নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে> প্রভুর প্রস্থান

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি
লিখেছেন লুৎফর রহমান রিটন (তারিখ: সোম, ১৭/১২/২০১২ - ১২:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(২০০১ থেকে আমি দেশান্তরি। আমার প্রবাসকালে অনেক প্রিয় মানুষ চলে গেছেন আকাশের ঠিকানায়। সেইসব মানুষকে নিয়ে আমার স্মৃতিগদ্যের বই ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে’ প্রকাশিত হচ্ছে একুশের বইমেলায়। সচলায়তনকে কথা দিয়েছিলাম প্রভুকে নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখবো। প্রভুর মৃত্যুর পর তাৎক্ষণিক বিহবলতা কাটিয়ে লিখতেও বসেছিলাম। কিন্তু লেখাটা শেষ করতে পারিনি। আজ শেষ করলাম।)

প্রভুর প্রস্থান

প্রভু চলে গেলেন।

সর্ব বিষয়ে প্রভুর প্রভূত পাণ্ডিত্য আমাদের বিষ্মিত করতো। তাঁর পঠন পাঠনের ব্যাপ্তি নিয়ে রীতিমতো একটা কিংবদন্তি গড়ে উঠেছিলো। প্রভু ছিলেন চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া। এতো জানতেন! পৃথিবীর হেন বিষয় নেই যে ব্যাপারে প্রভুর আগ্রহ ছিলো না কিংবা বলতে পারি পড়াশুনা ছিলো না! ছড়া বিষয়টা আমার কিন্তু ছড়া নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রভু এমন সব রেফারেন্স দিতেন যে আমার মুখে কথা সরতো না।
বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড নাস্তিক ছিলেন প্রভু।

এই প্রজন্ম প্রভুকে জানে না, জানার কথাও নয়। তিনি চিরদিনই ছিলেন নেপথ্যের মানুষ।
প্রভুকে নিয়ে বহু চমকপ্রদ কাহিনি চালু ছিলো বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গণে। শৈশব থেকেই আমি এই অঙ্গণের বাসিন্দা হবার সুবাদে প্রভুর যৌবনকালের বন্ধু-সুহৃদদের অনেককেই চিনতাম জানতাম। তাঁদের কাছে প্রভুর প্রশস্তি শুনেছি এন্তার। লক্ষ্য করেছি প্রভুর কথা বলতে গিয়ে প্রত্যেকেই তাঁর মেধা আর প্রজ্ঞার বিস্তারকে প্রথম বাক্যেই কবুল করে নিতেন।

প্রভুর দেখা পেলাম আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। প্রথম দর্শনেই প্রভু আমাকে জয় করে নিলেন। ধর্ম বিশ্বাস থেকে নয়, সাংস্কৃতিক অভ্যাসের কারণেই আমরা কারো সঙ্গে দেখা হলে স্লামালেকুম বলি। আমিও স্লামালেকুম বললাম। জবাবে প্রভু প্রণামের ভঙ্গিতে দুইহাত বুকের কাছে জড়ো করে বললেন—জয় হোক। আমি আবারো বললাম—প্রভু স্লামালেকুম। প্রভু বললেন—জয় হোক। ব্যাপারটায় খুবই মজা পেলাম আমি। আমার বন্ধু আহমাদ মাযহার প্রভুর এই বিষয়টা বিস্তারিত বললো আমাকে। আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলা করলো। আমি অপেক্ষায় থাকলাম। প্রভুর সঙ্গে দুষ্টুমিটা আমাকে করতেই হবে। কেন্দ্রে আমাদের গুরুদেব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও প্রভুর প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতেন। সায়ীদ স্যার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে প্রভুকে যে কোনো ভাবেই হোক সম্পৃক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। একটা প্রকল্পে প্রভুকে যুক্ত করে প্রভুর জন্যে কিছু সম্মানীর ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। সেই কারণে বাংলা মোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে প্রায়ই দেখা পেতাম প্রভুর। একদিন, মাথায় কুটকুট করা দুষ্টুবুদ্ধিটার প্রয়োগ ঘটালাম। সেদিন সকালে আমি বসে ছিলাম কেন্দ্রের নিচতলার আম গাছটার নিচে। মূল ফটকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রভু আসছেন। চট করে লুকিয়ে পড়লাম দেয়ালের আড়ালে। প্রভু সেই দেয়ালের পাশ দিয়ে যাবার সময় পেছন থেকে আচমকা আমি বলে উঠলাম—স্লামালেকুম। আমার দিকে তাকানোর আগেই আগেই প্রভু বললেন—জয় হোক। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে তাঁর শিশুর সারল্য মাখা হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন—কেমন আছেন আপনি?
আমাকে প্রভুর আপনি সম্বোধনের বিষয়ে বহুবার নিষেধাজ্ঞা জারির পরেও সম্বোধনটা তিনি বহাল রেখেছিলেন। আসলে শুধু আমাকেই না, সবাইকেই আপনি করে বলতেন প্রভু।

একটা সময়ের পর দেখা গেলো প্রভু কেন্দ্রে আর নিয়মিত আসছেন না। তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কমে গেলো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে হুটহাট দেখা হয়ে যায়। সেই সময়টাও আমার জন্যে হয়ে ওঠে এক অনির্বচনীয় আনন্দময় অভিজ্ঞতার স্মারক।

......সালে আমার প্রিয় অভিনয় শিল্পী আবুল খায়ের মারা গেলেন। আবুল খায়ের আর আমি একসঙ্গে কাজ করেছি একটি প্রতিষ্ঠানে। কলিগ হিশেবে আবুল খায়ের ছিলেন অবিরাম আনন্দের প্রবল স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া এক মজার মানুষ। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁকে শেষ অভিবাদন জানাতে দুপুরে ছুটে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে। ওখানে তাঁর জানাজা হবে। ওখানে গিয়েই পেয়ে গেলাম প্রভুকে। পার্কিং লটের কর্ণারে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা দুজন। জানলাম খায়ের ভাই প্রভুর নিকট আত্মীয় ছিলেন। জানাজা শুরু হলো। শেষ মুহূর্তে দৌড়াতে দৌড়াতে জানাজায় শরিক হলেন মুকুল ভাই, এম আর আখতার মুকুল। আমি আর প্রভু দূর থেকে সেই দৃশ্য অবলোকন করলাম। প্রভু আমাকে বললেন—যান আপনি জানাজায় শামিল হন। আমি বললাম আমার অজু নাই। আমার অজু না থাকার কথাটায় এতো মজা পেলেন প্রভু যে হাসতেই থাকলেন।

পার্কিং লটে দাড়িয়েই প্রভু আমাকে বললেন—আমার ছেলেটা দেখি প্রভু আপনার ভীষণ ভক্ত!
--আপনার ছেলে? নাম কি? আমি কী চিনি ওকে?
--চেনেন প্রভু। আপনার গল্প করে সে নিয়মিত। ওর নাম সুজন। আপনাদের গ্রুপে ছবি আঁকে। মীনা কার্টুন নিয়ে আপনারা কাজ করেছিলেন না প্রভু?
আমি চিনলাম সুজনকে। খুবই বিনয়ী আর হাসিখুশি একটা ছেলে। আমি আর শিশির ভট্টাচার্য, চারুকলার ছাত্র ডিউক-শিফা এবং সুজনকে নিয়ে সায়েন্স ল্যাবোরেটরির গলিতে নাজমুলের অফিসে বসে নিয়মিত কয়েকমাস কাজ করেছি। ইউনিসেফের মীনা প্রজেক্টে আমরা জড়িত ছিলাম। আমার কাছে সুজনের অনেক প্রশংসা শুনে প্রভুর ভেতরকার পিতা সত্তাটির আনন্দের উদ্ভাস দেখতে পেলাম প্রভুর চোখে মুখে।
২০০২ সালে আমি কানাডায় চলে আসার পর প্রভুকে ফোন করেছিলাম আমার অনাবাসী হবার বিষয়টা তাঁকে অবহিত করতে। প্রায় ঘন্টাখানেক গড় গড় করে কানাডা সম্পর্কে প্রভু এতো কথা বললেন যে আমার তো মনে হলো লোকটা মানুষ না, একটা কম্পিউটার। আমি অটোয়ায় থাকি শুনে ব্যাখ্যা করলেন কী কারণে অটোয়ায় শীত এবং বরফ বেশি পড়ে। কানাডার কোন অঞ্চল কোন বৈশিষ্টমন্ডিত সেটাও বলে গেলেন আমাকে বিস্ময়ের দরিয়ায় নিক্ষেপ করে! আমি কানাডায় বাস করেও এতোকিছু জানি না।

আমার মন খারাপ থাকলেই আমি প্রভুকে ফোন করতাম। আমার ফোন পেলে প্রভুও খুশি হতেন। আমাদের আলোচনার কোনো স্টেশন-গন্তব্য থাকতো না। প্রভু বলতেন--শুধুমাত্র মসলার জন্যে বারবার ভিনদেশী লুটেরাদের হামলার শিকার হয়েছি আমরা এই উপমহা্দেশের মানুষেরা। এখন যেমন তেলের জন্যে আক্রান্ত হয় মধ্যপ্রাচ্য। বলতেন পুরান ঢাকার কথা। আমি খুব মিষ্টি পছন্দ করি জেনে মিষ্টির ইতিহাস বলে যেতেন গড়গড় করে। পুরান ঢাকার বাকরখানি, ডালপুরি, গুলিস্তানের রেক্স রেস্টুরেন্টের পরটা-কাবাব, কার্ল মার্ক্স, অনুবাদ সাহিত্য, পেইন্টিং, মানুষের বিকশিত হবার ধারাবাহিক ইতিহাস, প্রগতির বই, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের দায়বদ্ধতা এবং পলায়নপরতা, সিনেমা হয়ে আমাদর আলোচনা এসে থামতো মিষ্টি কিংবা বিরিয়ানীর আলুবোখারায়। প্রতিবার প্রভুর সঙ্গে কথা বলার পর আরেকবার নতুন করে উপলব্ধি করতাম—কিছুই জানি না আমরা!


বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খানের কাছে জেনেছি, একবার সদরঘাট এলাকায় আউটডোর ছবি আঁকার সময় ছাত্র হাশেম খানের পেছনে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি পরা একজন পথাচারী অনেকক্ষণ ধরে তাঁর ছবি আঁকা দেখছিলেন। আউটডোরে কাজ করার সময় কিছু অতি উৎসাহী উটকো লোক এরকম করে মাঝে মধ্যে। হাশেম খানের আঁকাআঁকির এক পর্যায়ে চলে যাবার আগে লুঙ্গি পরা সেই লোকটা মন্তব্য করলেন—ফার্স্ট ইয়ার হিশেবে ছবি খারাপ হয়নি।
চমকে উঠলেন হাশেম খান—আরে! এই লোক ছবির কী বোঝে? আর আমি যে ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট এটাই বা লোকটা জানলো কেমন করে!
অনেক পরে হাশেম খান জানতে পেরেছিলেন লুঙ্গি পরা সেই লোকটার নাম খালেদ চৌধুরী।

২ক
অন্য লোকেশনে আরেকদিনের ঘটনা।
কালো একজন রাখাল। নদীতে একটা গরুকে গোসল করাচ্ছে। গরুকে গোসল করিয়ে গরুটাকে নিয়ে আউটডোরের কাজে ছবি আঁকায় নিমগ্ন হাশেম খানের পাশ দিয়ে যাবার সময় সেই রাখালকে চিনতে পারলেন হাশেম খান—আশ্চর্য! এই লোকটাই সেই লোক, খালেদ চৌধুরী! তাঁর আঁকা ছবি দেখে মন্তব্য করেছিলো ‘ফার্স্ট ইয়ার হিশেবে খারাপ হয়নি’! হাতের পাজন দিয়ে গরুটাকে সামনের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে যেতে লোকটা বললো—গরু আমাদের কতো উপকার করে। গরুর সেবা করা উচিৎ আমাদের সকলের।

২খ
হাশেম খান ছবি আঁকতে গেছেন নদীর ধারে। গিয়ে দেখেন একটা লোক পানিতে শরীর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাশেম খানকে দেখে লোকটা অনুরোধ করলো—আমার জন্যে একটা কাপড়ের ব্যাবস্থা করেন। পাড়ে লুঙ্গিটা রেখে স্নান করছিলাম। কেউ একজন লুঙ্গিটা চুরি করে নিয়ে গেছে। হাশেম খান অবাক বিস্ময়ে আবিস্কার করলেন এই লোকই সেই লোক! খালেদ চৌধুরী! তাঁর ছবি আঁকার সময় কমেন্ট করেছিলো! পরে হাশেম খানের উদ্যোগে আশপাশের লোকজনের সহায়তায় একটা কাপড় এনে দেয়া হয়েছিল খালেদ চৌধুরীকে।
বিস্ময়কর এই খালেদ চৌধুরীকেই আমরা চিনি প্রভু হিশেবে। আপাদ মস্তক এমন ইন্টারেস্টিং চরিত্র আমাদের সমাজে দ্বিতীয়টি নেই বললেই চলে। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার আর্ট কলেজে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে চালু হওয়া ঢাকা আর্ট কলেজের প্রথম ব্যাচের দ্বিতীয় ছাত্র ছিলেন প্রভু। কিন্তু শেষ করেননি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
পড়ুয়া হিশেবে প্রভু ছিলেন কিংবদন্তিতূল্য।


প্রভুর মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধু নিউ ইয়র্ক প্রবাসী প্রখ্যাত কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে কথা বলেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। দিনের পর দিন। শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ জমে ওঠে মুহূর্তেই। ঢাকাইয়া ডায়ালেক্টে আমার পারঙ্গমতা এবং তাঁর প্রায় সমস্ত বন্ধুকে কাছ থেকে চিনি বলে শহীদ ভাই আমার সঙ্গে গল্প করে মজা পান বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশর শিল্প-সাহিত্য এবং টেলিভিশন বিষয়ে বিপুল তথ্য আমার নখদর্পণে বলে এইসব ব্যাপার নিয়ে অনর্গল বলে যান শহীদ ভাই কোলকাতার বিশুদ্ধ বাংলা আর ঢাকাইয়া ডায়ালেক্টের মিশ্রণে। দোহার হিশেবে আমার ব্যাটিং-বোলিং পারফরম্যান্স মন্দ নয় বলে শহীদ ভাই বলতেই থাকেন বলতেই থাকেন প্রচুর নেপথ্য কাহিনি। আশ্চর্য এই মানুষটার স্মরণশক্তি। শহীদ ভাইয়ের ম্যামোরি হচ্ছে ফটোগ্রাফিক ম্যামোরি। কিন্তু শহীদ ভাই বলেন— আমার ম্যামোরির কি দ্যাখছো মিয়া ম্যামোরি তো আছিলো আমাগো বন্ধু খালেদের মানে প্রভুর। এতো পড়ুয়া ছিলো আমার এই বন্ধুটা যে কী কমু তোমারে। গেছি তোমার রামমোহন লাইব্রেরিতে। দেহি খালেদ এনসাইক্লোপিডিয়া পড়তাছে! সক্রেটিস জাতীয় লোক ছিলো খালেদ। সক্রেটিসকে গ্রিক উচ্চারণে খালেদ কইতো সোক্রাতিস। ষাটের দশকে পুরান ঢাকার গোবিন্দ ধাম নামের চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা হইতো। আমাদের আরেক বন্ধু ছিলো সুকুমার মজুমদার। খুব জ্ঞানী ছিল সুকুমার। জার্মান জানতো ফরাশি জানতো। জার্মান কালচারাল সেন্টারে পড়াইতো। মার্ক্সিস্ট সুকুমার ছিলো দর্শনে বিরাট পাণ্ডিত্বের অধিকারী। ভারতীয় এবং ইউরোপীয় দর্শনে তার ছিলো অগাধ জ্ঞান। আর খালেদ ছিলো মার্ক্সবাদ আর ভারতীয় দর্শনে চ্যাম্পিয়ান। এই দুইজনের তুমুল আলাপের মাঝখানে আমি থাকতাম মুগ্ধ শ্রোতা। দুই পণ্ডিত বন্ধুর তুমুল তর্ক-বিতর্ক আমাকে ঋদ্ধ করতো। বাকিটা আমি আপটুডেট হইতাম বই পইড়া। আহারে আমাদের বন্ধু সুকুমার ৭৫/৭৬ সালের দিকে আত্মহত্যা করলো!

আমি বললাম—শহীদ ভাই প্রভুরে লইয়া মজার কিছু কন। খালি জ্ঞানের কথা ভাল্লাগে না।

টেলিফোনের অন্য প্রান্তে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন শহীদ ভাই—শোনো তোমারে বলি তাইলে প্রভুর কাণ্ড। মধ্য পঞ্চাশ-ষাইটের ঘটনা। অবজারভার তখন মতিঝিলে ছিলো না। ছিলো পুরান ঢাকায়। অবজারভারের পিছনে আল হামরা লাইব্রেরী, সদরঘাটের কাছে, তোমার প্রভু করলো কি সেই লাইব্রেরি থিকা ‘গাইড বুক টু লণ্ডন’ বইটা মাইরা দিলো! হাহ্‌ হাহ্‌ হাহ্‌। আমিও মারছিলাম একটা।

--বলেন কী! আপনারা দুজনেই বই মেরে দিলেন লাইব্রেরি থেকে?

--হ্যাঁ দিলাম। বলি তোমাকে ঘটনাটা। হয়েছি কি হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। তো অন্ধকারেই দেখি বেরিয়ে যাবার সময় হাতের কাছে পাওয়া একটা বই খালেদ তার কোটের পকেটে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। আমারও পরনে ছিলো কোট। প্রভুর দেখাদেখি আমিও একটা বই চালান করে দিলাম কোটের পকেটে। তারপর লাইব্রেরি গেটে এসে দুজনেই দিলাম একটা দৌড়। অনেক দূরে এসে জিজ্ঞেস করলাম কী নিলেন খালেদ? খালেদ বলল জানি না। এখন দেখব। আপনি কী নিলেন? আমি বললাম –হাতের কাছে যেটা পেয়েছি সেটাই নিয়েছি। দেখা গেল খালেদ চুরি করেছে ‘গাইড বুক টু লণ্ডন’ আর আমি চুরি করছি বুঝছ বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘প্রবলেমস অব ফিলসফি’ বইটা। এই ঘটনা যখন ঘটাইছি তখন কিন্তু আমার লেখা ছাপা হচ্ছে চতুর্দিকে বুঝছ? একটু একটু নামডাকও হচ্ছে। হাহ্‌ হাহ্‌ হা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়, কী কাণ্ডটাই না করেছিলাম সেদিন আমরা...

--মস্কোয় প্রগতি প্রকাশনীতে চলে গেলেন প্রভু। আপনি গেলেন না?

--না আমি যাইনি। অনুবাদের কাজে খালেদকেই দরকার ছিল তাদের।

--আপনি আর প্রভু তো একসঙ্গে অনেকদিন চাকরি করেছেন এপিএন নামের একটা প্রতিষ্ঠানে, তাই না?

--হ্যাঁ। ১৯৬৪ থিকা অনেকগুলা বছর পর্যন্ত প্রভু কাজ করছে রাশান সরকারী সংবাদ সংস্থা এপিএন-এ। ‘এজেন্সি প্রেস নোভস্তি’ সংক্ষেপে এপিএন। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলো খালেদ। উদয়ন, সোভিয়েত দেশসহ তিনটা পত্রিকা ছিলো খালেদের আণ্ডারে। খালেদ সোভিয়েত থিকা প্রকাশিত মার্ক্সবাদ সম্পর্কিত আরেকটা তাত্ত্বিক পত্রিকাও দেখতো। খালেদ রাশিয়া গেলো দাসক্যাপিটাল অনুবাদ করতে। প্রথম খণ্ডটা খালেদের অনুবাদ। মূল জার্মান থেকে অনুবাদ হয়েছিলো ইংরাজিতে। ওইখানে ভুল ধরেছিলো খালেদ। খালেদ খুব পান খাইতো বুঝছ? তখন ঢাকা থিকা পান-জর্দা যাইতো রাশিয়ায়, খালেদের জন্য, রেগুলার। এপিএন-এ আমার জন্যেও একটা কাজের ব্যাবস্থা করেছিল খালেদ। ইংরেজি বিভাগে।

--প্রভুর অনুবাদে প্রগতি থেকে বেরিয়েছিল একটা বই। প্রভু যার নাম দিয়েছিলেন ‘জামিলা’।

--আরে! খালেদের এই বইটা তো আমি দেখিনি! শুনেছিলাম মনে হয়। মূল বইটা চিঙ্গিস আইতমাতভের লেখা না? দেখি নাই তো!

--আচ্ছা, শহীদ ভাই, আমি যদ্দুর জানি প্রভুর সঙ্গে তাঁর বাবার একটা ঝামেলা ছিল। প্রভু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর ফিরে যাননি। বাবার কাছ থেকে ডাইরেক্ট কোনো টাকা পয়সা নিতেন না প্রভু। কিন্তু তাঁর অসাধারণ বাবা ছেলে খালেদ চৌধুরী যাতে না খেয়ে না থাকে সে কারণে একটা ব্যবস্থা রেখেছিলেন। একটা রেস্টুরেন্ট থেকে প্রভু টাকা নিতেন প্রতিমাসে, যখনই প্রয়োজন হতো। দেখা গেল দিলদরাজ প্রভু তাঁর অভাবী বন্ধুদেরও টাকা দিচ্ছেন ওখান থেকে। বাড়তি খরচ ঠেকাতে প্রভুর বাবা নতুন নিয়ম বেঁধে দিলেন। প্রভু আর নগদ টাকা পাবেন না। কেবল খেতে পারবেন সেই রেস্টুরেন্টে। শুনেছি সেই রেস্টুরেন্টে অর্থ সংকটে থাকা সৈয়দ শামসুল হক এবং আবদুল গাফফার চৌধুরীও মাঝে মধ্যে খেতে যেতেন প্রভুর সঙ্গে। আপনিও যেতেন নাকি?

--না আমি যাইনি কখনো। আরেকটা ব্যবস্থার কথা তো তুমি বললে না।

--কোনটা শহীদ ভাই?

--খালেদ সিগারেট খেতো খুব। তার বাবা পোলার সিগ্রেট খাওনের ব্যবস্থাও রাখছিলেন বুঝছ? একটা দোকানে বলা ছিল। খালেদ ওখান থেকে সিগ্রেট নিত। শুধু নিজে নিতো না। বন্ধুদেরও দিত সিগারেটের পুরা প্যাকেট। দোকানি লিখে রাখত। বিল পেমেন্ট করতেন খালেদের বাবা।

--প্রভুর বাবা সেই মানুষটা তো অসাধারণ ছিলেন শহীদ ভাই!

--হ্যাঁ ছিলেন। কিন্তু প্রভুর সঙ্গে বনিবনা হলো না।

--প্রভুর একজন বন্ধু ছিলেন ফজলুল করিম নামে। আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন বোধ হয়। ফজলুল করিম প্রভুকে তাঁর সংকটের সময় নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন।

--হ্যাঁ। সেই লোকের বাড়িতে থাকত খালেদ। থাকা খাওয়া ফ্রি। একটা দেড় তলা টিনের বাড়ির ওপর তলায় খালেদ থাকত। ওর কাজ ছিল খাওয়া আর বই পড়া। কতো যে পড়ত খালেদ! আমিও গিয়েছি ওই বাড়িতে।

--আপনি তো শহীদ ভাই দেখেছেন প্রভুর দিন গেছে কী রকম সংকটের ভেতর দিয়ে। প্রবল অর্থ কষ্ট। সীমাহীন দারিদ্র।

--হ মিয়া। ফজলে লোহানীর একটা পত্রিকা ছিলো ‘অগত্যা’।
অগত্যার অফিস আছিল ইসলামপুরে। খালেদের থাকার জায়গা নাই। খালেদ অগত্যার টেবিলের উপ্রে ঘুমাইত। মাথার নিচে এনসাইক্লোপিডিয়ারে বালিশ বানায়া। সংকটের আরেকটা অধ্যায়ের কথা বলি তোমারে রিটন। খালেদ তখন থাকে বাংলাবাজার বিউটি বোর্ডিং-এ। আমাদের কাউরে খালেদ বলে নাই কী কষ্টের ভিতর দিয়া সে যাইতাছে। খাওয়ার টাকা ছিল না। প্রতিদিন সকালে বিউটি বোর্ডিং থেকে হাঁটতে হাঁটতে খালেদ যেত বহু দূরের এক বন্ধুর বাড়িতে, পাগলায়, নারায়গঞ্জে যেতে হলে পাগলা হয়ে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে ধর এগারোটা বারোটায় খেত একপ্রস্ত। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করত বিউটি বোর্ডিং-এর দিকে। শেষ বিকেলে এসে পৌঁছাত বিউটি বোর্ডিং-এ। আসলে খালেদের জীবনে এরকম অনেক চড়াই উতরাই ছিল।

--শহীদ ভাই, স্বাধীনতার আগে আপনি ঢাকা টেলিভিশনে জয়েন করেছিলেন প্রডিউসার হিশাবে। আমি শুনেছি আপনি প্রভুর উপস্থাপনায় একটা অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতেন।

--হ্যাঁ বছর দুয়েক চাকরিটা করেছিলাম। আষট্টির শেষদিকে টিভির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। খালেদকে দিয়ে যে অনুষ্ঠানটা করতাম তার নাম ছিল ‘বিচিন্তা’।
লাইভ ছিল অনুষ্ঠানটা। বিশাল বিশাল মহীরুহকে ধ্বসাইয়া দিত খালেদ। জায়ান্ট কিলার হিশাবে আমি ইউজ করতাম খালেদকে। খালেদ চৌধুরীর বিপুল পড়াশুনা এবং ওর মেধা-প্রজ্ঞা আর স্মৃতিশক্তির সামনে টিকে থাকা টাফ ছিল। ধরো স্টুডিওতে বসাইয়া দিলাম ওরে মুনীর চৌধুরীর লগে। জইমা উঠল তর্ক মুনীর চৌধুরী ভার্সেস খালেদ চৌধুরী। অসাধারণ সেই কনভার্সেশান। তারপর মনে করো প্রফেসর খান সরোয়ার মুরশিদ। তারপর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ভার্সেস খালেদ চৌধুরী। অহ্‌ ঘাইমা উঠত একেকজন। দর্শকও বিস্মিত হইত—অধ্যাপক না পিএইচডি না কে ইনি? অই অনুষ্ঠানটা বলতে পারো আমার কিলিং মিশন আছিল। বিশেষ কইরা ফাঁপা বুদ্ধিজীবী গো অন ক্যামেরা বধ কইরা ফালাইতাম খালেদরে দিয়া। শুধু একজনকে আমি বসাতে পারিনি খালেদের মুখোমুখি।

--কাকে শহীদ ভাই?

--প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে। দৃশ্যমান কোনো কাজ নাই কিন্তু বড় বড় কথা। হ্যারল্ড লাস্কির আন্ডারে পিএইচডি করতাছিলেন। লাস্কি গেল মইরা। লাস্কি নাই অইন্য কেউ বুঝবনা তাঁর থিসিস-- এই ফিকির তুইলা তিনি তাঁর থিসিস ছুঁড়ে ফেললেন। ভাসায়া দিলেন টেমস্‌ নদীতে। পিওর বুলশিট এইটা বুঝছ? আমি চেয়েছিলাম প্রফেসর রাজ্জাককে খালেদের সঙ্গে বসাতে। অন ক্যামেরা। কিন্তু খালেদ ভীষণ শ্রদ্ধা করত প্রফেসরকে। সে কিছুতেই রাজি হল না।

--এই রকম বিধ্বংসী একটা টিভি প্রোগ্রামের প্ল্যানিংটা এলো কোত্থেকে?

--ইংরেজি অই প্রবাদটা জান তো—নো ম্যান ইজ এন আইল্যাণ্ড। অইটারে সামনে রেখে অইটার বিপরীতে আমরা বলতে চাইলাম—না, কেউ একা নন, নিশ্চয়ই আছেন কেউ না কেউ। অর্থাৎ পক্ষে বনাম বিপক্ষে। কিন্তু এইরকম একটা অনুষ্ঠান করা সহজ ছিল না। আমাদের বুদ্ধিজীবী অধ্যাপকরা গৎ বাঁধা কথা বলেন। তাঁদের কথাকে কাটার জন্যে, তাঁদের কথার মাঝখানে কোপ মারার জন্যে একজন জাঁদরেল উপস্থাপক লাগে। আমার বন্ধু খালেদ ছিল সেই পাওয়ারফুল উপস্থাপক। খালি দর্শকরা না আমন্ত্রিত অতিথিরাও অনুষ্ঠানের পর আমার কাছে জানতে চাইতেন—কে এই লোক!


শহীদ ভাইকে বললাম—আপ্নের লগে প্রভুর ইমুন দোস্তি আছিল তো প্রভুর মৃত্যু সংবাদ জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
শহীদ ভাই বললেন—আমি কানছি সারা রাত। ঘুমাইতে পারি নাই রিটন।

--আম্রিকা থিকা কথা কইতেন বন্ধুর লগে?

--একটা অপরাধ বোধ থিকা আমি অরে ফোন করি নাই। আমার ছোট বইনটাও চইলা গেছে। তারেও ফোন করা হয় নাই। একটা অপরাধ বোধ বুঝছ অপরাধ বোধ...।


২০১১ সালে প্রভুপুত্র সুজনকে আমার একটা ছড়ার বইতে যুক্ত করার ইচ্ছে থেকে কিছু পরিকল্পনা করলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটা করতে গিয়ে দেখলাম মহা মুশকিল। বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী-রফিকুন নবী-হাশেম খানদের প্রচ্ছদ আর অলংকরণ হাসিল করার চাইতেও কঠিন সুজনকে হ্যাণ্ডল করা। একটু বোধহয় বকাটকা দিয়েছিলাম সুজনকে ঢাকা থেকে। এক দুপুরে হঠাৎ আমার সেলফোনে প্রভুর কল—আরে প্রভু আপনি ঢাকায় এলেন আর এখনো আমাকে হ্যালো করলেন না?
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম—প্রভু মাত্র তো এসেছি। আপনাকে অবশ্যই হ্যালো করতাম কাল-পরশু। প্রতিবার ঢাকা এসে যেমনটা করি।

--জ্বি প্রভু। কিন্তু আজকে আপনাকে ফোন করলাম একটা বিশেষ কারণে।

--বলেন প্রভু।

--আপনার সঙ্গে সুজন কথা বলতে চায় কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। আপনাকে আমার এই ছেলেটা প্রচণ্ড ভালোবাসে জানতাম কিন্তু এখন তো দেখি ভয়ও পায়! আপনি প্রভু ওকে ক্ষমা-টমা করে দিয়ে ওকে একটু কথা বলার সুযোগটা করে দ্যান।
উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠলাম আমি—আপনার এই ছেলেটা তো দেখছি ডেঞ্জারাস!

--কী রকম প্রভু!?

--আরে প্রভু আপনার হাতে রেফারির বাঁশিটা ধরিয়ে দিয়েছে! এখন আপনি বাঁশি বাজালে আমি যাই কোথায় বলেন? ওরে একটা মাইর দিতে হবে কানাডা ফিরে গিয়ে।

আমার কথায় খুব আশ্বস্ত হলেন প্রভু। বললেন—আপনার বইয়ের কাজ করবে সুজন এটা জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি প্রভু। ইলাস্ট্রেশন আপনার পছন্দ না হলে ওকে বললেন। বারবার করাবেন। ওর এখন শেখার সময়। প্রয়োজনে বকাও দেবেন প্রভু।
সে বছর করা না হলেও পরের বছর অর্থাৎ ২০১২-র ফেব্রুয়ারির বইমেলায় সুজনের করা প্রচ্ছদ আর ইলাস্ট্রেশন নিয়ে ‘ভুতের বিয়ের নিমন্ত্রণে’ নামে আমার একটা চাররঙা ছড়ার বই বেরিয়েছিল। কিন্তু বইটা দেখে সবচে বেশি খুশি হতেন যে মানুষটি—সেই প্রভুই চলে গেলেন আকাশের ঠিকানায়। আমার লেখালেখির জীবনে এটা একটা বেদনার অনুষঙ্গ হয়ে রইল।

সালাম প্রভু। জয় হোক।

ছবি: 
12/08/2007 - 9:52অপরাহ্ন

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

উনার পাণ্ডিত্য সম্পর্কে ভাসা ভাসা শুনেছিলাম, লিখা পড়ে কিছুটা জানতে পারলাম আরও।

প্রভুর জন্য শ্রদ্ধা

অসাধারণ স্মৃতিচারণ।

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ। হাততালি

-প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে। দৃশ্যমান কোনো কাজ নাই কিন্তু বড় বড় কথা। হ্যারল্ড লাস্কির আন্ডারে পিএইচডি করতাছিলেন। লাস্কি গেল মইরা। লাস্কি নাই অইন্য কেউ বুঝবনা তাঁর থিসিস-- এই ফিকির তুইলা তিনি তাঁর থিসিস ছুঁড়ে ফেললেন। ভাসায়া দিলেন টেমস্‌ নদীতে। পিওর বুলশিট এইটা বুঝছ? আমি চেয়েছিলাম প্রফেসর রাজ্জাককে খালেদের সঙ্গে বসাতে। অন ক্যামেরা। কিন্তু খালেদ ভীষণ শ্রদ্ধা করত প্রফেসরকে। সে কিছুতেই রাজি হল না।

গুল্লি গুল্লি গুল্লি

বইটি কারা করছে জানতে পারি? হাসি

সবজান্তা এর ছবি

অসাধারণ স্মৃতিচারণ।

এমন স্মৃতিচারণ গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এই কারণেই না যে, প্রচারবিমুখ একজন সত্যিকারের জ্ঞানী মানুষ সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি- একই সাথে অনুপ্রেরণা হিসেবেও।

আমার ম্যামোরির কি দ্যাখছো মিয়া ম্যামোরি তো আছিলো আমাগো বন্ধু খালেদের মানে প্রভুর। এতো পড়ুয়া ছিলো আমার এই বন্ধুটা যে কী কমু তোমারে। গেছি তোমার রামমোহন লাইব্রেরিতে। দেহি খালেদ এনসাইক্লোপিডিয়া পড়তাছে! সক্রেটিস জাতীয় লোক ছিলো খালেদ। সক্রেটিসকে গ্রিক উচ্চারণে খালেদ কইতো সোক্রাতিস। ষাটের দশকে পুরান ঢাকার গোবিন্দ ধাম নামের চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা হইতো। আমাদের আরেক বন্ধু ছিলো সুকুমার মজুমদার। খুব জ্ঞানী ছিল সুকুমার। জার্মান জানতো ফরাশি জানতো। জার্মান কালচারাল সেন্টারে পড়াইতো। মার্ক্সিস্ট সুকুমার ছিলো দর্শনে বিরাট পাণ্ডিত্বের অধিকারী। ভারতীয় এবং ইউরোপীয় দর্শনে তার ছিলো অগাধ জ্ঞান। আর খালেদ ছিলো মার্ক্সবাদ আর ভারতীয় দর্শনে চ্যাম্পিয়ান। এই দুইজনের তুমুল আলাপের মাঝখানে আমি থাকতাম মুগ্ধ শ্রোতা।

এই অংশটা পড়তে পড়তে চিন্তা করতেছিলাম যে আমি আমার সমবয়েসী, কয়টা পোলাপানরে চিনি যাদের জ্ঞান চর্চার প্রতি এমন ভালোবাসা আছে ... খুব বেশি দেখলাম না। খালেদ চৌধুরীর মতো মানুষ সব যুগেই বিরল, তবুও একটা ব্যাপার অনুভব করি- ব্যবহারিক কিংবা প্রায়োগিক না, এমন ধরনের জ্ঞান চর্চার প্রতি আমাদের আগ্রহ অনেক কমে গেছে, যাচ্ছে। চারপাশে প্রচুর ভালো ছাত্র দেখি- ফাটাফাটি অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার। কিন্তু মৌলিক চিন্তার জায়গাটাতে প্রাগ্রসর কিন্তু দেখিই না। এই ধরনের মানুষের কথা যতো বেশি ছড়াবে, ততো হয়তো মানুষের মনে আগ্রহ সৃষ্টি হবে।

লেখাটা দুর্দান্ত লাগলো রিটন ভাই। লেখাটা পড়ে মনে হলো উনাকে নিয়ে আপনার মধ্যে এতো উচ্ছ্বাস এবং স্মৃতি আছে যে, লেখার কলেবর সীমিত রাখার জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হইছে। আমার অনুমান অবশ্য এইটা, ভুলও হইতে পারে।

ধন্যবাদ, কাজ ফাঁকি দিয়ে লেখাটা পড়ে সময় সার্থক হইলো।

তারানা_শব্দ এর ছবি

শ্রদ্ধা

অসাধারণ। এমন একটা মানুষের কথা আগে জানতে পারলে একবার নিজ চোখে দেখে আসতাম। মন খারাপ

"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"

জুন এর ছবি

একেবারে আমার মনের কথাটা বলছেন। মন খারাপ শ্রদ্ধা

যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...

মন মাঝি এর ছবি

চলুক দারুন! স্মৃতিচারণ রক্স!

কোলকাতাইয়া আর কুট্টি ডায়ালেক্টের ক্রস কেমন চিজ্‌ - ভাবতেই মজা লাগছে হাসি

****************************************

পৃথ্বী এর ছবি

অসাধারণ স্মৃ্তিচারণ। এরকম মানুষের সান্নিধ্য পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

অসাধারণ স্মৃতিচারণ, রিটন ভাই ...

স্পর্শ এর ছবি

কী অসাধারণ একজন মানুষের কথা জানলাম! আফসোস হলো কখনো তার সাক্ষাৎ পাইনি বলে।
প্রভুর পুত্র সুজন-ই কি আমাদের সচল সুজন চৌধুরী?


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হ্যাঁ, সচল সুজন চৌধুরী ও সুমন চৌধুরী উভয়ে তাঁর পুত্র।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৌরভ এর ছবি

অসাধারণ স্মৃতিচারণ। এরকম অসাধারণ মানুষদের কথা তারা চলে যাওয়ার আগে জানতে পারলে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য বেশি উপকার হবে, কারণ এমন অনেক গুলো ক্ষেত্র আছে যেখানে আমাদের সামনে অনুকরণিয় পরিচিত ব্যাক্তিত্বের সংখ্যা এতোই কম যে মাঝে মাঝে মনে হয় আমারা যেন একটা বিচ্ছিন্ন প্রজন্ম, তাছাড়া নিজেদের আশে-পাশে অসাধারণ মানুষ আছে জানতে পারলে নিজেদের মধ্যে ভালো কিছু করার উৎসাহ প্রবল হয়। তাই সৌভাগ্যবানদের অনুরোধ করি তারা যেন সুযোগ পেলেই তাদের পরিচিত অসাধারণ ব্যাক্তিত্বদের কথা আমাদের সামনে তুলে ধরেন।
আর বিচিন্তার পর্বগুলোকে ইউটিউবে দিয়ে দেয়া যায় না? আমারা দেখতে পেতাম 'ভন্ড' বধ করে কিভাবে হাসি

শুভকামনা

স্পর্শ এর ছবি

চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

অসাধারণ স্মৃতিচারণ -- অনেক ধন্যবাদ !

----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!

স্যাম এর ছবি

অসাধারণ !! প্রভুর জন্য শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
'প্রভু' নামে উনাকে কবে থেকে বা কিভাবে ডাকা শুরু হল জানতে ইচ্ছা করছে।

দুর্দান্ত এর ছবি

শ্রদ্ধা

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

রিটন ভাই আপনাকে ধন্যবাদ এরকম দুর্দান্ত একটা স্মৃতিচারণের জন্য। আমাদেরকে জানানোর মত অনেক কিছুই আছে আপনার স্টকে। সময় করে এরকম আরও যদি লিখেন তবে আনন্দিত হব।

সাবেকা  এর ছবি

অসাধারণ!

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো জেনে, উনার জন্য শ্রদ্ধা।

''দিবাকর''

তিথীডোর এর ছবি

সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' বইটার অনেক জায়গায় খালেদ চৌধুরীর কথা আছে।

দুর্দান্ত স্মৃতিচারণ! চলুক

প্রভুর জন্য শ্রদ্ধা রইল।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

Guest_Writer নীলকমলিনী এর ছবি

অসাধারণ!

বাপ্পীহায়াত এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রিটন ভাইকে!

সুজন্দা আর বদ্দার কাছ থেকে উনাকে নিয়ে সচলে দু'টা লিখার (স্মৃতিচারণ) দাবি জানিয়ে গেলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরু গুরু

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক কিছুই জানা হলো অজানা একজন প্রভুদা সম্পর্কে,নিভৃত জ্ঞান পিপাসু মানুষ ছিলেন।উনি কি কোন বই লিখেছেন কখনো?লিখে থাকলে দয়া করে জানাবেন। অসাধারণ একটা স্মৃতিচারনমূলক লেখার জন্যে রিটন ভাইকেআপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মাসুদ সজীব

রাত-প্রহরী এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।