আমার সকালটা শুরু হলো সজল খালেদের মৃত্যু সংবাদের মাধ্যমে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট চূড়াকে পদানত করে ফিরে আসার পথে মৃত্যু তাকে কেড়ে নিয়েছে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অসংখ্য কিশোর-তরুণের মধ্যে সজলকে আলাদা করা যেতো অনায়াসেই। দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ ছিলো না ওর সঙ্গে। আমি বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে কানাডায় থাকার কারণে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হতো না ঠিকই কিন্তু ওর কর্মকাণ্ড আমার জানা হয়ে যেতো ফেসবুকের কল্যাণে। ওর সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগটা হলো বহু বছর পর। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকদের নিয়ে ‘একাত্তরের শব্দসেনা’ নামে একটা ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছিলো সজল। সরকারি অনুদানে নির্মাণ করেছিলো শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘কাজলের দিনরাত্রি’।
কানাডায় চলচ্চিত্র দুটির প্রদর্শনের ব্যাপারে আমার সহযোগিতা চেয়েছিলো সে। আমার ইনবক্সে সেই আকাঙ্খাটা জানানোর মাধ্যমে ১২ জুলাই ২০১২তে আবার নতুন করে ওর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলো। গেলো বছর ৩১ জুলাই সজল লিখলো—‘আর ৭ দিন পর আমার ছেলে সুস্মিত হোসেন সূর্য'র জন্মদিন। খুবই অস্থির আর হাসিখুশি হয়েছে সুস্মিত। ওর জন্মদিনের আমন্ত্রন কার্ডের জন্য ছোট্ট একটা ছড়া লিখে দিবেন প্লিজ?
সজল’
তরুণ পিতা-মাতা জুটি বিশেষ করে সজলকে খুশি করতে আমি লিখলাম-- নিশ্চয়ই দেবো। এটা ওর কতোতম জন্মদিন? তারিখটা?
সজল লিখলো—‘প্রথম জন্মদিন। ৭ আগস্ট একই সাথে ফ্রেন্ডশিপ দিবস। আমরা রোজার কারণে ৭ আগস্ট ছোট্ট অনুষ্ঠান করবো আর রিয়েল অনুষ্ঠান করবো এক মাস পর ৭ সেপ্টেম্বরে। তখন ওর ১৩ মাস হবে।’
২ আগস্ট আমি লিখলাম-- সজল, এই ভুলটা প্রায় সবাই করে। প্রথম জন্মদিন না, ৭ তারিখ সূর্যের দ্বিতীয় জন্মদিন। ওর প্রথম জন্মদিন হচ্ছে ও যেদিন জন্মালো! যাক। ছড়া লিখেছি এই মাত্র। ইমেইল আইডিটা পেলে এক্ষুণি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তাৎক্ষণিক লিখে ফেলা ছড়াটা সজলকে পাঠিয়ে দিলাম। সজল লিখলো—‘সুস্মিতের পক্ষ থেকে অনেক ভালোবাসা। খুবই সুন্দর হয়েছে আপনার উপহার।’
সজলের পুত্রকে নিয়ে লেখা ছড়াটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ সজলের মৃত্যু সংবাদ জানার পর সজলকে একটু দেখার জন্যে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। প্রথমেই একটা ইমেইল পাঠালাম ওর ইনবক্সে—‘এটা কী হলো সজল!!’ তারপর সজলের টাইমলাইনে গেলাম। সজলের ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক ছবিগুলো দেখতে দেখতে সকালটা আমার অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। বিশেষ করে ওর ছোট্ট ছেলেটাকে দেখে, কোনোদিন না দেখা আমার ছোট্ট বন্ধুটাকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবার আদর থেকে থেকে চিরদিনের জন্যে বঞ্চিত হলো সূর্য নামের দুই বছরেরও কম বয়েসী বাচ্চাটা! আহারে...
না দেখা সূর্যকে নিয়ে যে ছড়াটা আমি লিখে দিয়েছিলাম ওর বাবাকে, সেটা খুঁজে বের করলাম কম্পিটার থেকে। এই ছড়াটার কথা আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। যে কারণে এবছর বইমেলায় বেরুনো আমার কোনো বইতে এটা দেয়া হয়নি। পাঠক বন্ধুদের জন্যে ছড়াটা এখানে তুলে দিচ্ছি—
সূর্যকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা
এত্তোটুকুল ছোট্ট ছেলে নাম হলো তার সূর্য
তার হাতে এক জাদুর বাঁশি, ভালোবাসার তূর্য।
দুষ্টুমিতে ভীষণ পটু মুগ্ধ করা দৃষ্টি
হাস্য এবং চঞ্চলতায় অপূর্ব এক সৃষ্টি!
দুরন্ত সে, দস্যিপনায় কেউ নেই তার তূল্য
স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলল!
চাহিদা তার খুব বেশি নয়, অল্প খুবই অল্প
একটা চুমু, একটু আদর, বিরতিহীন গল্প।
সূর্য নামের এই ছেলেটি তাতেই খুশি বুঝলে?
ত্রিভুবনে আর পাবে না দ্বিতীয়টি, খুঁজলে!
অদ্বিতীয় সূর্যবাবুর একটি বছর পূর্তি
জন্মদিনের উৎসবে তাই আনন্দ আর ফূর্তি।
ফোঁকলা দাঁতে সূর্য হাসে, কী অপরূপ দৃশ্য!
সূর্য তোমার আলোয় আলোয় ভরিয়ে তোলো বিশ্ব।
০১আগস্ট২০১২
সজল, এই ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় এক সন্ধ্যায় তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে। আমাকে পেয়ে খুবই উচ্ছ্বল ছিলে তুমি। তোমার পুত্রের কথা বলেছিলে অনেক উচ্ছ্বাস নিয়ে। আমার কন্যা নদীও একদিন ছোট্টটি ছিলো। আমিও বাবা হয়েছি তরুণ বয়েসে। তরুণ বাবা-মায়ের আনন্দটা আমার জানা। নব্যপিতা হিশেবে তোমার কাঁধ আর পিঠ চাপড়ে আমি যখন অভিনন্দন জানাচ্ছিলাম তোমাকে—স্মার্ট ভঙ্গিতে খানিকটা লজ্জামিশ্রিত লাজুক হাসিতে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিলে তুমি!
সজল, মৃত্যুর আগে তুমি আমাদের সবার উচ্চতাকে ছাপিয়ে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায়।
আজ অশ্রুসজল চোখে পৃথিবীর পাদদেশ থেকে শেষ অভিবাদন জানাতে এভারেস্টের উচ্চতায় থাকা তোমাকে স্যালুট করতে গিয়ে টের পেলাম—তুমি অনেক দূরে...
বিদায় বন্ধু, বিদায়।
কানাডা ২১ মে ২০১৩
মন্তব্য
facebook
এমন মানুষগুলো এভাবে চলে যায় কেন অসময়ে!
ভিন্ন মাত্রার কাজগুলোই বাঁচিয়ে রাখবে সজল খালেদকে
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আমাদের যাকে যাকে প্রয়োজন তারাই চলে যায়, দৌড়ে চলে যায়।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ভাল মানুষগুলোরই কেবল চলে যাবার এত তাড়া---
সর্বোচ্চ শৃঙ্গজয়ী বীরকে স্যালুট।
বিদায় হে বীর, বিদায়। আবার দেখা হবে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
মনটা খারাপ করে দিলেন।
কেন্দ্রে সজল আমার ব্যাচের ছিলো।
মনটা খুব খারাপ। ছোট বাচ্চাটার জন্য বেশি খারাপ লাগছে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মনটা খারাপ হয়ে গেল। কামলা খাটতে ছোট্ট বাচ্চাটাকে ছেড়ে আছি কয়েকদিন হলো
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
নতুন মন্তব্য করুন