সীমান্তরখা-১, সীমান্তরখা-২, সীমান্তরখা-৩
ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না মোজাম দেড়ে। বিরক্ত হলেন বিডিআরদের ওপর। তবু দরজা খুলতে হলো।
‘কী ব্যাপার, এতো রাতি দরোজা খুইলে নিলে কেনো গা?’ বিরক্তি উগরে দিলেন খাকি পোশাকের বিডিআর জওয়ানদের ওপর।
‘চাচা,’ মুখ খুলল এক জওয়ান। ‘সারগর্তটা কি আপনার?’
‘হ্যাঁ, আমার বৈকি।’ মোজাম দেড়ের দ্বিধাহীন জবাব। ‘তা...?’
‘মানে, আপনার সারগর্তে খুঁড়ে আমরা ছ’বস্তা চিনি পেয়েছি। ওগুলো বোধহয় আপনার।’
রাগে লাল হয়ে উঠল মোজাম দেড়ের কৃষ্ণবরণ মুখমণ্ডল। কোনোমতে নিজেকে সামলে বললেন, ‘আমার বাড়ির চাকর-বাকরাও বিলাক করে না, এ কথা মুখ থেইকে ছাড়ার আগে একবার আমার সম্পক্যে খোঁজ-খবর করা উচিৎ ছিল তুমাদের।’
‘চাচা, আপনি খামোখাই চটছেন, খোঁজ-খবর না করেই আপনার বাড়ির দরজা খুলিনি আমরা। এই তো এক লোক বলে গেল এই মাল আপনার। আপনি নিজেই বড় ব্লাকার।’
‘কী, যত বড় মুখ নাই তত বড় কথা! কোন সমইনভাই বলেছে আমি ব্লাক করি। কিডা সে!’ রেগে গলাটা আকাশ সমান উচ্চগ্রামে তুলে চেঁচাতে শুরু করেছেন মোজাম দেড়ে। ‘বলো কিডা? চুপ কেন? বলো? তুমাদেরও দেকি সাহস কম নাই। ভালো কইরে যাচাই না করেই আমাকে ব্লাক মার্কেট সাজানোর পায়তারা! বলো ক’ট্যাকা ঘুষ খেয়ে আমাকে বেইজ্জতি করতি এয়োচো?’
‘চাচা আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।’ মোজাম দেড়ের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে সমান তেজে বলে উঠল আরেক জওয়ান। ‘নেহাৎ বয়স্ক মানুষ বলে এখনো আপনার কোমরে দড়ি পরায়নি।’
‘কী!’ বিডিআরের ধৃষ্ঠতা যেন গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় মোজাম দেড়ের দেহমনে। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার সামনে দাঁড়িয়ে ছোকরাপানা বিডিআরের দল এভাবে কথা বলতে পারে। গলা উচ্চগ্রামে রেখেই বললেন, ‘জুইতে খাল খুলে দোবো হারামির দল! তোদের বড় বাপেরা পর্যন্ত আমার সামনে মুখ নিচ করে কতা বলে, কমনেগ্যারের বাল হইস্য বাল এসে আমার মুখির ওপর কতা! দ্যাড়া তোদের বাপের নাম ভুইলে দিচ্চি....’
তারপরেই যা ঘটে গেলো তা অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়! বিডিআরের এক জওয়ান ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল মোজাম দেড়ের গালে। রাগে ক্ষোভে উত্তেজনায় সাধারণত মানুষের কথা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মোজাম দেড়ের তা হলো না, গলাটা সপ্তাকাশে চড়িয়ে হাঁকলেন, ‘কালু, আলতা, বাবু, হকু, হাসেমআলি কিডা কনে আচিস শীঘ্রি আয়। শুয়োরের বাইচ্চারা আমার মেইরে ফেললে রে!’
কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে সেই হাঁক প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। সেই প্রতিধ্বনিকে অনুসরণ করে ছুটে এলো একদল শঙ্কিত মানুষের শোরগোল। লাঠি, ফলা, খুন্তা, কোদাল-- যে যা হাতের কাছে পেয়েছে নিয়ে ছুটে এসেছে দেড়ের আত্মীয় থেকে প্রতিবেশিরা। জনতার রুদ্ররোষ কি তা জানা ছিল না তরুণ জওয়ানদের, জানা ছিল না নিষ্ঠুর সীমান্তের সবচেয়ে তুচ্ছ প্রাণী বিডিআরদের অসহায়ত্বের কথা, জানা ছিল না জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা সেনাবাহিনীর থাকলেও তাদের নেই। পিঠে বহন করা অধুনিক অস্ত্রগুলোর মুরোদ কতটুকু সীমান্তের সংগ্রামী মানুষের জানা থাকলেও জানত না যুবা জওয়ানরা। বোকামীর দণ্ড কতাটা ভয়াবহ হত কে জানে-- রাইফেলধারী তার পিঠের রাইফেল খুলে আকাশ পানে দু-চারটে উড়ো ফায়ার করেছিল বলে রক্ষা। তবে আইনের লোকের গায়ে হাত তোলার অপরাধে মোজাম দেড়ে বড় আকারের ঝামেলা এড়াতে পারলেও, যুবা জওয়নেরা পারে নি। তবে বিডিআর বলেই কিনা কে জানে, হাতের অস্ত্রগুলো ব্যবহারের সাহস পায়নি উত্তেজিত আগন্তুকরা। তাছাড় সময়মতো মোজামদেড়ের মাথা ঠাণ্ডা হয়েছিল বলে, পরিস্থিতি দ্রুত অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলে ইউনিফর্মের কলার ছেঁড়া, কিংবা নাক থেকে মুখ থেকে সামান্য রক্ত ঝরা ছাড়া বড় কোনো আঘাতের আগেই মোজামদেড়ে সহমর্মীদের রোষ নিবৃত করতে পেরেছিলেন। হাজার খারাপগুনের ভেতর এটা বিরলতম ভালোগুণ তাঁর।
পাঁজচনের একজনের ঘাড়ে রাইফেল অথচ এমন উত্তম মাধ্যম! লজ্জায় অপমানে মিশে যেত চাইল যেন তরুণ জওয়ানেরা। এর মধ্যে ওয়ারলেস ক্যাম্পে খবর গেছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই স্বয়ং ক্যাম্পপ্রধান নায়েক সুবেদার দুজন অনুচর নিয়ে হাজির। হাতি আধুনিক অস্ত্র। তবে অস্ত্র থাকেলেও যে সে অস্ত্র যে ব্যবহার করা যায় না, সে বাস্তবতাটুকু সীমান্তে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া এই সেনানী ভালোই বোঝেন। বোকামীটা যে তার লোকজনই করেছে, বুঝেছেন ক্যাম্পছাড়ার আগেই। তাই শান্ত মেজাজেই বাইক থেকে নিজের ভার লাঘব করে ধীরে সুস্থে নামলেন। বেচারা জওয়ানদের দেখে সহনুভূতি দেখানো দূরে থাক, বরং ঝামেলাটা মোজাম দেড়ের সাথে বেঁধেছে শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। বিশ্রী ভাষায় জওয়ানদের গালিগালাজ করে, মোজাম দেড়ের কাছে মাপ চেয়ে তাদের নিয়ে ক্যাম্পে ফেরার আগে এ ঘটনার ন্যায্য বিচার হবে বলে দেড়েকে প্রতিশ্রতি দিয়ে গেলেন।
দেড়ের স্বজন আর প্রতিবেশিদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। দু’জন তিনজনে ভাগ হয়ে একে অন্যকে নিজের বীরত্বের বয়ান করছে। কে কয়টা ঘুষি চালিয়েছে, কার হাতে বিডিআরের নাক ফেটেছে, কার হাতে ছিঁড়েছে ইউনিফর্ম, দেড়ে নিবৃত্ত না করলে ব্যাটাদের অবস্থা কত খারাপ হতো-- এসব গল্প। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তো অবশ্যই। যারা দেরি করে এসেছে, তারা যে কত দুর্ভাগা এবং ঘটনার কথা শুনলে যে অবাক হতে হবে একথা আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করছে প্রত্যক্ষদর্শিরা। তা কেউ কেউ অবাক হচ্ছেও। কিন্তু যারা হচ্ছে না, তারা কেন হচ্ছে না তা, তারা কি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না, নাকি নিজের বর্ণনাটাই ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি এ নিয়ে বেশ চিন্তিত কথক। শেষ মেষ শ্রোতাকে আরো ভালোভাবে গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য আরেকজনকে ডেকে নিচ্ছে তাদের মাঝে-- যদি সে বুঝাতে পারে। কিন্তু গুঞ্জন বেশিক্ষণ থাকল না। থামল সেই সেই মেঘস্বরে। মোজাম দেড়ের কোঠাঘরের রোয়াকে বসে। ‘শোন তুমরা।’ গলা খাকারি দিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলে উঠলেন মোজাম দেঁড়ে। ‘বিডিআর যা করেছে করেছে। এখন বলোতো এই কাজ কিডা করালে?’
