বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৫ : আশশেওড়া

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৩/০৪/২০১৩ - ৩:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সূর্য পূব আকাশে উঁকি মারার ঠিক আগ মুহূর্ত। গায়ের ধূসর পথ। লাঙ্গল কাঁধে ফেলে গরু তাড়িয়ে মাঠে চলেছে কৃষক। গুরু খেদানো পাচনটা তার কোমরে গোজা। এক হাতে কাঁধের লাঙ্গল আরেক হাতে চিকন একটা গাছের ছোট্ট ডাল। কৃষক চলতে চলতে সেই ডালটা মুখে দিয়ে চিবুচ্ছে। কখনো বা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেটা দিয়ে দাঁত ডলছে। রাস্তার পাশে সকালের সোনারোদের অপেক্ষায় ভিড় করা শিশু আর মহিলাদের হাতে ওই একই জিনিস।
বলছিলাম এক-দেড় যুগ আগের কথা। এখন অবশ্য সময় বদলেছে। দাঁতনের বদলে অধিকাংশের হাতে উঠে এসেছে বাহারী সব টুথব্রাশ। তবে দাঁতনের আবেদন গাঁয়ে এখনো ফুরিয়ে যায়নি। কী দিয়ে তৈরি ওই দাঁতন?
কেউ কেউ অবশ্য নিম কিংবা ভাটামের ডাল ব্যবহার করে। তবে ওগুলো বড্ড তিতো তাই আশশেওড়ার ডালই বেশি জনপ্রিয়।
আবহমান গ্রাম বাংলার দাঁত সুরক্ষাকারী উদ্ভিদটার সাথে আজ একটু মোলাকাত করা যেতে পারে।

আশশেওড়া মূলত গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। গ্রামীণ বাংলার সর্বত্র এদের দেখা মেলে। যেকোনো পরিবেশে এরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।

পথের দু’ধারে, ফসল-ক্ষেতের আইলে-বেড়ায়, বাড়ির কাঁনাচে, পোড়ো বাড়ির ইটের খাঁজে, নদী-খাল বা পুকুর পাড়ে, বাগানে, বাঁছড়ায়, ঘোন ঝোপের আড়ালে-- কোথাও এদের বেড়ে উঠতে বাধা নেই।

আশশেওড়া ৩-৪ ফুট উঁচু হতে পারে। তবে কিছু কিছু গাছ ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।

আশশেওড়ার কাণ্ডের রং ধুসর। বেশ শক্ত। কাণ্ডের ১.৫-২ ফুট পর্যন্ত কোনো ডালপালা হয় না বললেই চলে। তবে মাথার দিকে অনেকগুলো ডালপালা গজায়। কাণ্ডের বেড় ১.৫-২.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে।

আশশেওড়ার মূলত বীজ থেকে জন্মায়। কিন্তু মূল থেকেও নতুন গাছ জন্মাতে পারে।

আশশেওড়ার পাতার রং সবুজ। কাণ্ডের গোড়ার দিকের পাতার রং গাঢ় সবুজ। গাছের মাথার দিকের পাতার রং হালকা সবুজ। পাতা একপক্ষল। উপবৃত্তাকার। পাতার দৈর্ঘ্য ৩-৪ ইঞ্চি। মাঝ বরাবর প্রস্থ ২-২.৫ ইঞ্চি। পাতা পাতলা, মসৃণ। আশশেওড়ার পাতা দিয়ে ছেলেমেয়েরা বাঁশি বানায়। বালাদেশের যেসব উদ্ভিদের পাতা দিয়ে বাঁশি তৈরি হয়, এর মধ্যে আশশেওড়ার বাঁশি উৎকৃষ্ট।


ছবি : সুশিল বাড়ৈ, projectnoha.org
আশশেওড়ার ফুল খুব ছোট। সবুজাভাব সাদা রঙের। মঞ্জরি বহুপুষ্কপক। ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিলিমিটার। ফুলে ৫ টা করে পাঁপড়ি থাকে। আশশেওড়া ফুল হালকা মিষ্টি গন্ধ যুক্ত।

আশশেওড়ার ফল সবুজ রঙের। মটর দানার চেয়ে সামান্য বড়। এক ঝোকায় ২০-৫০টা পর্যন্ত ফল থাকে। কাঁচা ফলের রং সবুজ।

পাকা ফলের রং গাঢ় গোলাপি। ফল গেলাকার। রসাল। বেশ মিষ্টি। সামান্য তিতাভাব আছে। পাখি ও শিশুদের প্রিয় ফল। ফলের ভেতর দ্বিবীজপত্রী গোলাকার বিঁচি থাকে।
অপু-দুর্গার কথপোকথানে আশশেওড়ার পাকা ফলের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া পথের পাঁচালি উপন্যাসের আম আঁটির ভেঁপু অংশে--

...ও দিদি ও ফল খাস নি!--দূর-আশশ্যাওড়ার ফল কি খায় রে! ও তো পাখিতে খায়---
দুর্গা পাকা ফল টিপিয়া বীজ বাহির করিতে করিতে বলিল--আয় দিকি--দ্যাখ দিকি--খেয়ে মিষ্টি গুড় যেন--কে বলেচে খায় না? আমি তো খেইচি।
অপু কঞ্চি কুড়ানো রাখিয়া দিদির কাছে আসিয়া বলিল--খেলে যে বলে পাগল হয়? আমায় একটা দে দিকি দিদি--
পরে সে খাইয়া মুখ একটু কাচমাচু করিয়া বলিল--একটু একটু তেতো যে দিদি--
--তা এট্টু তেতো থাকবে না? তা থাক্, কেমন মিষ্টি বল দিকি--কথা শেষ করিয়া দুর্গা খুব খুশির সহিত গোটাকতক পাকা ফল মুখের মধ্যে পুরিল।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পথের পাঁচালী
একাদশ পরিচ্ছেদ

ডাইনির মতো হাত তুলে তুলে ভাঁট আঁশ্যাওড়ার বন
বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো....জীবনানন্দ দাশ

আশশেওড়া একবর্ষজীবি নয়। বেশ কয়েক বছর বাঁচে। তবে সেটা ৫-৭ বছর হতে পারে। ১৫-২০ বছর নয়। আশশেওড়া পানি পেলে সারা বছর জন্মায়। সারা বছর ফুল-ফল দেয়।


ছবি : kymp.net
আশশেওড়ার ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম লেখা শেষ করার আগ মুহূর্তেও জানতাম না। কোলকাতার মৌসুমি মল্লিক নামের এক ফেসবুকীয় সুহৃদ নাম দুটো জানিয়ে ধন্য করেছেন।
আশশেওড়ার ইংরেজি নাম Rum berry. বৈজ্ঞানিক নাম Glycosmis pentophylla.

------------------------------------------------
এই সিরিজের অন্যলেখাগুলো--
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১ : শিয়ালকাঁটা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-২ : ভাঁটফুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৩ : কালকসুন্দা / কালকসিন্দা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৪ : আকন্দ


মন্তব্য

মহুয়া  এর ছবি

চলুক
ছেলেবেলায় যে সব জংলী ফল সুখাদ্যের অভাব মেটাত তাদের মধ্যে একটা ছিল এই গাছের পাকা ফল।
সুন্দর দেখতে এই গাছের গন্ধটাও বেশ সুন্দর, বিশেষ করে ফলের। যদ্দুর মনে পড়ে 'হা‍‍‌সকলি' নামে চিনতাম।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আমাদের্‌ এলাকার নামের সাথে আসল নামের মিল আছে বোধহয় বিভুতিভুষণের বাড়ির কাছে বলে।।। হাসি

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

শাব্দিক এর ছবি

আপনার সিরিজটা পড়ব বলে ভেবে রেখেছি। আজকে পড়লাম সব। খুব সুন্দর সিরিজ হচ্ছে। চালিয়ে যান।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ
চালিয়ে যাওয়ার আশা রাখি

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা এই গাছটাকে বলতাম 'মটকইলা গাছ'। ছোটবেলা এর গোলাপী ফল খেয়েছি। গোলাপী আবরণের ভিতরে কালো অথবা সবুজ রঙের বীজ থাকে। বীজ আর গোলাপী আবরণের মাঝামাঝি থাকে রসালো পদার্থ।ছোটদের অনেক প্রিয়।
ভাল লেগেছে আপনার লেখা।

সিরাজুল লিটন

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আমারও ভাল লাগছে এর স্থানীয় নামগুলো শুনে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সুলতান এর ছবি

আমাদের এলাকায় এইটাকে বলে আশশাইল। ছোটবেলার একটা অংশ আমার গ্রামে কেটেছে। তখন নানাবিধ ভাবে ব্যবহার করেছি এই গাছ। দাত মাজা, গুলতির হাতল বানানো ইত্যাদি কাজে। ধন্যবাদ রনি লেখাটার জন্য।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ইয়েস! আরেকটা দারুণ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন! গুলতির হাতল বানানো আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সিরিজটা মুগ্ধ হয়ে পড়ছি
চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, মুগ্ধতার জন্য

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

রাব্বানী এর ছবি

ছোটবেলায় এটার পাকা ফল খেতাম আর 'কান্ড' দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতাম

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

পাতা দিয়ে বাশি বানাননি?

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।