পুরো বছর ধরে দেশে যাওয়ার যে ছুটিটার জন্যে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে থাকি, সেই অতি মূল্যবান এক/দেড় মাসের অর্ধেকই আসলে কেটে যায় পথে। কখনো রাজশাহী তো কখনো দিনাজপুর, কখনো ঢাকা তো কখনো খুলনা। সব কূল রক্ষা করতে যেয়ে নিজের হাতে সময় বলতে গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। এরই মাঝে - এক দুপুরে পিচঢালা চওড়া হাইওয়েটা ধরে যাচ্ছিলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। কাছাকাছি পৌঁছে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি এক স্মৃতিস্তম্ভ, আবদার ধরলাম সেখানেই নেমে পড়ার। 'স্মৃতিস্তম্ভ' শব্দটাতে কেন জানি বরাবরই ধাক্কা খাই আমি - স্তম্ভিত স্মৃতি নাকি স্মৃতির স্তম্ভ! কি জানি কি বোধ কাজ করে ভেতরে, তবে শব্দটার নিজস্ব একটা ভার আছে, যেটাকে ঠিক অস্বীকার করা যায় না। এর আগেও একবার আসা হয়েছিলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু পাশের এই বধ্যভূমিটির ব্যাপারে জানা হয়নি কিছুই। বুকে রক্তবর্ণের এক বৃত্ত নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র-সফেদ মিনারগুলোর কারণেই হয়তো সেদিন চোখ থেমে গিয়েছিলো জায়গাটাতে। তখনো খুব বেশিদিন হয়নি ওটার বয়স, আশেপাশের আলগা মাটি বলে দিচ্ছে মাত্র ক'দিন আগেই হয়তো ঘোমটা খুলে গর্বের সাথে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে স্তম্ভটি। ভাড়া মিটিয়ে বিদায় দেয়া হলো ব্যাটারিচালিত 'টুকটুক' অটোরিক্সাটি। এগিয়ে গেলাম বিশাল স্থাপনাটার দিকে, জানলাম জায়গাটাকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ নয় মাস হানাদার বাহিনী কর্তৃক স্লটার হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো... হ্যাঁ, কসাইখানা কিন্তু মানুষ হত্যার। ভাবছিলাম বা আরো স্পষ্ট করে বললে চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো -- সাধারণ মানুষ, ছাত্র, খেটে খাওয়া দিনমুজুর, খুচরো ব্যবসায়ী, হিন্দু অথবা মুসলমান, কখনো বা মুক্তিযোদ্ধা... অজানা অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর আতংক মাখা করুণ মুখ! যাদের রোজ এখানে ধরে এনে নির্বিচারে গরু-ছাগলের মত জবাই দিয়ে পাশের ময়ূর নদীতে ফেলে দেয়া হতো!! পৃথিবীর তাবৎ অনাচার একদিন ঠিকই প্রকাশ পায়, এই নৃশংসতার কাহিনীও চাপা থাকেনি বেশিদিন, যুদ্ধের পর পাশের ছোট্ট নদীটিতে পাওয়া যায় হাজারে হাজারে নরকঙ্কাল, যাদের পরিচয় কোনদিন জানা যায়নি, জানা যায়নি তাদের নির্দিষ্ট কোন সংখ্যাও। কারণ কীটপতঙ্গের মতো বাঙ্গালীনিধনে মেতে থাকা পাকি কুত্তারা ও তাদের সেবায় নিয়োজিত এদেশেরই কিছু শুয়োর মিলে যখন পুরো বাংলাকেই মানুষ মারার কসাইখানায় পরিণত করেছিলো, তখন তারা এসব হত্যাকাণ্ড বা নিজের পাপের হিসেব কোথাও রাখবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
গল্লামারি স্মৃতিস্তভের কথা বলছি, বলছি এই রক্তস্নাতা ভূমিটির কথা। এখনো কান পাতলে যেখানে আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয় সেই হাজারো অজানা শহীদের গোঙ্গানি। ৭১-এ ঘটে যাওয়া বীভৎস সব গণহত্যাগুলোর মধ্যে খুলনার চুকনগরের কথা কিছুটা জানা থাকলেও, সত্যি বলতে গল্লামারির ইতিহাস আমার জানা ছিল না। পরবর্তিতে এই গল্লামারির তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েও খুব হতাশ হয়েছি, কোথাও নির্দিষ্টভাবে এর কোন উল্লেখ নেই দেখে।
৭১-এ এই খুলনার ক্ষতের মাত্রাটা ছিলো তুলনামূলক কিছুটা বেশি। তাজা দেড়লক্ষ প্রাণ বা কে জানে হয়ত তারও বেশি। ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার সংলগ্ন ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত এক চুকনগরে একদিনে ঘটে যাওয়া নারকীয় গণহত্যা শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও নৃশংস একটি গণহত্যা নয় বরং পৃথিবীর আর কোথাও একদিনে একসাথে এত ব্যাপক কোন হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। যেখানে মুহূর্তে মেরে ফেলা হয়েছিলো দশ হাজার বা তারও বেশি মানুষ। প্রাণের ভয়ে বর্ডার পার হতে জড় হওয়া নিরপরাধ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ! সারে সারে লাশের স্তুপ... মৃত মায়ের কোলে লেপ্টে থাকা মৃত সন্তান, মৃত স্বামীকে আকড়ে রাখা মৃত স্ত্রী, মৃত পিতার বুকে লুকানো মৃত কন্যা... এভাবেই মুহূর্তে প্রাণমুখর একটি অঞ্চল পরিণত করা হয়েছিলো মৃত নগরীতে। কয়েক ঘন্টা ব্যাপী আবিরাম গুলি বর্ষনে এতোগুলো মানুষের তুলনায় যখন ফুরিয়ে এসছিলো দানবগুলোর বুলেট তখন বেনোয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা শুরু করে বাকিদের... হতভাগাদের রক্তের ধারা মিশে হয়ত লাল হয়েছিলো ভদ্রা নদীর পানি পর্যন্ত... এতো লাশের যায়গা হয়ত হয়নি নদীটির বুকে, তাই এখনো এখানকার জমিতে লাঙ্গল দিলে উঠে আসে মানুষের হাড় কখনো বা স্বর্ণালংকার।
একটি দেশ, মানচিত্র ও পতাকার মূল্য এ মাটিকে যতখানি দিতে হয়েছে, পৃথিবীর আর কোথাও ততখানি দিতে হয়েছিলো কিনা আমার জানা নেই। এত বিশাল হারানোর ভার নিয়ে আজ আমি গর্বিত হতে পারি না, বরং আমার লজ্জা হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞগুলো আজ ৪১ বছর পরেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজে যথাযথ ঠাঁই পায় না দেখে। লজ্জা হয় প্রশাসনের টানাপোড়ন, অনীহা ও বিলম্বীকরণ দেখে। একদিনে সংঘটিত পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যার নাম হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে ভিয়েতনামের মাইলাই। মাইলাইয়ের গণহত্যায় মারা যায় প্রায় ১৫০০ মানুষ। আর চুকনগরে কম করেও হলে ২০ মে গণহত্যার শিকার হয়েছে ১০ সহস্রাধিক মানুষ। তবু পৃথিবীর কোন ইতিহাসে এই গণহত্যার স্থান মেলেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের 'স্বাধীনতার দলিল' নামে ১৫ খণ্ডে লিখিত যে দলিল রয়েছে, সেই ১৫ খণ্ডের কোথাও চুকনগরের গণহত্যার স্থান হয়নি (২০১০ সালের সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী)। কেন হয়নি? এই ব্যাপক নৃশংসতার ইতিহাস চেপে রেখে আদতে কার লাভ? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
লেখাটা আমার অন্যান্য অসমাপ্ত লেখার মতই এভাবে আধা-আধুরা, পরিত্যক্ত পড়ে থাকত ল্যাপটপটার নোটপ্যাডের কোনো এক ফোল্ডারে, স্নায়ুচাপ থেকে রক্ষাপেতে যেটাকে কৌশলে এড়িয়ে যেতাম বারবার। যদিনা গত কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় মনটা ভীষণভাবে আবার অস্থির হয়ে উঠত...
