‘ছিঃ ছিঃ, আমার নাকের ডগা দিয়ে চুরি, বলিহারি সাহস তোর!’ বিল্টুর পিঠে শপাং শপাং কঞ্চির লাঠি চালাতে চালাতে বললেন
হেকমত স্যার। ‘লোকে কী বলবে? কী বলবে, বল্। আমরা স্কুলে চুরি শেখাই! চুপ করে আছিস কেন হারামখোর, উত্তর দে...’
টিফিনের ফাঁকে স্কুলের পাশে রায়বাবুদের আমবাগানে আম চুরি করতে গিয়ে হেকমত স্যারের হাতে ধরা পড়ে গেছে বিল্টু। হেকমত স্যারের নামটা যেমন, তেমনি দশাসই তাঁর চেহারা। মুশকো জোয়ান, শুধু পেছন দিকে অড়হর ক্ষেতের লাইনের মতো একসারি চুল ছাড়া মাথার বাকিটুকু চকচকে টাক। আর এই চেহারায় যখন অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন তখন শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয়, জুনিয়র শিক্ষকরা পর্যন্ত কেঁপে ওঠেন।
পড়া না পারলে কিংবা ছোট-খাটো দুষ্টুমি করলে ছেলেয়েদের গায়ে কখনো হাত তোলেন না। তবে মিথ্যা কথা বললে, বড়দের অসম্মান করলে কিংবা অন্য কারো বই, খাতা, পেন্সিল, টাকা ইত্যাদি চুরি করলে আর রেহায় নেই। তখন তিনি মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।
আচ্ছামতো পিটুনি দিয়ে, কান ধরে ‘আর কখনো চুরি করবে না’ এই শর্তে রাজি করিয়ে অবশেষে বিল্টুকে ছেড়ে দিলেন তিনি। স্কুলের সব ছেলেয়েদের ভিড় এখন আমতলায়- অন্যের পিটুনি খাওয়া দেখতে মজা লাগে কিনা! স্যার বিল্টুকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন- কেন চুরি করা উচিত নয়, চুরি করলে লোকে কী বলে- ইত্যদি।
স্যারের ধোলায়টা সহজে হজম করতে পারল না বিল্টু। শুধু মারটা হলে কথা ছিল না; এতগুলো ছেলেমেয়ের দাঁত কেলানো হাসি তার শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। ভাবছে, মহা যন্ত্রণার স্কুলে আর নয়- তবে স্কুল ছাড়ার আগে হেস্ত নেস্ত একটা করে যেতে হবে। মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল বিল্টুর। টিফিনের পরে ক্লাসে আর ফিরে গেল না। স্কুলের পাশে কাঁঠাল গাছটার আড়ালে আধলা একটা ইট হাতে নিয়ে লুকিয়ে থাকল।
ছুটির পর হেকমত স্যার সেই পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আচমকা গুলির বেগে একটা ইট উড়ে এসে আঘাত হানল তাঁর মাথায়। জ্ঞান হারানোর আগে এক পলকের জন্য দেখতে পেলেন, গাছের আড়াল থেকে বিল্টু পালিয়ে যাচ্ছে।
বেশ কয়েকমাস হলো বিল্টু আর স্কুলে আসে না। হেকমত স্যার মনে মনে অনুশোচনায় পোড়েন আর ভাবেন, তাঁর জন্যই ছেলেটা আজ স্কুলে আসে না; সেদিন যদি ওভাবে না পিটিয়ে বুঝিয়ে বলতেন, তাহলে হয়েতো...
তারপর বেশ কয়েকবার তিনি দপ্তরিকে বিল্টুদের বাড়ি পাঠিয়েছেন, বিল্টুর বাবার সাথে আলাপ করেছেন, কিন্তু তাকে আর স্কুলমুখো করা যায়নি।
পরের বছর একদিন।
স্কুল ছুটির পর বাজারে গেলেন স্যার; তরিতরকারি কিনে তবে বাড়ি ফিরবেন। স্যারের বাড়ি স্কুল থেকে পাঁচমাইল দূরে। বাজার করতে গিয়ে স্যার অনেক দেরি করে ফেললেন। রাস্তায় চোর ডাকতের ভয় নেই, তাই হেকমত স্যার তাড়াহুড়োও করছেন না।
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। লাল টকটকে একটা থালা যেন। স্যার তখন এসে পৌঁছালেন নিজর্ন এক মাঠের ভেতর। সেখানে খালের ধারে জংলা একটা ফলের বাগান। নারকেল, আম, কাঁঠাল আর লিচুগাছে ভরপুর বাগানটা। স্যার সাইকেল চালিয়ে বাগানটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কে যেন হেঁকে উঠল, ‘স্যার দাঁড়ান!’
স্যার চমকে উঠলেন, ক্ষণিকের জন্য সাইকেল থামালেন। ঝোপঝাড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে লম্বা একটা দা হাতে সেই বাগান থেকে বেরিয়ে এলো বিল্টু। হিম হয়ে উঠল স্যারের পুরো শরীর। ভাবলেন, আজ বুঝি আর রক্ষা নেই।
‘ভালো আছেন, স্যার?’
‘ভালো-ভালো-’ ঢোক গিলতে গিলতে উত্তর দিলেন হেকমতস্যার।
‘স্যার মনে আছে, আম চুরির জন্য আমাকে মেরেছিলেন?’
‘আজ বুঝি আর রক্ষা নেই,’ ভয়ে কাঁপতে বিড় বিড় করে বললেন হেকমতস্যার। ‘নির্জন মাঠে একলা পেয়ে ছোকরাটা বুঝি প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না।’
‘কী ভাবছেন স্যার?’ স্যারকে আরেকবার চমকে দিয়ে বলল বিল্টু। ‘একটু দাঁড়ান স্যার, আমি আসছি,’ বলে দা হাতে ফলের বাগানটার দিকে ছুটল সে। বাগানে ঢোকার আগমুহূর্তে হঠাৎ থেমে, স্যারের দিকে ঘুরে বলল, ‘চলে যাবেন না কিন্তু স্যার!’
স্যার একবার ভাবলেন পালাবেন কিনা। কিন্তু ভয়ে-আতঙ্কে তাঁর শরীর জমে গেছে যেন; তাছাড়া বিল্টুর সাথে আরো কতজন আছে তা কে জানে- পালানোর চেষ্টা করলে তারা হয়তো পেছন থেকে কুপিয়েই তাঁকে মেরে ফেলবে! স্যার মনে মনে দোয়া-কালাম পড়তে শুরু করে দিয়েছেন।
বিল্টু ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তার একহাতে সেই লম্বা দা আর আরেক হাতে এককাঁদি কচি ডাব। স্যারের নাকের ডগায় এসে ডাবটা এমন ভাবে কোপাতে লাগল যে, এই ডাব খেয়েই সে স্যারকে এভাবে কোপাবে! কিন্তু কুপিয়ে ফুঁটো করা ডাব স্যারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, ডাব খান।’
স্যার ভাবলেন বুঝি মেরে ফেলার আগে তাঁকে দয়া করে একবার ডাব খাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে বিল্টু। ‘না’ বলার সাহস পেলেন না। তাঁর হাত থেকে ডাবটা নিয়ে চুমুক দিলেন। একটা শেষ হতেই আরেকটা এগিয়ে দিল বিল্টু। স্যার সেটাও শেষ করলেন। এরপর আরেকটা। স্যার তখন একটু সাহস করে বললেন, ‘আর পারব না।’
বিল্টু জোর করল না। তারপর অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল সে। দা ফেলে দিয়ে হঠাৎ সাইকেলের প্যাডেলের ওপর রাখা স্যারের বাম পা’টা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিন স্যার, আমি পাপ করেছি। কথা দিচ্ছি আর কেনোদিন চুরি করব না। বিশ্বাস করুন স্যার, এই ডাবও চুরি করা নয়। এই ফলের বাগানটা আমাদের স্যার।’
‘তোদের নিজের বাগান থাকতে সেবার পরের গাছে আম চুরি করেছিলি কেন?’ স্যার যেন আবার হেকমতস্যার হতে শুরু করেছেন।
‘গতবার আমাদের বাগানে আম ধরেনি স্যার,’ করুণ সুরে কৈফিয়ত দিল বিল্টু। ‘এখন আমাকে মাফ করে দিন, স্যার।’
স্যার সাইকেল থেকে নেমে বিল্টুর হাত থেকে শান্তভাবে পা ছাড়িয়ে নিয়ে গলটা চড়িয়ে বললেন, ‘কাল থেকে যদি স্কুলে না দেখি, তবে পিঠের চামড়া তুলে লবণ মাখাব! কথাটা মনে থাকে যেন-’
তারপর হাঃ হাঃ করে হেসে বিল্টুকে বুকে জড়িয়ে নিলেন হেকমতস্যার।
মন্তব্য
ভাল লাগলো! কিন্তু শেষটুকু যেন এক্সপেক্টেড
লাইন ব্রেকে আর প্যারা ব্রেকে একটু সমস্যা হয়েছে (মনে হয় কোথাও থেকে কপে করে পেস্ট করেছেন)। তাই পড়তে একটু ধাক্কা খেতে হয়।
ধন্যবাদ!
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
ধন্যবাদ
ঠিকই ধরেছেন। আমি সরাসরি সচলের পেজে লিখি না। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ডকুমেন্টসে লিখে সেখান থেকে কপি করে তারপর সচলে পোস্ট করি।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ভাল লাগলো।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ মহারাজ
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নতুন মন্তব্য করুন