“কিন্তু স্যার... পানি লাগবে কেন?”
আহসানের ছুঁচো প্রশ্নে মিঃ জামশেদের ভ্রু কুঁচকে আসে। পঞ্চাশোর্ধ বলিরেখায় চাপ পড়ে। চোখে-মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে ওঠে। এবং এসব কিছুর পরোয়া না করেই সে তাকায় আহসানের দিকে।
আহাসান আমতা আমতা করে – “না, মানে... এই রিজিওনে তো পানিবাহিত রোগ নাই বলেই জানি। বাসায় খাবার পানি ফিল্টারের যে ব্যবস্থা আছে, তা যথেষ্ট সেফ। অফিস ও বাসায় সেম ব্যবস্থা। আই মিন ফিল্টার। তাহলে বোতল পানির বিলাসিতা কেন?“
যত্তোসব হাভাতের দল! দুইটা এক্সিকিউটিভ গেস্ট আপ্যায়নের মুরোদ নাই, যাচ্ছে পার্টি দিতে।
ভেতরে আরো দু’য়েকটা গালি আসতে থাকে। আজকাল এই এক সমস্যা অল্পতেই মেজাজ খিঁচড়ে মুখ খারাপ হয়। কাইলা লোকালরা কিছু বুঝে না বলেই রক্ষা, মুখে মেকি হাসি টেনে দিব্যি ‘শুয়োরের পয়দায়িশ’ বলে চালায়ে দেয়া যায়। কিন্তু কোত্থেকে এই উটকো বাঙ্গালীটা এসে জুটল। খারাপ না! ক্ষমতা জাহিরের কেউ না থাকলে, সেই ক্ষমতা অর্থহীন। চেহারায় তাচ্ছিল্যের ভাবটা বজায় রেখেই মিঃ জামশেদ লিস্টটা আগামাথা, চুলচেরা খতিয়ে দেখতে থাকে। যার প্রতিটা জিনিস অতি যত্নে টুকে রেখেছে মিতা। আহসানের স্ত্রী।
যদিও আহসান এখানে মিতার করা লিস্ট যাচাই করতে আসে নাই। এসেছিল সিনিয়ার স্টাফদের সাথে পরিচিত হওয়ার একটা উপযুক্ত দিনক্ষণ মিঃ জামশেদের সাথে আলাপ করে ঠিক করতে। প্রায় দু’সপ্তা হলো সে এখানে এসেছে, এখনো সিনিয়ার তেমন কারো সাথেই পরিচয় হয়ে উঠেনি। মিঃ জামশেদের কাছে আসার কারণ দু’টো। প্রথমত, যেহেতু আহসান তার প্রজেক্টেই জুনিয়র হিসেবে জয়েন করেছে, তাই তাকে অন্য স্টাফের সাথে পরিচয় করানোর প্রাথমিক দায়িত্বটা মিঃ জামশেদের উপর বর্তায়। আর দ্বিতীয়টা, কাকতালীয়ভাবে মিঃ জামশেদ একজন বাঙ্গালী। কিন্তু মিঃ জামশেদের আগবাড়ায়ে পরদারিমূলক আচরণ আহসানকে প্রথম ধাক্কায় খুশির বদলে হতাশই করে বেশি। বলতে গেলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই সে লিস্টটা তুলে দেয় তার হাতে।
“না না... ড্রিক্সস আরো লাগবে! ভদকা, রেড ওয়াইন এড করো। ক্যাশু ন্যাট, চিজ বাইট, প্রিংগেলস রাখো ডিংক্সের সাথে। আর থাকবে ঝলসানো মাংশ। এপিটাইজার, সাইড-ডিসগুলো হতে হবে রকমারি। বাচ্চাদের জন্য চকলেট, কাপকেক, আইসক্রিম... সারপ্রাইজিং আইটেমে কি কি বৈচিত্র্য আনা যায় ভাবো... ইন দ্যাট কেস ইউ সুড সিক অ্যাডভাইস ফ্রম মাই ওয়াইফ! সি হ্যাজ দ্য রিয়েল আইডিয়াস! সি গট এবসোলুটলি দ্য ম্যাজিক!”
“স্যার, এটা তো সে অর্থে পার্টি না একটা ছোটখাটো গ্রিটিংস মাত্র। এখানে এত বাড়াবাড়ির কি আদৌ প্রয়োজন আছে?“
আহসানের কথা শুনেও না শুনার ভান করে, গলায় আরেকদফা বিরক্তি ঢেলে মিঃ জামশেদ বলে, “মেইন কোর্স, ডেজার্টের কিছুই দেখি না এখানে। রোজকার আলু-পটলের সদাই দিয়ে কি সিনিয়ার স্টাফের পার্টি দিতে চাও তুমি?”
“আসলে মিতা বলছিল এই সুযোগে যদি কিছু মানুষকে আমাদের সংঙ্কৃতির সাথে পরিচয় করানো যায়, তো খারাপ কি। যেমন ধরেন মেইন কোর্সে থাকল খুব সাধারন মাছ, ডাল, ভাত। আর ডেজার্টে পিঠা-পায়েস, সন্দেশ।“
“তাই নাকি! এসব এক্সিকিউটিভ লেভেলে ওঠা-বসার কোন অভিজ্ঞতাই তোমাদের নাই দেখছি? বাই দা ওয়ে তোমার স্ত্রী বাংলাদেশের কোন রিজিওনের?”
“হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন স্যার?”
“অবশ্যই ভ্যালিড রিজন আছে!” শুরু থেকেই নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে আসা মিঃ জামশেদের অবজ্ঞার ভাবটা যেন থার্মোমিটারের পারায় ম্যালেরিয়া জ্বরের মতো উর্দ্ধমুখি। “আমার বাবা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শওকত আলী বাঙালীদের নিয়ে যে বিশেষ উক্তিটি করতেন, তা হলো – হালচাষা বাঙ্গালীদের কাছ থেকে একটি বিশেষ লেভেলের পর সেন্স আশা করা মূর্খতা।“
ছাত্রজীবনে ডিবেট চ্যাম্পিয়ন আহসানও এবার পাল্টা জবাব দিতে ছাড়ে না, “মাফ করবেন স্যার! আমার মনে হয়, আপনার বাবা নন-বাঙ্গালী ছিলেন। পাঞ্জাবি বা পাকিস্তানী আর্মি। কারণ একমাত্র তাদের পক্ষেই বাঙ্গালীদের নিয়ে এরকম ছ্যাঁদো মন্তব্য করা সম্ভব।”
“হোয়াট ডু ইউ মিন!” জামশেদের কানের লতি লাল হয়ে ওঠে।
আহসান ব্যাখ্যা করে, “দেশটা যদি কৃষিপ্রধান হয়, তাহলে সেটা হালের সেন্সেই টিকে থাকার কথা। হালচাষা বাঙালী বলে কাউকে আলদা ক্লাসিফাই করাটাই বরং কোনো সেন্স প্রমাণ করে না।“
মিঃ জামশেদ সে মুহূর্তে কিছুটা থতমত খেলেও পরক্ষণেই নিজের নিশ্ছিদ্র দাম্ভিকতা সামলে নেয়, এবং কিছুটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলে, “জানো তো, বড় বড় দেশ এবং তাদের এই দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে কি চোখে দেখে? দুর্নীতিতে পর্যুদস্ত, বানে ভাসা একটা দেশ। যেখানের মানুষেরা সব আনসিভিলাইজড, আনকালচার্ড। তার উপর বাংলাদেশ এখন অরেঞ্জ জোন। অর্থাৎ অবস্থা ওয়েস্ট আফ্রিকান এ দেশগুলো থেকেও খারাপ। স্বাধীনতার পরপর অ্যাখ্যাপ্রাপ্ত তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থা লিটারালি খুব একটা বদলায়নি এখনো। ঘরে অতিথি এলে চা দেয়ার কালচারটুকুও আমরা শিখেছি বৃটিশদের কাছ থেকেই। অতএব তাদেরকে আমাদের কালচার দেখিয়ে রাতারাতি পগারপার করার চিন্তাটা হাস্যকর।“
আহসানের ধৈর্য্য জবাব দিচ্ছিল, “আমি তর্কে যেতে চাই না, লোক দেখানো কালচার শেখার আগে আমরা হয়ত একটু বেশি উদার ছিলাম। অন্তত ছোটকালে আম্মাকে ঘরে মেহমান এলে অবেলায়ও ভাত রেঁধে খাওয়াতে দেখেছি!”
জামশেদের তেলচু এক্সামপলে এবার ভাটা পড়ে, উপায়ন্তর না দেখে মরিয়া হয়ে সে তার শেষ অস্ত্র বের করে। দু’দিনের এই বাঙাল ছোকরার কাছে হার মানার অর্থ হলো পরবর্তী সময় অলিখিতভাবে তার অধীন হয়ে থাকা। এর ডানা এখনই কেটে ফড়ফড়ানি রুখতে হবে। কিল দ্য ক্যাট ইন দ্য ফার্স্ট নাইট - নাহলে এতদিনের সঞ্চিত ক্ষমতা কি কাজের!
“আহসান আমি এই অরগানাইজেশনের সাথে আছি বিশ বছর। সিনিয়র স্টাফ হিসেবে আমার একটা রেপুটেশন আমি মেইন্টেইন করে আসছি শুরু থেকে। তোমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে জুনিয়র প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে। আমরা কোওয়ার্কার হলেও, আমি সিনিয়র। টপ অফ দ্যাট তোমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে, আনফরচুনেটলি দেশটা আমার।“
“আনফরচুনেটলি! আমি অস্বীকার করছি না।“ প্রাসংগিকভাবেই আলোচনার এ পর্যায়ে গতসপ্তাহে লোকাল স্টাফদের সাথে তাদের গ্রিটিংস পর্বটা চলে আসে, যা খুব সাধারণভাবে এ্যারেঞ্জ করা হয়েছিল। এ্যারেঞ্জ বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না, কারণ লোকালরা নিজ গরজে এসেছিল আহসান ও মিতাকে গ্রিট করতে। তাদের ঝামেলায় ফেলবে না ভেবে এসেছিল একদম সর্ট নোটিসে। তারপরও আপ্যায়নে ও আন্তরিকতায় তারা খুশি। সবকিছু অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিল মন খুলে। আফ্রিকানদের নিয়ে তাদের মনে নানা ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গেছিল তখনই। অথচ আজ সে একই মোলাকাত পর্ব নিয়ে শুধুমাত্র গায়ের চামড়া ও পদমর্যাদাভেদে বাড়াবাড়ির মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে আহসানের বাঁধে। সে ভেতরের অস্বস্থিটা স্বীকার করে, “আই আম নট কম্ফোরটাবল ইন মেকিং ডিফরেন্সেস বিটউইন লোকাল এন্ড ইন্টারন্যাশ্ন্যাল স্টাফ।“
মিঃ জামশেদের ধড়িবাজি চোখ ত্বরিত চারপাশ মেপে নেয়, তারপর গলার স্বর হঠাত খাদে নামিয়ে, বাচ্চা ভোলানোর বিশেষ কায়দায় বলে, “লিসেন আহসান, ইউ আর আ পার্ট অফ এন ইন্টারন্যাশন্যাল অরগানাইজেশন। লোকাল স্টাফ আর ইন্টারন্যাশনাল স্টাফের তফাৎ তোমাকে শিখতে হবে। লোকাল স্টাফদের সাথে কি হল তাতে আসলে তেমন কিছু যায় আসে না, বাট ইন দ্যাট কেস উই হ্যাভ সাম রেস্পনসিবিলিটি। আমি তোমাকে সাহায্য করছি যাতে, আমরা কিছুটা হলেও কালচার্ড এই কনসেপ্টটা ওদের মাথায় থাকে।“
আহসানের বলার কিছুই থাকে না, মিঃ জামশেদের মাত্রাতিরিক্ত আধিপত্য জাহিরের চেষ্টায় সে বিরক্ত হলেও একটা নতুন জায়গায় এসে শুরুতেই বেঁধে যাওয়া গ্যাঞ্জামটাকে আর টানতে চায় না। অবাধ্য শিশু যেমন ছ’মাথা, বারহাত ও সতেরো শিঙের দানবের ভয়ের কাছে বশ মেনে অবশেষে ঘুমোতে যায়, তেমনি এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির চাপে এক্সিকিউটিভ জুজুর ভয়ের কাছে বশ মানা ছাড়া আহসানের আর কোনো উপায় থাকে না।
***
(পরের পর্বে সমাপ্য)
মন্তব্য
রংতুলি, আপনার এ গল্প যে দক্ষতার সাথে লিখেছেন তাতে শেষের ঐ 'বিঃ দ্রঃ' দেওয়া ঠ্যাংনোট-টা একেবারেই বেমানান। ওটার 'পরের পর্বে সমাপ্য'- এই জাতীয় কিছু ছাড়া বাকী অংশটা যদি সরিয়ে নেন, বড়ই আনন্দ পাব।
প্রবল আগ্রহে পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
কি যে বলেন এক লহমা! আমি আরো আপনার কমেন্ট দেখে কয়টা বানান ভুল করলাম ভাবতেছিলাম। আপনার আনন্দের জন্যে ঠ্যাং নোটটা আরেকবার দেখতেছি।
পরের পর্ব কামিং সুন...
বাঃ! ঠ্যাং নোটটা বাদ দিয়ে শেষটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
তাই তো!
পার্টির জন্য লাইন দিয়ে বসলাম। জমে উঠেছে গল্প, ঠ্যাং নোটের বিষয়ে এক লহমা ভাইয়ের সাথে সহমত।
খেতা-বালিশ নিয়ে আরাম করে বসেন। পার্টি শুরু হইলো বলে!
“দেশটা যদি কৃষিপ্রধান হয়, তাহলে সেটা হালের সেন্সেই টিকে থাকার কথা। হালচাষা বাঙালী বলে কাউকে আলদা ক্লাসিফাই করাটাই বরং কোনো সেন্স প্রমাণ করে না।“ - অসাধারণ লেখার দুটি অসাধারণ লাইন।
ফাহিমা দিলশাদ
অনেক ধন্যবাদ! ফাহিমা দিলশাদ
বাহ! দারুন জমেছে।
- ছায়াবৃত্ত
জমেছে নাকি! অনেক ধন্যবাদ!
চমৎকার
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
ধন্যবাদ!
ওহ্ দারুণ জমেছে।
আমার আনন্দটা হলো আমি এখনই দ্বিতীয় পর্ব পড়বো।
অনেক শুভকামনা রংতুলি।
অনেক ভালো থাকবেন।
-------------------------
কামরুযযামান পলাশ
অনেক শুভকামনা, ভালো থাকবেন।
aliahasan
ঠ্যাংনোটে কি ছিল ঝানতি চাই
গপ্প ভালা লাগে।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন