মহামারী আমার কাছে অজানা/অপ্রতিরোধ্য কোন জীবাণু সংক্রমণ নয়, এক স্পষ্ট অনুভূতি, অনন্তকাল বা কালচে পরিত্যক্ত এক বইয়ের প্রতিচ্ছবি। যা আমি এক রকম জোর করেই রাখি অন্তর্দৃষ্টির বাইরে। যার মলাটে আনমনে কখনো চোখ পড়ে গেলে গা শিউরে ওঠে, আপনা থেকে দ্রুত চোখ সরে যায়। যত্নের বুকশেলফ ঝাড়পোঁছের সময় কৌশলে স্পর্শ বাঁচিয়ে চলি - যেন উই-খাওয়া, ছেঁড়া পাতাগুলোর ভেতর ওঁৎ পেতে আছে ভয়ানক সে রোগের জীবাণু। আলতো এক ছোঁয়ায় আবার জেগে উঠতে পারে সর্বগ্রাসী দানব, প্লেগ।
আমার মতো দুর্বল স্নায়ুর পাঠকের অনুপুযুক্ত ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি পড়া ছিল নির্দ্বিধায় জীবনের সেরা দুঃসাহসগুলোর একটি। যারপর আর দ্বিতীয়বার সেটির দিকে তাকানোর সাহস যোগাতে পারিনি। সেই থেকে এক অদৃশ্য আতংক আমাকে তাড়া করে। প্লেগের মতোই যার শেষ নেই...
বারবার গৃহযুদ্ধের সাথে যুঝতে থাকা আফ্রিকার কিছু অঞ্চলের আরেক যুদ্ধের নাম এখন ইবোলা। এক ক্ষত শুকোতে না শুকোতে আরেক ক্ষত বিভীষিকারূপে দণ্ডায়মান। ঈশ্বরের কৃপাবঞ্চিত এ কালো মানুষগুলো যুদ্ধ, ক্ষুধা আর রোগশোকের অভিশাপ মাথায় নিয়ে ইতস্তত টিকে থাকে। এইডস, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েডের মত ঈশ্বরের অভিশাপের কাছে তারা আগেই পরাস্ত... তার উপর পঞ্চাশ বছর ধরে একটু একটু করে পুষ্ট ইবোলার তাণ্ডব এখন শুরু হয়েছে পুরোদমে। ইবোলা, আমার প্রজন্মের দেখা সবচেয়ে বড় মহামারী। ইবোলা, যা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় আলবেয়ার কামু’র ‘দ্য প্লেগ’ এর কথা।
এবছর শুরুর দিকে গিনি থেকে এই সংক্রমণ শুরু হলেও লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। লোকজনের আতংক আর অসহযোগিতায় ইবোলা নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সিয়েরা লিওনে কারফিউ দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা বাড়ানোসহ নতুন সংক্রমণ ও মৃত তল্লাশি চালানো হয় তিনদিন। মহামারী চলাকালীন সময়ে কারফিউয়ের মত অমানবিক প্রক্রিয়া ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও, সিয়েরা লিওন সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে – ‘এটি ছিল একটি সফল অভিযান।‘
কেন কারফিউ? ওদের ধারণা হসপিটালে নিয়ে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। তারা হসপিটালে যেতে যায় না। আপনজন থেকে বিছিন্ন হতে চায় না। লাইবেরিয়ায় কিছু রোগী আইসোলেটেড ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে, তাদের দ্বারা আরো কতজন সংক্রমিত হয়েছে, তার হদিস নেই। কিছু রোগী পরিবারের তরফ থেকে জোর করে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়াও আইসোলেটেড ওয়ার্ডের সামনে থেকে আত্নীয়দের ভিড় সরানো যাচ্ছে না।
যেমনটা কামুর ভাষায় ছিল প্লেগের বর্ণনা – রাতের স্তব্ধতা ভেঙে এ্ম্বুল্যান্সগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন সংক্রমিতদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে আসে, যা এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করে। পরিবার থেকে কিছুতেই স্বজনদের যেতে দেয়া হয় না। কারণ এরপর আর কখনোই তারা দেখবে না প্রিয় মানুষটির মুখ। তাদের আর্তচিৎকারে রাতের স্তব্ধতা খান খান হলেও, পড়শিদের ঘুম ভাঙ্গে না, তাদের জানালা-দরজা আরো শক্ত হয়ে বন্ধ থাকে। কেউ আসে না স্বজনহারাদের স্বান্তনা দিতে। উল্লেখ্য, উপন্যাস প্লেগের আইসোলেশনকে বহু আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সাথে তুলনা করেছেন সাহিত্য বোদ্ধারা।
নয় মাসে তিন হাজারের বেশি মত্যু আর ছয় হাজারের বেশি আক্রান্তের হিসেব আসলে পুরোটা অসম্পূর্ণ, যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের আইসোলেশনের ভয়ে চিকিৎসার আওতায় আনা হয় না, পরিবারের তরফ থেকে গোপন করা হয় রোগের উপসর্গ ও মৃত্যু। উল্লেখ্য, ইবোলার প্রকৃত মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা আরো আড়াইগুণ বেশি হবে বলে ধারণা করা হয়।
কিছুদন আগে গিনি সীমানা পেরিয়ে সেনেগালে আসে এক তরুণ, যে কিনা নিজের সাথে বহন করে এনেছিল ইবোলার জীবাণু। এটিই সেনেগালের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র সংক্রমণ। সেনেগালের মানুষ তখন প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল ইবোলা বহনের অপরাধে সেই তরুণকে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারতে। সৌভাগ্যবশত সে সংক্রমণ রুখে দেয়া গেছে। তাই হয়তো জনরোষ প্রলম্বিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। এ ঘটনায় মনে মনে আফ্রিকানদের বর্বর বলে গালি দিয়েছিলাম। কিন্তু গত দু’দিনে আমেরিকায় প্রথম ইবোলা সংক্রমনের (লাইবেরিয়া থেকে আমেরিকায় যাওয়ার পর এক ব্যক্তির শরীরে ইবোলা সংক্রমণ ধরা পড়ে) ঘটনায় সভ্য জাতির যে প্রতিক্রিয়া দেখলাম, তাতে বর্বর আফ্রিকানদের সাথে সভ্য আমেরিকানদের তফাৎ খুব একটা করা গেল না! মন দিয়ে বিবিসি ব্রেকিং নিউজে’র কিছু কমেন্ট পড়লাম। যার মধ্যে বেশিরভাগ মন খারাপ করা, তবে মজার কমেন্টও ছিল, যেমন – ‘Clam down America! You wouldn't vanish, it’s only one case!’
আসলে নির্বোধ, বর্বর, মূর্খ বা জংলী – আফ্রিকানদের পৃথিবী যাই বলে গালি দিক না কেন, সত্য হলো, খুব কম জাতিরই এ পরিস্থিতিতে স্নায়ুচাপ সামলে, স্বাভাবিক আচরণ করার ক্ষমতা থাকে। মহামারীর তোড়ে নির্বোধ, জংলী অথবা সভ্য, জ্ঞানী সব এক।
কারণ মহামারী কেবল রোগশোক, আর মৃত্যুর মিছিল নয়। মহামারীর অর্থ আরো ব্যাপক, আরো গভীর এবং অন্তহীন!
মহামারী মানে বিচ্ছিন্নতা, মহামারী মানে হাহাকার, মহামারী মানে বিপন্ন মানবতা, মহামারী মানে ঈশ্বরের মুখ ফিরিয়ে নেয়া; স্থবিরতা, অনাবাদ, অনাহার, দুর্ভিক্ষ; কান্না, উন্মাদনা, চেতনাহীনতা, দিগবিদিকজ্ঞানশূন্যতা, যুদ্ধ...
