আমার শৈশবকে রাঙিয়ে দেয়া চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা সুভাষ দত্ত চলে গেলেন। নিজের প্রথম পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে সুহাসিনী কবরীকে তিনিই প্রথম ব্রেক দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে ও পরে নিজের পরিচালনায় নির্মিত বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন। ‘আলিঙ্গন’, ‘বিনিময়’, ‘আবির্ভাব’ ‘আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘ডুমুরের ফুল’—সুভাষ দত্ত নির্মিত দর্শক নন্দিত কয়েকটি ছবি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একটি ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র। এই ছবিটিকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবিও বলা চলে। কথাশিল্পী আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করেছিলেন অসাধারণ চলচ্চিত্র ‘বসুন্ধরা’।
কীর্তিমান এই মানুষটি ওয়ারি লারমিনি স্ট্রিটের বাসিন্দা ছিলেন। আমার ছেলেবেলা কেটেছে হেয়ার স্ট্রিটে। হাঁটাপথের দূরত্ব। স্কুলের ফোর ফাইভের ছাত্র ছিলাম যখন, তখন-- কতোদিন বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম তাঁর বাড়ির সামনে! দূর থেকেই উঁকিঝুঁকি মারতাম। মাঝে মধ্যে দেখা পেতাম তাঁর। কিন্তু প্রায়ই ফিরে আসতাম তাঁকে না দেখার বেদনা নিয়ে। তবে মাঝে মধ্যে দেখা হলেও কথা কিন্তু হতো না আমাদের মধ্যে। তিনি জানতেনও না যে ছোট্ট একটা ছেলে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে শুধু তাঁকে এক নজর দেখবে বলে! পরে তাঁর পুত্র রানা’র সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হলো। আমরা একসঙ্গে ফুটবল-ক্রিকেট খেলতাম। রানাকে কোনোদিন বলা হয়নি তাঁর বাবার প্রতি আমার মুগ্ধতার কথা।
দিন যায়।
তাঁর সম্পর্কে জানতে জানতে তাঁকে দেখতে দেখতে বেড়ে উঠি আমি। ছিলেন আঁকিয়ে। সিনেমার পোস্টার আঁকতেন। তারপর হলেন সিনেমার আর্ট ডিরেক্টর বা শিল্প নির্দেশক। মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রে কাজ করলেন শিল্প নির্দেশক হিশেবে। কিন্তু নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে এলো অভিনয়ে এবং চলচ্চিত্র পরিচালনায়।
সুভাষ দত্তের একেকটা ছবি বারবার দেখি। তেরোবার দেখি বসুন্ধরা ছবিটা। কী অসাধারণ ছবি! এই ছবিতে নূতন নামের অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পীকে দিয়ে চমৎকার একটি ধ্রুপদী নাচ তিনি উপহার দিলেন দর্শকদের। নূতন তাঁর অভিনয় জীবনে এরকম নৃত্যবৈভব প্রদর্শনের সুযোগ আর পাননি। নাচের সঙ্গে ব্যবহৃত ক্লাসিক্যাল গানটি সম্ভবত ওস্তাদ আখতার সাদমানী গেয়েছিলেন। এই ছবিতে সঙ্গীতের ব্যবহারে দারুণ শক্তি দেখিয়েছিলেন সুভাষ দত্ত। আমি সুভাষ দত্ত পরিচালিত ও অভিনীত প্রায় সমস্ত ছবিই দেখেছি। শুরু থেকেই ছবিতে যত্রতত্র গানের ব্যাবহারের ব্যাপারে সুভাষ দত্ত ছিলেন অতিমাত্রায় আগ্রহী। কিন্তু স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালে নির্মিত অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবিতেই প্রথম উপলব্ধি করি সেই ‘অতিমাত্রা’র বিষয়টি থেকে তিনি সরে এসেছেন। ছবিতে বাহুল্য এবং অনাবশ্যক গান জুড়ে না দিয়েও যে একটি সঙ্গীতপ্রাচূর্যে সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব সেটা তিনি দেখিয়েছেন ‘বসুন্ধরা’য়। আঞ্চলিক ভাষার গানের সৌন্দর্যসুধার অপরূপ প্রয়োগ তিনি দেখিয়েছেন এই ছবিতে। এই ছবিতে আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী হিশেবে প্রতিষ্ঠিত শেফালি ঘোষের গাওয়া ‘মানুরে অ সুন্দর মানু, কি ছবি বানাইবা তুমি আই ন বুঝি’ গানটি মানুষকে অপার আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। চারুকলার গোলপুকুর চত্ত্বরে চিত্রায়িত ‘রঙধনু ছড়িয়ে চেতনার আকাশে আসে আর ভালোবাসে’ গানটিও ছিলো অসাধারণ। এই গানে স্লো মোশন ব্যাবহারটিও দারূণ ছিলো। অথচ এক সময় এই সুভাষ দত্তই গানের দৃশ্যে নায়ক নায়িকার অবিরাম চোখ পিটপিট করার অসহ্য ইরিটিটিং ফর্মুলা ব্যাবহার করতেন। একের পর এক ছবি নির্মাণ করে সুভাষ দত্ত আসলে নিজেই নিজেকে অতিক্রম করেছেন ঈর্ষণীয় দক্ষতায়। নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম দিককার ছবির সঙ্গে অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী কিংবা বসুন্ধরার কোনো রকম মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ধাপে ধাপে নিজেকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন উচ্চতর এক অবস্থানে। অবশ্য এক পর্যায়ে ফের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতেও চেয়েছেন, ক্রিজে টিকে থাকার অজুহাতে। নির্মাতা হিশেবে সুভাষ দত্তের এই ইউ টার্ণকে আমি সাধুবাদ জানাতে পারিনি। যদিও সেই ইউ টার্ণ তাঁকে বাণিজ্যিক ছবিতে খুব একটা সাফল্য দেয়নি। এই পর্যায়ে তাঁর পরিচালিত ‘ফুলশয্যা’ কিংবা ‘সকাল সন্ধ্যা’র নাম স্মরণে আনতে পারি। ইমপ্রেস চলচ্চিত্রের ব্যানারে তাঁর পরিচালিত ছবি ‘ও আমার ছেলে’ও একটি ‘সুভাষ দত্ত নির্মিত চলচ্চিত্রের উচ্চতা’ থেকে বহু দূরত্বে অর্থাৎ নিচে অবস্থানকারী চলচ্চিত্র বলে আমি মনে করি। এই ছবিগুলো একজন সুভাষ দত্ত কর্তৃক নির্মিত না হলেও ক্ষতি ছিলো না। এইরকম ছবি বানাতে সুভাষ দত্ত হওয়া লাগে না।
দিন যায়।
অনেক বছর পর—এক বিকেলে হুমায়ূন আহমেদ এফডিসিতে শুটিং করছেন ‘আগুনের পরশমনি’র। সেটে শুটিং-এর বিরতিতে আমি হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে লাল চা খেতে খেতে গল্প করছি। এমন সময় পাশের ফ্লোর থেকে শশ্রুমণ্ডিত সুভাষ দত্ত এলেন। আমাদের সঙ্গে আড্ডায় শামিল হলেন। হুমায়ূন আহমেদের ছবিতে অভিনয়ের ইচ্ছের কথা বললেন। কিন্তু হুমায়ূন ভাই তাঁর ব্যাপারে কেনো জানি খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না!
এরপর দীর্ঘ একটা সময় প্রবাসে কাটিয়ে আমি দেশে ফিরলে চ্যানেল আইয়ের সিদ্ধেশ্বরী কার্যালয়ে দেখা হলো সুভাষ দত্তের সঙ্গে। একটা কিশোরী সঙ্গীসহ তিনি এসেছিলেন সেদিন। অনেক কথা বললাম আমি। তাঁর বিষয়ে আমার আশৈশব লালিত মুগ্ধতার কথাও বললাম। আমি যে তাঁরই ওয়ারির মানুষ সেটাও বললাম। কিন্তু সুভাষ দত্ত কেনো জানি আমার ব্যাপারে কোনো আগ্রহই দেখালেন না! (তাঁর আচরণে খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম আমি!)
পরে সাগর ভাইকে (ফরিদুর রেজা সাগর) বললাম আমার বিস্মিত হবার ঘটনা। সাগর ভাই হাসলেন। বললেন—একবার সুভাষ দত্ত নাকি গেছেন আমেরিকান এম্বাসিতে। ভিসার জন্যে আবেদন করেছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর তাঁর নাম ডাকা হলো। ইন্টারভিউর জন্যে তাঁকে একটা উইণ্ডোতে যেতে বলা হলো। তিনি গেলেন। দূতাবাস কর্মকর্তা প্রশ্ন করলেন তাঁকে। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দিলেন না। কর্মকর্তা আবারো প্রশ্ন করলেন। কিন্তু সুভাষ দত্ত নিরুত্তর। হতবাক কর্মকর্তা বিরক্ত হয়ে আবারো প্রশ্ন করলেন। এবার নিরুত্তর সুভাষ দত্ত একটা কাগজ মেলে ধরলেন সেই কর্মকর্তার সামনে। কাগজটায় লেখা—তিনি মানে সুভাষ দত্ত কি এক সাধনা তপস্যা কিংবা ধর্মীয় বিধান জনিত কারণে সকাল ১১টা পর্যন্ত বাক্যালাপরহিত অবস্থায় বিদ্যমান থাকেন। কাগজটায় লিখিত ‘মৌনব্রত’ পালনের বয়ানে মহাবিস্মিত সেই কর্মকর্তা তাঁর ওই সাধনায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না করেই তাঁর ভিসা মঞ্জুর করেছিলেন!
শুনে আমি সাগর ভাইকে বললাম—কিন্তু আমি তো সুভাষ দত্তের সঙ্গে কথা বলছিলাম সকাল ১১টার পরে!
সাগর ভাই বললেন—দেখো ইতিমধ্যে দাদা তাঁর সাধনার টাইম ফ্রেমিংটা চেঞ্জ করে ফেলেছেন কী না!
আজকে সুভাষ দত্তের মৃত্যুসংবাদ পাবার পর থেকেই আমার চোখে বারবার দাদার সেই কথা না বলা চেহারাটা ভেসে উঠছে। এখন তো দাদা স্থায়ীভাবে চলে গেলেন কথা না বলার দেশেই!
আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা ছিলো সুভাষ দত্ত! ভালো থাকবেন দাদা...
অটোয়া ১৫ নভেম্বর ২০১২
মন্তব্য
সুভাষ দত্ত, টিকাটুলি রামকৃষ্ণ মিশনে বেড়াতে আসতেন প্রতিদিন বিকেলে। ছোটবেলায় প্রায়শই দেখা হতো। তাঁর মৌনব্রত এর ব্যাপারে জানতাম, দেখেওছিলাম কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকতে। কিছুদিন আগেও দেখেছিলাম, আজকে খবরটা শুনে হতবাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এবছর অনেক গুনী মানুষ চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
খবরটা জেনে খুব মন খারাপ লাগছে বাংলাদেশের হাতে গুণা কিছু পরিচালকের মাঝে একজন ছিলেন । ছিলেন আমার একজন প্রিয় পরিচালক ।
চিরশ্রদ্ধা মানুষটার প্রতি! এ বছরটা শুধু হারানোর বছর!
অসাধারণ একটি মানুষ চলে গেলেন !
অমি_বন্যা
শ্রদ্ধা।
অজ্ঞাতবাস
পাবনায় সুচিত্রা সেনের বাড়ি উদ্ধার করে তাঁর স্মৃতি রক্ষা আন্দলনের তিনি একজন উত্সাহ দাতা ছিলেন।
আবির্ভাব, বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুলের নির্মাতার স্মৃতিতে শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
অনেক প্রতিভাবান ঝরে গেলেন এই বছর।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
উনার জন্য শ্রদ্ধা।
এ বছরটা শুধু হারানোর বছর!
facebook
এক প্রতিভাবানের বিদায়!
সুভাষ দত্তের কথা এলেই কেন জানি আমার 'সুতরাং'এর কথাই মনে হয় !
সুভাষ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা।
আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
মূর্তালা রামাত
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
আহা 'সুতরাং'!!
ফারাসাত
শ্রদ্ধা।
শ্রদ্ধাবনত
_____________________
Give Her Freedom!
নতুন মন্তব্য করুন