কনকনে ঠাণ্ডা সকালে বনের ভেতর তুষার মোড়ানো পথ পাড়ি দিয়ে ভাই বোনদের সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে কখনও বা দৌড়ে সবচেয়ে ছোট যে ছেলেটা স্কুলে যায় ওর নাম আলমানজো। বয়স ন' হয়নি। পায়ে তলাবিহীন 'মোকাসিন জুতো', কারণ বুট জুতো পরার বয়স হয়নি তার তখনো। এমনকি ছোট বলে সকলের খাবার পাত্রটাও বয়ে নিতে হয় তাকেই। ঠাণ্ডায় তার গাল দুটো আপেলের মতো আর ছোট্ট নাকটা টকটকে চেরী ফুলের মতো লাল দেখায়।
স্কুল আলমানজোর ভাল লাগে না মোটেও। বরং বাবার সাথে ক্ষেত আর গোলাবাড়িতে কাজ করতেই তার যত আগ্রহ, কত কিছুই না করবার আর দেখ্বার আছে সেখানে। স্কুলে গিয়েই বা তার কাজটা কি, সে তো আর বড় ভাই রয়াল বা বড় বোন এলিজা জেনের মতো স্টোর কিপার কিংবা স্কুল টিচার হতে চায় না, যেখানে তাকে অন্যের তোয়াক্কা করে চলা লাগে। সে হতে চায় বাবার মতো মতো স্বাধীন একজন মানুষ।
তবুও শীতকালীন স্কুলে আলমানজোকে যেতে হয়। শিখতে হয় পড়তে, লিখতে, বানান আর অংক কষতে। পাকা গেরস্তেরও কত সব জটিল হিসেব-নিকেশ জানা লাগে! স্কুল থেকে ফিরেও তাদের বিশাল গোলাবাড়িটিতে তার জন্য করার থাকে অনেক কিছু। গবাদি পশুগুলোকে পানি ও জই খাওয়ানো, ওদের বিছানা পরিষ্কার করা, নোংরা-বাসি খড়গুলো ফেলে সেখানে পরিষ্কার খড় বিছিয়ে দেয়া। নিজের বাছুর দু'টো 'স্টার' আর 'ব্রাইট' কে আদর করা। আর সুযোগ পেলেই ঘোড়ার খোঁয়াড়ে গিয়ে তার সবচেয়ে প্রিয় কাজটি করা, 'কোল্ট' (ঘোড়ার বাচ্চা) গুলোর দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকা। আলমানজোর মতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী এই ঘোড়াই! এরচেয়ে সুন্দর আর কিছু হতেই পারে না! যদিও ওদের কাছে যাওয়ার অনুমতি তার নেই। ছোট কোল্টগুলোকে খুব সাবধানে তালিম দিয়ে ভাল ঘোড়ায় পরিণত করতে হয়, একটু অসাবধানে একটা ভাল কোল্টও নষ্ট হয়ে যেতে পারে চিরতরে। আলমানজো জানে এসব, সে কিছুতেই ফুটফুটে একটি কোল্টকে ভয় দিয়ে নষ্ট হতে দিবে না! সে শুধু ওদের মসৃণ গায়ে, নরম তুলতুলে নাকে একটু হাত বুলিয়ে আদর করতে চায়। তবুও বাবা ওদের কাছে তাকে ভিড়তে দিবে না! ইশ! 'স্টার লাইট' এর মতো এমন সুন্দর একটা কোল্ট যদি তার নিজের থাকতো, ঠিকই তাকে সে তালিম দিয়ে একটা সেরা ঘোড়া বানাতো!
আলমানজো এখনও অনেক ছোট। আপাতত সে তার নিজের বাছুর স্টার আর ব্রাইটকে তালিম দিয়ে যায় জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার পাওয়া ছোট লাঙল আর স্লেজ গাড়িটা দিয়ে। ছোট্ট চাষীর ছেলেটির কাজের তো আর অন্ত নাই, বরফ সংরক্ষণের কাজে বাবাকে সাহায্য করা, বরফ গলা শুরু হলে বাবার সাথে বনে ম্যাপল শিরাপ, গ্রিন বেরি, স্ট্রবেরি যোগাড়ে যাওয়া, বসন্তের শেষে বিচনাট কুড়োতে যাওয়া, ক্ষেতে আলু আর কুমড়ো বীজ বোনা, ভুট্টা আর জই ক্ষেতে নিড়ানি দেয়া, সবজি বাগানের আগাছা সাফ করা। আর সবকিছুর পরে বড় হয়ে ঠিকই 'স্টারলাইট' মতো সুন্দর একটা ঘোড়ার বাচ্চা তার নিজের হবে এই স্বপ্নে দিন গুণে যাওয়া।
'স্টার'ও 'ব্রাইট' বসন্তের ঘাস-পাতা খেয়ে খেয়ে মোটা-তাজা হয়ে বেড়ে ওঠে, মায়ের সবজি বাগানের কুমড়ো ও লাউ লতাগুলোও তরতরিয়ে বাড়ে, বাড়ছে না শুধু সেই! আলমাজো খায় এবং খেতেই থাকে... শুয়োরের চর্বিতে সিম ভাজা, মাখন চুয়ে পড়া আলু আর শালগম ভর্তা, তার প্রিয় আপেল এবং পিয়াজের ভাজি, জিভে জল আনা গন্ধে ভুর ভুর শূকরের ভাজা মাংস, ভেতরে মসলাদার রসালো পুর দেয়া বাইরে মুচ মুচে আপেল পাই, কতশত পিঠে, কেক... স্ট্রবেরী, গ্রিনব্রেরী'র চাটনি, জেলি, মোরব্বা... তরমুজের খোসা এবং লাউয়ের মোরব্বা... এগলগ, জইয়ের ক্ষীর... আরো কত কি! বাবার কটাক্ষ ও মায়ের হাসি উপেক্ষা করে প্লেট উপচে খাবার নিয়ে, মিষ্টি কুমড়ো ও অ্যাপল পাইয়ের সবচেয়ে বড় টুকরোটা সাবাড় করেও সে যথেষ্ট বাড়ছে না! কেউ তো আর জানে না, কেন তার এত বড় হওয়ার তাড়া! বড় হয়ে সে বাবার মতো একই দক্ষতায় লাগাম টেনে টেনে ঘোড়া বশ মানাবে, সেই তর যে তার আর সয়না!
***
অতঃপর পড়ে কিংবা বলা ভাল চেটেপুটে খেয়ে শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম লরা ইঙ্গেলসের মজাদার 'The Farmer Boy'। আমার কলিগ কাম বন্ধু যে আমাকে বইটি ধারে পড়তে দিয়েছে, কেউ তাকে বলেছিলো - 'This is a delicious book'। বইটি আসলে কতটা delicious এতক্ষণে যারা এই ছোট্ট রিভিউ পড়ছেন আশা করি তারাও জেনে গেছেন। রান্না উপাদেয় হতে শুনেছি রাঁধুনির সূক্ষমাত্রার স্বাদবোধ সাথে পঞ্চ ইন্দ্রিয়র বাকী চার ইন্দ্রিয়ও সজাগ থাকা লাগে। একটি বই এই মাত্রায় উপাদেয় হতে হলে বোধহয় লেখকের সজাগ পঞ্চ ইন্দ্রিয়, সূক্ষ স্বাদবোধ এসবের বাইরেও কিছু থাকা লাগে, আর তাহলো জীবনকে প্রতি পরতে চেখে দেখার দুর্লভ অভিজ্ঞতা, অপরাজেয় এক আকাংখা!
আমার লরা ইঙ্গেলস সিরিজের হাতে খড়ি হয়েছিলো জাহানারা ইমামের চমৎকার অনুবাদ 'নদীর তীরে ফুলের মেলা' (On the Banks of Plum Creek) এবং 'তেপান্তরের ছোট্ট শহর' (Little Town on the Prairie) দিয়ে। এই সিরিজের অন্য বইগুলো পড়ার সুপ্ত বাসনা মনে লালন করে আসছি অনেকদিন। সময় আর সুযোগ কোনোটাই হয়ে ওঠেনি। অবশেষে দীর্ঘ লালিত বাসনা পূরণ হয়ে গেল সে কোন প্রবাস জীবনের কর্মক্ষেত্রে বসে, একই টিমে সমমনা দেশি বন্ধুটিকে পেয়ে। জানলাম এই সিরিজের পুরোটা পড়ার সখ তারও অনেকদিনের! একদিন মেয়েটি সত্যি সত্যি অনলাইনে বাংলা লরা ইংগেলস সিরিজের সবকটা বই অর্ডার দিয়ে দিল। ব্যস, আর পায় কে! কোনো কোনো দিন সকালে বাস মিস করে, মেজাজ খা্রাপ নিয়ে অফিস যেয়েও মন ভাল হয়ে যেতে থাকলো ডেস্কের উপরা পেতে থাকা এই টুকরো আনন্দগুলো কারণে। সিক্যুয়েন্স অনুযায়ী সেই ঠিক করে দিল, কোনটার পর কোনটা পড়ব এবং তারই আবদারে আজকে এই রিভিউ লিখতে বসা। পড়লাম 'খোকাখুকুর গল্প শুনি' (Little House on the Big Woods), এবং এক যে ছিল চাষীর ছেলে' (The Farmer Boy)। সাথে একটু একটু করে পড়ে শেষ করলাম গল্পগুলো কিছুটা কেটে ছেঁটে সাজানো এই সিরিজ নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের রূপান্তর সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ দুটোও। সেবার অনুবাদ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই, সেতো আলমাঞ্জোর মায়ের বানানো মুচমুচে আপেল পাই!
তবে আবু ইউসুফ এর অনুবাদে 'এক যে ছিলো চাষীর ছেলে' নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন বোধ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব কম লেখকেই চিনি। চাষীর ছেলের আবু ইউসুফ বা খোকা খুকুর গল্প শুনির অনুবাদক খন্দকার রফিকুল হককেও আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। যদি চিনতাম তাহলে কিছু প্রশ্ন আমি অবশ্যই করতাম। যেমন, কি ভেবে লেখক ফার্মার বয় পুরো বইটি আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ করে; আলমানজোর গরু 'স্টার', 'ব্রাইট' আর ছোট্ট ঘোড়া 'স্টারলাইট'এর নাম পর্যন্ত বদলে বাংলায় 'তারা', 'উজল' এবং 'তারারআলো' বানিয়েছেন, অথচ বড়দিনের আস্ত শূকর ছানার রোস্টকে মুখে লাল আপেল দেয়া আস্ত ভেড়ার ছানার রোস্ট বানিয়ে ফেলেছেন! এবং কেনই বা আলমানজোদের শীতের মাংস সংগ্রহে পাঁচটি শূকরকে বদলিয়ে পাঁচটি ভেড়ায় পরিণত করেছেন! বড় দিনের ভোজে মুখে আপেল দেয়া ভেড়া আমার কল্পনায় কোনোভাবেই খাপ খাচ্ছিল না, কারণ বড়দিনে আয়োজনে টেবিলে মুখে আপেল দেয়া আস্ত শূকর অবচেতনে মাথায় গেঁথে আছে হাজারবার টিভিতে দেখা নানা মুভি, সিরিয়াল, কার্টুন (টম এন্ড জেরী), এবং কয়েকশবার পড়া নানা গল্পের বর্ণনায়। তারুপর শীতের মাংসের জন্য পাঁচটি ভেড়া মেরে ফেলায় আমার ভেতরের চাষী মন রীতিমত আক্ষেপ শুরু করছিলো, আহারে মাংসের জন্য পাঁচটি ভেড়া গেল, ওগুলো থাকেল পরের গ্রীষ্মে আলমানজোরা কত পশম পেত! খোকাখুকুর গল্পের খন্দকার রফিকুল হকও কম যান না, তিনি লরাদের পোষা শূকর ছানা কে হরিণ ছানা বানিয়ে পুরাগল্পে কীভাবে দিব্যি চালিয়ে দিলেন, যেটাকে শীতের মাংসের জন্য শেষমেষ মারা হয়! পরদিন অফিসে লাঞ্চে বসে কলিগ সহ শূকর-ভেড়ার ধাঁধার কিনারা করলাম সেবার বইদুটো ঘেটে, অতঃপর শান্তি! যেখানে অনুবাদকের ধর্মীয় সংস্কার নিজের খাবার টেবিলের মধ্য সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল, সেখানে লরা বা আলমাঞ্জোর খাবার মেনু বদলানোর অধিকার একজন অনুবাদক পেলো কোথা থেকে, তা আর জানা হলো না!
১।
ষাটের দশকে ফ্র্যাংকলিন বুক্সরা বাংলা ভাষায় এই সিরিজটা বের করেছিল। সেই সিরিজের সব বই পড়ার সুযোগ হয়নি - 'ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির' আর 'খোকাখুকুর গল্প শোনো' ছাড়া। যতদূর মনে পড়ে ঐ দুটো বই আতোয়ার রহমানের অনুবাদ করা ছিল।
একটা/দুটো বই জাহানারা ইমামের অনুবাদ আর একটা বই দিলারা হাশেমের অনুবাদ বলে শুনেছি, পড়ার সুযোগ পাইনি। কয়েক বছর আগের কথা। শুনলাম বইমেলাতে কোন এক প্রকাশনী এই সিরিজটা পুনর্মুদ্রণ করবে। ফেসবুকে পাঠকদের এক গ্রুপে এই সংক্রান্ত আলোচনা উঠলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম প্রকাশক ফ্র্যাংকলিন বুকসের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করছেন কিনা। একজন জানালেন প্রকাশক নাকি বলেছেন তিনি সৈয়দ সাইফ ইমাম জামী'র কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন। আবার প্রশ্ন করলাম, ফ্র্যাংকলিনের প্রজেক্টে বের হওয়া বইয়ের মালিক তো ফ্র্যাংকলিনই হবার কথা। একজন অনুবাদকের পুত্র কি সেই অনুমতি দিতে পারেন? ব্যাস, ক্যাচাল লেগে গেলো। পাবলিক আলোচনা অন্য দিকে নিয়ে কুতর্ক শুরু করলো। আমি চুপ করে গেলাম। এখন দেখি এই বইগুলো'চারুলিপি' নামের এক প্রকাশনী বের করেছে। কিছু কিছু অনুবাদকের নাম পালটে গেছে। যেমন, আতোয়ার রহমান আউট, খন্দকার রফিকুল হক - আবু ইউসুফ ইন! কাহিনী খৎনা করার কাজটা মনে হয় এনারাই করেছেন। আরও জানতে পারলাম 'ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির' আলী ইমামও অনুবাদ করেছেন, শামীম পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত। লরা মারা গেছেন ১৯৫৭ সালে, যদি তিনি বা তার ওয়ারিশগণ সিরিজের কপিরাইট কারো কাছে বেচে দিয়ে না থাকেন তাহলে কপিরাইটের ঝামেলা গেছে। এই বার বাজারী অনুবাদকেরা দুই হাত খুলে এর অনুবাদে বসে যাবেন। আশা করি উনারা গল্পে ফার্মের মুরগী, কোয়েল, মামা হালিম, শরমা হাউসের শরমা, নান্নার বিরিয়ানী ইত্যাদি আমদানী করে তামা তামা বানিয়ে ফেলবেন।
২।
সেবা প্রকাশনীর অনুবাদের কিছু ভালো এবং কিছু খারাপ দিক আছে। একটা ভালো দিক হচ্ছে সারা দুনিয়ার ক্ল্যাসিকগুলো বাংলা ভাষায় আমাদের হাতে তুলে দেয়া। দ্বিতীয় ভালো দিক হচ্ছে এক কালে দক্ষ অনুবাদকেরা উচ্চ সাহিত্যমূল্য মানের অনুবাদ উপহার দিতেন। আর খারাপ দিক হচ্ছে সেবা সাইজের অনুবাদ পড়ার ফলে পরে পাঠক 'আরে এটা তো সেবা থেকেই পড়ে ফেলেছি' ভাবনায় মূল বই পড়ার সুযোগ পেলেও আর পড়তে অনীহা বোধ করেন। অথচ মূল বইটা না পড়লে এটা কেনো ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিকে ঠাঁই পেলো সেটা আর বোঝা যায় না।
৩।
যে আমলে টেলিভিশন মানে কেবলমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটা চ্যানেলে বিকাল পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটার অনুষ্ঠান ছিল, সেই আমলে এই সিরিজ বছরের পর বছর ধরে বিটিভিতে দেখানো হয়েছে। অসম্ভব ধীর এই সিরিজটা এখন দেখালে কী হতো তা বোধগম্য, তবে ওই আমলে আমরা সেটা হামলে পড়ে দেখতাম। তার ইন্ট্রো, তার ফিনিশিং, তার থিম সং এখনো মাথায় গেঁথে আছে। চার্লস ইঙ্গলসের ভূমিকায় মাইকেল ল্যান্ডনের অভিনয় আমাদের প্রিয় ছিল। পরে তার অভিনীত 'আইওয়ে টু হেভেন'ও আমরা হামলে পড়ে দেখতাম। গত বছর দেখলাম আমার ভগ্নীপতি আমেরিকা থেকে তার কন্যার জন্য এই সিরিজের পুরোটার ডিভিডি সেট নিয়ে এসেছেন। বুঝলাম শৈশবের স্মৃতি থেকে মানুষের সহসা মুক্তি নেই।
অটঃ লেখালিখির সামান্যতম অভ্যাসও যাদের আছে না লিখলে কিছু দিন পর পর তাদের হাত নিশ্পিশ্ করতে থাকার কথা। এমন বছর তিনেকের সাবটিক্যাল লিভ নিতে গেলে নিজের দু'হাত নিজেই গামছা দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে।
ত্রিরত্নের নৌবিহার জেরোম কে জেরোমের মূল লেখার মতোই উপাদেয় লেগেছে আমার। পৃথিবীর সব ভাষা তো আর জানতে পারবো না। দস্তয়ভস্কির লেখা সে ইংরেজিতেই পড়ি কি বাংলায়, অনুবাদই তো পড়ছি!। তাছাড়া, ভাষার যে আঞ্চলিক অলংকার সেটা ভালো করে না জানলে মূল ভাষাতে পড়েও অতোটা সুখ হয় না। এই যেমন জেমস জয়েসের ইউলিসিসটা আমার বুক শেলফে পড়ে রয়েছে আজ প্রায় উনিশ বছর, পড়ে উঠতে পারলাম কই! তবে এটা ঠিক, আমরা যেহেতু ঐতিহাসিক ভাবে ইংরেজির সাথে মোটামুটি পরিচিত, ইংরেজিতে লেখা বই গুলো ইংরেজিতে পড়লে আখেরে ভালোই হয়। আর ওদের অনুবাদ তো ভুবন বিখ্যাত। আহারে, যদি জার্মান জানতাম! যদি গড়গড় করে পড়ে যেতে পারতাম রুশ, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, গ্রীক, আরবি............। নিদেন পক্ষে সংস্কৃত!
---মোখলেস হোসেন।
একজন বাংলা ভাষাভাষীর পক্ষে অসমীয়া, ওড়িয়া এবং হিন্দুস্তানী ভাষাসমূহ শেখা অপেক্ষাকৃত সহজ। এগুলোর যে কোন একটা শিখতে পারলেও তার জন্য সেই ভাষার সাহিত্য-চলচ্চিত্র-নাটক-গানের দরজা খুলে যাবে। একটা নতুন ভাষা শেখা মানে আরও কয়েক জোড়া চোখ-কান খুলে যাওয়া। তবে এর জন্য অমানুষিক খাটুনি দিতে হয়। সেটা করার ধৈর্য্য সবাই রাখতে পারে না। এই জন্য বেশিরভাগ মানুষকে একটা/দুইটা ভাষা ভর করে জীবন পার করতে হয়।
'আইওয়ে টু হেভেন' --> হাইওয়ে টু হেভেন
লিট্ল হাউজ অন দ্য প্রেইরি আর হাইওয়ে টু হেভেন - দু'টি সিরিজই আমিও হামলে পড়েই দেখতাম বিটিভিতে। ভোলার মত না! বিটিভিকে এককালে তার "সাহেব-বিবি-গোলাম" তোষক চরিত্রের কারনে, অনেক ফালতু নিজস্ব প্রোগ্রামের কারনেও প্রচুর গালিগালাজ করতাম আমরা। অথচ এখন নস্টালজিক ফিল করি, সেই বিটিভিকে মিস করি! বিটিভির অনেক ভালো দিকও ছিল তখন। বেছে বেছে খুব ভাল-ভাল বিদেশী ফিচার ফিল্মই দেখানো হতো স্যাটারডে নাইট সিনেমা বা মুভি অফ দা উইকে। এভাবে অনেক ক্লাসিক্স দেখেছি। ভাল বিদেশী সিরিজও হত। প্রচুর ভাল নাটক, ভাল প্রোগ্রামও হত। এখনকার মতো দিনরাত ২৪ ঘন্টা বকর-বকরে কান ঝালাপালা হত না।
টাইপোটা পরে খেয়াল করেছিলাম, কিন্তু মোখলেস হোসেন প্রতি মন্তব্য করায় আর সম্পাদনা করা সম্ভব হয়নি।
সত্তর-আশির দশকে একটা মাত্র চ্যানেল ছিল বলে সবাই সেখানে কাজ করার চেষ্টা করতেন। ফলে সেখানে বেশি পরিমাণে ভালো কাজ দেখানোর সুযোগ ছিল। এখন মোট ভালো কাজের পরিমাণ একই থাকলেও কয়েক ডজন চ্যানেলে ভাগ হয়ে গেছে। ফলে দর্শককে ভালো কাজ দেখার জন্য হাবল্ টেলিস্কোপ, ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের সাথে ট্যারট কার্ড নিয়ে বসতে হয়। তার সাথে অসীম ধৈর্য্য ধরে রাখার জন্য বরফের চাঁই, স্ট্রেস বল ইত্যাদি নিয়ে বসতে হয়।
এখন সারা দুনিয়ার সেরা মুভি, টিভি সিরিজ, অন্য সব অনুষ্ঠান দেখার জন্য কোন টিভি চ্যানেলের দয়ার ওপরে নির্ভর করতে হয় না। তাই বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে অমন সব অনুষ্ঠান দেখানোর চাড় নেই।
দুনিয়ার যে কোন বিষয়ে ভালো করতে গেলে মেধা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা, সৃজনশীলতা, সাহস ইত্যাদি দরকার হয়। এগুলোর অভাব থাকলে টিভি চ্যানেল খুলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে বসে থাকলেও ভালো অনুষ্ঠান বের হবে না। পাঁঠা পিটালে কেবল নাদিই বের হবে, দুধ না।
ধন্যবাদ পাণ্ডবদা। কত তথ্যই না জানলাম আপনার মন্তব্য থেকে!
১। আতোয়ার রহমানের অনুবাদগুলো বোধহয় এখনো পাওয়া যাবে। দেখি, আনাবার ব্যবস্থা করছি। আলী ইমামের 'ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির' কিন্তু লরা ইঙ্গেলসের 'লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি'র অনুবাদ নয়। বইটি আসলে আলী ইমামের নিজের লিখা শিশু-কিশোরদের উপযোগী ছোটগল্প সংকলন টাইপ। অনুবাদভুবন দেখি রঙ্গমঞ্চ, কার প্রজেক্টের অনুমোদন যে কে দেয়, কার লাভের গুড় যে কে খায় খোদা মালুম! এত এত পাবলিশার্স এত এত অনুবাদক থাকতে আমরা সাধারণ পাঠক পড়ার উপযোগী একটা ভাল অনুবাদ পাই না, এ কেমন কথা! একবুক আশা নিয়ে কোনো একটা ভাল বইয়ের অনুবাদ হাতের কাছে পেয়ে পড়তে শুরু করে শেষমেশ মুখ তিতো করে সেই ফার্মের মুরগী, কোয়েলের ডিম, মামা হালিমই গিলতে হয়েছে।
২। সেবা প্রকাশনী ছিলো বলে আমাদের মতো পাঠক ক্ল্যাসিকগুলোর স্বাদ কিছুটা হলেও পেয়েছে। তারপরেও আমি বলব মূল বইগুলো পড়া দরকার, অনেক গল্প ও বর্ণনা সেবার বইগুলোতে বাদ পড়ে যা মূল বই না পড়লে আসলে কখনোই জানা যায় না। আপাতত আশাবাদী ছেলের অবশ্য পড়ার লিস্টে লরা ইঙ্গেলস সিরিজ রেখেছি, সেই সুবাদে মূল ইংলিশ সিরিজটিই সংগ্রহে থাকবে, পড়াও হবে।
৩। আমরা বোধহয় বিটিভির আরেকটু পরের আমলের মানে ম্যাকগাইভার যুগের মানুষ। ছেলেকে ম্যাকগাইভার সিরিজগুলো নামিয়ে দিয়েছিলাম, সেও সমান আগ্রহ নিয়ে দেখেছে। 'রুটস' এর সিরিজগুলোও নামিয়ে একটার পর একটা দেখেছি টানা কয়েকবার। অবাকলাগে এককালে বিটিভিতে এত ভাল মানের ক্ল্যাসিক প্রচার করা হতো! অথচ শেষ কবে এই টিভি চ্যানেলটি আগ্রহ নিয়ে দেখেছি মনে করতে পারছি না।
অটঃ নয়টা-পাঁচটা অফিস, ছেলে-মেয়ের স্কুল, ডে-কেয়ার, বাস/ট্রেনের জন্য ছুট, লাঞ্চে একঘণ্টা বন্ধু/কলিগের সাথে সুখদুখের আলাপ। দিনশেষে ঘরে ফিরে ছেলে-মেয়েদের সময় দেয়া, ঘরের কাজ-অকাজ। আর একটু সময় পেলে দূরে কোথাও চলে যাওয়া - এই তো চলে গেল তিনটি বছর! তবে একদিন একদিন হাতের ঘামছা খুলে লিখতে বসে যেতে মন যে একেবারেই চায় না, তা না। বেঁচে থাকলে লিখব নিশ্চয়ই সে তিন কিংবা তিরিশ বছর পরে পরেই হোক!
অটঃ মাঝে মাঝে নিজেকে ঠাকুমার ঝুলির গল্পের সেই মাঝিটার মতো মনে হয় যে কেবল লোকজনকে নদী পারাপার করে যায় কিন্তু নিজের ছুটি মেলে না। শেষে চাষীর ছেলের পরামর্শে পরের যে যাত্রী আসে তার হাতে বৈঠাটা ধরিয়ে দিয়ে এক ছুটে পালিয়ে যায়। মাঝির মুক্তি মেলে। বাস্তবে মাঝির মুক্তি মেলে বালিশ ছাড়া মাটির বিছানায় অথবা জ্বালানী কাঠের সাজানো বিছানায় শুয়ে - যখন সে জীর্ণ বস্ত্রের মতো এই নশ্বর দেহটাকে ত্যাগ করে।
আমরা সাধারণ মানুষেরা প্রতিনিয়ত অন্যের সাথে অন্যায় আচরণ করি, তবে সবচে' বেশি অন্যায় করি সম্ভবত খোদ নিজের সাথে।
পোস্ট পড়ে শেষ করেছি তিন মিনিটে। আআর মন্তব্য পড়তে লাগলো তিরিশ মিনিট পাক্কা! তবে এটাই সচল-এর মাজেজা। একারনেই ভাল্লাগে। অনেক কিছুই জানলাম, বুঝলাম। নিজে ইদানীং অনুবাদ করছি বলে এই তর্কে নিরপেক্ষভাবে অংশ নেয়ার আর উপায় নেই। কাজেই চুপ রইলাম। তবে সেবার অনুবাদ পড়ে এই সিরিজ মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে। এখনও প্রায়ই ভাবি, ইশ, একটা ফার্ম যদি দিতে পারতাম। নিয়মিত লেখালেখির বিনীত অনুরোধ জানিয়ে যাই।
মন্তব্য
মুসলমানের শুকরানুভূতিতে আঘাত দিবে - অনুবাদকের কি জানের দাম নাই?!
Emran
এখানে মনে হয় অনুবাদক তার নিজের ধর্মীয় সংস্কার নয়, বরং টার্গেট পাঠকশ্রেণীকে (বাংলাদেশের প্রিডমিন্যান্ট সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোর) অস্বস্তিতে না ফেলে এবং কোনো সাংস্কৃতিক হোঁচট না খেয়ে যাতে তারা কাহিনির সাথে সহজে একাত্ন হতে পারে এবং উপভোগ করতে পারে, সেজন্যেই যৎসামান্য একটু কালচারাল এ্যডাপ্টেশন করেছেন। এটা তাঁর বিবেচনা। অনুবাদককে এইটুকু ল্যাটিচ্যুড দিতে আমি সম্পূর্ণ রাজি (হয়তো ভূমিকাতে বা অন্য কোথাও একটু ডিস্ক্লেমার বা নোট দিয়ে দেয়া উচিত)। তবে বিনা ডিস্ক্লেমারে এবং এর চেয়ে হাজার গুন বেশি কালচারাল এ্যডাপ্টেশনের নমুনা বিশ্বসাহিত্যে ভুরি-ভুরি আছে। শিশুসাহিত্যে আরও বেশি। এটা অধিকারের প্রশ্নও না। অধিকারের প্রশ্ন তুললে এই অপরাধে পৃথিবীর বহু রথীমহারথী অনুবাদককে বেতিয়ে পাছার ছাল তুলে ফেলতে হবে। এই মুহূর্তে আমার সর্বকালের প্রিয় এক অনুবাদক, ওমর খৈয়ামের অনুবাদক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের কথা মনে পড়ছে। তাঁকে তো তাহলে ছাল-চামড়া তুলে লবন-মরিচ মাখিয়ে মুখে লাল আপেল দেয়া আস্ত মানুষের ছানার রোস্ট বানিয়ে লটকিয়ে দিতে হবে!!!
****************************************
গল্পের চরিত্রগুলি খৃস্টান আর তারা শুকরের মাংস খায়, এটা জানলে সাংস্কৃতিক হোচট খেতে হবে কেন? বাংলাদেশেও তো খৃস্টানরা শুকরের মাংস খায়।
"কাহিনির সাথে একাত্ম হওয়া" মানে কি? পাঠক কি গল্প নিজের জীবনে রিপ্লে করে? তাহলে তো গল্পে ডাইনসর রাখা যাবে না, কারন পাঠক একাত্ম হওয়ার জন্য বাস্তবে ডাইনসর পাবে না। ডাইনসর বদল করে একটা ছাগল ঢুকিয়ে দিতে হবে। তবে খুন-জখম-চুরি-ডাকাতি-ঘুষ-শিশু ধর্ষন এইসব রাখা যাবে মনে হয়। পেপার খুললেই এইসব দেখা যায়। একদিন না একদিন এসব করে কাহিনির সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ অনেক।
এই অনুবাদ গল্পের টারগেট পাঠকরা কি তাদের চেয়ে ভিন্ন কারু সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চায় না? যদি তারা তা নাই চায় তাহলে এরকম গল্প অনুবাদ না করে কোন মুসলিম সমাজের গল্প অনুবাদ করাই কি ভাল নয়?
আমি সচলায়তনের নিয়মিত পরিচিত লেখক বা পুরনো সচল ছাড়া আর কারও সাথে তর্ক-বিতর্ক বা প্রশ্নোত্তরের চাপান-উতোরে এখন আর বিন্দুমাত্র আগ্রহী না। আর কুতর্কে কারও সাথেই না। দুঃখিত।
****************************************
সে কোন সুদূর পশ্চিমে প্রেইরি বা খামারবাড়ির গল্পের চরিত্রগুলোর খাবার তালিকায় কি ছিলো, তা নিয়ে পাঠক বা অনুবাদকের হোঁচট খাওয়ার কিছু নেই। পুরো বই জুড়ে যেখানে অপ্রয়োজনীয় আক্ষরিক অনুবাদ ভরা (গবাদি পশুগুলোর নাম পর্যুন্ত), সেখানে বেছে বেছে শুধু শূকরের বেলায় অনুবাদকের cultural adaptation এর সুযোগ নেয়াটা একটু হাস্যকর লেগেছে!
সমৃদ্ধ শিশুমন নিয়ে অনুবাদকের এতো না ভাবলেও চলত, সেবার বইগুলোতে শূকর কে শূকররই রাখা হয়েছে, টম এন্ড জেরির বিচ্ছু জেরি খাবার টেবিলে রাখা শূকরের মুখের লাল আপেলটা দিয়ে টমকে ঘায়েল করছে এতে অন্তত কারো তা উপভোগ করতে অসুবিধা হয়েছে বলে আমার জানা নাই। বরং শূকরের জায়গায় ভেড়া আনা হয়েছে বলেই আমার কল্পনা হোঁচট খেয়েছে বারবার। যা আরোপিত বা জোর করে গেলানোর চেষ্টা লেগেছে।
মূল গল্প অনুবাদের ক্ষেত্রে একজন অনুবাদকরের স্বাধীনতা কতটুকু তা আমার জানা নেই। ভিন্ন সংস্কৃতি তুলে ধরতে গিয়ে অনুবাদক যদি একটু সাহসিকতার পরিচয় দিত, তাহলে সামনে গিয়ে পাঠক আরো বড় হোঁচট সামলে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারত। এবং ভিন্ন সংস্কৃতির সহাবস্থান আরো সহজ হত। এক্ষেত্রে অনুবাদক তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এই জন্যই হয়ত Zoodopia'র মতো 'anyone can be (or eat) anything' এতো সুন্দর একটা concept আমাদের মাথা থেকে আসে না।
ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থান শিশু-কিশোরদের কল্পনায় পাহারা বসানোর যে কোনো অবান্তর চেষ্টার বিপরীতে।
প্রমথেশ বরুয়া বা চাষী নজরুল ইসলামে'র 'দেবদাস' যদি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের অনুবাদ হয়ে থাকে তাহলে সঞ্জয় লীলা বানশালীর 'দেবদাস' তার রূপান্তরও না। বানশালীরটার নাম 'ধর্মদাস' বা 'দ্বিজদাস' হলেও ক্ষতি ছিল না। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মূল উপন্যাস থেকে যথেষ্ট সরে গিয়েও সত্যজিত রায়ের 'পথের পাঁচালী' তার নিজস্বতার গুণে মহৎ শিল্পকর্ম। অনুবাদ/রূপান্তর কর্মের নিজস্বতা না থাকলে, শিল্পগুণ না থাকলে সেটা আবর্জনা। ফিটজেরাল্ডের অনুবাদ নিজ গুণে পাঠকের অনুমোদন পায়।
যে সাহিত্য আসলে শিশুমনের জন্য না, সেই সাহিত্যকে শিশুদের উপযুক্ত বানানোর প্রচেষ্টা আমার দৃষ্টিতে তিরস্কারযোগ্য অপরাধ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমিও সেই কথাই বলি। তাই আপনার সাথে আমি ১০০% সহমত!
তবে আপনার মন্তব্য থেকে উদ্ধৃত প্যারাটার ইমপ্লাইড অর্থটা লক্ষ্য করেছেন? আপনি কিন্তু অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই অনুবাদকের "এডাপ্টেশন" করার "অধিকার" স্বীকার করে নিয়েছেন! এই "অধিকার"-কে এক রকম সমাজ-স্বীকৃত প্রিয়েম্পটিভ লাইসেন্স বলা যেতে পারে, পক্ষান্তরে "অধিকার না-থাকাকে" বলা যেতে পারে প্রিয়েম্পটিভ নিষেধাজ্ঞা। তো, এই "অধিকার" না থাকলে অর্থাৎ প্রিয়েম্পটিভ নিষেধাজ্ঞা থাকলে - আমরা সত্যজিতকেও পেতাম না, ফিটজেরাল্ডকেও পেতাম না! কিছুতেই এবং কস্মিনকালেও পেতাম না ফিটজেরাল্ডের অমর অনুবাদ বা সত্যজিতের অসামান্য সিনেমাটিক রেন্ডিশনটি - বা দুনিয়ার অন্য কোনো অসাধারণ অনুবাদ, এডাপ্টেশন বা রেন্ডিশন। কে করত এগুলি? আপনি তো সেই রাস্তাই বন্ধ করে দিলেন! আমি সেজন্যেই বলেছি (রসিকতা করেই - এই ডিস্ক্লেমারটুকু এক্সপ্লিসিটলি দিতে হবে?!), স্বীকৃত প্রিয়েম্পটিভ নিষেধাজ্ঞা তথা নিজের "অধিকার" বা অধিকারের সীমা লঙ্ঘণ করে এরা যদি এতবড় গর্হিত অপরাধ করেই ফেলেন, তাহলে এই জাতীয় ব্যক্তিদের -
নাকি বলবেন... জনগন বা বিশ্বসংসার আগে থেকেই সু-নির্দিষ্টভাবে জানতো জনৈক ফিটজেরাল্ড বা জনৈক সত্যজিতের হাত দিয়ে এমন অমর কীর্তি বেরুবে - সুতরাং আগে থেকেই বেছে বেছে শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই বা অলৌকিক ক্ষমতাবলে আগে থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে জানা তাদের মতো সুপ্ত প্রতিভাদেরকে প্রিয়েম্পটিভ এক্সেম্পশন দিতে হবে প্রিয়েম্পটিভ নিষেধাজ্ঞা থেকে???!! আমি জানি এমন বিকট উদ্ভূতুড়ে কথা আপনি বলবেন না, বলেনও নাই। বরং বলেছেন - অনুবাদের "নিজস্বতা", "শিল্পগুন" আর "পাঠকের অনুমোদন"-এর কথা। ঠিকই বলেছেন। তো এই তিনটা বিষয়ই কিন্তু আসলে 'অধিকার' তথা 'প্রিয়েম্পটিভ লাইসেন্সের" স্বীকৃতি-সাপেক্ষে "রেট্রোস্পেক্টিভ" জাজমেন্ট বা পশ্চাৎদৃষ্টিভিত্তিক মূল্যায়ণ। এই প্রিয়েম্পটিভ লাইসেন্স এবং রেট্রোস্পেক্টিভ" জাজমেন্ট, বিচার বা মূল্যায়ণ - সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা জিনিস। কিন্তু প্রথমটা ছাড়া দ্বিতীয়টা সম্ভব না। প্রথমটার ক্ষেত্রে অবারিত দ্বার না থাকলে মানবজাতি দ্বিতীয়টার সুযোগ অর্জনের সৌভাগ্য থেকে নিজদোষেই নিদারুণ ভাবে বঞ্চিত হবে। আমি এটাই বলতে চেয়েছি এবং পোস্টদাতার মূল লেখার শেষ বাক্যে অনুবাদকের "অধিকার"-হরণের অর্থাৎ তার উপর "প্রিয়েম্পটিভ নিষেধাজ্ঞা" আরোপের একটা তাড়না লক্ষ্য করেছি - এবং সেটাতেই আপত্তি করেছি। "অধিকার" নিয়ে সবকিছুতে অপ্রয়োজনীয় কচলাকচলি করলে যে আপনার উল্লেখিত সৃষ্টিশীলতা, শিল্পসৃষ্টি, শিল্পগুণ ইত্যাদি সম্ভাবণার স্রোতস্বিনী শুকিয়ে যাবে, মুখ থুবড়ে পড়বে অফুরন্ত সম্ভাবণা, বঞ্চিত হবো আমরা - ফিটজেরাল্ডের ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরঞ্জিত, অতিনাটুকে উদাহরণটা সেই সূত্রেই এসেছে।
আর হ্যাঁ, "অধিকার" থাকলে অনেক বাজে অনুবাদ হবে, বাজে কাজ হবে, ইত্যাদি - এই কুতর্ক কেউ কেউ তুলতে পারেন। তাদের জন্য বলি। হ্যাঁ, হতে পারে। হবেই আসলে। আমার উত্তর হচ্ছে - তো সেই জন্য কি মহৎ কীর্তির পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে? বাজে কাজের ভয়ে নিজেদের আরও দরিদ্র করে ফেলব? ছোটবেলায় গুরুজনরা শিক্ষা দিতেন - কয়লা খনিতেই হীরা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, হীরা পেতে হলে কয়লার ময়লার অস্তিত্ত্ব স্বীকার করে নিতে হবে। কিম্বা, নদীর জল পেতে চাইলে ভেসে আসা কচুরীপানার সম্ভাবণা মেনে নিতেই হবে। আর কচুরীপানা আটকাতে গিয়ে বাঁধ দিয়ে নদী বন্ধ বা ডাইভার্ট করে দিলে সেটা নিজের পায়েই কুঠারাঘাত হবে!
এ ব্যাপারেও আমার দ্বিমত ও সহমত দু'টোই আছে। পরে আরেকটা হাতি কমেন্টে লিখব। এখন লিখতে লিখতে টায়ার্ড হয়ে গেছি।
****************************************
ও হ্যাঁ, আপনার আরেকটা বিশেষণ - "আবর্জনা"-র কথা ভুলে গেছিলাম। আপনি লিখেছেনঃ
তো, এই "আবর্জনাত্ব"-ও "প্রাক-অধিকার"-সাপেক্ষ বিষয়ের পশ্চাৎদৃষ্টিভিত্তিক মূল্যায়ণ। কে মহৎ সৃষ্টি করবেন আর কে আবর্জনা প্রসব করবেন সেটা কোন অলৌকিক ক্ষমতাবলে আগে থেকে বলে দেয়া যায় না। আবর্জনা প্রসবের আগেই সেটা আটকাতে গেলে, সেই জালে মহৎ সৃষ্টিও আটকে যাবে।
নোট-১ঃ আমার বাংলা / ইংরেজি কয়েনেজগুলিতে শব্দচয়ন নির্ভুল হলো কিনা পুরো নিশ্চিত হতে পারছি না। তাড়াহুড়ায় মাথায় যেটা এসেছে সেটাই লিখেছি। তবে তাতে কিছু এসে যায় না, উদ্দিষ্ট অর্থ বোধগম্য হলেই চলবে।
নোট-২ঃ আমার উপরের মন্তব্য আইন-কানুনের প্রেক্ষিত থেকে করা নয়। আইনের বাইরে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব নীতি-নৈতিকতা বলে যদি কিছু থাকে - সেই দৃষ্টিকোণ বা প্রেক্ষিত থেকে করা। বলাই বাহুল্য, আইন-কানুনের (কপিরাইট সংক্রান্ত) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেখানে যা আছে সেসব মেনে চলাই উচিৎ। এদিক থেকে দেখলে আমার মনে হয় কপিরাইটের মেয়াদভুক্ত সোর্সের ক্ষেত্রে এডাপ্টেশনের জন্য কপিরাইট-মালিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আর সেটা সম্ভব না হলে কপিরাইটমুক্ত বা কপিরাইট-মেয়াদোত্তীর্ণ কাজেরই শুধু এডাপ্টেশন করা উচিৎ।
****************************************
প্রথমে একটা বিষয় আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে, আইনের সীমার মধ্যে থেকে একটি সৃজনশীল কর্মকে এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে বা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরের অধিকার সবার আছে। এই অধিকার বলে কেউ অমন রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় 'শিব গড়তে বাঁদর' গড়লে দায়টা ঐ রূপান্তরকারীর। এর জন্য পাঠক/দর্শক/শ্রোতা তাকে গালি দিতে পারেন, কিন্তু তার অধিকারটিকে অস্বীকার করতে পারেন না।
কোন কোন ক্ষেত্রে রূপান্তরটি নিজ বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে তার উৎসের সাথে সম্পর্ক থাকা না থাকার ব্যাপারটিকে গুরুত্বহীন করে তুলতে পারে। সে নিজেই একটি স্বাধীন, পূর্ণাঙ্গ, যথার্থ সৃজনশীল কর্ম হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এর উল্টোটা যখন হয় তখন আবর্জনা সৃষ্টি হয়। এই বিচারটাও পাঠক/দর্শক/শ্রোতা তার নিজস্ব বিশ্লেষণ ও রুচি অনুযায়ী করে থাকেন। এখানেও আমাদেরকে পাঠক/দর্শক/শ্রোতা চিন্তা করার ও গ্রহন করার স্বাধীনতাকে মানতে হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
উপরে আমার জটিল-কুটিল কমেন্টেরই খুব সুন্দর আর সহজবোধ্য একটা সংক্ষিপ্তসার হয়েছে যেন! এটা অনেকটা আপনার মন্তব্যে ২য় প্যারায় বলা ১ম ধরণের "এডাপ্টেশন" হয়েছে। এজন্যে আপনাকে "মন মাঝি"-র "ফিটজেরাল্ড" আখ্যা দেয়া গেল।
****************************************
হায়! হায়! আমি তো তাইলে আভান্তি'র গল্পের 'স্যুপের স্যুপ' হয়ে গেলাম!!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
যদিও মন্তব্যটি আমাকে করা হয়নি, তবুও কিছু বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন মনে করছি। এই অধম পাঠক দ্বারা আর যাই হোক এককালে পোষা বেড়ালটিরও অধিকার হরণ সম্ভব হয়নি/নয়। বরং অনুবাদক দ্বারা যে পাঠকের জানার অধিকার গণ্ডিবদ্ধ করে এক নির্দিষ্ট ছকে ফেলার প্রয়াস দেখেছি তারই বিপরীতে সামান্য বিস্ময় (!) প্রকাশ করেছি মাত্র।
পাঠক হিসেবে আমার কাছে 'অধিকার' হলো একটা খোলা দিগন্ত যেখানে আমি ইচ্ছামত কল্পনায় হাতি, ঘোড়া, শূকর, গাধা দৌড়াবো। এখন আমার খোলা দিগন্তে যদি অনুবাদক (বিশেষ স্বার্থে) তার হাত-পা ঢুকিয়ে দিতে চায়, সে অধিকার আমি তাকে দিব না।
তার মানে এই না যে, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও চেহারার অধিকার একই সাথে যার যার দিগন্তে অবাধ বিচরণ করতে পারে না, অবশ্যই পারে - নিজের ও অন্যের অধিকারের প্রতি সমান সচেতনতা ও সম্মানবোধ থেকে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যাতে কেউ কারো খোলা মাঠে নিজের হরিণ, ভেড়া, দুম্বা জোর করে ঢুকিয়ে না দেয়, অর্থাৎ অন্যের রাস্তায় এসে তার অধিকার ভোগে বিঘ্ন না ঘটায়, তবেই সে আধিকার সার্বজনীন। অধিকার তো আর কারো একার পকেটের কড়ি নয়, নির্জীব দেয়াল বা প্রাণহীন স্তম্ভ নয়। সামাজিক চেতনাবোধ থেকে এর জন্ম, সমাজেই এর বিকাশ। আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনের সাথে সাথে অধিকারও পরিবর্তিত হয়। অধিকার গতিশীল। থাক অধিকার নিয়ে কচলাকচলি আর না করি।
****************************************
বাব্বাহ! আপনি এতো চেতছেন কেন!
পুরো বইটি অপ্রয়োজনীয় আক্ষরিক অনুবাদে ভরা যেমনটা আমি মূল লেখাতেই বলেছি, বেছে বেছে শুধু শুয়োরের জায়গায় এসে অনুবাদ ভাবানুবাদ বনে যাওয়াটা যদি অনুবাদকের স্বাধীনতা হয়ে থাকে, তাহলে ভিন্ন সংস্কৃতি জানতে (যা পাঠকের অধিকার) যারা এই অনুবাদগুলো ইতিমধ্যে পয়সা খরচ করে কিনেছে, মুফতে নয় যে চাইলেই ছুঁড়ে ফেলে আরেকটা কিনে নেবে, এতোটা বাহুল্যতা/সামর্থ্য পাঠকের নাও থাকে পারে, এখন এই বইগুলো থেকে পাঠকের সে জানার অধিকার, কষ্টের পয়সা, বুকভরা আশা ইত্যাদির কি হবে?
শুয়োরের বেলায় এসে লেখকের 'ঢাক ঢাক-গুড়গুড়' আর কিছুই নয় নিজের ধর্মীয় সংস্কার, এটাও আমি মূল লেখায় বলেছি। যা সহজে বোধগম্য এবং পরিষ্কার। সে সংস্কার বেড়ি হয়ে লেখকের কলম চেপে ধরে কখনো ভেড়া, কখনো হরিণ, কখনো খাসী হয়ে যাচ্ছে। এবং আপনার কাছে তা অনুবাদকের স্বাধীনতা বলে মনে হচ্ছে। আমার বিশ্বাস, অনুবাদকের এ অযাচিত সংস্কার শুধু পাঠকের গন্ডি সীমাবদ্ধ করে নাই, বরং লেখক নিজেকেও বেঁধে রেখেছে (কে জানে বইটি পড়ার সময় হয়ত শুয়োরের অংশগুলোতে লেখক চোখ বন্ধ রেখেছিলো কিনা!)। কারণ অনুবাদ করার আগে অনুবাদককে একটি ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে হয়, অনুবাদক যদি নিজে একটি আলাদা সংস্কৃতি নিতে না পারে, তাহলে সাধারণ পাঠক তার কাছ থেকে কি পাবে! যার সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে আপনি বলেছেন পাঠককে (শিশু-কিশোরকে) অস্বস্তিতে না ফেলে বা কোনো সাংস্কৃতিক হোঁচট না দিয়ে গল্প উপভোগের উদ্দশ্যে অনুবাদক এমনটি করে থাকতে পারেন। ঠিক এই জায়গাটাতে আমার আপত্তি, শিশুমনের গ্রহণ ক্ষমতা আমার, আপনার আর আমাদের সন্মানিত অনুবাদকের চেয়ে ঢের বেশী। শিশু কল্পনায় শূকর কোনোমতেই আনা যাবে না এই ধারণা অনুবাদক পেলো কোথা থেকে সেটা আমি আসলেই বুঝি নাই। শিশু কল্পনায় পাহারা আরোপের যে তাড়না অনুবাদকের লক্ষ করেছি তারই সমালোচনায় 'অধিকার' শব্দটি এসেছে। যা এতোটা লিটারেলি না নিলেও হয়।
আপনি কি প্রমাণ করতে বলছেন সেটা পরিষ্কার না। শিশুদের পাঠ্যবই যেখানে খৎনা হয়ে গেছে, প্রথম শ্রেণীর বাচ্চাদের পড়ানো হয়, "ও তে ওড়না চাই"। সেখানে শিশু সাহিত্য বেছে বেছে শুয়োর কে খাসী, ভেড়া বানানো তো লেখক অনুবাদকের অধিকারই বটে!
আজ ২১ মার্চ Harmony Day। 'অধিকার' নিয়ে আক্ষরিক 'কচলাকচলির' চেয়ে গুরুত্বপূর্ন হলো, সাংস্কৃতিক সহবস্থানে আমাদের শিশু-কিশোরদের মনন কতটুকু উপযোগী, তা নিয়ে ভাবা! এ সাহিত্য/ অনুবাদ্গুলো এতে কতটুকু অবদান রাখছে। Everyone belongs এ মানসিকতা তাদের গড়ে উঠছে তো!
জানা ছিলো না
[quoteঅনুবাদকের ধর্মীয় সংস্কার নিজের খাবার টেবিলের মধ্য সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল, সেখানে লরা বা আলমাঞ্জোর খাবার মেনু বদলানোর অধিকার একজন অনুবাদক পেলো কোথা থেকে, তা আর জানা হলো না!]
জানা হলো
আরোও জানা হলো, ব্যক্তিগত সংস্কার সাহিত্যে উগরানো অনুবাদকের অধিকারের আওতাভুক্ত। আলোকিত হলাম, ধন্যবাদ।
বাব্বাহ! আপনি এতো চেতছেন কেন!!!
****************************************
চাইলাম কামান, কাস্তে পেলেও নাহয় মানতাম, ধনেপাতা গছিয়ে দিলেন যে বড়!