স্কুলগুলো বন্ধ, ভেঙ্গে পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থা। ইবোলায় মা/বাবা হারিয়ে হাজার হাজার শিশু অনাথ, অনিশ্চিত তাদের ভবিষ্যৎ।
পালিয়ে গিয়েছে বহু ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। হুমকির মুখে স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
প্রকৃতির প্রতিকূলতার সাথে বোঝাপড়া করে চলে এসেছে এতদিন এ অঞ্চলগুলোর চাষাবাদ। বছরের অর্ধেক সময় ধরে এখানে চলে খরা, আর অর্ধেক সময় পানি। পানি ছাড়া আবাদ অসম্ভব। অথচ ভরা আবাদের মৌসুমে মানুষ ইবোলা আতংকে গ্রামছাড়া, ক্ষেতছাড়া। অতএব খাদ্যাভাব অবশ্যম্ভাবী। মাথার উপরে দুর্ভিক্ষের ছায়া।
ব্যবসাপাতি নেই, বিকিকিনি বন্ধ, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। বিদেশি পর্যটকরা আসে না তাই হোটেলগুলোতে তালা লাগার যোগাড়। ঐতিহ্যবাহী ক্র্যাফট শিল্প বন্ধ। মানুষের হাতে নেই রোজগার, ঘরে নেই খাবার আর মনে মৃত্যুভয়। এই উভয়মুখী গ্রহণ সৃষ্টি করছে অসহনশীলতা, অসন্তোষ ও ক্ষোভের। যে কারণে এসব অঞ্চলে যে কোন মুহূর্তে দাঙ্গা, অশান্তি, গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
তার উপর ইবোলা নিয়ন্ত্রণে ইউ এস’র সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্তকে সহজভাবে নিতে পারছে না অনেকেই। ফেসবুকে নানা আফ্রিকান গ্রুপ ও পেজগুলোতে এব্যাপারে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে এ আরেক আগ্রাসনের আয়োজন, কলোনিয়ালিজমের আরেক পাঁয়তারা। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাবে, এটাই স্বাভাবিক।
সবশেষে আমেরিকায় সংক্রমণের ঘটনায় মহা তোলপাড়। ফেসবুকে নানা সংবাদ মাধ্যমের লিংকের কোন কোনটার সাথে হাজারের বেশি মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য, যার কিছু কিছু দেখে যে আশংকা মনে আপনা থেকে জায়গা করে নেয়, তা হলো – ইবোলা বুঝি আরেক দফা উস্কে দিলো নির্লজ্য বর্ণ-বৈষ্যমের।
উপন্যাসে প্লেগ অবশেষে অরিও শহর থেকে বিদেয় নিয়েছিল এবং শহরবাসী আতশবাজি পুড়িয়ে মুক্তির সে দিনটি উৎযাপন করেছিল। জানি না, প্রতি তিন সপ্তাহ অন্তর অন্তর সংক্রমণের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকা এ ইবোলা দানবের গতি কবে শ্লথ হবে, কবে রেহাই পাবে জরাগ্রস্ত আফ্রিকার এ অঞ্চলগুলো। যদিও বা কখনো এ সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রকোপ রুখে দেয়া যায়, তারপরেও এই ব্যাপক আকারে আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত ধ্বস কিভাবে সামলে উঠবে ভাগ্যাহত এ মানুষগুলো, ইবোলা কি আদৌ কখনো মুছে যাবে এদের জীবন থেকে - কোন উত্তর খুঁজে পাই না আমি!
---------------
তথ্য সূত্রঃ
মন্তব্য
আশংকার বিষয়। কেন যেন এই কালো, গরিব দেশের মানুুষগুলোকে খুব আপন মনে হয়। এরা একের পর এক গৃহযুদ্ধ, সামরিক শাসন, দুর্বল অর্থনীতি, বিদেশিদের লুটপাট, রোগবালাই -এসব থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না।
সেই, দাঁড়াবেই বা কীভাবে! ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
লেখা ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ।
ভীষণ সংবেদনশীল বর্ণনায় উঠে এসেছে নবাগত মহামারীর শংকা!
শুভকামনা। অনিঃশেষ। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
এ প্রজন্মের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারী এখন চলমান। জানিনা কবে, কীভাবে তা ছেড়ে যাবে বা আদৌ যাবে কিনা!
ধন্যবাদ।
ভীষণ নাড়া দিয়ে গেল। সিয়েরালিয়নে কেটেছে আমার দীর্ঘ ১ বছর ৫ মাস সময়। সে সময়ে সে দেশের কালো মানুষগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। আজ তাদের এই দুর্দশার দিনে খুব খারাপ লাগছে। এমন সংবেদনশীল লেখা হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
এ কালো মানুসগুলোর ভেতরে যে সাদা মন আছে তা আসলে এদের সাথে একাত্ম না হয়ে জানা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে এদের মানবতা সভ্যদের হার মানায়। আশংকা, ভয় আরো নানা অনুভূতি’র মিশেল এই লেখা, আপনার হৃদয় ছুঁয়েছে জেনে ভাল লাগলো।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন