আজ অনেকদিন পর মায়ের বাসায় নিজের পুরনো বই-খাতাগুলো নিয়ে বসলো নূপুর। টেনে নিলো বেশ ক'বছরের অবহেলায় ধুলো জমা গাদাখানেক নোটবুক। যেন খুঁজে পেয়েছে এমন একটা ভাব করে তুলে নিলো সেখান থেকে একটা, দ্রুত হাতে উল্টাতে থাকলো ওটার পাতাগুলো, শেষে এক জায়গায় এসে থেমে গেলো সে, চোখ আটকে থাকলো ছোট্ট একটা লাইনে -- 'আমার নাম সাজেদা'। কেউ জানলো না, কি তীব্র ঝড় বয়ে যেতে লাগলো তার ভেতর দিয়ে! স্মৃতি-ঝড়। সাইমুম, সাইক্লোনের চেয়েও খারাপ এ ঝড়। যা সরাসরি আঘাত করে মানুষের কালে, তলিয়ে দেয় বর্তমান, মুহূর্তে নিয়ে যায় ফেলে আসা অতীতে -
ছাদের নিচে ছোট্ট এক রুমের একটা বাসা। নিজের, একান্ত নিজের একটা সংসার। আপন নীড়। জীবনে প্রথমবারের মত বাবা-মায়ের ছায়া শেকল থেকে বেরিয়ে মাথার উপর খোলা আকাশটা পেয়ে সে দিশেহারা। মুক্তি ও পূর্ণতার ডানা মেলে ধরেছে নির্দ্বিধায়। সারাদিন পুতুলখেলায় মেতে থাকার মতোই পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে নিজের ঘরদোর। হাতে গোনা ক'টা আসবাব, তাও আবার এপাশ-অপাশ করে অহেতুক, বারবার। দিন-দুনিয়ার হিসেব তখন তার কাছে অর্থহীন, মাথাব্যথাও ছিলো না রাজনীতি, দেশ বা অন্য কোনো বিষয়ে, যা কিছু ছিলো তার ছোট্ট ঘরটার বাইরে। সে সময় বিরোধীদলের ডাকা একের পর এক হরতালগুলো ছিলো বরং তার কাছে মেঘ না চাইতে জলের মতই অতি-আনন্দের! কারণ হরতালে সারাদিন কাছে পাবে প্রিয় মানুষটিকে। আর ঠিক রাতে শুতে যাওয়ার আগে নিয়ম মেনে কারেন্ট চলে যাওয়াও প্রচন্ড গরমে যোগ করত আলাদা রোমাঞ্চের। রোজ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার সেরে, তারা অপেক্ষা করতে থাকত এবং কারেন্ট যাওয়া মাত্রই গীটারটা নিয়ে সোজা ছাদে। পল্লব ফেরার পথে ছাদের চাবিটা দারোয়ানের কাছে থেকে নিয়ে আসতো, আবার কখনো অন্ধকারেই নিচে গিয়ে চাবিটা আনতে হতো।
ছাদে তাদের প্রিয় একটা কোণ ছিলো, সে দিকটায় তখনো কোনো বাড়ী উঠে নাই, একপাশে রাস্তা, রাস্তার ওপাশেও তখন ফাঁকা প্লট, তারপর বড় মেইন রাস্তা। জ্যোৎস্না রাতে মনে হতো পৃথিবী থেকে তারা সম্পূর্ণ বিছিন্ন দু'জন মানব-মানবী। আপন মনে গীটার বাজাতো পল্লব আর নূপুর বেড়ালের মত গুটিশুটি মেরে ওর হাতের ফাঁকা-ফুকো দিয়ে ঠিকই কোলের মধ্যে আরামের জায়গা করে নিতো। বেড়ালের মতই চোখ বন্ধ রেখে মিউ মিউ করে আব্দার করে যেতো, একটার পর একটা গানের। কখনো - কাঞ্চন জঙ্ঘা, বেলা বোস, আমার চক্ষু নাই... আবার কখনো - ববি রায়ের কথায় চলে যেও না ছেড়ে আমায়...
একদিনের কথা মনে পড়লে এখনো লজ্জা পায় নূপুর, যেদিন বাড়িওয়ালী আন্টি এসে বলল - "তোমরা নাকি টোনা-টুনি রোজ ছাদে উঠে টুংটাং করো?" সে ভেবেছিলো কমপ্লেইন করতে এসেছে বুঝি, তাই কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। বাড়িওয়ালী তাকে অবাক করে দিয়ে ছাদের আরেকটা চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলল - "এটা রাখো, যখন খুশি ছাদে গিয়ে টুংটাং করবা!"
অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই পল্লব হাত ভরে নিয়ে আসতো দোলনচাঁপা, নূপুরের প্রিয় ফুল। খুব যত্ন করে জারে পানি ঢেলে রেখে দিতো সে, পুরো বাড়ি মন পাগল করা বেহেশতী গন্ধে ভরে যেত! এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো স্বপ্ন আর কবিতার মত! এক সময় নূপুর আবিষ্কার করলো তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে নতুন আরেক স্পন্দন! প্রথমে ভয় তারপর অদ্ভুত মোহাচ্ছন্ন ভালো লাগায় ভরে উঠলো তার মন! শুধু বাবা, মা-কে জানাবে কিভাবে এ চিন্তায় তারা দু'জনেই লজ্জায় লাল! কারণ মা বলেছিলো লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে যেন উল্টা-পাল্টা কিছু না হয়। আর সেই 'উল্টা-পাল্টা কিছু' টা যে এত তাড়াতাড়ি বাধিয়ে বসেছে, তা এখন বলে কোন মুখে। তাই নিঃশব্দে তারা দু'জন দু'জনকে অভিনন্দন জানালো। নূপুর কল্পনায় বুঁদ হয়ে মা হবার অনুভূতিটাকে নিজের মধ্যে তরিয়ে তরিয়ে অনুভব করতে লাগলো।
বাড়িওয়ালী আন্টির স্বভাব ছিলো দু'দিন পর পর নূপুরের খোঁজখবর নেয়া। সে তার অভিজ্ঞ চোখে মুহূর্তে কেমন করে জানি ধরে ফেলেছিলো নূপুরের অদৃশ্য পরিবর্তন। কোত্থেকে এক কাজের মেয়ে নিয়ে এসে বলল - "তোমাকে সারাদিন কাজ করতে দেখি। এসময়ে ভারী কাজ করা ঠিক না। মেয়েটাকে রাখো। নতুন ঢাকায় আসছে, এখানকার হাওয়া-বাতাস এখনো গায়ে লাগে নাই।"
নূপুর অবাক হয়ে বললো - "সেকি! ও ঢাকায় আসলো কিভাবে?"
"এক ব্যাটা ওকে গ্রাম থেকে বিয়ে করে আনছিলো, কাছেই এক বস্তিতে ঘর ভাড়া করে সংসারও করছে দুই মাস, তারপর সে লাপাত্তা। বেচারীর এখন পেট শুকায়ে মরার দশা! গ্রামে ফেরত নেয়ার মতোও কেউ নাই, সৎ মায়ের ঘরে দাসি বান্দি করে বড় হইছে। বাপ মরার পর খোঁজখবর না নিয়েই, কোনোরকমে আপদ বিদায় করছে সেই মায়।" - এ যেন রোজকার খুব স্বভাবিক গল্প, এমন একটা ভাব করে বলল বাড়িওয়ালী।
এবার রীতিমত ধাক্কা খায় নূপুর। দুই মাসের কিছু বেশি সময় সেও স্বামীর সাথে আছে। মফঃস্বল থেকে ঢাকায়। পল্লবের সাথে অবশ্যই ওই মেয়েটির স্বামীর তফাৎ আছে, কিন্তু কোথায় জানি নিজের সাথেই ওর মিল খুঁজতে থাকে। তাকায় মেয়টার দিকে -
নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। আর নিত্য ঘাটতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা শরীরটাতেও স্পষ্ট দৈন্যতার ছাপ। গায়ে বেঢোপ আলখাল্লা সাইজের সালওয়ার-কামিজ। দেখে প্রায় হেসে ফেলেছিলো সে। তার উপর মস্ত বড় একটা ওড়না দিয়ে কপাল থেকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। শুধু ক্লান্ত চোখ দু'টো দিয়ে ঠুকরে বেরিয়ে আসা অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা! কোনো আবরণ ঢাকতে পারেনি তা। বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না সেখানে নূপুর, বুকটা কেমন হা হা করে উঠলো!
"কি নাম রে তোর?"- জানতে চাইলো সে।
"সাজেদা।"- জবাব দিলো মেয়েটা।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সাজেদা রোজ আসা শুরু করলো। সারাদিন থাকে। যতক্ষণ না তাকে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়, সে চুপচাপ রান্নাঘর বা বারান্দার এক কোণে বসে থাকে।
নূপুর একদিন জিজ্ঞেস করেছিলো - "এতো দেরি করে যাস কেন?"
"একা ঘরে ঢুকতে ডর করে।" - বলেছিলো সাজেদা।
"ভয় কেনো?" নূপুর আবার জিজ্ঞেস করে।
"পাশের ঘরে হের দুরসম্পর্কের এক বোন থাকে, গার্মেন্টসে কাম করে। আর তার স্বামী সারাদিন লাফাঙ্গা পোলাগো লগে গাঞ্জা টানে, বৌ না থাকলে আমার ঘরে উঁকি দেয়।"
সাজেদার ভয়ের কারণ বুঝতে পেরে গা কাঁটা দিয়ে উঠে নূপুরের! পায়ের নিচে মাটি শক্ত করে, গলায় জোর এনে বলেছিলো - "তুই এখানেই থাক!"
কিন্তু সাজেদা বলেছিলো - "হে যদি আসে!"
অদ্ভুত ধোঁয়াশায় যুঝছিলো সাজেদার মন, স্বামী ফিরে আসবে এ বিশ্বাস তখনো তাকে শক্তি দিচ্ছিলো, চারপাশের প্রতিকূলতাগুলোর বিরুদ্ধে টিকে থাকতে। নূপুরেরও তখন জীবনের নির্মম বাস্তবতার সাথে পরিচয় ছিলো না। তার ভেতরের নব্য পরিণতা নারীও কেন জানি সাজেদার বিশ্বাসকেই সমর্থন করতে চাইতো। মনে মনে ভাবতো, হয়তো সত্যি ফিরবে সাজেদার স্বামী! তাই রোজ ওর মুখে তাকাতো একটু আলো দেখবে বলে, কখনো উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেও বসতো - "কিরে ফিরেছে সে?"
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
নূপুর আর পল্লবের গাদা গাদা বইয়ের পাহাড় জমে যাচ্ছিলো। মাঝে সাঝে সেগুলোর ধুলো ঝাড়পোঁছ করে নিজেরটা আর পল্লবেরটা আলাদা করে গোছানোর চেষ্টা করতো সে। একদিন দেখে সাজেদা খুব আগ্রহের সাথে জ্ঞানকোষের পাতা উল্টাচ্ছে, কৌতূহল থেকে জানতে চাইলো - "তুই পড়তে পারিস?"
"পারি।"
"একটু পড়ে শোনা তো?"
সাজেদা পড়া শুরু করলো, ঝর ঝরে রিডিং, কোথাও আটকালো না, উচ্চারণে আঞ্চলিক টান ছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিলো না।
হাতের কাছেই নূপুরের ক্লাসের একটা নোটবুক ছিলো এগিয়ে দিয়ে বললো - "লিখ তো?"
সাজেদা গোটা গোটা অক্ষরে স্পষ্ট করে লিখলো - 'আমার নাম সাজেদা'।
"কেলাশ এইট পড়ছিলাম, হের পর বিয়া হইলো!" আপন মনেই যেন নিজেকে শোনালো সে।
অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নূপুরের ভেতর থেকে!
এর মাঝে একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। রান্না ঘরে ওরা দু'জনে কাজ করছিলো, সাজেদা একটু দুরে সিঙ্কে থালাবাসন ধুচ্ছিলো। হঠাৎ সে শূন্যে হাত তুলে কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো, তারপর ধড়াম করে পড়ে গেলো। নূপুর কি করবে বুঝে উঠতে পারেনি, শুধু এটুকু বুঝলো এটাকে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া বলে। হাতের কাছেই পানি ছিলো, চোখে মুখে দেয়া শুরু করলো। একটু পরেই চোখ মেললো সাজেদা। তারপর ওকে নিয়ে গেলো পাশের এক হসপিটালে। সাজেদা যেতে চাইছিলো না, ওর নাকি এরকম মাথা 'চক' প্রায়ই লাগে, আবার নিজেই ঠিক হয়ে যায়। রিক্সায় নূপুরের ভয় হচ্ছিলো সাজেদা আবার পড়ে যায় কিনা, তাই ধরে রেখেছিলো তাকে শক্ত করে। হসপিটাল গেটে টিকেট করার সময় নূপুরের হাত কাঁপছিল।
ডাক্তারও প্রথমে নূপুরকেই জিজ্ঞেস করেছিলো - "কি সমস্যা?"
নূপুর সাজেদাকে দেখিয়ে বলেছিলো - "ও মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো।"
ডাক্তার সাজেদাকে পরীক্ষা করে বলল - "তেমন কিছু না, দুর্বলতা থেকেই ফেইন্ট হয়েছে। রেস্ট প্রয়োজন।"
সাজেদা যে প্রেগন্যান্ট সেটা ওখানেই ডাক্তারের কাছ থেকে জানলো নূপুর।
দু'জন নার্স ফেরার পথে তাদের ধরলো কিছু করাতে চাইলে যাতে দেরি না করে, ওদের পরিচিত এক জায়গায় এসব কম খরচে করানো হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা মনে মনে সূত্র মিলিয়ে নিয়েছে, সাজেদার গর্ভের সন্তান অবৈধ, সে সন্তানের পিতা হয়তো পাশের মেয়েটার অর্থাৎ নূপুরের স্বামী। নূপুর চোখ-কান বুঝে সেই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে কোনরকমে বেরিয়ে আসে।
তার ভেতরটা সমানে হাহাকার করে যাচ্ছিলো, এই মেয়েটা এতবড় হতভাগী যে জীবনে মা হবার মতো আনন্দটুকুও প্রাণভরে উপভোগ করার উপায় নাই। অন্যদিকে সাজেদা তখনো নির্বিকার!
নূপুরের সাধের ঘর ঝাড়াপোঁছা বন্ধ হয়ে গেলো। সে তার পছন্দের মজার কিছু বই সাজেদা কে দিয়ে পড়াতে শুরু করলো - টুকুনজিল, হাত কাটা রবিন, টুকি ঝাঁ, পাগলা দাশু, প্রফেসর শঙ্কু... একেক দিন একেকটা, বিশেষ করে বেছে বেছে হাসির অংশগুলো বার বার পড়তে বলত। সাজেদা জোরে জোরে পড়তো, আর নূপুর পেট চেপে হো হো করে হাসতো। তাকে হাসতে দেখে সাজেদাও হাসতো। আবার কখনো খুব সিরিয়াস কোনো নাটকের কষ্টের মুহূর্ত দেখে দু'জনেরই চোখ ভেসে যেতো।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এটা সত্য যে পল্লব বাসায় থাকলে সাজেদার উপস্থিতি তাদের দু'জনের জন্যেই খুব অস্বস্তিকর ছিলো। তখন তাদের ছোট ঘরটা কেমন যেন আরো ছোট হয়ে যেতো। পল্লব প্রায়ই নূপুরকে বলতো সাজেদাকে বলো ছুটির দিনগুলোতে যেন না আসে। কিন্তু সে পারতো না। সে তো জানে সাজেদা কেন আসে, এক দণ্ড নির্ভরতার আশ্রয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে।
৭২ ঘন্টার হরতাল। পল্লব বাসায়। সেদিন স্বামীর মন রক্ষার্থে নূপুরকে খুব বেশি স্বার্থপর হতে হয়েছিলো, সাজেদাকে বলেছিলো - তিন দিন তোর ভাই বাসায় থাকবে, এ ক'দিন তুই আসিস না। সাজেদা কিছু বলে নাই চুপচাপ চলে গেলো। কিন্তু সে ক'দিন অজানা আশংকা আর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকল নূপুর।
প্রথম বারের মত টানা পাঁচদিন আসে নাই সাজেদা। মনে মনে অস্থির হয়ে নূপুর যখন ভাবছিলো ওর খোঁজে যাবে কিনা, তখন সে এলো। অস্থিরতা রাগে পরিনত হয়, কিছুটা ঝাঁঝালো স্বরে জানতে চায় সে - "এ ক'দিন আসিস নাই যে?"
"হরতালে আমার স্বামী ফিরছে।" সাজেদা জবাব দেয়।
চোখে বিস্ময় ঠুকরে বের হলো নূপুরের।
সাজেদা আঁচলে লুকানো হাতটা তার সামনে মেলে ধরে বলে - "আমার জন্যে এটা আনছে।" ওর হাতে একটা শাড়ি। মেরুন রঙ, জরির পাড়।
নূপুরের চোখে জল এসে গেলো, গলায় মিথ্যে অভিমান টেনে বলল - "ও আচ্ছা, তাই স্বামীকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছিলি বুঝি!"
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
নূপুরের মা হবার খবরটা পেয়ে আর দশটা মায়ের মতোই নূপুরের মা-ও তাকে নিয়ে যথারীতি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন! মেয়ের পড়াশুনা, বাচ্চা, শরীর কোনটারই যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো বাকী সময়টা সে মায়ের বাড়িতেই থাকবে। মা নিজে এসে তাকে নিয়ে গেলো। নূপুর চলে গেলো, তার ছয় মাসের ছোট্ট সংসারটা রেখে।
এরপর পড়াশুনা ক্লাস ইত্যাদি নিয়ে সে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মায়ের বাড়িতে আদর-যত্ন, সেবা-শুশ্রুষায় কোনোটারই কোনো কমতি ছিলো না। পল্লবও সুযোগ পেলেই তাকে দেখে আসতো। তারপরেও তার মন পড়ে থাকতো নিজের ঘরে -- দোলনচাঁপার গন্ধ, রাতের খোলা আকাশের নিচে গীটারের সুর আর হরতালের অলস দুপুরগুলোতে।
ইয়া বড় একাটা পেট নিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে কোনোমতে পরীক্ষাগুলো দিলো সে। এর কিছুদিন পরেই নূপুরের কোল জুড়ে এলো রূপকথার ডালিমকুমারের মতোই লাল টুকটুকে এক রাজপুত্র। নিজের ঘরে ফিরে আসলো তারও অনেক পরে, ছেলে একটু শক্তপোক্ত হলে। নূপুর ফিরে আসার পর বাড়িওয়ালী আন্টি খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে নতুন মেহমান দেখতে এলো। তার কাছে নূপুর জানতে চাইলো সাজেদার কথা। বাড়িওয়ালী বললো- "তুমি যাওয়ার পর তো তাকে আর দেখি নাই।"
নূপুরের পীড়াপীড়িতে বস্তি থেকে সাজেদার যে খোঁজ নিয়ে এলো বাড়িওয়ালীর বুয়া, তা হলো - বস্তির ওই ঘরে সাজেদা এখন আর থাকে না, সেখানে অন্য কেউ বাস করছে। নূপুর ভাবলো হয়তো সাজেদার বর তাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। কিন্তু তারপরেও সাজেদার বাবুটা কেমন হলো এটা জানার জন্যে নূপুরের ভেতরটা খচ খচ করেই যাচ্ছিলো।
শেষে অনেক কষ্টে সাজেদার স্বামীর সেই দুরসম্পর্কের বোনের নাগাল পেল নূপুর। সেদিন নিজেই চলে গিয়েছিলো সে বস্তিতে। মহিলার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে, সাজেদার ব্যাপারে জানতে চাইলো? মহিলা নূপুরকে চিনলো। সে বলল - "আপনি যাওনের পর হেরে আমি গার্মেন্টস এ কাম দেই, সেখানে একদিন মাথা চক লাইগা পইড়া গেলো, বাচ্চাটাও গেলো। মেলা দিন খাড়া হইতে পারে নাই, যেখানে-সেখানে পইড়া পইড়া থাকত। তারপর কই যে গেলো, মেলাদিন আর তারে আমিও দেখি না!"
তার কথা শুনে নূপুর জমে গেলো, কোনমতে জানতে চাইলো - "আর ওর স্বামী?"
"হেতো সেই কবে ওরে ছাইড়া চইলা গেছে, খালি পরথম দুই মাস এক লগে বস্তিতে আছিলো, তারপর গেছে গ্যা। আপনে জানেন না?!" বিস্ময় ফুটে উঠে তার স্বরে।
নূপুরের মাথায় এবার রক্ত উঠে গেলো, রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বলল- "তুমি মিথ্যা বলছো কেনো?! সাজেদার স্বামী তো আবার ফিরে এসেছিলো। সাজেদাই আমাকে বলেছে!"
মহিলা এবার অবাক হয়ে বলল - "আমি সত্যই বলছি। সাজেদার স্বামী মরছে, না তারে পুলিশে ধরছে, না অন্য কোনো মাইয়ার লগে বিয়া বইছে আমি জানি না। কিন্তু সে ওই একবারই সাজেদারে ছাইড়া গেছে, আর ফিরে নাই! কেউ তারে আর বস্তিতে ফিরতে দেখে নাই! আপনি হগলরে জিগান!" উপস্থিত অনেকেই তার কথায় সায় দিলো।
প্রায় সাত বছর হয়ে গেলো। নোটবুকে সাজেদার লেখাটা এখনো ঐ একই রকম আছে, গোটা গোটা, স্পষ্ট। জ্বলজ্বলে এ ক'টা শব্দের ভেতর দিয়ে যেন ভেসে ওঠে -- সেই চোখ, সেই বিষণ্ণতা! বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না নূপুর এবারো, লেখাটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। কেন মিথ্যে বলছিলো সাজেদা, এ রহস্য আজো অজানা তার। সে শুধু জানে হারিয়ে গিয়েছে সাজেদা। সাজেদারা হারিয়ে যায়।
মন্তব্য
বেশ ভালো লেগেছে। গাথুনি সুন্দর। লিখতে থাকুন।
মন্তব্যে আপ্লুত হলাম!
- দোলনচাঁপা তো মৌসুমী ফুল, সারা বছর আনবে কী করে?
- বড় পেট নিয়ে কোন গর্ভবতী নারীই লজ্জিত হন না। অন্তত আমার জীবনে অমন কাউকে কখনো দেখিনি।
এটা যদি সাজেদার গল্প হয় তাহলে নূপুরের গল্পে সেটা চাপা পড়ে গেছে। এটা যদি নূপুরের গল্প হয় তাহলে সাজেদাকে শিরোনামে আনার বা তাকে অতো স্পেস দেবার দরকার ছিল না। ক্লাইমেক্স বিবেচনায় এটা সাজেদার গল্পই হবার কথা। আর এটাকে যদি দু'জনের গল্পই বলতে চান সেক্ষেত্রে নূপুরের জীবনেও ক্লাইমেক্স বা টার্নিং দরকার ছিল।
আপনার গল্পের ভাষা ভালো, ঝরঝরে। কাহিনীতে একটু মনোযোগ দিন - তাহলে আপনার কাছ থেকে আমরা আরও ভালো গল্প পাবো। চালিয়ে যান।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পুরো গল্পটাই বলতে গেলে নূপুরের জীবনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশের স্মৃতিমন্থনের কাহিনী। আরো নির্দিষ্ট করে বললে গল্পে উল্লেখিত টুকরো টুকরো ভালো লাগার স্মৃতিগুলো নূপুরের সংসারের জীবনে প্রথম সেই 'ছয় মাস' এর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। পল্লব নূপুরের জন্যে 'প্রায়ই' হাত ভরে দোলনচাঁপা আনতো! ছয় মাসের 'প্রায়ই' ক'টা দিন না হয় দোলনচাঁপার মৌসুম চলুক! নিজে দোলনচাঁপা ভালু পাই কিনা!
অবশ্যই কোনো মেয়ের জীবনে মা হওয়ার প্রতিটি ধাপই অত্যধিক মর্যাদাপূর্ণ। সবখানেই সে সময় মেয়েদের সম্মান ও সহানুভূতির দৃষ্টিতেই দেখা হয়, জানি। এই লজ্জা মোটেও খারাপ বা নিকৃষ্ট অর্থে বোঝাতে চাইনি, একই বয়সি বন্ধু অথবা শিক্ষকদের সামনে যখন কোনো মেয়ে (যার নিজের তখনো বয়স কম বা ছাত্রী) নিজের এই পরিবর্তিত রূপ নিয়ে যায়, ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভেতরের সরল অনুভূতিটির কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম, অবশ্যই আমাদের দেশের মেয়েদের প্রেক্ষিতে। তবে পরীক্ষায় একশ পেয়ে, ব্রাভো পেয়ে যে লজ্জা, আর জিরো পেয়ে, শেম পেয়ে যে লজ্জা এই দু'য়ের মধ্যে তফাৎ যদি পাঠক গুলায়ে ফেলে, তাহলে অবশ্যই লেখকের লেখায় গলদ আছে, স্বীকার করলাম।
গল্পটিতে ক্লাইমেক্স মূলত একটাই 'সাজেদার হারিয়ে যাওয়া'। আর সেটা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম নূপুরের মধ্যে চলা স্মৃতিঝড়ের ভেতর দিয়ে। উপলদ্ধিঃ গল্প লেখায় মেলা হ্যাপা! তারচেয়েও বড় হ্যাপা হলো নামকরণ। রাতে গল্প লিখে সারাদিন মাথা শর্ট সার্কিট হয়ে ছিলো, এখন ঘুম দিয়ে উঠলাম। তাই রিপ্লাই দিতে দেরি হলো।
আপনার মন্তব্য বরাবর উৎসাহিত করে!
দোলনচাঁপার ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। আসলে বাক্যটা একটু ঘুরিয়ে (অর্থাৎ, যখনই পাওয়া যেতো তখনই নিয়ে আসতো) লিখলেই আর সমস্যাটা হতো না। দোলনচাঁপা এমন একটা ফুল যেটা পছন্দ না করে উপায় নেই।
দুই প্রকার লজ্জার (শেম আর শাই!) পার্থক্য বুঝি। এখানেও বাক্যটা একটু ঘুরিয়ে লিখলে বা ভিন্ন প্রতিশব্দ লিখলে হতো। পল্লব-নূপুরের গল্প পড়তে পড়তে আমার নিজেদের কথা মনে পড়ছিল। আমরা আরও কম বয়সে বিয়ে করেছিলাম। দিশা আরও কম বয়সে মা হয়েছে। সে'সময় ওর মুখে যে আলো ফুটে উঠতো সেটা অপার্থিব। সেটা বোঝাতে লজ্জা/ব্রীড়া/শাই কোনটাই ঠিক হয় না।
ছাদে বসে লোডশেডিং-এর অন্ধকারে পল্লবের গিটার বাজানো আর নূপুরের গুটিশুটি মেরে পল্লবের কোলে জায়গা করে নেয়ার বর্ণনা পড়ে একই সাথে কষ্টে ও আনন্দে কেঁপে উঠেছি।
গল্প লিখলে মাথা শর্টসার্কিট হতে বাধ্য। তাই গল্প লেখার পর দুই/তিন দিনের ব্রেক নিন। এই সময় গল্পটা পড়বেন না বা এটা নিয়ে ভাববেন না। ব্রেকের পর গল্পটা আবার পড়ুন। তখন সংশোধনগুলো করা সহজ হয়ে যাবে। কিছু দরকারী চেঞ্জও করতে পারবেন। জুতসই নামকরণটাও তখন হয়ে যাবে। এরপর সেটা আমাদের পাতে তুলে দিন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দাদা, আপনার কমেন্টটা পড়ে আমি জাস্ট থম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ! আপনাকে কি লিখা উচিৎ ভেবে পাচ্ছি না। তবে এটুকু বলি সচলে আমার লেখায় এযাবৎ পাওয়া কমেন্টের মধ্যে এটা সেরা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকলো।
পল্লব-নূপুরের গল্প আপনাদের জীবনের সাথে এভাবে মিলে গেলো দেখে আমার নিজেরো অসম্ভব ভালো লাগছে! আমি মানুষটা এমনিতে কিছুটা ইমোশনাল ফুল টাইপের, একটা ইমোশনাল আব্দার করে বসি - সম্ভব হলে গল্পটা একবার দিশা বৌদিকে পড়াবেন, প্লিজ!
উপদেশগুলো মাথায় থাকবে!
নূপুরকে খুশি করতেই হয়ত মিথ্যে বলেছিল সাজেদা। কিংবা তার দীনতা ঢাকতে।
আপনার প্রথম লেখা এটা? পাণ্ডবদা'র সাথে একমত, আপনার গল্পের ভাষা ঝরঝরে!
প্রথম না তো! এর আগে গাদাখানেক লেখা দিয়ে তবেই হাচল হয়েছি, তবে হাচল হবার পর এইটাই প্রথম!
অনেক ধন্যবাদ!
লেখকের অন্যান্য লেখা'র তালিকায় শুধু এই লেখাটিই দেখা যাচ্ছে, তাই ওরকম বোকার মত প্রশ্ন করা।
আপনার বাকী লেখাগুলো তালিকাভুক্তির জন্য সচল বরাবরে একটা মেইল করে ব্যাপারটা জানালে খুব দ্রুতই এর
সুরাহা হয়ে যাবে। হাচল প্রাপ্তির অভিনন্দন থাকলো
আগের লেখার লিঙ্কগুলো দিয়ে তো মেইল করলাম, হাচল হবার সাথে সাথেই, কিন্তু এখনো লেখাগুলো প্রোফাইলে আসছে না কেন বুঝছি না!
অসংখ্য ধন্যবাদ আয়নামতি!
দোলনচাঁপা আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল।
গল্পের ভাষা ভাল লেগেছে।
আর এই অংশটা পড়তে গিয়ে মায়া লাগল খুব।
লেখা চলুক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
চিমটি, আমারো! তাই তো চান্স পেলেই লেখায় ঢুকায় দেই!
মন্তব্য পেয়ে খুশি হলাম তীথি! আপনার জন্যে দোলনচাঁপা ওয়ালা আমার প্রথম গল্পটা!
লেখা ভালো লেগেছে। দারুণ
অমি_বন্যা
অনেক ধন্যবাদ!
#প্রথমেই অভিনন্দন জানাই আপনাকে হাচল হওয়ার জন্য, শুভেচ্ছা সাথে অজস্র।
#দারুন লিখেছেন গল্পটি, দ্রূত সচল হয়ে উঠুন, এ প্রত্যাশা, ভাল থাকুন
আশরাফুল কবীর
অজস্র ধন্যবাদ!
ভালো থাকুন আপনিও
ভালো লাগলো !
ধন্যবাদ আরজু!
শেষে এসে আমারো মনে হলো, নূপুর, না সাজেদা?
তবে আপনার লেখা ভীষণ সাবলীল। পড়তে ভালো লাগে।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো শিমুল!
ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ আরাফাত ভাই!
চমৎকার লেখা
আসমা খান
ধন্যবাদ আসমা!
ভালইতো হচ্ছে। চলুক।
অনেক ধন্যবাদ!
নতুন মন্তব্য করুন