দেড়েদের বটগাছে আবার ফকির বাবার আছর হয়েছে- সঙ্গে আছে কয়েকশ' জ্বীন। জ্বীনে কারো ঘাড় মটকায়নি। তবে মটকাতে কতক্ষণ! গাঁয়ের লোক তাই ভয়ে-আতঙ্কে তটস্থ। তাছাড়া ভয় পাওয়াটা আবহমান গ্রাম-বাংলার জীবনযাত্রারই অবিচ্ছেদ্য অংশ; মরণনেশা।
মর্দাঘাটের কিনার থেকে ঝোপ-জঙ্গলের বুকচিরে বোয়ালমারির মাঠে ঢুকে গেছে যে খালটা, তার শেষ মাথায় ভাঙ্গাচোরা একটা জমিদার বাড়ির পাশেই ঠাই দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী প্রকা- একটা বটগাছ। দেড়েদের বটগাছ। মোজাম দেড়ে এর বর্তমান মালিক তাই এই নাম। প্রায় রাতেই ভূতের শিশুর রক্ত হিম করা কান্না ভেসে আসে সেই গাছ থেকে। মানব শিশুর মতো। তবে তীব্রতায় বহুগুণ- কয়েক মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। তা নিয়ে চলে বিস্তর গবেষণা। নানাজনে আবিষ্কৃত হয় নানা কিংবদন্তি। যারটা যত ভয়ংকর তারটা টিকে থাকে দাপটের সঙ্গে। বাকিগুলো স্তিমিত হয়ে যায়। ভয়ের এই রসনায় ইদানিং যুক্ত হয়েছে আরেকটা মশলা। গ্রামবাসীরা তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করে সে রসনার শেষ চুমুক। রাত একটা কি দেড়টার পরে বটগাছ থেকে ভেসে আসে তুমুল হুটোপুটির শব্দ। বটগাছে বানর কি হুনুমান বাস করে- তাও নয়। গভীর রাতে বটতলায় গিয়ে আসলেই জ্বিন-ভুত কিংবা ফকির বাবার আসর বসে কিনা খোঁজ নিয়ে আসে এমন দুঃসাহস কার আছে? বরং জ্বিন-ভূতের তত্ত্বটা মেনে নিয়ে বদ্ধ ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, কিংবা আখড়া জমিয়ে ভয়ের কলকেয় সুখটান দেয়। সত্যি বলতে কি, মদ-গাঁজাখোরদের নেশা হয়তো চেষ্টা করলে ছোটানো যায়; ভয়খোরদের নেশা ছোটানো বোধহয় ফারাওরাজদের পিরামিডের রহস্য উদঘাটনের চেয়েও শক্ত কাজ।
দেড়েদের বটতলার কিংবদন্তিটা লবণযোগে জালি তেঁতুলের মতোই মুখরোচক, নরবলির মতোই ভয়ঙ্কর। আর এই ভয়ঙ্কর নেশা নিয়েই ঘাটে চলছে বিস্তর পর্যালোচনা। হাবু ডাগা, ভোটকা মধুর মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক তুমুলে উঠেছে। কথাটা তোলে ভোটকা মধু। গরুর পিঠে লেগে থাকা ময়লা পানিতে ভিজিয়ে বিচালি দিয়ে ডলতে ডলতে বলে, 'হাবু শুনেচিস, দেড়েদের বটগাচে আবার ফকিরবাবা ফিরে এয়েচে!'
'ধুরো, ফকিরবাবা না ছাই! কনতে হয়তো রাতি এট্টা হুনুমান এসে থাকে তার ঠিক নেই, তাতেই উনারা ভয়ে আকাটা!' নদীতে প্রথম ডুবটা দেয়ার আগে জবাবটা দেয় হাবু ডাগা।
'আচ্ছা, তোর কি আল্লহ-খুদার ভয় হবে না কোনোদিন? মরে গেলি দেখা যাবে এতো বড়াই কনে থাকে!' হাবুডাগা ভুস করে মাথাটা তুলতেই বলে ভোটকামধু।
'একেনে বড়াইর কী হলো বল তো? আর আল্লাহ-খুদার কথায় বা আসচে কেন? বলচিস তো ফকির বাবা আর জ্বেন-পরির কথা-'
'ওই একই ব্যাপার,' ভোটকা মধু বলে। 'জ্বেন-পরিকে অবিশ্বাস করা মানে তো ঈমানের বরখেলাপ করা।'
'তুমি ইমানের ন্যাওড়া জানো?' রেগে ওঠে হাবুডাগা। 'একবার রাতি গিয়ে দেখেচিস দেড়েদের বটতলায়?'
'আমার যাওয়ার কী দরকার? আমি তো জানিই ওকেনে কারা থাকে; সাহস থাকে তো তুই গিয়ে পরমাণ দে না ওগাছে ফকির বাবার দলবল নেই।'
'পরমাণ একদিন দোবো- তোর ফকিরবার মুণ্ডু ছিঁড়ে আনব- ঠিক- সেদিন দেখিস!' বলে দ্বিতীয় ডুবটা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু বজ্রহুঙ্কারের কম্পনে মূর্তির মতো জমে গেল হাবুডাগা- ‘কী বললি হারামজাদা! আমার বটগাছে ফকিরবাবা নেই?’ মুহূর্তে পাল্টে যায় হাবুর মুখম-লের অভিব্যক্তি। এই গলা একজনেরই আছে গাঁয়ে। হাবুডাগা যমের মতো ভয় করে তাঁকে। মোজাম দেড়ে। বাপের মহাজন। বাপের সামনে মুখোটি করতে পারে কিন্তু এই লোকটার সামনে পড়লে কোথায় হারিয়ে যায় ওর নব যৌবনের উদ্ধত চাঞ্চল্য! দুষ্টু ছেলের হাতের কাঠির ঠোকর খাওয়া কেন্নোর মতো নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে চাই নিজের দেহের আড়ালেই।
'তোর বাপকে একবার জিজ্ঞেস করে দ্যাখ না- ফকিবাবার কাহিনি তো ফজলে বেশ ভালো কৈরেই জানে।' কাঠের বাটের ছাতাটা মাথায় দিয়ে আরেকটু এগিয়ে এসে গলাটা আরেকটু চড়িয়ে বলেন মোজাম দেড়ে।
হাবুডাগা নিরুত্তোর। বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়তে চাই ভোটকা মধু। কিন্তু মোজাম দেড়ের সামনে সে ধৃষ্টতা দেখানোর ক্ষমতা ওরও নেই। শুধু হাবুডাগা বা ভোটকা মধু কেন সুবৃহৎ গ্রামটার তাবৎ জনতার কারোরই নেই সে সাহস। এমনকি থানার বড় দারোগা কিংবা বিডিআর ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার পর্যন্ত তাকে সমঝে চলেন। তবে মোজাম দেড়ের সামনাসমনি কথা কেউ বলতে না পারলেও আড়ালে-আবডালে নানাজন নানা কথা বলে। এই যেমন তার চারখানা বিয়ের পর আরেকখানা করবার খায়েশের কথা, বড় ছেলের শ'পাঁচেক জমির মালিক বনে যাওয়ার কথা, ছোটপক্ষের ছেলেদের নিয়েও অনকে কথা হাওয়ায় ভাসে। আর তার নামের শেষে দেড়ে পদবিটা লাগানোর ধৃষ্টতা তো গাঁয়ের লোক অনেক আগেই দেখিয়েছে। অবশ্য দেড়ে টাইটেলটাকে মোজাম দেড়ে অলংকার বলেই গণ্য করে। লম্বা দাড়ির জন্য একটা উপনাম যদি নামের পিঠে সেঁটে যায় তবে সেটা তো মুসলমানিত্ব পোক্ত হওয়ারই লক্ষণ।
কণ্ঠ, খাওয়া-দাওয়ায় তাঁর অহঙ্কার স্পষ্ট হলেও সাজ-পোশাকে সেসবের বালাই নেই মোজাম দেড়ের। এ নিয়ে নবিজান বিবি একটা কইতে গেলেই পাঁচকথা শুনিয়ে দেন তিনি- 'জামা ছিঁড়া হলিও আমি মণ্ডল, জামা না থকলিও মণ্ডল। আমার হাঁকে বাঘে-মোষে একঘাটে পানি খায়। বিচার মজলিশি আলাদা কৈরে চেয়ার পাতা থাকে। তোমার মতো ছিঁড়া জামার কথাও কেউ তোলে না, ছাতির বাট নিয়েও কারুর মাথাব্যাথা নেই।'
আজ যে বাড়িতে মোজাম দেড়ে বাস করছেন সেই বাড়িটার পূর্বতন মালিক মৃণাল চাটুজ্জের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের দাঙ্গায় দেশভাগের গ্যাঁড়াকলে গ্রামে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। শুধুমাত্র ইছামতীর কারণে শতভাগ হিন্দু অধ্যুষিত শ্যামকুড় গ্রামের পিঠে সেঁটে যায় পাকিস্তানী লেবাজ। তেমনি ওপারের শতশত মুসলিম প্রধান গ্রামগুলোর গায়ে মেখে যায় হিন্দুস্থানী গন্ধ। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পারস্পারিক শত্রুতা উত্তোরোত্তোর বৃদ্ধি পেলেও এপারের হিন্দু আর ওপারের মুসলিমরা সমঝোতা করে সম্পত্তি বিনিময় আইন পাশ করে। অর্থাৎ এপারের কোনো হিন্দু গিয়ে ওপারের যে বাড়িতে উঠবে, বিনমিয় আইন অনুসারে সেই বাড়ির মালিক এপারে ওই হিন্দুর ভূ-সম্পত্তিসহ বাড়ির মালিক হবে। ফলে এক বছরের মধ্যেই শতভাগ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটা পরিণত হয় আশি ভাগ মসুলিম অধ্যুষিতে। বাকি হিন্দুরা মাতৃভূমির টানে এপারেই থেকে যায়। ঢাকা, নোয়খালি, কুমিল্লা, টাঙ্গাইলসহ উত্তরবঙ্গীয় মঙ্গাপিড়িত মানুষেরা দলে দলে এসে গ্রামের জনসংখ্যার সাথে সাথে মুসলিম সংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি করে।
মোজাম দেড়ে ওরফে মোজাম্মেল হক বিনিময় প্রথার হাত ধরে ওপার থেকে পাঁচ সন্তান আর দুই বিবিকে নিয়ে এদেশে এসে মৃণাল চাটুজ্জের ভিটে মাটির মালিক হন। সেই সূত্রেই প্রত্যেক ঝুরিতে ঝুরিতে মিথ জড়ানো বটগাছের মালিক বনে যান তিনি। বটগাছের পূর্বের নামের সাথে হিন্দুয়ানী গন্ধটা মুছে ফেলার তাগিদ অনুভব করে গ্রামবাসীরা। চাট্টুজ্জের-বটতলার পরিবর্তিত নাম হয়, দেড়েদের বটতলা। বটতলার নানা মিথের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল অলৌলিক ক্ষমতাধর এক সাধুবাবার নানা আজব কীর্ত্তিকলাপের কাহিনি।
যুগ-যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিমের রক্তের সাথে বয়ে বেড়ানো জাত্যভিমানের বীজটা এতটুকু উর্বর জমি পেলেই অঙ্কুরিত হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মহিরূহ আকার ধারণ করতে সময় নেয় না। তাই নব্য মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ গ্রামের লোকেরা উপযুক্ত প্রতিপক্ষ না পেয়ে শেষমেষ চাট্টুজ্জ্যের বটতলার ইতিহাস আগাপাশতলা বদলে দেবার প্রয়াশে ব্রত হয়। তাই শুধু নাম পরিবর্তনে সন্তুষ্ট না থেকে এর মিথলোজি পরিবর্তন করাটাও নৈতিক দায়িত্ব মনে করে। তারা প্রচার করে কিংবদন্তির ওই সাধুবাবা নাকি আসলে হিন্দু সাধুবাবা নন; মুসলিম ফকিরবাবা। মুসলমান ফকিরবাবা বলেই তাঁর পক্ষে অলৌকিকসব কারবার করা সম্ভব হতো। হিন্দু সাধুদের ক্ষমতার দৌড় তাদের জানা আছে।
হিন্দুদের পিঠে সংখ্যলঘুর তকমা সেঁটে গেছে রাতারাতি। পরিস্থিতির বাস্তবতা তারা ভালোই বোঝে- তাই কিংবদন্তিতুল্য বটগাছটার নাম পরিবর্তন তারা মুখ বুঁজে সহ্য করেছে। তাই বলে বটতলার ইতিহাসও পরিবর্তন করবে! কিন্তু করার তো কিছু নেই। মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টি করে আগেই নরকের খড়িকাঠ হয়ে বসে আছে। এখন নতুন করে সাধুবাবাকে ফকির বাবা সাজানোর পায়তারা কেবল পাপের বোঝা বৃদ্ধিরই নামান্তর। মা কালী এই অবিচার সইবেন না- তাদের এই যা ভরসা।
উত্তুরে লোক ফজলে কানা। উত্তর ঠিক উত্তরবঙ্গ নয়, কুষ্টিয়া জেলার উত্তরাঞ্চলই এ গাঁয়ের লোকেদের কাছে আসল উত্তর। ভাষাগত ব্যবধানের কারণেই উত্তুরে শব্দটা জুড়ে রিফিউজডদের সাথে পার্থক্য তৈরি করা হয়। তেমনি কুমিল্লা অঞ্চলের লোকেদের ত্রিপুরা আর ঢাকা অঞ্চলের লোকেদের বলা হয় ঢাকালে। ঢাকালে আর ত্রিপুরাদের আলাদা কলোনি থাকলেও উত্তুরেদের বাস স্থানীয় হিন্দু আর রিফিউজড মুসলমানদের সাথে।
মোজাম দেড়েদের বাড়িতে মাইন্দারি করে সংসার চালায় ফজলে কানা। ত্রিশ বছর যাবৎ এই তার পেশা, জীবিকার একমাত্র উৎস। অবশ্য ছেলেরা বড় হয়ে আর বাপের পথ মাড়ায়নি। কেউ পরের জমিতে মজুর বিক্রি করে, কেউ একজোড়া হালের গরু কিনে পরের ক্ষেতে লাঙ্গল বিক্রি করে, বাঁকা পথে হেঁটে ক্ষুদ্র ব্ল্যাক মার্কেটের তকমা গাঁয়ে সেঁটে মোটমুটি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ফজলের বয়স হয়েছে তাছাড়া একটামাত্র সচল চোখ নিয়ে স্বাধীন হওয়ার কথা সে চিন্তাই করতে পারে না, ছোট ছেলেটাও অকম্মার ঢেঁকি। তাই বাকি জীবনটাও যে মোজাম দেড়ের মুখাপেক্ষি হয়ে কাটিয়ে দিতে হবে সে বাস্তবতাটুকু ফজলে অনুধাবন করতে পারে। রাতে খেতে বসে ব্যাপারটা কনিষ্টপুত্রকে বোঝাবার চেষ্টা করে ফজলে, ‘বাবা হাবিবুর রহমান?'
'কিছু বলবা নাকি আব্বা?’ হাবুডাগা ভালোই জানে তার জনক দু-চারটে উপদেশ দেয়ার আগে এভাবেই 'বাবা' সম্মোধন করে কথা শুরু করে।
'কার ভাতডি খাইবার লাগছ বাবা?'
'তোমার ভাত আব্বা।' পটল পোড়া মাখানো ভাত দলা পাকাতে পাকাতে বলে হাবুডাগা।
'হু, ভাতডি তো আমার লয়-'
হাবুডাগা অবাক হয়, কী বলতে চায় তার বাপ- পরের বাক্যটা শোনার জন্য বাপের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
'হঁ ঠিকোই বুলছি, ভাতডি আমার লয়, দেড়েলের। এই বিষ্টি-বাদলার দিনডিতে কুন ব্যাডা চারডি ভাত খায়ি ঘোমবার যায়? দেড়েলের বাড়িত্ কাজডি কইরবার আচি বুলেই ভাতের মুখডি দেখবার পাইচ্চ। সেই দেড়েলের সাত্ মুখুটি কইরবার সাহস তুমি কুন্ঠি পাইছ বাপ?'
দুপুরের ঘটনা মনে পড়ে যায় হাবুর। কিন্তু সে তো মুখোটি করেনি! দেড়েল অসময়ে ঘাটে আসবে জানলে কি আর সে বটগাছের ফকিরবাবার কথা তুলত? বজ্জাৎ লোকটা ঠিকই বাপের কাছে নালিশ করেছে। একরাশ ঘৃণা মেশানো ক্ষোভ এসে কিলবিল করে হাবুডাগার মগজের ভেতর- ধমনি বেয়ে নেমে ঠিক গলার ভেতর এসে পাকস্থলির আহবানে নিচে নামা চিবানো ভাতের পথরোধ করে দাঁড়ায়। তবু মুখ ফুটে কিছু বলে না হাবু। বাপের মুর্খতার জন্য দুঃখ পায়। বিশটাকা দিয়ে দু'শো টাকার কাজ করিয়ে নেই মোজাম দেড়েল- এই উপলব্ধিটা নিজে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে বাপকে করানো যাবে সেটা ভালো করেই জানে হাবুডাগা।
'আর কয়ডাদিন সবুর করো, তখন তুমাদের ভাত আর খাবো না, তুমাদের খাওয়াব।'
'হালারপুতে কয় কী, জমিদারী পাইছস লাকিরে? আমাগোর খাওয়াইব!'
বাপের গালি ঠাণ্ডা মাথায় হজম করে হাবু। বাপ থামলে বলে, 'মাল টানার কাজ পেইচি আব্বা, সবেদ ভাইর দলে।
'কয়দিন কইরবি এই কাম, লবাবের ব্যাটা লবাব! স্ববাবডি হইচে তো চুরের লাহান, তুরে কাজে কয়দিন রাখবি সিডা আমি ভালোডি করি বুঝবার পাইছুনি।'
তবুও রাগে না হাবুডাগা। তেল ফুরিয়ে আসা টিনের ল্যাম্পটার সলতে কাঠি দিয়ে উসকে বলে, ‘আব্বা, মানুষ কী সারাডা জেবন একরকম থাকে, বদলায় না? এবার আমি সত্যি সত্যি বদলে গিইচি- সীমান্তরেখা-১দেইখো তুমি।'
'দেখা যাবিনি, কয় কুটি ট্যাক্যা কামাইবার পারস? এবার ভাতডি তারাতারি খায়ি ল, লম্পের তেল ফুরাইবার আইতেছে।' ছেলের অবয়বে প্রত্যয়ের ছাপ লক্ষ্য করেই হয়তো ফজলে কানার মন নরম হয়ে যায়।
ভাত শেষ করতে পারে না হাবু। কোথা থেকে একটা গান্ধি পোকা এসে পড়ে ভাতের ওপর। বোটকা গন্ধে ভরে যায় সারা ঘর। থালায় পানি ঢেলে ভাতসহ পানিটা নিক্ষেপ করে উঠোনের ভেজা মাটিতে। গায়েবী কায়দায় কোথা থেকে এসে হাজির হয় কেলে নেড়িটা। প্রথমে বুভুক্ষের মতো খাবল মেরে, পরে ভাতের সংখ্যা বিশ-পঞ্চাশের কোঠায় এসে ঠেকলে জিব দিয়ে একটা একটা করে খুঁটে পাকস্থলিতে চালান করে দেয়।
আবছা আলোয় কুকুরটার খাওয়া মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল হাবুডাগা। ঘোর দুর্দিনে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মতো তার ভাইয়েরাও হয়তো আটাঘুটা খেয়ে কিংবা না খেয়ে বিছানায় গেছে। অথচ একটা গান্ধি পোকার দৌলতে পথের কুকুরটা শান্তিতে ভাত দিয়ে উদরপূর্তি করছে। বহুল প্রচলিত একটা ধর্মের বাণী মনে পড়ে যায় হাবুর- 'যার যেখানে যে রিজিক অদৃষ্টে লেখা আছে তা রদ করার ক্ষমতা কারোর নেই-' ধর্মীয় বাণী বা মিথের সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের ধার হাবু কখনো ধারেনি, এখনো ধারে না। অদৃষ্টের লেখনের পরোয়াও সে করে না। তবে এই মুহূর্তে ওর কেন জানি মনে হচ্ছে, বরাতে নেই বলেই সে খালিপেটে বিছানায় যাচ্ছে। আর কুকুরটার বরাতে আছে বলেই মানুষের ভাগ্যে যা জুটছে না সেই খাবার সে খেতে পারছে পরম আয়েশে। তাই বলে অদৃষ্টের ওপর দায় চাপাল না হাবু। বরং ছোট্ট একটা গান্ধি পোকার ক্ষমতাই ওর কাছে অদৃষ্ট বা ভাগ্যবিধাতার চেয়ে বেশি মনে হলো।
হঠাৎ করে দেড়েদের বটগাছের পান থেকে বাতাসে পঙ্খিরাজে চেপে ভয়ের তরবারি হাতে ছুটে এলো ভূতের শিশুর নাকি সুরে কান্না। সেই ভয়েই কিনা কেরোসিনের ল্যাম্পটা সুপারনোভার মতো দপ দপ করে জ্বলে-কেঁপে উঠল কয়েকবার। কেঁপে কেঁপে উঠল মাটির দেয়ালের অঙ্কিত হাবুডাগার অন্ধকার অবয়বটাও। 'লাইলাহা ইল্লালাহু' পড়ে নিজের বুকে থুতু ছিটালো ফজলে কানা। ক্ষণিক পরেই তার ভাঙ্গাঘরের ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঝপ করে নামল পৃথিবীর বয়সী নিকষ কালো রাত।
মন্তব্য
বানান ভুলগুলো না থাকলে ভালো লাগতো। আমি নিজে খুব যে এক বানান বিশারদ তা বলছি না। কিন্তু সেখানেই আসল ঘটনা। আমি যদি দুই/চার লাইন পরপর হোঁচট খাই, তাহলে অন্য অনেক পাঠক/পাঠিকা সম্ভবত লাইনে লাইনে আটকে যাবে।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
দেখি সামনে কি হয়।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন