আমার মধ্যে ছড়াচেতনা এবং ছন্দ-দ্যোতনা সৃষ্টিতে বিশিষ্ট এক মাতালের ভূমিকাকে আমি স্মরণ না করে পারি না। আমি তখন খুব ছোট। প্রাইমারী স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করেছি সবে। থাকি হেয়ার স্ট্রিট,ওয়ারিতে। আমাদের বাড়িটা এমন এক জায়গায় যার ডানে এবং বাঁয়ে মুচিদের (রবিদাস সম্প্রদায়)টানা বস্তি। মাঝখানে আমাদের বাড়িটাই শুধু ইটের দালান। সেই বস্তিতে থাকা মুচিদের প্রধান জীবিকা ছিলো জুতো সেলাই। রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকেরা মদ্যপান করবে, মাতলামি করবে এটাই যেনো সতঃসিদ্ধ ছিলো। মদ্যপান ওদের করতেই হবে, তা নইলে ওরা জুতোর কাজ করতে পারে না এই রকম একটা ধারণার প্রতি এলাকার মানুষদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিলো। চোলাই এবং বাংলামদ খেয়ে ওদের মাতলামি আর হৈচৈ চিৎকার চ্যাঁচামেচি করাটা ছিলো নিয়মিত ব্যাপার। সেই চিৎকারের একটা প্রধান অনুষঙ্গ ছিলো অশ্লীল খিস্তি আর গালাগাল। জীবনের যতো কুৎসিত গালাগাল আমি শৈশবেই শুনেছি। চ-বর্গীয় গালাগালগুলোর ডিপো ছিলো এই মুচিপাড়া। এই গালাগালসমূহ আমাদের গা সওয়া নয়, কান সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। মুচিদের ভাষাটাও আমার জানা হয়ে গিয়েছিলো। মহিলারা শিশু-কিশোর কিংবা বয়স্ক কারো ওপর বিরক্ত হলে একটা কমন গালি দিতোই দিতো—নাতিয়াকা বেটা তেরি মাটি লাগোল্। ভাই ভাইকে গাল দিতো—তেরি মাকা...।
তো এইরকম ভয়ংকর একটা পরিবেশের মধ্যেই আমি বড় হচ্ছিলাম। প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হবার পর আমার চারপাশে সুন্দর বলতে ছিলো সিলভারডেল কিণ্ডারগার্টেন স্কুল কম্পাউন্ডের কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার ইশকুল শিল্পবিতান আর গানের ইশকুল সুরবিতান।
আমার মধ্যে ছড়াচেতনা এবং ছন্দ-দ্যোতনা সৃষ্টিতে ‘ডিজেল’ নামের এক বিশিষ্ট মাতালের গুরুত্বপূর্ণ বিশাল ভূমিকাটা এখানে বলে রাখি। রোগা-পটকা মাঝারি উচ্চতার এই লোকটা অন্য এলাকা থেকে মুচিপাড়ায় আসতো মদ্যপান করতে। বেশির ভাগ সময়েই তার পরনে থাকতো ল্যান্ডি মার্কেট থেকে কেনা জিন্স অথবা গ্যাভার্ডিন প্যান্ট এবং শরীর আঁকড়ে থাকা সাইজের ছোট টিশার্ট কিংবা চকড়াবকড়া জামা। লোকটার পলকা শরীর দেখেই বোঝা যেতো একরত্তি শক্তি নেই ওর গায়ে। ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে এমনই পলকা তার শরীর-স্বাস্থ্য। তো লোকটার নাম ডিজেল ক্যানো? শোনা কথা—একবার পান করবার মতো এক ফোঁটা মদও যোগাড় করতে পারেনি বলে লোকটা নাকি গাড়ি থেকে ডিজেল চুরি করে সেটা পান করেছিলো। সেই থেকেই লোকটার অরিজিনাল নামটা ভ্যানিস হয়ে গিয়ে ডিজেল নামটাই স্থায়ী হয়ে গিয়েছিলো। ডিজেল আমাদের মহল্লায় এলেই ওর পিছু নিতো মুচিপাড়ার দুষ্টু ছেলেরা। ওরা ডিজেলের পেছন পেছন ধাওয়া দিয়ে দিয়ে স্লোগানে স্লোগানে ব্যতিব্যাস্ত করে তুলতো তাকে। ডিজেল দৌড় এবং দ্রুত গতিতে হাঁটার মাঝামাঝি পর্যায়ের স্পিডে ছুটে পালাতে চাইতো। মাঝে মাঝে অতিষ্ট হয়ে রাস্তা থেকে ইটের টুকরো তুলে নিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে ওটা ছুঁড়ে মারতো ছেলেগুলোর দিকে। মাতালের নিশানা ঠিক থাকে না বলে ওটা কারো গায়ে আঘাত করতে সমর্থ হতো না। উল্টো—ঢিল ছোঁড়ার অপরাধে ধাওয়াটা আরো প্রবল হয়ে উঠতো। এই ধাওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতো স্লোগান। নেতৃত্বে থাকা একটা ছেলে সুর করে উচ্চ কণ্ঠে বলতো—ডিজেল মেরা লাল হ্যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেগুলো বলতো—ল্যাওড়াকা বাল হ্যায়। সম্মিলিত কচিকণ্ঠের বিস্ময়কর স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠতো এলাকাটা—ডিজেল মেরা লাল হ্যায়—ল্যাওড়াকা বাল হ্যায়। এইটুকুন ছোট্ট বালক আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডিজেল নামের মাতালটাকে আমারই বয়েসী একদল বালকের কাছে হেনস্তা হতে দেখে খুশি হয়ে উঠি একবার। আবার একটু পরেই বিষণ্ণ হয়ে উঠি ডিজেল নামের আপাত বিপদগ্রস্ত মাতালটার জন্যে। এবং খানিক পরেই মহাবিস্ময়ে আবিস্কার করি পাজির হদ্দ সেই বালকদের অপূর্ব স্লোগানের অপরূপ ছন্দমাধুর্যে সম্মোহিত আমি অজান্তেই শামিল হচ্ছি ওদের সঙ্গে। নেতৃত্বে থাকা ছেলেটা বলছে—ডিজেল মেরা লাল হ্যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেদের সঙ্গে অনুচ্চ কণ্ঠে আমিও বলছি—ল্যাওড়াকা বাল হ্যায়। কী মুশকিল! নিজের কাছে নিজেই ধরা পড়ে লজ্জিত হই। দ্রুত সরে আসি বারান্দা থেকে। আমাদের বাড়ি অতিক্রম করে ছোটখাটো মিছিলটা চলে যেতে থাকে। দূর থেকে ভেসে আসে স্লোগান—ডিজেল মেরা লাল হ্যায়...।
সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসে আবিস্কার করি ভয়াবহ বিপদটা। ক্লাশের পড়া তৈরি করতে গিয়ে টের পাই—ফ্লোরের ওপর পায়ে তাল ঠুকে খুব নিচু স্বরে আমি গুণগুণ করছি—ডিজেল মেরা লাল হ্যায়...।
সব্বোনাশ!
স্নানের সময় গান গাওয়াটা আমার চিরকালের অভ্যেস। স্নান করতে গিয়ে ফের সেই একই বিপদ—শরীরে সাবান ঘষতে ঘষতে ছন্দে ছন্দে মাথা দুলিয়ে আমি অবিরাম আউড়ে যাচ্ছি—ডিজেল মেরা লাল হ্যায়...।
পরিপাটি ফিটফাট বাবুটি সেজে স্কুলে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে টের পাই—অবচেতনে ছন্দোময় পদক্ষেপে আমি আউড়ে চলেছি—ওয়ান টু থ্রি ফোর—ডিজেল মেরা লাল হ্যায়...।
আজ পঞ্চাশ পেরুনো পরিণত বয়েসে এসে অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমার মধ্যে ছড়া চেতনা আর ছন্দ-দ্যোতনা তৈরি করে দিয়েছিলো ডিজেল এবং তার প্রতি নির্দয় সেই বালকেরা। জল পড়ে পাতা নড়ে টাইপের কোনো ভদ্রোচিত দৃশ্য আমাকে ছন্দে এতোটা উদ্ভুদ্ধ করেনি যতোটা করেছিলো মাতাল ডিজেল এবং তার খুদে দুশমনরা!
অটোয়া ১৭ মে ২০১৩
মন্তব্য
ছড়াটা দারুন, যেন আপনারই রচনা। এই রে! আমিও তো তাড়াতে পারছি না মন থেকে!
হা হা হা...
দারুণ লেখা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ডিজেল মেরা লাল হ্যায়...।
facebook
সুবোধ অবোধ
আরেকটু এগিয়ে গেলে ছিল বোধহয় ধাঙর পট্টি নাকি ?
আমরা বলতাম 'মেথর পট্টি'।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
আব্দুল হাই, করে খাই খাই
ডিজেল খেয়ে বলে, এখন ভুলি নাই
হেহে খুবই ক্যাচি লাইন দুইটা।ডিজেল বাবার নামে একটা বই উৎসর্গ করে দিয়েন রিটন ভাই।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
ইয়ে মানে আপনার কিশোরপাঠ্য ছড়াগুলিতে বেশি সরাসরি প্রভাব পড়েনি আশা করি
পড়েছে, কিন্তু পাব্লিক বুঝতে পারেনি!
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
হা হা হা! অসাম!!
রিটন ভাই, ছোটোদের কাগজের গ্রাহক হিসাবে একটা ছোটদের গল্প দাবী করে গেলাম। ছোটদের না আসলে, কিশোরদের। একটা গল্প বেশ কয়েক সংখ্যা ধরে চলেছিল, ভূতের ডিম নিয়ে খুব সম্ভবত। মা কে প্রচুর জ্বালাতন করেছিলাম নতুন সংখ্যা কবে আসবে কবে আসবে জিজ্ঞেস করে, ওই গল্পটা পড়ব বলে।
সবচে প্রিয় সংখ্যা ছিলো ভাই-বোন সংখ্যা। নিজের ছোট ভাইটা যথেষ্টই যন্ত্রণার কারণ ছিলো, ওই সংখ্যায় আমার সমব্যাথি আরো কিছু ত্যাক্ত-বিরক্ত বড়বোনের দেখা পাওয়ায় একটু তাও শান্তি পাওয়া গেছিলো।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
আহারে সুরঞ্জনা ছোটদের কাগজের কথা মনে করিয়ে দিলে!
'ভূতের ডিমের ওমলেট' নামে বইটা বেরিয়েছিলো কিন্তু, অবসর থেকে।
'ভাইবোন সংখ্যা'টা খুবই ইন্টারেস্টিং ছিলো।
দেবো একটা গল্প, তোমার দাবী অনুযায়ী।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
বাসায় আছে 'ভূতের ডিমের অমলেট'।
ছোটদের কাগজের সেরা ছিল এক ঈদ উল ফিতরে ঢাউস ঈদ সংখ্যাটা! আগের দুই মাসে প্রকাশ না হওয়ার পাপ হালকা করে দিয়েছিল ওই সংখ্যাটা।
হুমায়ূন আহমেদের 'কালো জাদুকর' এসেছিল ছোটদের কাগজে, বাসায় আমরা প্রায়ই বলাবলি করতাম হুমায়ূনের পতনযাত্রার শুরু এখানে! বৃক্ষ, গলা পর্যন্ত মাটিতে গেঁথে পূর্ণিমা দেখা- এইগুলা প্রথম কালো জাদুকরেই চোখে পড়েছিল।
মুস্তাফা মনোয়ারের কমিকসও আফসোস বারায় বৈ কি! ছোটদের কাগজ গেল, এগুলো গেল!
আর সে সময় অবাক ও লেগেছিল, ছোটদের কাগজ হঠাৎ করেই নাই হয়ে গেল! ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় 'আলী লাইব্রেরী' থেকে আর সব বইয়ের মত 'ছোটদের কাগজ'ও যোগাড় হয়- কত কত বই গেলো, ছোটদের কাগজ আর এলো না কখনো!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
আশা করি প্রতিনিয়ত আপনার লিখা পাবো
রাত দুটো বাজে এখন। জোরে হাসতেও পারছিনা।
আনন্দ পেলাম। ছেলেবেলার কথা মনে পরছে।
সত্যি কথাটা সবার সাথে শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
আসলে সত্যেই আনন্দ। সত্যই সুন্দর। এরকম ‘সত্যি’ একধরনের নির্মল আনন্দ দেয়।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
একুশে পদক পাওয়ার পরে আফনেরে কেউ জিগায় নাই, ছগা লেখার অনুপ্রেরণা কোথায় পেয়েছেন?
এই অতি সুশীল প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চই সত্যি কথাটা বলেন নাই, নাকি?
জিগাইছিলো তো! আমিও সত্যিটাই কইছিলাম কিন্তু কেউ প্রকাশ করে নাই!
(একুশে না, বাংলা একাডেমী পদক), (ছগা না, ছড়া) বুঝছো?
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
স্যরি বস!! ১ম'টার জন্য। দ্বিতীয়টা টাইপো।
দারুণ লেখা। আমাদের বিস্ময়কর সব মানবিক প্রেরণা আসলে তথাকথিত খুব সাধারণ সব মানুষ থেকেই পাওয়া। নিরন্তর শুভকামনা।
তানিম।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
মন্তব্য করবোনা করবোনা করেও করতে বাধ্য হলাম। ভাবছিলাম এই সংক্রামক স্লোগানটা হয়তো আমাকে প্রভাবিত করবেনা। কিন্তু আজ দুপুরে খাবার টেবিলে বসেও যখন জিনিসটা মাথায় এলো তখন ভাবলাম মন্তব্যে সেটা জানিয়ে দেই।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
এক কোথায় - "দারুণ !!!"
অফিসে বসে পড়লাম প্রাণ খুলে হাসতে পারছিনা, দারুন
চমৎকার! চমৎকার স্মৃতিচারণ!!!!
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
মাথায় ঢুকে গেল...
নতুন মন্তব্য করুন