিজা সৎ নির্লোভ আর সত্যবাদী। আপাদমস্তক একজন ভালোমানুষ। চোখের সামনে ছেলেটা দিন দিন বড় হয়েছে। খুব ছেলেবেলায় রেডিওতে ছোটদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতো সে। তখন ওর নাম ছিলো সবুজ ফুল কুমার।সেই সবুজ ফুল কুমার, আমাদের সবুজ, ওয়াসিফ-এ-খোদা হয়ে আমার ছোটদের কাগজে প্রতিবেদকের দায়িত্ব পালন করেছে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে।কোনোদিন ফাঁকি দেয়নি এতোটুকু।ঝড় বৃষ্টি তুফান ওকে আটকাতে পারে নি। অফিসে ও আসবেই।এখন সে ইত্তেফাকে চাকরি করে।ঝড় বৃষ্টি তুফান হরতাল ওকে আটকাতে পারে না এখানো।ইত্তেফাক যদি কোনোদিন ধংসের মুখে পড়ে,ধংসের তান্ডব চলতে থাকলে ইত্তেফাক ভবন ছেড়ে সবাই পালাবে কিন্তু ভাতিজা ঠিক ঠিক ইত্তেফাকে হাজির থাকবে।আর এই কারণেই ইত্তেফাকের রেফারেন্স এডিটর নোমানুল হককে আমি বলেছিলাম, আমার ভাতিজা হচ্ছে ইত্তেফাকের সেকেন্ড মানিক মিয়া।নোমান ভাই আমার সঙ্গে একমত।

ভাতিজার সারল্য আমাকে বিস্মিত করে। এক জীবনে এই সারল্য ওকে কম ভোগায় নি। ওর সারল্যের সুযোগ নিয়ে একবার তো ওকে মহা বিপদেই ফেলে দিয়েছিলাম আমি।গানের বিষয়ে আমার কিঞ্চিত প্রতিভা আছে।বহু বহু গানের বানী এবং মিউজিক আমার মুখস্ত,ইন্টারল্যুড মিউজিকসহ।সেই প্রতিভায় ভাতিজাকে ঘায়েল করেছিলাম এক সন্ধ্যায়।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সমন্বয়কারী আহমাদ মাযহার আমার এই প্রতিভাকে হিশেবে না ধরে একবার পাঁচশ টাকা জরিমানা দিয়েছিলো।একটি গানের বিষয়ে মাযহারকে বিভ্রান্ত করে বললাম-লাগবা বাজী? ৫০০ ট্যাকা? সরল মাযহার বাজী ধরলো হারলো এবং পরদিন শুকনো মুখে আমার হাতে অর্পণ করলো ৫০০ টাকার একটি নোট।আমার নীতি হচ্ছে বাজীতে জিতলে সেই টাকা আমি ছাড়ি না।বাজীর টাহা বাজীর টাহা দেতে অইবে দেতে অইবে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেই এক সন্ধ্যায় আমার পাতা ফাঁদে পা রাখলো মাযহারের চাইতেও একলক্ষ গুণ বেশি সরল আমার ভাতিজা। সেদিন ভাতিজার সঙ্গে আমার আলোচ্য বিষয় ছিলো ভাতিজার বাবা গীতিকার ফজল-এ-খোদা। সালাম সালাম হাজার সালামের মতো অমর গানের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু অসাধারণ আধুনিক গান দেশের গান এবং চলচ্চিত্রের গানের গীতিকার হিশেবে তিনি আমার নমস্য। ফিল্মের গানের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মাসুদ পারভেজের এপার ওপার ছবিতে ‘ভালোবাসার মূল্য কতো আমি কিছু জানি না’ গানটির কারণে তাঁকে এবং সুরকার ও কন্ঠশিল্পী আজাদ রহমানকে আমি চিরদিন মনে রাখবো। ভাতিজাও আমার সঙ্গে একমত হলো যে ওর বাপী এই গানটা লিখেছে দারূণ।আমি বললাম
--খালি এইটা না।এপার ওপার ছবিতে তোমার বাপে আরেকটা মারাত্মক গান লিখছে মিয়া!
ভাতিজা নড়েচড়ে বসে। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়।আমার মুখে বিভ্রান্তির হাসি।সরল ভাতিজা,আমি ফাজলামো করছি ভাবে।এবং ভুলটা করে।
--এপার ওপারে এই গানটি ছাড়া বাবা আর কোনো গানতো লেখেনি!
--না লিখেছে।আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘মন রেখেছি আমি কারো মনেরো আঙিনায়’…গানটা তো তোমার বাবারই লেখা বলে আমার মনে হচ্ছে।
--আরে ওটা আমার বাবার লেখা হলে আমি জানতাম না? ওটা অন্য কারো লেখা।
আমি বললাম,
--লাগবা বাজী? ৫০০ ট্যাকা? অবশ্য এটা তোমার বাবার লেখা হলে তো আমার থেকে বেশি তোমারই জানার কথা……আমি নিজের ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ ছুঁড়ে দিই। ভাতিজা বিভ্রান্ত হয়।
আমার পাতা বিভ্রান্তির ফাঁদে পড়ে ভাতিজা ১০০ পার্সেন্ট নিশ্চিত জানার ভাবচক্করের দোলায় না দুলে চট করে রাজী হয়ে যায়। আর আমি মন খারাপের ভান করে বলি,
--ঠিক আছে,মনে হয় আমার ৫০০ টাকা গেলো।যাক।এখানে তো ওটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না।তুমি বরং বাসায় গিয়ে তোমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করে দেখো। তোমার বাবা যদি বলে যে এটা তাঁর লেখা নয় তো আমার কাছ থেকে কাল এসে ৫০০ টাকা নিয়ে যেও।

৫০০ টাকা বাজীতে জেতার আনন্দে উতফুল্ল ভাতিজা চোখ থেকে ফুল পাওয়ারের চশমা খুলে খামোখাই সেটার কাচ শার্টের কোণা দিয়ে মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে রওনা হয়।ও গেটের কাছে চলে গেলে আমি উচ্চকন্ঠে বলি—আর যদি এটা তোমার বাবার লেখা হয় তো এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০০ টাকা দিয়ে যাবে।ক্ষমা নাই।বাজীর টাহা বাজীর টাহা দেতে অইবে দেতে অইবে।

ঘটনাটা মাযহারকে বলি।হাসতে হাসতে এটাও বলি যে বাসায় গিয়েই চাচ্চু টের পাবে সে ৫০০ টাকা জেতে নাই।হেরেছে।জিতসি জিতসি ভাবতে ভাবতে বাড়ি পর্যন্ত আনন্দটা বহাল থাকবে। বাপের সাথে দেখা হবার পরেই সকল আনন্দ ফুট্টুস।
মাযহার দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, ভাতিজা ৫০০ টাকা কোথায় পাবে?ওর তো কোনো টাকা পয়সা নেই।চাকরিও তো করেনা বেচারা।(ঘটনাটা ৮৮-৮৯ সালের।ভাতিজা তখন অনেক ছোট।)আমি বলি, সেই চিন্তা আমার না দোস্তো।বাজীর ক্ষেত্রে আমার নীতিমালা কঠোর।ক্ষমার কাহিনী নাই। বাজীর টাহা বাজীর টাহা দেতে অইবে দেতে অইবে।

পরদিন ভাতিজার বাড়িতে টেলিফোন করে আমার জেতার বিষয়টি নিশ্চিত হই। তারপর সময় বেঁধে দিই।সাতদিন পর শিশু একাডেমীতে বিকেল সাড়ে চারটায় পরিচালকের কক্ষে আসতে বলি ওকে। ওইদিন শিশু একাডেমীর আনন্দমেলা আর বইমেলার অনুষ্ঠানে আমি আর আলী ইমাম বক্তা।পরিচালক গোলাম কিবরিয়ার কক্ষে বসে আমরা চা-বিস্কুট খাচ্ছি।একটু পরেই মঞ্চে যাবো আমরা।এমন সময় ভাতিজা উঁকি দিলো কক্ষে।সারল্যভরা অপরূপ হাসি ভাতিজার চোখে।ঘাড় কাৎ করে আমি শুধু বললাম-আনছো?এনেছি,বলতে বলতে ভাতিজা আমার পাশে এসে বসে।সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সবাইকে উঠতে হয়।এক্ষুণি শুরু হবে অনুষ্ঠান।পরিচালকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে হেঁটে মঞ্চের দিকে যেতে যেতে ভাতিজাকে ইশারা করি।ভাতিজা আমার গা ঘেঁসে হাঁটতে হাঁটতে কঠিন গোপনীয়তায় পকেট থেকে একমুঠো টাকা আমার হাতে এমন ভাবে তুলে দেয় যেনো বা ঘুষ দিচ্ছে। ভাতিজাকে দর্শকদের আসনে একেবারে সামনের সারিতে বসার ব্যাবস্থা করে দিয়ে টাকাটা পকেটে পুরে মঞ্চে উঠি।মঞ্চের টেবিলের তিনপাশ কাপড় দিয়ে মোড়ানো। সুতরাং পাবলিক টেরও পাবে না আমি সিটে বসে কি করছি।পকেট থেকে ভাতিজার দেয়া টাকাগুলো বের করে দেখি।ভাতিজা কি গুনতে ভুল করে বেশি টাকা নিয়ে এসেছে?পাঁচশ টাকা এতো মোটা হবে কেনো? ভাতিজার একমুঠো টাকার ভেতরে দুটো একশ টাকার নোট, কয়েকটা দশ আর পাঁচ, আর বাদবাকি সব এক এবং দুই টাকার নোট। সুতরাং মোটা না হয়ে পাঁচশ টাকার কোনো উপায়ই নেই!
আমাদের বকবকানি শেষ।মঞ্চ থেকে নেমে ভাতিজাকে ধরলাম,
--অই মিয়া এতো খুচরা ট্যাকা ক্যান? তোমার পাঁচশ ট্যাকার সাইজ তো পাঁচ হাজারের সমান! বলতে বলতে ভাতিজাকে নিয়ে বইমেলার বিভিন্ন স্টল প্রদক্ষিণ শুরু করলাম।
অপরাধীর ভঙ্গিতে কাঁচুমাচু অবস্থায় কিছুটা তোতলানো উচ্চারণে ভাতিজা বললো, অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি।
--তোমার বাপে কি কইলো?
--বাবা আমাকে তিরস্কার করে বলেছেন গানটা যে আমার লেখা সেটা তোমার জানা উচিত ছিলো। বাজী ধরা তোমার উচিত হয় নি।বাজীতে তুমি হেরেছো। সুতরাং টাকা তোমাকে দিতেই হবে। ভবিষ্যতে আপনার সং আর কোনো বাজী না ধরতেও বলে দিয়েছেন।
--গুড।আমার সঙ্গে জীবনে আর বাজী ধরবা?
--কক্ষণো না। জীবনেও না।
--তোমার তো অনেক লস হয়ে গেলো। চলো কিছুটা পুশিয়ে দেই।দুইটা বই পছন্দ করো। আমি কিনে দিচ্ছি তোমাকে।
মনের আনন্দে ভাতিজা দুটো বই পছন্দ করলো।সেলসম্যান বই দুটোর দাম বললো।ত্রিশ- পঁয়ত্রিশ টাকার মতো হয়েছে।আমি পকেট থেকে ভাতিজার দেয়া টাকার বান্ডিলটা ওর হাতে দিয়ে বললাম,
--এতো খুচরা টাকা গুণতেও তো মিয়া একজন এসিসট্যান্ট লাগে।কি আর করা, তুমিই গুণে দাও।একদম বেশি খুচরাগুলা পয়লা ধরো।
ভাতিজা এক দুই আর পাঁচ টাকার সমন্বয়ে সেলসম্যানকে টাকা পরিশোধ করলো।

এইকথা সেইকথা বলতে বলতে শিশু একাডেমীর ফটকে এসে একটা রিকশায় একাই উঠে বসলাম আমি। ভাতিজা আমাকে অবশিষ্ট টাকাগুলো দেবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলো।আমি রিকশায় বসেই ওকে বললাম, বইদুটো আর বাদবাকি টাকাগুলো আমার পক্ষ থেকে তোমাকে উপহার দেয়া হলো।বুঝছো? ভাইবো না নিজের ট্যাকায় কিনলা। জীবনে আর লাগবা বাজী?
রিকশাচালককে ইশারা করতেই সে প্যাডেল মারতে শুরু করেছে হাইকোর্টের দিকে।
কিছুটা হতভম্ব কিছুটা অপ্রস্তুত কিছুটা অভিভূত ভাতিজা আমার দাঁড়িয়ে থাকে শিশু একাডেমীর মূল ফটকের জমাট বাঁধা ভিড়ে।

ভাতিজার মতো একজন অসাধারণ ভালোমানুষকে আটলান্টিকের এপার থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা।

ক্যাপশনঃ একুশে ফেব্রুয়ারি (২০১০) সকালে বাংলা একাডেমীর তথ্যকেন্দ্রের সিঁড়িতে আহমাদ মাযহার আর আমার মাঝখানে অসহায় ভাতিজা ওয়াসিফ-এ-খোদা। আলোকচিত্র/ড মাসুদুজ্জামান।

ছবি: 
08/12/2007 - 10:52অপরাহ্ন

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

(গুড়)
মনে হচ্ছে কানাডা যেয়ে আপনাকে নিয়ে একটা ছোট ট্যুর দিয়ে ফেলি, তাহলেই আপনার কলম থেকে আসবে এমন সুস্বাদু আরো লেখা।

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

আসো।

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

অসাধারন বর্ননা আপনার। ভাতিজাকে দেখা হলে আমার শুভকামনা দেবেন। চাচ্চুর মতো অতি সহজ একটা জীবন সকলেরই কাম্য থাকে কিন্তু বাস্তবে এটা অতো সহজে হ্ওয়ার নয়।

চাচ্চু তার বাবার লেখা গানটির কথা জানতে না পেরে কি পরিমান বেদনাহত হয়েছিলো তা আন্দাজ করি, যেটা বাজীতে হারার চেয়েও লক্ষগুণ বেশি।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

বলবো ভাতিজাকে।
ঠিক। ওটা বাজীতে হারার চেয়েও বেদনার ছিলো। আর ওর থেকে ওর বাবার বেদনাটা ছিলো আরো বেশি। দেঁতো হাসি

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

দারুণ! তবে এই লেখাটা আগেও পড়েছি রিটন ভাই! হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

পড়েছো? চিন্তিত আমার ফেসবুক নোটে! শয়তানী হাসি

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

দেঁতো হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

রু এর ছবি

লেখাটা খুব ভাল লাগলো।

রিটন ভাই, আপনাকে এখন থেকে চাচ্চু ডাকি?

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

ওকে চাচ্চু! রেগে টং

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

স্যাম এর ছবি

দারুন বর্ননা! কিন্তু এটা অন্যায় রিটন ভাই ভাতিজারে দিয়ে ভাই ডাকায়ে পুরা লেখায় আপনি ভাতিজা ভাতিজা বলে গেলেন - ভাতিজাদের ও কি সাধ হয়না ভাই হওয়ার (প্রমোশন পাওয়ার) চোখ টিপি ভাতিজা কে ভাল্লাগছে!

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

এইটা ওর শাস্তি! দেঁতো হাসি

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

সুমাদ্রী এর ছবি

দারুণ লেখা রিটন ভাই। ভাতিজা এখন আপনাকে কী নামে ডাকে?

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

রিটন ভাই-ই ডাকে শয়তানী হাসি !

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

সাবেকা  এর ছবি

ভাতিজাকে ভাল্লাগছে । এরকমই থাকুক ভাতিজা সহজ সরল সুন্দর হাসি

কড়িকাঠুরে এর ছবি

ঝরঝরে বর্ণনা
সোজা কোনো কর্ম না- দেঁতো হাসি

ওয়াসিফ ভাই তো অনেক বড় রিটন ভাই...

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ভাতিজারে ভাতিজা
এই বার খাতি জা
বিল দেবে রিটন ভাই
আর কুনো চিন্তা নাই!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

যুমার এর ছবি

ভাতিজা কি সত‌্যিকারের বড় হয়েছে?

অতিথি লেখক এর ছবি

রিটন ভাই রিটন ভাই
দিন গিয়েছে চলে
তুমি আর ভাই নাই।
তুমি হয়ে গেছো চাচা
রেগে গিয়ে আমায়
খেয়ো না কো কাঁচা। খাইছে

দ্রোণ মৈত্র

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।