কোন কাজ? বুঝতে বাকি রইল না সমাবেশের কারো।
‘আমার মনে হয় পেছনের বাড়ির কেউ কইরেছে।’ অন্যদের জবাবের অপেক্ষা না করে মোজাম দেড়ে নিজেই জবাবটা দিয়ে দিলেন।
‘আমারো তাই মনে হয় দাদা,’ পিতামহের সাথে সহমত পোষণ করে মোজাম দেড়ে দ্বিতীয় পুত্র কালুর প্রথম পুত্র আলী আহম্মদ বাবু। ‘তমিজদ্দির ভাব চক্কর ভালো ঠ্যাকছে না ক’দিন। খালি বাড়ির আনাচ কানাচ ঘোরে। জিজ্ঞেস করলিই বলে, ‘এই একটু থানকুনির পাতা খুঁজচি। তুমার চাচির পেটে আমাশা হয়েছে তো। তা দেখোদিনি বাপু, সারাদেশ ঘেঁটে পালাম না। তা ভাবলাম বুধহয় তুমাদের লেবুগাছের তলায় থাকতি পারে।’’
‘আমিও দেখিচি চাচা,’ প্রতিবেশি হাসেমালিও একমত। তারপর দেখা গেল সমাবেশের সবাই সেদিকেই ঝুঁকছে। মহিলাদের মত সেদিকে গেলেও তার দৃষ্টি পেছন বাড়ির মহিলাদের দিকেই। কেউ তমিজদ্দির, কেউ আছেরদ্দির বউয়ের ঘাড়ে দোষ চাপায়। তাদের মত, হতভাগীগুলোই যত নষ্টের গোড়া। পুরষমানুষ আর কতক্ষণ বাড়ি থাকে, মাঠ থেইকে কাজ কইরে বাড়ি আসলিই মাগিনরা ফুস-মন্তর শুরু করে। বোকাকাণ্টা মিনসেগুলোও যেমন-- মেয়ে মানুষের কথায় ওঠে আর বসে! শেষমেষ নবীজান বিবির দিলেন বর্তালেন আসল কথা, ‘তমিজদ্দি, আছেরদ্দি কেউ নাই, ওদের বউরাও নাই, এই কাজ ওই বুড়ো মাগিডার। ভাতারখাগী সারাদিন ছেলেদের পেছনে আঠার মতে লেগে থাকে, কূট বুদ্দি শিখোয়। সবকডা ছেলেই মাগীর হাতের মুঠোয়।’
‘সে না হয় হইল, কেন্তুক সারগাদায় মাল রাখলে কিডা?’ বিড়বিড় করে বললেন মোজাম দেড়ে।
‘কিডা আবার! ওই মাগী আর ওর হাটকুড়ো ছেইলেরা--’
‘আমার মনে হয় অন্য কেউ, বাদলা মাতায় তমিজদ্দিদের কাজ বন্ধ। এ ঠিক মুটেদেরে কাজ।’ বলে ভিড়ের মাঝে এদিক ওদিক দৃষ্টি বোলালেন মোজাম দেড়ে। তারপর ফজলে কানার চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তাঁর। ক্ষণিকের ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলে ফজল কানার মেরুদণ্ড বেয়ে। এই হীমশীতল দৃষ্টির মানে তার জানা আছে ভালোমত।
‘ফজলে!’
‘জে, ভাইসাপ?’ কণ্ঠে ভয়মেশানো প্রশ্নবোধক স্বর।
‘তুমার কুলাঙ্গারডা নাকি মুটেদের দলে যোগ দিয়েছে?’
‘জে ভাইসাপ।’
‘তুমার কি মনে হয়, হাবু ছাড়া এ কাজ করার ক্ষমতা আর কারো আছে?’
‘জে, না ভাইসাপ।’ ফজল কানা জানে সরল স্বীকারোক্তিই কেবল বুড়োর রোষ থেকে তার ছেলেকে বাঁচাতে পারে।
‘ওর এট্টু বইলো তো, আমার সাথে দেখা করতি। আর এক কাজ করো মালগুনু বিডিআর নিয়ে যায় নি। ওগুনু তুইলে নিয়ে এসো। যে ব্লাকারের বাইচ্চার মাল তারও কপালে কষ্ট আচে। ক’ বস্তা, জানো?’
‘হু, দেখিচি। ছ বস্তা চিনি।’
চিনিই বটে। তবে ছ’ বস্তা নয়, ন’বস্তা। বাকি তিন বস্তা মোজাম দেড়ের আরেক মায়েন্দার বশির কেওটের সাথে ষড় করে সারগর্তে আবর্জনার নিচেই আপাতত লুকিয়ে রাখে ফজল কানা। এই প্রথম কুলাঙ্গার ছেলেটাকে মনে মনে স্যালুট জানায় সে। এতদিনে কাজের মতো কাজ হতচ্ছাড়াটা। বুদ্ধি করে মোজাম দেড়ের সার গাদায় না রাখলে চিনির বস্তাগুলো হয় বিডিআরের পেটে যেতো, না হয় হাভাতে চাষা-ভুষাদের। অবশ্য তাতেও ক্ষতি ছিল না হাবুডাগার। বিডিআরের তাড়া খেয়ে কোনো মাল যদি মাইর যায় তবে সে ভাগিদার মুটের দল নয়। লস মালিকেরই। বাকি ছ’ বস্তা নিয়ে মোজাম দেড়ে কী করবে, সেটা নিয়ে ফজল কানার মাথা ব্যাথা নেই। যে তিন বস্তা সে বশির কেওটের সাথে বাটোয়ারা করতে পারছে সেটাই এখন তার উপরি পাওনা।
(চলবে)
মন্তব্য
লেখাটা খুব ভাল লাগছে। সীমান্ত, অথাৎ ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত এবং ছিটমহল ইত্যাদি নিয়ে আমার ঔৎসুক্য বরাবর। সীমান্তে কিছু ঘোরাঘুরিও করেছি। এসবের ফল স্বরূপ বেশ কিছুদিন আগে (বছর খানেক বা তার কিছু বেশী) সচলে একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু মডুদের বোধ হয় সেটা পছন্দ হয়নি। যাক, আপনার লেখাটা অনেক ভাল হচ্ছে। চালিয়ে যাবেন আশা করছি।
চালিয়ে নেয়ার আশা রা্খি
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
আপনার উপন্যাসের বিষয়বস্তটা দারুণ ছিল, শুধু যদি আরেকটু মনোযোগ দিয়ে লিখতেন, ভাল হত বলে আমার ধারণা ।
ঠিক বলেছেন, মনোযোগটা আরো বাড়ানোর তাগিদ আমি নিজেও অনুভব করছি।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নতুন মন্তব্য করুন