‘তোমাদের মনটা এখন কুমোরের চাকে ওপর বসানো একতাল নরম কাদার মতো। এখন তা দিয়ে তুমি যা বানাতে চাও তাই পারবে। হাঁড়ি চাইলে হাঁড়ি, কলস চাইলে কলস। কিন্তু এই কাদা যখন শুকিয়ে মাটি হয়ে যাবে কিংবা পোড়ালে বাসন-কোসন হবে তখন শত চেষ্টা করলেও তাকে একটুও এদিক-সেদিক করতে পারবে না।’ আমার এক পাইমারি শিক্ষকের বয়ান এটা।
তখন কি ছাই বুঝতাম কথাগুলোর মর্ম। একটু যখন বড় হলাম, সামাজিক জীবনের জটিলতাগুলো যখন একটু একটু করে মর্মস্পর্শ করতে শুরু করল- তখন মনে হতো শিক্ষাগুরুর ওই উপদেশবাণীতে কোথায় যেন একটু ফাঁক আছে। ঠিক ঘড়ির কাঁটা ধরে নিয়ম-কানুনের ঘেরাটোপে জীবনকে আটকে ফেলে ব্যক্তিক জীবনে সফল হয়তো হওয়া যায় কিন্তু জীবন সরোবরের চারধারটা ঠিক ঘুরেফিরে দেখা হয় না। কিন্তু আরও যখন বড় হলাম, জীবনকে, সমাজকে, পৃথিবীকে অল্পবিস্তার জানতে বুঝতে শিখলাম তখন মনে হলো বাল্যশিক্ষকের কথাগুলি একেবারে ফেলানা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না আবার অকপটে স্বীকার করে নিতেও কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকে। কিঞ্চিৎ হলেও বুঝলাম দেশ-কালের সীমানায় যেমন জীবনের স্বরূপ আটকে থাকে না, আবার ন্যূনতম শৃংখলতা ছাড়াও জীবন ঠিক জীবন হয়ে ওঠে না। আজ যে শিশুর জন্ম হলো সে যে সমাজে জন্মালো যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সে বেড়ে উঠবে, সেখানকার কারিগরদের নির্দেশিত ছাঁচেই তার অনাগত কঠিন-দুষ্পরিবর্তনীয়-জীবন কাঠামো লাভ করবে।
নিজের জীবনের কথা যদি বলি, ট্রেনে চেপে ঢাকা টু দিল্লি ভ্রমণের মতো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সমাজ-সংসারের পোড় খাওয়া শক্ত-সমর্থ পৌরষের দাবী করা দূরে থাক, জীবন পথের দশমাইল যাত্রার অভিজ্ঞতা লাভ করলেও ধন্য হতাম। তবে গোযানে চেপে সামান্য মেঠোপথ পাড়ি দিতে গিয়ে পথের দু’ধারে দলিত মথিত দুর্বাঘাসের হাহাকার শুনেছি, পানাভরা পুকুরে বর্ষার রিমঝিম ছন্দ শুনেছি, পানকৌড়ির ডুব সাঁতার দেখেছি, এক পায়ে ভর দিয়ে বোকা বোকা ভান মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ধবল বকের দুরভসন্ধি আঁচ করেছি, দেখেছি চুনোপুটিদের ওপর ত্বরিৎ মাছরাঙার আগ্রাসন। আরো নব্বইের গণ-আন্দোলন দেখেছি, ভাতের অভাবে আটাঘোটা খেয়ে কিংবা না খেয়ে প্রতিবেশীর নিশিযাপন দেখেছি, কাটাতাঁর ছাড়া সীমান্ত দেখেছি, দেখেছি পাপিষ্ঠদের সাথে গলাগলি করে বড় দলগুলোকে ক্ষমতার মসনদে চড়তে।
আকৈশর কেঁটেছে নিভৃত পল্লির অজ-পাঁড়া গায়ে- যেখানে পাশের গ্রামগুলো নাকি অন্যদেশের। যৌবনের শুরতেই মফস্বলে, তারপর বছর দুয়েক হলো রাজধানীর বায়ান্নোগলির ঘুর্ণিপাকে খেই হারাচ্ছি। স্পষ্ট ভাবেই তাই জীবন সংসারের হাজার রূপের মধ্যে অন্তত তিনটিকে জানা হলো। গাঁয়ে বসে বিডিয়ার বিএসএফ, ব্লাকার আর ক্ষুধার দানবীয় দৌরাত্ম্যে দিশেহারা মানুষের ভিড়ে হাসফাঁস করেছি, মফস্বলের জীবনকে মনে হয়েছে ইস্পাত কঠিন, কিন্তু রাজধানীর জীবন? শওকত ওসমান জাহান্নাম হইতে বিদায় হয়েছেন দেড় দশক আগে, কিন্তু আজ আমরা কোন জাহান্নামে? মহাশূন্যের ওপার থেকে কী তিনি জবাব দেবেন? দেবেন না! দেবনই বা কেন? জবাব তো তিনি দিয়েই গেছেন।
শুরু করেছিলাম এক শিক্ষকের উপদেশবাণী দিয়ে। এখন মনে হয়, তিনি কথা বড় অসার বলেন নি। চাকার ওপর ঘুর্ণিত কর্দমপিণ্ডে কুমোরের হাতের পরশ নিপুন না হয়ে যদি কেঁপে যায়, তখন সেটা বাসন না হয়ে হবে বকের ঠ্যাং জাতীয় কোনো অপাত্র। কুমোর হয়তো নরম বিকালাঙ্গ বাসনকে শুকাতে দেবে না, কিন্তু আমার মতো ছন্নছাড়াদের যারা কারিগর তাদের ধৈর্য্য বড় কম, আয়ুও কম। তা না হলে ছন্নছাড়াদের জাহান্নামের পথ দেখিয়ে শওকত ওসমান কেন নিজেই জাহান্নাম থেকে বিদায় নেবেন! অন্তত কাদা শুকিয়ে মাটি হবার আগেই সেটাকে নতুন করে গড়িয়ে দিয়ে না যেতেন সেটাকে দলা করে চাকের পরে বসিয়ে অন্তত যেতে পারতেন। তাহলে অন্তত রামুর ঘটনায় দেশের সুশ্রী বাসন-কোসনদের সাথে উল্লাসে মাততে পারতাম; রাজপথে নেমে ‘জেলের তালা ভাঙব মোল্লাজিদের আনব’ জাতীয় শ্লোগানে গলা ফাটাতে পারতাম, মোবাইল ফোনে, কম্পিউটারে জোরে জোরে ইহুদি-নাসারেদের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করা জিকির-ওয়াজ শুনতে পারতাম কিংবা মার্কস-লেলিনের ঝাণ্ডা উড়িয়ে ভারত নামের সীমান্তঘাতকের বিরোধীতা করতে গিয়ে পাকিস্তান নামের জাতশত্রুর স্তুস্তি গাইতাম। কিংবা আমেরিকা নামের মহাদানবের মুখে ছাই দিতে গিয়ে চীন নামের ধূর্ত স্বার্থপরের কোলে আশ্রয় নিতাম। মুজাহিদ (এটার আরেকটা নাম আবার জঙ্গি), কমরেড কিংবা মধ্যপন্থি আমি হই নি- বলা উচিৎ, হারুন-অর-রশিদের সামান্য ক্রীতদাস আর সৌদামিনীর মতো তুচ্ছ মালোগিন্নিরা হতে দেয় নি।
ছোটবেলায় নাটক পগল ছিলাম। রেডিওর নাটক। শনি-বুধ আর শুক্রবারের রেডিও বাংলাদেশ’র আর বৃহস্পতি-রবিবারে আকাশবাণীর। সেদিন বুধবার, রাত দশটায় রেডিওর মিষ্টি এক নারী কণ্ঠ ঘোষণা করল, ‘স্রোতা বন্ধুরা এখন শুনবেন নাটক ক্রীতদাসের হাসি। রচনা- শওকত ওসমান, পরিচালনা- অমুক, প্রযোজনা- অমুক। নাটক ক্রীতদাসের হাসি।
সেই সুচনা। সুচনা আত্মদন্দ্বের, সুচনা আমার আমিত্বকে খোঁজা। সেদনি নাটক শেষ হলেও তার একটা স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল আমার বুকের নরম কাদায়। ‘বাগদাদের বাদশা হারুন-অর-রশিদের কানে এলো অভিসাররত ক্রীতদাসের স্বস্ত্রীর সাথে হর্ষধ্বনি। বাদশাহেরও সখ হলো ক্রীতদাসের হাসি শোনার। কিন্তু ক্রীতদাসের আত্মসম্মানে বাধল। যে হাসি বরাদ্দ শুধু প্রিয়ার অভিসারে, সে হাসি শুনতে চাওয়া মহারাজের অন্যায়। সেই অন্যায় কিছুতেই মানতে পারল না ক্রীতদাস। রাজার হুকুম অমান্য করার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখাল। রাজার রোষে পড়লে যা হয়, তার পিঠেও নেমে এলো চাবুকের খড়গ। কিন্তু মৃত্যুদুয়ারে দাড়িয়েও তার অকপট উচ্চারণ, ‘টাকা দিয়ে ক্রীতদাসের জীবন কেনা যায়, কিন্তু তার হাসিকে নয় (!!!)।
স্কুলের ধর্ম বই, ক্যাসেট প্লেয়ারে ইসলামী জারিগান আর মোল্লাদের ওয়াজ-নছিয়তের কল্যাণে খলিফা হারুণ-অর-রশিদ আমাদের কাছে তখন ইসলামের প্রধান চার খলিফার মতোই মহৎপ্রাণ মহাশয়। তিনি এতোখানি অত্যাচারী হতে পারেন এতোবড় অধর্ম করতেন পারেন, একথা নাট্যকার লিখতে পারেন কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। মাকে বললাম সে-কথা। আমার অর্ধশিক্ষিত মা হারুন-অর-রশিদের মহত্ব সম্পর্কে অতটা সজাগ ছিলেন না। তাই তার দ্বিধান্বিত উত্তর, ‘কী জানি বাবা, কে ভালো রাজা কে মন্দ রাজা, বোঝা বড় দায়!’
কিন্তু আমি আমার বিশ্বাসে অটল- হারুণ-অর-রশিদ এমন হতেই পারেন না। নিশ্চয় শওকত ওসমান সাহেব নাটকটা বানিয়ে লিখেছেন। লোকটার ওপর রাগ হলো। এতো সুন্দর একটা নাটকে একজন মহৎ ব্যক্তিকে ভিলেন না সাজালেও পারতেন। সেদিন কিছুটা সন্দেহ থাকলেও আজ আমি ঠিক জানি ইতিহাস থেকে নয় শওকত ওসমান বানিয়েই লিখেছিলেন গল্পটা। তবে সেদিন নাটকের গূঢ়ার্থটা না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝি- খলিফা হারুন-অর-রশিদের রূপকের আড়ালে লেখক কী ইঙ্গিত লুকিয়ে রেখেছিলেন। তবে না বুঝলেও সে কালে মনের ভেতর একটা দ্বন্দ্ব ঠিকই তৈরি করেছিল নাটকটা। বলা চলে আমার ভেতরের নরম কাদায় সমাজ নামের কুমোরের নিপুন হাত প্রথমবারের মতো কেঁপে উঠেছিল। সেদিন শওকত ওসমানকে শ্রদ্ধা করতে পারি নি কিন্তু মনে রেখেছিলাম।
এর পরে আমার জীবনচাকে পাঠ্যপুস্তকে সেই কর্দমপিণ্ডে বার বার কেঁপেছে কারিগরের হাত। ‘ভাঙ্গাকুলা’য় ইব্রাহিম খাঁর দ্বারা কুমোরের হাত কেঁপেঁছে, ‘রিলিফ-ওয়ার্ক’-এ আবুল মনসুর আহমেদ, মহেশ-এ শরৎবাবু, একটি তুলসি গাছের কাহিনি বর্ণনায় সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, এবং সৌদামিনী মালো গল্পে আবারো শওকত ওসমান সেই হাত কাঁপানোর নেপথ্যের কারিগর। যেহেতু শওকত ওসমানের জীবন-কর্ম এখানে প্রাসঙ্গিক তাই অন্যগুলোর প্রসঙ্গে না গিয়ে সৌদামিনী মালো গল্পটার প্রসঙ্গে কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
সৌদামিনী মালো। গল্পের প্রধান চরিত্র। নাম শুনেই ধর্ম আর জাত দুটোই স্পষ্ট হওয়া যায়। কিন্তু শওকত ওসমানের মনের সাথে না হোক নামের সাথে মুসলমানিত্ব রয়েছে। শরৎবাবুও গফুর নিয়ে ’মহেশ’ গল্প লিখেছিলেন। কিন্তু সেখানে প্রধান চরিত্র মুসলমান হলেও প্রেক্ষাপট হিন্দুসমাজ। তাই নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ সেখানে ছিল না। জানি না এ নিরপেক্ষতার কারণেই কি শওকত ওসমান কাহিনির বর্ণনা শুরু করলেন মধ্যম পুরুষের মাধ্যমে যেখানে পাঠকের সাথে উত্তম পুরুষও প্রভাবহীন দর্শক কিংবা শ্রোতা। যাই হোক, তাঁর উদ্দেশ্য যে ব্যর্থ হয়নি তা কিন্তু প্রমাণিত। কেননা কেউ নিরপেক্ষতা নিয়ে টুঁ-শব্দটিও করেন নি।
সৌদামিনী শক্তিমত্তার দিক দিয়ে হৈমন্তি, বিলাসীর চেয়ে যোজন যোজন ভিন্ন দূরত্বে। বরং তাকে আমারা নারী চরিত্রের সাথে তুলনায় না গিয়ে কতগুলো পুরুষ চরিত্রের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি- ভিখু (প্রাগৈতিহাসিক), কুবের (কুবের) কিংবা করালীর (হাঁসুলি বাঁকের উপকথা) সাথে। কুবেরে চেয়ে চারিত্রিক দৃঢ়তায় সৌদামিনী বরং এগিয়েই ছিল, যেহেতু কুবের উপায়ন্তর না পেয়ে সমাজ সংসার ছেড়ে কপিলার সাথে ঘর ছেড়েছিল। তবে ভিখু কিংবা করালির সমান বললে আশা করি ভুল হবে না। হ্যাঁ শেষ পর্যন্ত সে ভিখু-করালির মতো সমাজ-সংসারকে অবজ্ঞা করে অপারাজিত থাকতে পারেনি, ব্রাদার জনের কারসাজিতে নিজের অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যেতে দিয়েছিল, কিন্তু তার আগে সে খেল কম দেখায় নি।
দাম্পত্য জীবনের শুরুতে সৌদামিনী অসুখি ছিল না। কিন্তু মাতৃডাক না শোনার অক্ষমতা যেমন নারীকে কুরে কুরে খায়, পুরুষও কিছুটা হাটকুড়ো অপবাদের ভয়ে কিছুটা বংশের প্রদিপ জ্বালার কেউ থাকল না বলে হীনমন্যতায় ভোগে। হীনমন্যতায় বা বলি কেন। পুরষ তো আর নারীর মতো অবলা নয়, তার বলিষ্ঠ দুটো হাত আছে, ঋজু-পেটানো মেরুদণ্ড আছে, আরেকটা সংসারের ভার বইবার মতো চওড়া কাঁধ আছে, জমিন আঁকড়ে থাকার মতো শক্ত-সমর্থ দু’খান পাও যখন আছে তখন হীনমন্যতায় ভোগার মতো অপৌরষিক ভঙ্গুরাতা অন্তত সৌদামিনী স্বামীর জগদীশের ছিল না।
আবহামান বাংলার পৌরষিক বিশ্বাস- বন্ধ্যা যদি হয় তো সে নারী, পুনর্বার বিয়ের পিড়িতে বসলেই হাটকুড়ো অপবাদ ঘোচে- এই বাণীকে সানাইয়ের সুরে ঝংকৃত করার যাবতীয় ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল জগদীশ। কিন্তু সৌদামিনী আসতী না হতে পারে তবে, সাবিত্রিও নয়। তাই জগদীশের দ্বিতীয় বিয়ের খায়েস সে মেনে নিতে পারেনি। নিতে পারেনিটাই বলি কেন- নেয় নি। সন্দেহ বোধহয় লেখকেরও ছিল। অন্তত নাসির মোল্লার বয়ানে তেমন আভাসও দিয়েছেন- ‘‘বেচারা বর সাজার অবসর পায় নি। হঠাৎ মরে গেল। অথচ বিয়ের কথাবার্তা ঠিক। তার মৃতুটা আজও রহস্যই রয়ে গেছে। কু-লোকেরা রটিয়ে দিলে, সৌদামিনী তাকে বিষ খাইয়েছে। বংশ রক্ষা হোক কিন্তু অপরের সন্তানে নয়। সৌদামিনী হয়তো ভেতরে ভেতরে একটা দুর্জয় পণ করে বসেছিল। এ সব খোদাকেই মালুম। এসব ক্ষেত্রে কোন মেয়ে কী করে বোঝা বড় দায়।’
ভেতরে ভেতরে সন্তানের জন্য গুমরে মরছিল সৌদামিনীও। তাই স্বামীর মৃতুর পর কোথা থেকে হরিদাস নামের এক শিশুকে কুড়িয়ে এনে নিজের ছেলের মতো বুকে আগলে লালন-পালন করে।
জগদীশের মৃত্যুর পর তার জেঠতুতো দাদা মনোরঞ্জন, যে নাকি আবার স্বদেশী করত, অপরদিকে জগদীশ সরকারের পেয়ারের লোক- তাই তাদের সম্পর্কটা সাপে নেউলে- জগদীশের মৃত্যুর পর তার চোখ পড়ে বিধবা সৌদামিনীর ওপর। বলা ভালো সৌদামিনীর সম্পত্তির ওপর। কিন্তু সৌদামিনী তাতে সাই দেয় নি। তখন সৌদামিনীর সামনে একে একে এসে জুটল নানান উটকো ঝামেলা- আজ ঘরের চালে ঢিল পড়ে তো, কাল বাগানের কলাটা মুলোটা সাবাড় হয়। প্রথম প্রথম ব্যপারটা হালকাভাবে নিলেও পরে কোঠর হতে হয় সৌদামিনীকে। কতটা কোঠার তা আবার নাসির মোল্লার বয়ানে শোনা যেতে পারে- ‘‘... সৌদামিনীর শরীরর গৌর আর মুখ সুন্দর হলেও, কঠোর হওয়ার মতো যথেষ্ট তেজ ছিল। অবরে-সবরে এই মানুষ আবার হীরার চেয়েও শক্ত হতে পারে।....মাঝে মাঝে রাত্রে বন্দুক ছুঁড়ত। কমিশনার সাহেব জগদীশকে নিজের বন্দুক দিয়েছিলেন বখশিস-রূপে। আস্ত্রখানা তখন সৌদমিনীর হাতে আছে। তাছাড়া তার তাক আশ্চর্য। মনোরঞ্জন ফেল মারলে... সৌদামিনীর হাতে কয়েকটা লোক ছিল। তারা জমিনের চাষী, কয়েকজন। তারা বলত, মায়ের অন্নে প্রতিপালিত, মার অপমান তো হতে দিতে পারি নে। মনোরঞ্জণের সেও এক ভয়। ছোটলোকগুলো কখন কী করে বসে সে তো বলা যায় না।’
এই যে চারিত্রিক দৃঢ়তা, এই দুঃসাহস- কোনো নারী রাতে বন্দুক ছুঁড়ছে- একথা সেসময়ে দূরে থাক, এই একবিংশ শতাব্দীর অত্যধুনিক বাংলার জাঁকালো শহরের মেরেরাও কি দেখাতে পারবে! যদি নাই পারে, ‘সৌদামিনী গল্পটা’ শিকল ভাঙ্গার গান আর স্বয়ং সৌদামিনীকে সেই গাণের বিদ্রোহী গায়িকা বললে কি অত্যুক্তি হবে? মনে হয়, না। অনেকে আবার বলতে পারেন, সৌদামিনী বৃত্ত ভাঙতে গিয়ে মানুষের আদিম প্রবৃত্তি যা নাকি অস্বীকার করা অসম্ভব, তাকে অস্বীকার করছে- সেটা কি লেখকের কল্পচোখে দেখে কোনো পরাবাস্তব চিত্র নয়? মোটেও নয়। বয়স তার ভাটার দিকে, যৌবনের তাড়না তার ছিল না। হরিদাসকে দিয়ে মাতৃত্বের হাহাকার মেটাতেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ওখানেই শেষ হলো না সৌদামিনীর বিরুদ্ধস্রোতে লড়ায়। সৌদামিনীর মন জয় করে সম্পত্তি জয়ের যে গূঢ় পরিকল্পনা মনোরঞ্জন এঁটেছিল তাঁর কফিনে শেষ পেরেক যখন কোথাকার কোন হরিদাস এসে ঠুকতে যাচ্ছে তখন সে অন্য পরিকল্পনা ফাঁদল। গাঁয়ে রটিয়ে দিল সৌদামিনীর পোষ্য পুত্র জাতে নমশূদ্র নয়, সাক্ষাত ব্রাহ্মণ। আবহমানকাল ধরে হুজুগে মাতালের রক্ত বয়ে বেড়ানো গ্রামবাসীরাও হুজুগ রটানোর জন্য একটা প্রসঙ্গ পেল। সৌদামিনীও তো দমবার পাত্র নয়। সে হলপ করে বলল, তাঁর পোষ্যপূত্র নমশূদ্রই। কিন্তু হুজগেদের যা স্বভাব- একবার যা রটেছে তার শেষ না দেখে ছাড়বে না। তাই স্বয়োৎযোগে বনের মোষ তাড়িয়ে তারা প্রমাণ দাখিল করল, হরিদাস আদতে ব্রাহ্মণ। ধর্ম দিনে খেলা! এতোদিন যে চাষীরা সৌদামিনীকে মাতৃজ্ঞান করত তারা ধর্মনাশের ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। ‘‘কী ভয়ানক শাস্ত্রবিরুদ্ধ পাপকর্ম। ব্রাহ্মণের জাত মেরেছে এক শূদ্রানী। রাম, রাম। ... আগে শত্রুতা বা ঈর্ষা যা বলো, ছিল ব্যক্তিগত। এবার তা সমাজগত হয়ে দাড়ালো...’’ অতএব শুরু হলো আবারও উৎপিড়ন। এখন তো আর ঠেকাবার কেউ নেই, তাছাড়া ক্রুসেড যে কারণে রক্তাক্ত হয়, গান্ধীর অহীংসবাণীও যে রক্তস্রোতে বাঁধ দিতে পারেনি, সেখানে সৌদামিনীর বন্দুকই বা আর কত ফাঁকা আওয়াজ করবে?
এহেন পরিসিস্থিতে ঔপনোবেশিক আমলে হিন্দু মুসলানরা যা করত, বুদ্ধিনাশ হয়ে সৌদামিনী তাই করল- বানরকে রুটি ভাগ করতে ডাকা- ধূর্ত পাদ্রী ব্রাদার জনকে টানল সমাধানের আশায়। ফল যা হবার তাই হলো। পাদ্রী একুল-ওকুল দুকুলই বজায় রেখে নিজের কুল বাঁধিয়ে নিল ফন্দি এঁটে। এতে অবশ্য সৌদামিনী বা ধর্মপূত্রদের কারও স্বার্থ রক্ষা হয় না। তখনই আবার স্বমূর্তি ধারণ করে শেষ বোমাটা ফাটায় সৌদামিনী, ‘‘শোনরে অভাগীর ব্যটারা... ধর্মপূত্র যুধিষ্টিরের দল’’ বলে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের এক করুণ বর্ণনা বের হয় সৌদামিনী মুখ থেকে, তারপার, ‘‘...আমার হরিদাস মুসলমান’’!
সেই বোমার স্প্রিন্টে যারা ক্ষতবিক্ষত তারা তো থামলই, কানে তালা ধরে হতভম্ব হয়ে গেল দর্শকের আসনে যারা বসে তামাশা দেখছিল তারাও। তাদের সাথে হতভম্ব হয়ে যায় শওকত ওসমানের পাঠকরাও- তাঁর লেখনির মুন্সিয়ানায়।
মুন্সিয়ানা গল্পের রূপকতায়ও- ‘কৃতদাসের হাসি’তে যেমন একটা গূঢ়ার্থ ছিল। তেমনি সৌদামিনীর মাধ্যমে শওকত ওসমান যেমন শিকল ভাঙ্গার গান শুনিয়েছেন, পাশাপাশি সে সময়ের গোটা সমাজেচিত্রের সারমর্ম একটা চরিত্রের ভেতর সন্নিবেশ করেছেন নিপুণ দক্ষতায়।
কিন্তু বোমা ফাটানোটা ফল কিছু দিলেও শেষ পর্যন্ত ব্যুমেরাং হয়ে ধেয়ে আসে তার দিকেই। কারণ হঠাৎ নিজেকে মুসলমানরূপে আবিষ্কারের ধাক্কাটা সামলাতে পারে নি হরিদাস। সেই রাতে চুপি চুপি সৌদামিনীকে ছেড়ে পালিয়ে যায় সে। যে সত্তার জন্য এতো কিছু, সেই মাতৃত্বই যখন রক্ষা পেল না তখন পায়ের তলার মাটি সরে গেছে ভেবে সৌদামিনী ব্রাদার জনকে ডেকে খ্রিস্টান হয়ে গেল। নিজের সম্পত্তি উইল করে দিল মিশনের নামে। হাসিল হলো বিদেশী হায়েনার কূটিল স্বার্থ, উদ্দেশ্য।
সৌদামিনীর খ্রিস্টান হওয়ার ব্যাপরাটা যত সহজে বললাম, আসলে সেটা শওকত ওসমান অত সরলীকরণ করে করেছিলেন কিনা জানি না। এও হতে পারে গফুর প্রাণপ্রিয় মহেশকে মেরে একই সাথে দুর্ভিক্ষ আর ঘুনে ধরা তৎকালীন হিন্দু সমাজের ওপর যে প্রতিশোধ নিয়েছিল, সৌদামিনীও ধর্মন্তরিত হয়ে ধর্মপূত্রদের ওপর সেই প্রতিশোধ নিল।
রূপকতার আড়ালে যে চেহারাই লুকিয়ে থাক, ‘সৌদামিনী মালো’ গল্পটি শেষ পর্যন্ত শিকল ভাঙার মন্ত্রই জোরে সোরে আউড়ে গেছে। আজও যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও আউড়াবে। সেটা কী ধর্মীয় গোড়ামী, কী লালসা, কী ঔপনোবেশিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে- যেটাই বলি না কেন।
‘সৌদামিনী মালো’ প্রথম পড়েছি বছর দশেক আগে। এরপর পড়াশোনার পরিধিটা যখন পাঠ্যপুস্তকের বলয় থেকে বেরিয়ে এলো তখন জীবনের জটিল সমীকরণ আরো জটিল হয়ে উঠল। এতদিন যা শিখেছি যা বুঝেছি তা প্রয়োজনের বা অপ্রয়োজনের তুলনায় নস্যি। কত শত দিকনির্দেশকের কতশত দর্শন আজও অজানা। তবে কিছুটা হলেও ভাবতে শিখেছি, প্রতিটা মানুষ যেমন আলাদা আলাদা সত্তা, তার চিন্তা-চেতনায় তেমন সতন্ত্র। তাই কারো সাথে কারো কারোটা মিলবে এই চিন্তা করা বা কারও মধ্যে নিজের চিন্তার প্রতিফলন আশা করাও স্রেফ নির্বুদ্ধিতা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যয়, শওকত ওসমানরা সেই জাতের লেখক যারা নিজের চেতনাকে অন্যের ভেতর পরিচালিত না করে, প্রতিটা চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতহীন থেকে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে গেছেনে। সেখানে একজন পাঠকই ঠিক করবে, কাহিনিটা নিয়ে সে কী ভাববে। আমি এতোক্ষণ ‘ক্রীতদাসের হাসি’ বা ‘সৌদামিনী মালো’ নিয়ে এতো প্যাঁচল পাড়লাম সেটাও একান্তই আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা। অন্যের সাথে মিশ নাও খেতে পারে।
আমার এক মার্ক্সপন্থী চাচা বলেছিলেন, ‘সব বই পড়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়? দুনিয়ায় ভালো বইয়ের সংখ্যা নেয়াৎ কম নয়। এক জীবনে তার ক্ষুদ্রাংশও পড়ে শেষ করতে পারবে না।’
চাচার কথাটা হয়তো ঠিক, মূল্যবান। কিন্তু আমি তার সাথে একমত হতে পারি নি। না পারার কারণটাও একান্তই আমার নিজস্ব। আমি গাঁদা গাঁদা সায়েন্স ফিকশন পড়ি, অ্যাডভেঞ্চার পড়ি, মাসুদ রানা, কাকাবাবু, তিন গোয়েন্দা পড়ি, বিভূতিভূষণ পড়েছি, জিম করবেট, ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শার্লক হোমস পড়েছি। এগুলো পড়তে ভালো লাগে। তুলনায় ভালো বই বলতে যা বোঝায় তার পঠন সংখ্যা নগণ্য। সেগুলো যে ভালো লাগে না, তাও নয়। কিন্তু প্রথমোক্তগুলো পড়ে মজা পাই।
সেদিন কোনো এক দৈনিকের পুরোনো সংখ্যায় দেখলাম, ‘শওকত ওসমান তার এক ছাত্রের উদ্দেশ্যে বলেছেন, সব ধরনের বই পড়বে। তাহলে সত্যটা এমনিই তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। নইলে যে কোনো একপক্ষের বই পড়লে তাদের চিন্তা চেতনা তোমার মাথায় ঢুকে যেতে পারে।’ শিকল ভাঙার প্রেরণা পেতে এর চেয়ে ভালো পরামর্শ আর কী হতে পারে?
প্রিয় কথাশিল্পি চলে গেছেন প্রায় দেড় দশক আগে, কিন্তু রয়ে গেছেন আমাদের সৃজনে, মননে। ৯৫ তম জন্মবার্ষিকীর প্রাককালে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
আগামী ২ জানুয়ারী মহান কথাশিল্পি শওকত ওষমানের ৯৫ তম জন্মবার্ষিকী। সেদিনটা অনেক দূর। তাই আগেভাগেই লিখে ফেললাম তাঁকে নিয়ে দু’চারটি মনের কথা।
মন্তব্য
ভালো লাগল, আপনার অন্য লেখাগুলোর চাইতে আলাদা স্বাদের।
শওকত ওসমানের গল্প সমগ্র কেবল হাতে আসল, শীঘ্রই পড়ব আশা রাখি।
facebook
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ভালো লাগলো মনের কথা। কিছু বানান ভুল, টাইপো আছে। ঠিক করে দিয়েন।
ধন্যবাদ
ঠিক করে দিচ্ছি
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
বানানের ভুলগুলো চোখে পড়ে। একটু মনোযোগী হলেই ভাল, না?
ঠিকই বলেছেন নিলয়দা, য়থাসম্ভব ঠিক করে দিলাম।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নতুন মন্তব্য করুন