কত মানুষের মুখোশ যে খুলে গেল এরই মধ্যে! প্রতিটা মানুষের চেহারা যেমন ভিন্ন তেমন একজনের সাথে আরেকজনের চিন্তাজগতের তফাৎ থাকবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও কোথাও কোনো এক বিন্দুতে এসে কোনো এক সামগ্রিক চেতনা দাবী করে যে আমরা জাতি হিসেবে আসলেই মানুষ, সেইসব ককুরের বা শুয়োরের বীর্য থেকে আমাদের জন্ম নয় (আমি দুঃখিত, বারবার সাধারণ প্রাণীগুলোকে অপমান করছি)! আমি বোকা ছিলাম, ছিলাম মূর্খের মত আবেগি... ভেবেছিলাম আমার ছোট্ট দেশটার প্রতিটা মানুষ বুঝি আমার মতই সমান ঘৃণা আর লজ্জা নিয়ে এতদিন সহ্য করে আসছে ঐ গলার ঘ্যাগ হয়ে টিকে থাকা নিলজ্জ-বেহায়া নরপশুগুলোকে। ভেবেছিলাম এক রাজকারের ক্ষমাহীন অপরাধের বিচারে আজ সবাই একসাথে উল্লসিত, জ্বলে উঠেছে সেই পুরনো চেতনায়। কিন্তু আমি ধাক্কা খেলাম, থমকে গেলাম... মানুষের অকৃত্জ্ঞতা দেখে, বধিরতা দেখে। একটা স্বাধীন দেশ, মুক্ত আলো-বাতাস পেয়ে আমরা আজ ভুলে গেছি এই স্বাধীনতা অর্জনের গল্প। ভুলে গেছি নিজেদের দায়বদ্ধতা! আমার লজ্জার পাল্লাটা এবার নুয়ে পড়ে মাটি স্পর্শ করে।
আজ যারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালটি নিরপেক্ষ নয় তারাও গলায় জোর এনে বলার সাহস পায় না যে, আজন্মাগুলোর বিরুদ্ধে আনা ৭১-এর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তারপরেও অবাক লাগে যে মানুষগুলোকে আজ অব্দি কখনোই দেশের ছোট-বড় কোনো বিষয়ে তেমন উদ্বিগ্ন হতে দেখি নাই, তারাও আজ চুল-চেরা বিশ্লেষণে লেগে পড়ে কেন এই বিচারকার্যে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তাদের মতে বিচার তারাও চায় কিন্তু তা হতে হবে একশভাগ নিরপেক্ষ, অভিযুক্তদেরও যেন নিজের সমান 'সে' থাকে। তারা দেশের আশু বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, শিবিরের তান্ডব/প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভীষণ চিন্তিত, যে কারণে এখন থেকেই 'যুদ্ধপরাধীদের বিচার' বিষয়টিকে ইস্যু বানিয়ে রাজনৈতিক জল ঘোলা করতে পারলে নিজেরাই পানিতে নেমে পড়ে।
একবার না একহাজারবার তাদের আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে, কিন্তু তারা বা তাদের চামচারা কি অন্তত একবার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে ষোলোশো কিলোমিটার দুর থেকে উড়ে আসা পাকি হায়েনাদের দীর্ঘ নয় মাস ধরে তারা স্বজাতির মাংসের যোগান দিয়ে যায়নি? তারা কি একবার বলতে পারবে তাদের হাত, অন্তর নিজ অঞ্চলের এরকম লাখে লাখে নিরপরাধ/নিরস্ত্র মানুষের (নারী/শিশুর) রক্তে কুলষিত নয়? তারা কি ফিরিয়ে দিতে পারবে সেই কৃতিসন্তান বা বুদ্ধিজীবিদের অন্তত একজনকে? তারা কোন মুখে অস্বীকার করবে ক্ষমাহীন ২৫ শে মার্চ বা ১৪ ই ডিসেম্বর? কয়টা গল্লামারি, চুকনগর তারা অস্বীকার করবে? কয়টা ময়ূর অথবা ভদ্রা নদীকে তারা অস্বীকার করবে? -- এই পাপের বোঝা নিয়ে হাজার মানুষের অভিশাপ, ঘৃণা নিয়ে আজ অব্দি তারা বেঁচে আছে কেমন করে!! ধর্মে যথার্থ বলা হয় শয়তানের আয়ু অসীম!
