বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৬: কচুরিপানা

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৮/০৪/২০১৩ - ৮:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


পৌষের হিম দুপুর। সুয্যিমামার যেন উষ্ণতা ছড়ানোর গরজ নেই। তার ওপর মাঝে মাঝে উত্তরের হিমেল হাওয়া ছলকে এসে মেরদ- কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। ইছমতীকে যেন মনে হয় রুপালি মানচিত্রের ওপর আঁকা এক সবুজ বক্ররেখা। সবুজ! হ্যাঁ, সুবজই। বর্ষায় খরস্রোতা ইছামতীর পানিস্বল্পতার সুযোগ নিয়ে সবুজের লাগাম পরিয়ে দিয়েছে কচুরিপানারা। মাঝখানে গোসল করার জন্য গ্রামবাসীরা বের করে নিয়েছে গোল একটু খানি রুপালি বৃত্ত। বাকি সব কচুরিপানার রাজত্ব। অবশ্য প্রজা ছাড়া রাজ্য চালিয়ে সুখ নেই। তাই জমাট কচুরিপানার দঙ্গলে ঘাই মারে, শিং, মাগুর, টাকি নামের প্রজারা। চিংড়ির চটপটানি তো আছেই। ডুমুর পাতার আড়ালে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা মাছরাঙা কিংবা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো চিন্তিত ভঙ্গিতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুনো বক--ঝোপ বুঝেই কোপ দেয়। সব মিলিয়ে প্রকৃতির যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য মাঝ পৌষে দুই বাংলাকে বিভক্তকারী নদীটির পাড়ে সৃষ্টি হয় তার শতভাগ পূর্ণতা আসে ওই কচুরি ফুলের ফুলের শুভ্র দুলনিতেই।
প্রিয় সচল। ফিরে গিয়েছিলাম শৈশবের সীমান্তপারের জীবনে। যে জীবনে মেঠো ফুল-ফলের সাথে জড়িয়ে আছে কিছু জলজ উদ্ভিদের সৌন্দর্যও। আজ তাদের একজন--কচুরিপানার বর্ণনা তুলে দিলাম।

কচুরিপানা বাংলাদেশের শাপলা-পদ্মার পর সবচেয়ে পরিচিত জলজ উদ্ভিদ। তবে শাপলা-পদ্মা বিলুপ্তির পথে। কচুরিপানার সে ভয় নেই। কোথাও একটুখানি পানি পেলে ফ্যামিলি প্লানিংয়ের ধার না ধেরে জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে। কুচরিপানা বহু বর্ষজীবি জলজ উদ্ভিদ। সাধারণ পানির উপরিতলে ভেসে থাকে। তবে শিকড়ের আগাটা ঠেকে যায় নদী বা পুকুরের তলদেশের মাটিতে। অবশ্য মাটিতে না ঠেকলেও শুধু মাত্র পানিতে ভেসেই মাসকে মাস পার করে দিতে পারে। আবার সে যে জলজ উদ্ভিদ; শুকনো খটখটে মাটিতে তাকে ফুলে ফুলে সুশোভিত দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রথম ছবিটাই তার প্রমাণ। এর অবশ্য কারণ আছে। বর্ষাকালে নিচু ফসলের ক্ষেতে পানি জমে যায়। তখন সেই মাটিতে পড়ে থাকা কচুরিপানার বীজ থেকে চারা হয়। সেই চারা যতদিনে বড় হয়ে রীতিমতো ফুল দিতে শুরু করেছে ততোদিনে হয়তো দেখা যাবে জমিতে পানিই নেই। কিন্তু কচুরিপানারা আছে। কৈ মাছের প্রাণ আর কাকে বলে!

এই ছবিটা মাথাভাঙ্গা নদীর একটা খাল থেকে তোলা
কচুরি পানার গাছ হালকা-পলকা। ভেতরে স্পঞ্জের মতো তন্তু থাকে। এই স্পঞ্জই মুলত এদের পানিতে ভাসিয়ে রাখতে সহায্য করে। কচুরি পানার মূল থেকই চারদিকে গোল পাতা ছড়িয়ে পড়ে।


পাতার রং সবুজ। ফুল আসার পর পাতা কিছুটা তামাটে হয়ে যায়। পাতা অনেকটা গোলাকার। পাতার ব্যাস ৪-৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। পাতা বেশ পুরু এবং মসৃণ।


এই ছবিটা প্রজন্ম ফোরাম ডট কম থেকে নেয়া
পাতার বোঁটা একপক্ষল। মূলত পাতার বোঁটার উচ্চতার ওপর কচুরিপানার উচ্চতা নির্ভর করে। সাধারণত ২-২.৫ উঁচু হয়। কিন্তু বর্ষা কালে জলাশয়ের পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে উচ্চতাও বৃদ্ধি পায়। বর্ষকালে ৪ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। আবার যেগুলো স্থলে পড়ে থাকে সেগুলো বেশি বাড়তে পারে না। বড়জোর আধাফুট উঁচু হয়।


এই ছবিটা ইছামতী পাড়ের
শরৎ-হেমন্ত মৌসুমে কচুরি পানায় ফুল আসে। পাতাগুলোর মাঝখান থেকে কাণ্ডের মতো সবুজ একটা দণ্ড ওপরে উঠে যায়। আসলে এটা ফুলের মঞ্জরি। কিছু প্রজাতির কচুরিপনার মঞ্জরি পাতার বোঁটার চেয়ে বড় হয়। কিছু হয় পাতার চেয়ে ছোট। আসলে কচুরি পানার বেশ কয়েকটা প্রজাতি আছে। প্রজাতি ভেদে ফুল-পাতার আকৃতির তারতম্য ঘটে। মঞ্জরির গায়ে শাড়ি মতো পেঁচানোর মতো পাতা পেঁচানো থাকে। মঞ্জরি বহুপষ্পক। প্রতিটা মঞ্জরিতে ৬-৮ টা ফুল থাকে। ফুল গোলাকার। প্রতিটা ফুলে পাঁচটা করে পাঁপড়ি থাকে। পাঁচ পাঁপড়ির একটাতে হলুদ, আকাশী, বেগুনি, গোলাপি রঙের মিশেলে একটা উপবৃত্তাকার ব্যান্ড থাকে। (আসল ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার করে বোঝাতে পারছি না। ছবি দেখে বুঝে নিলে আমার এবং পাঠক উভয়ের কষ্ট কমে)


কচুরিপানার ফুল শুকিয়ে গেলে এর কাণ্ডের মতো মঞ্জরির শাড়ি প্যাঁচানো অংশটা বেশ ফুলে ওঠে। আসলে এটাই কচুরির ফল। এই ফলের ভেতর মটর দানার চেয়ে সামান্য ছোট সাইজের বীজ ভরা থাকে। কচুরিপানার বীজ কচুরিপানার মতোই মোক্ষম জিনিস। বীজ ৩০ বছর পর্যন্ত ভালো থেকে। এর মধ্যে যেকোন সময় উপযুক্ত পরিবেশ পেলে অঙ্কুরোদগম হতে পারে।


এই ছবিটা ইছামতীর। ওপারে পশ্চিমবঙ্গ।
কচুরি পনার বৈজ্ঞাণিক নাম Eichhornia crassipes .
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের চিরচেনা এই জলজ উদ্ভিদটা কিন্তু আমাদের দেশীয় নয়। মূলত দক্ষিণ আমেরিকান উদ্ভিদ। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষভাগে ইংরেজদের হাত ধরে বাংলায় আসে। কচুরি পানার আগমন ও উচ্ছেদ নিয়ে মজার ইতিহাস আছে। সেটা জানতে একবার ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন উইকিপিডিয়ায়

--------------------------------------------
এই সিরিজে অন্য লেখাগুলো
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১ : শিয়ালকাঁটা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-২ : ভাঁটফুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৩ : কালকসুন্দা / কালকসিন্দা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৪ : আকন্দ
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৫ : আশশেওড়া


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

কচুরীপানা যে একটা invasive species, এবং এর জন্য একদিকে যেমন দুনিয়ার স্বাভাবিক জলজ উদ্ভিদেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে জলতল ঢেকে দিয়ে এরা জলের অক্সিজেন কমিয়ে দিয়ে জলজ প্রাণীদের ক্ষতির কারণ হচ্ছে, এই দরকারী তথ্যটাই আপনার লেখায় নেই যে!

"কচুরি পনার বৈজ্ঞাণিক নাম ঊরপযযড়ৎহরধ পৎধংংরঢ়বং." এটা ঠিকমত আসেনি।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, বিষয়টা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। বৈজ।হানিক নামটাও ঠিক করে দিলাম।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সুলতান এর ছবি

ছোটবেলায় রান্না রান্না খেলায় কচুরিপানা ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এইটা কেটে বিভিন্ন রকমের তরকারি, মাছ, মাংসের আইটেম তৈরি করা হইতো।

লেখা ভালো হইছে! ধন্যবাদ।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

রনি ভাই,
কচুরিপানার যে বেশ কয়েকটা প্রজাতি বেশ করে টরে খাচ্ছে এদেশে, সেটা নিয়ে কিছু বলবেন না?

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

শুধু করে টরে খাচ্ছে না, রীতিমতো পায়ের ওপর পা তুলে রাজভোগ খাচ্ছে। তাদের জন্য লেখার কিছু আছে। ছবি তুলে আনি আগে, তারপর দেখা যাবে....

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

শুধু করে টরে নয়, একেবারে পায়ের ওপর পা তুলে রাজভোগ খাওয়া যাকে বলে। তাদের নিয়েও লেখার ইচ্ছা আছে, কিন্তু ছবি দরকার আগে। দেখি কবে নাগাদ তাদের ধরতে পারি...

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ঠিকই বলছেন ভাই। একেবারে রাজভোগ। একবার দেখি খেঁজুর গাছের নিচের দিকের কাটা ডালের ফাঁকে ছোট সাইজের কচুরিপানা, আরেক জায়গায় দেখেছি ঐ একই রকম একটা খেঁজুর গাছের ফাঁকে কচু বহাল তবিয়তে হাসছে। এই অভিজ্ঞতা আসলে মতলবে আই সি ডি ডি আর বি তে ফিল্ড পর্যায়ে যখন একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে যেতে হয়েছে কাজের জন্যে তখন হয়েছে। কচুরিপানার মাঝে, যেখানটায় কচুরিপানার শেকড় মাটি পেয়ে যায় ওখানটায় দেখবেন দেখতে বেশ রসালো কাঁটার মতো এক ধরনের গাছ আছে। কাঁটা বলছি কিন্তু কাঁটা যেরকম শক্ত হওয়া দরকার সেরকম সেটা না। অনেকটা সাকুলেন্ট এর মতো। এগুলোর ছবি তুলে এনেছিলাম। এখন পাচ্ছিনা। পেলেই আপনার মেইলে মেইল করবো। আর সব জাতের কচুরির ছবিই তুলেছিলাম, ঐ যে কোথায় রেখেছির ফাঁদে পড়ে বেচারারা কাঁদছে। ভালো থাকবেন।
মানিক

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

খুব ভালো হয়, কৃতজ।হ থাকব।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।