উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (চতুর্থ পর্ব)

রংতুলি এর ছবি
লিখেছেন রংতুলি [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০৩/২০১৩ - ১২:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভূমিকা বা ভণিতাহীন...

আমার আয়নায় প্রতিবিম্বিত চরিত্রগুলো -

পার্ল এস. বা্কের মা
চেজিরা, টু উইমেন, আলবার্তো মোরাভিয়া
দীপার সাতকাহন

গর্ভধারিনী জয়িতাঃ

উচ্চবিত্ত পরিবারের স্বাধীনচেতা মেয়ে জয়িতা। তবে সমাজের উঁচু শ্রেনীর আর দশটা মেয়ের মত সে নয়। নয় বিলাসিকতায় গা ভাসানো ঝকমকে এক্সপেন্সিভ শোপিস মাত্র। বিত্তশালীদের বৈভব-বিলাসিতার ভেতরকার নগ্ন-উন্মুক্ততায় তার দমবন্ধ হয়ে আসে। প্রতিবাদী সে আচরণে, প্রতিবাদী বেশভূষায়। ভাবনা-চিন্তায় সে স্বচ্ছ ও গতিশীল। চরিত্রে নেই তার ন্যাঁকা-ভণিতাসুলভ কোনো দিক।

কল্যাণ, সুদীপ, আনন্দ জয়িতার বন্ধু। জয়িতার সাথে প্রেসিন্ডেন্সিতে পড়ে। তার মতই মেধাবী ও স্পষ্ট চিন্তার মানুষ তারাও। জয়িতার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো দিক হলো, তারা কেউই তাকে মেয়ে বলে আলাদা খাতির অথবা বৈষম্য করে না। জয়িতা তাদের চোখে কেবল মেয়ে নয় বরং একটা মানুষ, তাদের বন্ধু। বন্ধুত্বের সম্মানটুকু জয়িতা তাদের চোখে দেখতে পায়। সস্তিবোধ করে তাদের সঙ্গ ও বন্ধুত্বে। চারজনের মধ্যে যে জিনিসটা কমন ছিল, তা হলো - প্রত্যেকে স্বপ্ন দেখতো একটা শ্রেণীহীন সমাজের, যেখানে ধনী-গরীব থাকবে না, সবার জীবনযাত্রার মান একই হবে, মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে না বরং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে সমান ভূমিকা রাখবে। তারা স্বপ্ন দেখে দুর্নীতিমুক্ত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, মানুষের ভেতরের কুসংস্কার ও অসচেতনতা মুক্ত সত্যিকারের স্বাধীন এক সমাজের, স্বপ্ন দেখে পরিবর্তনের। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ানো বৈষম্যের কুৎসিত রূপটা তারা ঘৃণা করে, তাই দুর্নীতিগ্রস্ত ঘুণে ধরা সমাজের ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলোয় সজোরে আঘাত করে নির্মূল করা ছাড়া আর কোন পথ দেখে না... বয়সে তারা তরুণ, রক্তে পরিবর্তনের নেশা, সমাজ বদলানোর এই গুরুভার তারা নিজেরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। বেটার নাও দেন নেভার, কিছু একটা করতে হবে, এখুনি...

বেছে বেছে তারা আঘাত করে সমাজের প্রকৃত বাস্তবতা থেকে পুরাই বিচ্ছিন্ন বৈষম্যের জলজ্যান্ত উদাহরণ বিত্তশালীদের নির্লজ্জতার প্রধান আখড়াগুলোতে, যা অচিরেই সমাজের প্রচলিত আইন-কানুন ও শিল্পপতি/বুর্জোয়াগোষ্ঠীদের আঁতে ঘা লাগায়। ক'টা বিছিন্ন তরুণ-তরুণীর এই খামখেয়ালী তারা মেনে নেবে কেন। তার উপর যাদের মাথায় উপর নেই কোন পলেটিক্যাল শেল্টার। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার পরিণতি হয় ভয়ানক, বুর্জোয়া ও রাজনীতিবিদদের রোষানলে পড়ে তারা বাধ্য হয় শহর ছাড়তে। আশ্রয় নেয় দুর্গম, বৈরী জলবাতাস-পূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে। জয়িতা ও তার বন্ধুরা কেবল পরিবর্তনের ফাঁপা বুলি আওড়ায় না, পরিবর্তনকে তারা ধারণ করে নিজের মধ্যে। যে কারণে শহর থেকে পালিয়েও থেমে থাকে না তাদের ভেতরের সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত উপায়ে সমাজ পরিবর্তনের স্পৃহা - সেই দুর্গম পাহাড়ি মাটিকেই তারা বেছে নেয় স্বপ্ন সার্থকের ভূমি হিসেবে। সেখানের মানুষের নির্দিষ্ট আয়, কো-অপারেটিভ ডেয়ারি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে মানসিক সুস্থিতি ফেরাতে তাদের সংগ্রাম শুরু হয় নব উদ্যমে।

জয়িতা নির্ভেজাল এক বিপ্লবী নারী, পরিবর্তন স্পৃহা মিশে আছে তার অস্তিত্বে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ সে দিয়েছিলো সেই পাহাড়ি মানুষদের মাঝে সত্যিকার অর্থে মিশে যেয়ে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী পুরুষটিকে ভালোবেসে তার সন্তান নিজ গর্ভে ধারণ করে। ধনী পরিবারের শহুরে ও শিক্ষিত মেয়ে হয়েও জয়িতা গ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিতে নির্দ্বিধায় হয়ে ওঠে তাদেরই একজন। শহরের তথাকথিত আধুনিক মানুষগুলোর ভেতর সে দেখে - "পুরু চামড়ার নখদন্তহীণ চোখের পর্দা-ছেঁড়া আত্নসম্মানহীন কয়েক লক্ষ বাঙালী গর্তে মুখ লুকিয়ে এ ওকে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে।" গ্রামের পাহাড়ি মানুষগুলো বরং তার কাছে ভণিতাহীন, অকৃত্রিম ও স্বচ্ছ।

সমরেশ-কে অনেককেই পোড় খাওয়া কমিউনিস্ট বলতে শুনি। এখানে বলে রাখা ভালো, লেখকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার আগ্রহ তার লেখা বা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা প্রিয় চরিত্রগুলোতে। আমার কাছে লেখক যদি তার লেখার মধ্যে বাস্তবতাকে তুলে না ধরে, তাহলে তা হবে রূপকথা। আর রূপকথাতে আমার আগ্রহ বরাবরই কম। আলবার্তো মোরাভিয়া'র মতে, বাস্তবতাকে সফলতার সাথে তুলে ধরতে হলে, লেখকের নিজের ভেতর যা থাকা আবশ্যক, তাহলো - স্পষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দার্শনিক ধারণার ভিত্তিতে নিজস্ব একটা নৈতিক অবস্থান গ্রহণ... এবং সেই নৈতিক অবস্থানটিই হয়ে ওঠে তার লেখার প্রাণ। যদিও মোরাভিয়ার মতে অবশেষে - "A writer survives in spite of his beliefs." গর্ভধারিনী-তে সমরেশকেও আমার কাছে সমাজ বাস্তবতার আলোকে নিজের বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে রীতিমত হিমশিম খাওয়া সংগ্রামরত উপন্যাসিক মনে হয়েছে। পুরো উপন্যাস জুড়ে তিনি নিজের ভেতরের শ্রেণীহীন সমাজের প্রত্যাশা তুলে ধরতে যেয়ে প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেকে অস্বীকার করতে পারেননি। উপন্যাসের মূল চরিত্র জয়িতার মধ্যেও আমি সমরেশের শ্রেণীহীন সমাজের সেই আত্নীক দাবী দেখতে পাই - যা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমতার দাবী নয়, বরং নারী-পুরুষের ভেদাভেদহীন, কুংস্কার-অসচেতনতা-জড়তা মুক্ত, সত্যিকারের বৈষম্যহীন স্বাধীন এক সমাজের প্রতি তার আকংখার প্রতিফলক।

আমার জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় আমি এমন অনেক মেয়ে দেখেছি - যারা রোদে বের হতে চায় না কালো হবার ভয়ে, কাদা-মাটি ছোঁয় না হাতে ময়লা লাগার ভয়ে, পানি ধরে না নেইল পলিশ উঠে যাবে বলে... ছুরি-কাঁটাচামুচ ধরার স্টাইলে বা কথায় ইংলিশ এক্সসেন্ট দিয়ে তারা বিচার করে কে কতটা স্মার্ট অথবা ক্যালাস। নিজের চারপাশে একটা অভেদ্য দেয়াল তারা সমসময় তুলে রাখে, কাউকে এর ভেতরে নেয় না, নিজেও এর বাইরে বের হয়না। পুরো পৃথিবীটাই এদের কাছে হাইলি আনহাইজিনিক, সাসপিশাস। আমি তাদের সম্পর্কে ভাল বা খারাপ কোনরকম মন্তব্য করছি না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম সঙ্গ অল্পেই আমার ভেতর বিরক্তি ধরায়, আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, এদের কাছে থেকে আমি হরহামেশাই পালিয়ে বাঁচি। যারা জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে জানেনা, অচেনা পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখেনা, মাটি-পানি-আলোর সংস্পর্শে আসেনা, তাদের প্রতি আমার শুধুই করুণা। তারা নিজেরাও জানেনা বাস্তবতা থেকে তারা কত দুর, জীবন থেকে কত দুরে। একই কারণে জয়িতার জীবনের চ্যালেঞ্জিং ক্ষমতা আমাকে টানে, মুগ্ধ করে, উৎসাহ দেয়... তাই জয়িতা আমার কাছে আকর্ষণীয়, আধুনিক, স্পষ্ট ও স্মার্ট।


মন্তব্য

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

রংতুলি, কঠিন এক কাজ হাতে নিয়েছেন । অভিবাদন না দিয়ে পারছি না...

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

রংতুলি এর ছবি

ধন্যবাদ আপু। উৎসাহ পেলাম অনেক! হাসি

বন্দনা এর ছবি

ভালো লাগা আর ও একটি উপন্যাস , আর ও একটি চরিত্র। আপনার ভালোলাগাগুলা আমার সাথে মিলে যাচ্ছে কিভাবে কিভাবে যেন, আগের পর্বে মন্তব্য করা হয়নি তবে দীপাবলী ও আমার বেশ পছন্দের একটা চরিত্র।

রংতুলি এর ছবি

ধন্যবাদ বন্দনা! আমিও তাই ভাবি - এই চরিত্রগুলো অবশ্যই আমার মত অনেক মেয়েরই ভালো লাগার। সচলের নারী লেখকদের সাথে পেয়ে আসলেই অনেক ভালো লাগছে! হাসি

তাসনীম এর ছবি

জয়িতা আমারও প্রিয় এক চরিত্র।

ভালো লাগলো লেখাটি।

চলুক।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

রংতুলি এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া! আপনার মন্তব্য পেয়ে উৎসাহ দ্বিগুণ হয়ে গেল... হাসি

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম
চলুক আপু। ভালো লাগছে ....

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

রংতুলি এর ছবি

ধন্যবাদ আরজু! চলছে... হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি তো চলতেই আছেন দেখছি হাসি চলতে থাকুন নিরবে পড়ে যাচ্ছি।

- পিনাকপানি

রংতুলি এর ছবি

হুম, সচলে প্রায় এক বছরে টেনে টেনে অনেক লেখাই লিখেছি, কিন্তু এই সিরিজটা লিখতে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে... চলবে... হাসি

তারেক অণু এর ছবি

আমার জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় আমি এমন অনেক মেয়ে দেখেছি - যারা রোদে বের হতে চায় না কালো হবার ভয়ে, কাদা-মাটি ছোঁয় না হাতে ময়লা লাগার ভয়ে, পানি ধরে না নেইল পলিশ উঠে যাবে বলে... ছুরি-কাঁটাচামুচ ধরার স্টাইলে বা কথায় ইংলিশ এক্সসেন্ট দিয়ে তারা বিচার করে কে কতটা স্মার্ট অথবা ক্যালাস। নিজের চারপাশে একটা অভেদ্য দেয়াল তারা সমসময় তুলে রাখে, কাউকে এর ভেতরে নেয় না, নিজেও এর বাইরে বের হয়না। পুরো পৃথিবীটাই এদের কাছে হাইলি আনহাইজিনিক, সাসপিশাস। আমি তাদের সম্পর্কে ভাল বা খারাপ কোনরকম মন্তব্য করছি না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম সঙ্গ অল্পেই আমার ভেতর বিরক্তি ধরায়, আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, এদের কাছে থেকে আমি হরহামেশাই পালিয়ে বাঁচি। যারা জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে জানেনা, অচেনা পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখেনা, মাটি-পানি-আলোর সংস্পর্শে আসেনা, তাদের প্রতি আমার শুধুই করুণা। তারা নিজেরাও জানেনা বাস্তবতা থেকে তারা কত দুর, জীবন থেকে কত দুরে। উত্তম জাঝা! -- আমিও

রংতুলি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।