সেসময়ের শক্তিশালী পাকিবাহিনীর পা-চাটা কুকুরগুলো নিজের সুবিধাজনক অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পরিণত হয়েছিলো স্বজাতির মাংস খুবলে খাওয়া শকুনে, এখনো সুযোগ পেলে আমাদের হারানোর মাত্রাটা তারা বারবার নিয়ে দাঁড় করায় সম্পূর্ণ অপূরণীয় এক অবস্থায়। যাদের অনেক আগেই ফাঁসির কাষ্ঠে তুলে দীর্ঘ চার দশক ধরে এই দমবদ্ধকর লজ্জার বোঝা বয়ে বেড়ানোর হাত থেকে জাতিকে মুক্ত করা উচিৎ ছিলো, তারাই পেয়েছে এই সেলুকাস দেশে এ-গ্রেড নাগরিকের মর্যাদা, তাদের থাকে সদা সক্রিয় সংগঠিত ইনডোর আউটডোর বেক-আপ, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শক্তি, যা এখনো তাদের রক্ষায় নিয়ে যাচ্ছে একের পর এক চোরা পদ্ধতির আশ্রয়। আমি অবাক হবো না যদি দেখি শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদের মতো আজ প্রিয় জাফর ইকবালকেও হঠাৎ কোন চোরা হামলা বা গুপ্ত হামলার শিকার হতে হয়। তারপর হয়তো এরকমই মুখোশধারী কোন সুশীলকে আমরা বলতে শুনবো -- যথার্থই হয়েছে বড্ড বেয়াড়া কথাবার্তা শুরু করেছিলো মুনাফিকটা!
যে পতাকার বিরোধিতা তারা করেছিলো আজ এতদিন পরেও সেই পতাকার সমুন্নত রূপ তারা মেনে নিতে পারেনা, তাদের বুক রক্তের তৃষ্ণায় ফেটে যায়, চোখ জ্বলে যায় হিংসায়। যে কারণে বেহায়ার মতো সেই স্বাধীন দেশেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে রেখেছে নিজের বিষাক্ত শেকড়। অথচ যারা নিজের সবটুকু দিয়ে এই দেশকে এনে দিলো স্বাধীনতার লাল সূর্য তারা সেই মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারগুলোকে হয়তো থাকতে হয় অজানা দীর্ঘশ্বাস চেপে, আধপেটা খেয়ে, খড়কুটোর আশায় বুক বেঁধে... একদিন তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত প্রিয় ভূমিটি ঐ জারজগুলোর ভারমুক্ত হবে, একদিন বাংলার প্রতিটি রাজকার, আলবদরের বিচার হবে!
আমার গা জ্বলে আসরে নিরব শ্রোতার ভূমিকায় থাকা বাকিদের উপর বেশি। নিজের পুতুপুতু ভালমানুষী বা জী-হুজুরি ইমেজ রক্ষায় যারা অত্যন্ত্ সচেতন। চারিদিকে অনুভূতিশূন্য জড়পদার্থের ভিড় দেখতে দেখতে আমার হাঁসফাঁস লাগে! আশ্চর্য ব্যাপার! এদের আসলেই কখনো কিছু বলার থাকেনা। যেন বসে বসে তামাশা দেখাই তাদের অন্যতম প্রিয় কাজ, তামাশাই তো বটে। গণহত্যার ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র অংশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) নেমে আসা সবচেয়ে বড় নৃশংসতা, ম্যাসাকার আর কালচক্রান্তের সীমা লঙ্ঘন করে একটি জাতিকে পুরো পঙ্গু করতে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা, বেহিসাবী ধর্ষিতাদের আর্তনাদ চোখের জলে ধুয়ে আসা স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে আজ তামাশা! তাও ভালো এই সো-কল্ড ভালো মানষি রূপ আমাকে কখনো নিতে হয়নি দেখে আজ সত্যি আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তাদেরই বলছি -- হয়তো অসংখ্যবার আপনারা এই বধ্যভূমিগুলোর কথা শুনেছেন। নানা প্রয়োজনে এ পথ ধরে হেঁটেও গিয়েছেন। কখনো একটিবার, একটিবারও কি আপনাদের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠেনি? মন বিষিয়ে ওঠেনি সেই খুনি এবং খুনির দোসরদের উপর? কখনো কি মনে হয়নি এই অন্যায়ের বিচারে কোনো আপোষ নাই, কোনো বিকল্প নাই? কখনো এই স্তম্ভের দিকে তাকিয়ে নিজের ভিতরে তীব্র কিছু কি গর্জে উঠেনি? মনে আসেনি কোনো প্রতিজ্ঞাবোধ? এক বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের কাপুরুষোচিত উত্তরসূরি হয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার চেয়ে, না হয় দেশের সবচেয়ে ভালোটার জন্যে সবচেয়ে খারাপটাকে দেখে নিলাম আর একবার! একবার ভাবুন তো, চল্লিশ বছর আগেই যদি এই বেজন্মাগুলার বিচার হয়ে যেত, তাহলে পুষে রাখা এই কালসাপের বিষাক্ত ছোবলে বারবার কি ক্ষতবিক্ষত হতে হতো প্রিয় জন্মভূমিকে? আফসোস হয় কি?
ভিনদেশী হয়েও এক অ্যালেন গিনসবার্গ বা জর্জ হ্যারিসনের হৃদয়ে সেসময়ে বাঙ্গালীর দুর্দশা দেখে যে পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়েছিলো, তার কতটুক ছুঁয়ে যায় আজ আমাদের?
মৌসুমি ভৌমিকের সুরে যশোর রোড বাংলায় -
আমার রাগ লাগে যখন দেখি প্রত্যক্ষ বা প্ররোক্ষভাবে কেউ রাজাকারদের পক্ষ নেয়ার চেষ্টা করে তাদের উপর, আমার ঘৃণা হয় তাদের উপর যারা সত্য জেনেও চুপচাপ মৌনবাবাজী সেজে তাদের কথায় সায় দিয়ে যায় কোন প্রতিবাদ ছাড়াই, আমার লজ্জা হয় তাদের নপুংশকতা দেখে, আমার করুণা হয় তাদের মেরুদন্ডহীনতায়। আমার থুথু দিতে ইচ্ছে করে তাদের মুখে যারা মুক্তিযুদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধা/স্বাধীনতার বিপক্ষে কথা বলে।
(লেখাটা একাধীক জায়গায় ডালপালা ছড়ানো, অগোছালো আর অতিমাত্রায় আবেগি... দেবো না দেবো না করেও কিছুটা জেদ থেকেই দিলাম... ভুলত্রুটি মার্জনীয়।)
মন্তব্য
এই দশ হাজার মানুষ কোথা থেকে এসেছিল? তারা কি সবাই স্থানীয় ছিল?
পড়েছিলাম দুমুরিয়া, চুকনগর, গল্লাবাড়ির ম্য়াসাকারে নিহতদের মধ্য়ে মুসলমান ছিল সামান্য়।
তাহলে এই হাত্য়াকান্ডে যেসব স্থানীয় হিন্দুরা ঝাড়ে বংশে মরে গেল, ওদের জমিজমা-ক্ষেতখামারগুলো এখন কে বা কারা দখল করে আছে?
***
একটা রগরগে লাল স্পুতনিক দিয়ে শহীদদের স্মরণ করতে হবে কেন, আমার বোধগম্য় হয়না।
আমাদের দেশে কি ভাস্কর আর স্থপতির এতই অভাব?
***
এই বর্বর গণহত্যর বিচার হতেই হবে।
- না, অভাব নেই। তবে সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল ভাস্কর-স্থপতি হলেই যে তিনি সরকারী টেন্ডারের নানা নিয়ম-কানুন আর অলিখিত ব্যাপার-স্যাপারগুলো মিটিয়ে কাজটা পাবেন এমনটা নয়। কোন জাদুমন্ত্র বলে বাংলাদেশ জুড়ে কেবল মৃণাল হকের ভাস্কর্য গত আড়াই দশক ধরে গড়ে উঠছে সেটা বোঝার চেষ্টা করলে স্থাপিত ভাস্কর্যকর্মে চিন্তার দীনতার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
মার্চের পর থেকে যখন পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী মোটামোটি পুরো দেশ জুড়েই গণহত্যা শুরু করে দেয়, তখন প্রথম ধাক্কায় দেশ থেকে হিন্দুরা দলে দলে পালাতে থাকে ভারতে। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে স্থানীয় দালালদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ বেড়ে যাওয়ায় বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে আনুমানিক ৭১ হাজার শরণার্থী বর্ডার পার হতে জড়ো হয় বাংলাদেশ-ভারত শীমান্তবর্তী ব্যবসাহিক অঞ্চল এই চুকনগরে, তাদের মধ্যে কিছু পার হয়েও গিয়েছিলো, আর বাকিরা সেদিন ২০ মে সকালে নৌকায় নোঙর করছিলো। স্থানীয় বাঙ্গালী দালাল ও বিহারীদের মাধ্যমে পাকিস্থান বাহিনী খবরটা জানতে পারে, এবং তাদেরই সহযোগিতায় সেখানে পৌছে এই বিশাল হত্যাযজ্ঞ চালায়।
ভাস্কর আর স্থাপনা নিয়ে কিছু বলার নাই, কিছু একটা যে এতোদিনে তৈরী হয়েছে এইটাই আসলে বড় কথা, যা না থাকলে স্থানগুলোর গুরুত্ব সাথে ইতিহাস সব মাটির সাথে মিশে যাবে অচিরেই! তবে শুধু স্থাপনা বা ভাস্কর্য নির্মানই শেষ কথা না, এ নৃশংসতার ইতিহাস যাথাযথভাবে সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের নথিপত্রে তালিকাভুক্ত জরুরি মনে করি।
এই বর্বরতার বিচারে কোনো আপোষ নাই!
অল্প কিছুদিন হয় চুকনগর হত্যাকান্ডের একটা দলিল পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। যে বইটি লিখেছেন, রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির নাম- মুক্তির সোপানতলে। প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার এ বইটির ইংরেজি ভার্সনও আছে। নাম- এ টেল অব মিলিয়ন্স্। ইংরেজি ভার্সনটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। বাংলাটি ১৯৮১ সালে। আবেগপ্রবণ মানুষের পক্ষে বইটির শেষ পৃষ্ঠাগুলো পড়ে শেষ করা কষ্টকর।
তথ্যে দু'টি ভুল করে ফেলেছি। সঠিক তথ্য হচ্ছে-
১। "মুক্তির সোপানতলে" বইটির প্রথম প্রকাশ জুলাই ২০০১।
২। "মুক্তির সোপানতলে" বইয়ের কোন ইংরেজি ভার্সন নেই। "টেল অব মিলিয়ন্স্" বইটি মূলতঃ "লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে" বইয়ের ইংরেজি ভার্সন।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
ধন্যবাদ অরফিয়াস!
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। এই অন্যায়ের বিচারে কোনো আপোষ নাই, কোনো বিকল্প নাই।
দারুন লিখেছেন আপু।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
বিচার হতেই হবে! কোনো আপোষ নাই, কোনো বিকল্প নাই!
অসহায় লাগে...কেন সবার ভেতরে একসাথে এই বোধটুকু কাজ করেনা!
ধন্যবাদ তোমাকে পোস্টটি পড়ার ও মন্তব্য করার জন্যে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা। বিষয়টি সামনে আনার জন্য ধন্যবাদ
facebook
৭১-এর গণহত্যার ইতিহাসগুলো আমাদের আরো ঠিক ঠিক জানা প্রয়োজন বলে মনে করি... না হলে এর পেছনের প্রকৃত নৃশংসতা, যুদ্ধপরাধীদের ভূমিকা ইত্যাদি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাবে, আর তিরিশ লক্ষ কেবল একটা সংখ্যা হয়ে থাকবে আমাদের কাছে, পরের প্রজন্মের কাছে।
খুলনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে খুলনায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকারী স ম বাবর আলীর বইতেও বিস্তারিত কিছু নেই। তবে সরকার বা অন্যকেউ যদি উদ্যোগ নেয়, তবে সেই সময়কার কমান্ডারেরা এবং এলাকাবাসী অনেক তথ্য দিতে পারবে। সেদিনের সেই প্রজন্মের প্রায় সকলেই কিন্তু ষাটোর্ধ, এরা মরে গেলে তথ্য পাওয়ার আর কোনও সূত্রই অবশিষ্ঠ থাকবে না।
লেখাটির গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এইসব লেখা আমাদের দায়গুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে যায়।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
পড়ার ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। আমি অনেকের কাছেই গল্লামারি সম্পর্কে জানতে চেয়েছি, কিন্তু কেউই তেমন কিছু বলতে পারেনি, শুধু এটুকুই যে - এখানে যুদ্ধের সময় মানুষ মারা হতো। এমনকি এই গল্লামারি নিয়ে কোথাও সুস্পষ্ট কিছু লিপিবদ্ধ নাই। চুকনগর নিয়ে সামান্য কিছু লেখা আছে, তাও সরকারী দলিলে হয়তো এখনো জায়গা হয়নি। যে হারানোর বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীনতা তার ইতিহাস সংরক্ষণে এত কালক্ষেপণ আর অনীহা কেন, এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
হয়তো এরই মাঝে হারিয়ে গেছে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী, আর বেশিদিন না তারপর এরকম অনেক বধ্যভূমির ইতিহাস মাটি চাপা পড়বে! আমরা বা আমাদের পরের প্রজন্ম জানবোও না!
নতুন মন্তব্য করুন