২০১০ সালের সূচনাতে, চট্টগ্রাম গেলাম সায়ীদ স্যারের সঙ্গে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। ভ্রমণের আরেক সঙ্গী অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ(আমাদের পাড়াতো বোনকে বিয়ে করার সুবাদে আমি যার শ্যালক হই!)।
আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম রিটার্ণ ট্রেনজার্নির পুরোটাই ছিলো আনন্দে ঠাঁসা। চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সংগঠক অধ্যাপক আলেক্স আলীম। তিনিও ছড়াকার বলে আমার সঙ্গে তাঁর প্রাচীন সমঝোতা। তাঁর স্ত্রী সুমীকে চিনতাম আলাদা পরিচয়ে। সুমী খান আমাদের দেশের সাহসী এক সাংবাদিক। একাত্তরের ঘাতক রাজাকারদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসী রিপোর্ট লিখে খ্যাতি অর্জন করেছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শেষে বিকেলে খানিকটা রেস্ট নিয়ে স্যার আমি আর সবুজ আমরা তিনজন স্থানীয় ক’জন উদ্যমী তরুণকে নিয়ে মাইক্রোবাস বোঝাই হয়ে পতেঙ্গা বিচে গেলাম। গাড়িতে সবুজ ভাই আর আমি প্রাণপণে গান গাইছিলাম। সঙ্গী তরুণেরা গাড়ির কোণাকাঞ্চিতে তাল ঠুকে ঠুকে আমাদের উদ্দীপ্ত করছিলো। আমার সলো পরিবেশনা ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে’ গানটি শুনে স্যার তো অবাক! বিশাল প্রবন্ধ আকারের গানটা আমাকে আগাগোড়া মুখস্থ গাইতে দেখে (শুনে) স্যার খুবই মজা পেলেন। আমার এই প্রতিভাটা স্যারের জানা ছিলো না তেমন। (কিছু কিছু লাইনে সবুজও কণ্ঠ মিলিয়েছে আমার সঙ্গে।) সন্ধ্যায় পতেঙ্গায় পাথরের ওপর বসে থেকে বিশাল বিশাল ঢেউ দেখতে দেখতে জলের ঝাপটা খেলাম অনেকক্ষণ ধরে। তারপর রাতের খাবার খেতে চলে গেলাম সুমীদের বাড়িতে। সুমীর মা নূরজাহান খান একজন অসাধারণ মহিলা। মানবাধিকার নেত্রী ও সংগঠক তিনি। বিশেষ করে নির্যাতিত মেয়েদের পাশে দাঁড়ান তিনি বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে। টেবিল বোঝাই নানান রকম সুস্বাদু আইটেম। রান্নাবান্নায় সুমীর মায়ের সহযোগী হাস্যোজ্জ্বল এক কিশোরী কিচেন থেকে খাবার-দাবার আনা নেয়া করছিলো। চোখাচোখি হলে দু’একবার হাসি বিনিময় হলো আমার সঙ্গেও। একটু পরেই জানলাম হাস্যোজ্জ্বল সেই কিশোরী কথা বলতে পারে না। আহারে! এতো মায়া লাগলো মেয়েটার জন্যে! এতো খারাপ লাগলো মেয়েটার জন্যে! তখনো বুঝিনি খারাপ লাগার সবেতো শুরু। একটু পরেই সুমীর কাছে শুনলাম—কথা বলতে না পারা বোবা এই মেয়েটিকে কয়েকজন কুলাঙ্গার ধনীর দুলাল ধর্ষণ করেছিলো। ধর্ষিতা মেয়েটিকে উদ্ধার করে পুলিশ ওকে থানায় নিয়ে এসেছিলো। বোবা মেয়েটিকে কোন ঠিকানায় কার আশ্রয়ে দেবে পুলিশ? অতঃপর পুলিশ ফোন করেছে সুমীর মা নূরজাহান খানকে—খালাম্মা মেয়েটার একটা গতি করেন। ওর একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার। নূরজাহান খান মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেই থেকে মেয়েটি এই বাড়িরই বাসিন্দা। কাহিনি শুনে এতো মন খারাপ হলো! মেয়েটির দিকে আর তাকাতে পারছিলাম না। সুমীর মাকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। তিনি শুধু হাসেন।
খাওয়া-দাওয়া সেরে কী মনে করে আশপাশের বাড়িগুলো একঝলক দেখে নিতে সুমীদের সরু একচিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার তারে কিছু কাপড় ঝুলছিলো। দেখলাম বারান্দার শেষ কর্ণারে জীর্ণশীর্ণ এক বৃদ্ধা দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে আছেন জবুথবু ভঙ্গিতে। চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে বয়েসের ছাপ আঁকা তাঁর। জিজ্ঞেস করলাম—কেমন আছেন? আমার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে নির্লিপ্ত তিনি তাকিয়ে রইলেন দেয়ালেরই দিকে। নিঃশ্বাস নিচ্ছেন বড় করে। যতোবার আমি জিজ্ঞেস করি—কেমন আছেন ততোবারই সেই বৃদ্ধার দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয় যেনো বা মহাসিন্ধুর ওপারের দিকে। সহস্র বছরের ক্লান্তি যেনো বা বৃদ্ধার ছানিপড়া চোখে। সবুজ ভাইকে ইশারায় বারান্দায় ডেকে এনে দেখালাম বিস্ময়কর সেই বৃদ্ধাকে। বিশেষ করে বৃদ্ধার দৃষ্টির সীমানা যে যোজন যোজন দূরের কোনো একখানে সেটা সবুজকে বললাম। বৃদ্ধাকে কিছুক্ষণ দেখে আমার কথায় সায় দিলেন সবুজ। অতঃপর সবুজও বারকয় জিজ্ঞেস করলেন—আপনি কেমন আছেন? কিন্তু বৃদ্ধা জবাব না দিয়ে আশ্চর্য রকমের নির্লিপ্ত দৃষ্টির দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়ে দেন তাঁর অপেক্ষার গল্প। সবুজকে আমি সেই গল্পটার সূত্র ধরিয়ে দিই—তারাশঙ্করের কবি-র সেই হৃদয় মোচড় দেয়া সংলাপ ‘জীবন এতো ছোট ক্যানে?’ এই বৃদ্ধার কাছে বিপরীত উচ্চারণে পরিহাস করছে—জীবন এতো বড় ক্যানে? জীবনের ভার বয়ে বয়ে ক্লান্ত তিনি। আর বইতে পারছেন না। আর বইতে চাইছেনও না। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি তাঁকে রেহাই দিতে রাজি নয়। একটুখানি মৃত্যুর জন্যে এই বৃদ্ধার অপেক্ষার প্রহর কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। কিন্তু মৃত্যু নামের সোনার হরিণ আসে না। আমার ব্যাখ্যাটা পছন্দ হয় সবুজের। তিনি বললেন—আহারে!
আমরা দু’জন বারান্দা থেকে ঘরে এলাম। আশ্চর্য সেই বৃদ্ধার অদ্ভুত দৃষ্টির কথা বলতেই সুমী জানালো—এই বৃদ্ধার নাম ঊষা রাণী। কিন্তু সুমীরা তাঁকে ডাকে হালিমার মা বুয়া। সুমীর মায়ের আশ্রয়ে আছেন ১৯৭৬ সাল থেকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুরতার শিকার তিনি। মহিলার এক কন্যা মুসলমান এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাবার কারণে ধনাঢ্য হিন্দুজোতদারদের রায়-এ জাতিচ্যুত হয়েছিলেন ঊষা রাণী। পালাতে হয়েছিলো তাঁকে। একপর্যায়ে নাম আর ধর্ম পালটে উষা রাণী থেকে ফাতেমা হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার ছোবলে তাঁর সামান্য ভিটেমাটি থেকেও উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিলেন। মুসলমান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া মেয়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি তাঁর। তারপর জীবনের তাড়া খেয়ে খড়কূটোর মতো ভাসতে ভাসতে এক পর্যায়ে সুমীর মায়ের কাছে এসে আশ্রয় পেলেন, সান্তনা পেলেন, ভালোবাসা পেলেন আর পেলেন মানুষের মর্যাদা। আশ্রিতা হলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন ওই সংসারেরই অনিবার্য একজন সদস্য। সুমীরা কয়েকটি ভাইবোন এই ঊষা রাণীর হাতেই বড় হয়েছেন বলতে গেলে। ধীরে ধীরে সুমীরা বড় হয়েছে আর মহিলা বৃদ্ধ হয়েছেন। শরীর নুব্জ হয়ে পড়েছে তাঁর। । এখন আর সংসারের কাজ করতে পারেন না। কিন্তু তাতে কী! অকেজো বৃদ্ধা বলে সুমীর মা তাঁকে তাড়িয়ে দেননি। তিনি এই বাড়িতেই আছেন পরিবারের একজন সদস্যের মতোন।
সুমীর কাছে সেই রাতে ওই বৃদ্ধার কাহিনি শুনে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলাম ভেতরে ভেতরে। গত কয়েক বছরে কতোবার যে মনে করেছি তাঁকে। কানাডায় এসেও আমি তাঁর সেই মৃত্যুপ্রতীক্ষীতদৃষ্টিকে কিছুতেই ভুলতে পারিনি।
কিছুক্ষণ আগে আলেক্স আলীমের ফেসবুক স্ট্যাটাসে সেই বৃদ্ধার ছবি দেখে চমকে উঠেছি—অবশেষে নব্বুই বছর বয়সে উষা রাণী তাঁর প্রার্থিত সেই সোনার হরিণটির সাক্ষাৎ পেয়েছেন, আজ সকালে।
ঊষা রাণী ওরফে ফাতেমা ওরফে হালিমার মা বুয়া—আমাদের সবাইকে ‘দীর্ঘ একটি দুঃখের গল্প’ শোনাতেই জন্মেছিলেন আপনি। আপনার যাত্রা শুভ হোক।
০৪ জুন ২০১৩
মন্তব্য
আপনার লেখা দেখলেই আমি লাফিয়ে লাফিয়ে ঢুঁকে পড়ি, এই প্রথম মনটা খারাপ করে দিলেন
facebook
নুরজাহান খানকে
ইমোর বদলে এইটা কি আসলো???
ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো লেখাটা পড়ে। জীবনে যেখানে সবখানে যৌবনের জয়গান সেখানে প্রৌড়দের কি ভাবে দিন কাটে?
ডিম পোচ
প্রৌঢ়দেরও দিন কাটে, কেটে যায়।
বুকের গভীরে কোথায় যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো! গুরুদাসী মন্ডলের কাহিনী জানতে পেরেছিলাম বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সের আলো- অন্ধকারের ছায়ায় বসে, শুকনো চোখে সেখান থেকে বের হতে পারিনি। আজ পর্যন্ত যতবার তাঁর কথা মনে পরে প্রার্থনা করি - সৃষ্টিকর্তা তাঁর মত এই মানুষগুলোর এই জীবন অনেক কঠিন করে দিলেন, পরের জীবনটা অনেক অনেক সুন্দর হোক।
আজ আরেকবার চোখ ভিজলো এই লেখাটা পড়ে। ঊষা রাণী, গুরুদাসী মণ্ডলদের মত মানুষরা অনেক বড় মাপের মানুষ, মানব জীবনের উর্ধ্বে গিয়ে তাদের ঠাই খুব সুন্দর একটা পৃথিবীতে হোক!
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
কান্না পাওয়ার মত কোন লেখাতো নয় এটি! তবে?!
...................................................
ঊষা রাণী ----- আপনার যাত্রা শুভ হোক ............
স্যাম কি ভেবে বলেছেন জানি না, কিন্তু ওনার সিদ্ধান্তের সাথে আমি একমত যে এই সুন্দর লেখাটি আদৌ কোন কান্না পাওয়ার মত লেখা নয়। আমার কাছে এ লেখা কয়েকজন মহান মানুষের কাহিনী, অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বালানোর প্রেরণা পাওয়ার কাহিনী। বয়স হয়ে গেলে মৃত্যুর প্রতীক্ষার হাত এড়াতে না পাড়াটা অস্বাভাবিক নয়। যেটা অস্বাভাবিক, অসাধারণ সেটা হচ্ছে সেই সময় তুলনায় কম বয়সীদের পাশে পাওয়া। সেই কারণেই "সুমীর মা নূরজাহান খান একজন অসাধারণ মহিলা।" এবং তাঁর পরিবার-পরিজন - তাঁরাও এই অসাধারণত্বের অংশীদার!
আমার তো মনে হয় লেখক-ও আমাদের এই অনুভূতির-ই শরীক করতে চেয়েছেন।
স্যাম-এর মন্তব্যের উল্লেখ কোরে একটু আগে করা আমার মন্তব্যের লেখক-দায় নিতে ভুলে গেছিলাম। এখন নিলাম
-
একলহমা
জীবনের নিষ্ঠুর সত্য!
আব্দুল্লাহ এ.এম.
এইসব মানুষ আছেন বলেই এখনো সূর্য ওঠে! সুমীর মায়ের জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে শুভকামনা। উনার দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকুক।
নুরজাহান খানকে হাজার সালাম
পুরো লেখাটা জুড়েই ঊষা রাণীর শূন্য দৃষ্টি আর কিশোরীটির বোবা কান্না ! নূরজাহান খানকে বিনম্র শ্রদ্ধা ।
ঊষা রাণীর সেই সহস্র বছরের ক্লান্তিভরা চোখ যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। উনার চলে যাওয়ার নিউজটিতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল, কিন্তু উনি তো বিদায় নিতেই চাইছিলেন, তবু কস্ট হল সম্ভবত এই কারণে যে, আমরা এই বৃদ্ধা মাকে সুখের বিদায় জানাতে পারিনি, সন্তানকে কাছে পাননি বা সমাজের দাহ তাকে মহাসিন্ধুর ওপারে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য করেছে।
রিটন ভাই, আপনার অসাধারণ লেখনি গুনে এই অচেনা-অজানা বৃদ্ধা এভাবেই আপন হয়ে উঠলেন।
নতুন মন্তব্য করুন