সীমান্তরেখা-৫

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৭/০৮/২০১৩ - ৪:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সীমান্তরেখা-১, সীমান্তরেখা-২, সীমান্তরেখা-৩, সীমান্তরেখা-৪

বর্ষকালের দিনটা একটু বড়ই হয়। বিশেষ করে যে দিন বিকেল নাগাদ একটা ঝুম বৃষ্টি হয়ে যায়। কয়েক ঘন্টার ঝরঝরানি। আকাশ কালো করা মেঘ বিকেল না পেরুতেই রাত নামিয়ে দেয়। ঘড়ি ধরে গৃহস্থের দিন চলে না। বরং আকাশের গায়ে শম্বুকগতিতে গড়িয়ে চলা সূর্যের রকমফের বুঝিয়ে দেয় কখন কী করতে হবে। তবে বর্ষার দিনে তেমনটা হবার জো নেই। একটানা বৃষ্টি হলে যদিও ঘড়ি দেখে বেলা আন্দাজ করে নিতে হয়। কিন্তু যখন ‘খেকশিয়ালের বিয়ে’ টাইপের বৃষ্টি হয় তখন সময়ের মর্জি বোঝা বড় দায়। মুষল ধারের বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় হয়তো গৃহিনীরা রাতের ভাত চড়িয়ে বসে আছে, গৃহকর্তার মুখে হাসি, যাক বাঁচা গেল, আজ আর বাজারে বেরুনো যাবে না, জন-মায়েন্দারের পাওনাটা অন্তত আরো একদিন টেনে নিতে পারবে, পাওনাদার মুনিষ-চাষাদের চোখে যখন অন্ধকার ঘিরে ধরেছে, আজ রাতেও উপোষ থাকতে হবে, হাঁস-মুরগী আর গৃহপালিত পশুগুলো যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘরে ওঠার, তখনই হয়তো গৃহস্থের হাসি মুখে ঝামা ঘষে, চাষা-ভূসাদের অবয়ব উজ্জ্বল করে শেষ বিকেলের সোনারোদ ছড়িয়ে পড়ে ভেজা উঠনে, বৃষ্টিধোয়া মাঠের বুকে, ভূখা চাষিদের ভাঙা চালের ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলিয়ে। শিমুল তুলোর মতো বাতাসে উড়ে বেড়ানো ছেঁড়া ছেঁড়া শুভ্র কিছু মেঘ ছাড়া গোটা মহাকাশে নীলের হরষ। জন-মায়েন্দাররা বেরিয়ে পড়ে পাওনা আদায়ে, গৃহস্থ কাঁথার তলায় দেহটা সেধিয়ে জর-সর্দির দোহায় দিয়ে হাট কামাইয়ের অজুহাত খোঁজে, গৃহপালিতারা ছুটে বেরিয়ে পড়ে অলিতে গলিতে।
হাবুডাগাও ভেবেছিল আরেকটা মেঘাচ্ছন্ন রাত বুঝি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু বিকেলের লাজুক রোদ কী যেন একটা ভাব ধরিয়ে দিল ওর মনে। অবয়বে চাপা উল্লাস। সৃষ্টি সুখের উল্লাস। দ্রুত হাতে লুঙ্গি গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তুলে বেটম বেঁধে ফেলে। টর্চ আর পাটকাটা হেঁসোটা নিয়ে ঘর থেকে বেরুত উদ্যত হলো। পেছন থেকে মায়ের ত্রস্ত স্বর, ‘ভইর বৈকেলে কুণ্ঠে যাইবার লাইগছস, বাপ?’
হাবু থামে না, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ভেজা উঠোনে নেমে পড়ে। সোনাঝরা রোদ তরবারীর মতো ঝিলিক দেয় হাবুর বগলচাপা দেয়া হেঁসোটার গায়ে। নরম মাটিতে পায়ের ছাপ ফেলে একপা-দু’পা করে এগোয় হাবুডাড়া। এবার মায়ের কণ্ঠে আঁকুতি ঝরে, ‘হাবু, শোন বাপ, কুণ্ঠে যাইস বুলবি তো?’
জবাব না দিয়ে পারে না হাবু, ক্ষণিকের জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে বিরক্ত গলায় বলে, ‘তুমার জ্বালায় কি মাটে-ঘাটেও এট্টু যাতি পারব না?’ মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে হেঁটে যায় খালের দিকে, দেড়েদের বটতলা বরাবর।
ভেবেছিল নির্বিঘেœ বেরিয়ে পড়বে, কিন্তু হলো না। মাঝপথে দেখা ভোটকা মধুর সাথে। এক কাঁধে ঠেলা জাল আরেক কাঁধে খারুই নিয়ে প্রমাণ সাইজে ভুড়িটা দোলাতে দোলাতে ফিরছে মাঠ থেকে। ঠোঁটে বিশ্ব জয়ের হাসি। খালুইটা যে মীনকন্যায় ভরে গেছে সেকথা কাউকে আর বলে দিতে হয় না। মাছ বড্ড ছোঁয়াছে জিনিস। হাঁট-মাঠ-ঘাট যেখান থেকেই আসুক কৈফয়ৎ দিতে দিতে বিরক্তি এসে যায়। হাট থেকে ঝুলিয়ে আনলে দাম দাম বলতে হবে, ঘাট-মাঠ থেকে এলে কতটুকু কী মাছ ধরা পড়ল তার কৈফিয়ৎ দিতে হবে। কিন্তু ভোটকা মধুকে কৈফিয়ৎ দিতে হলো না, ওকে এড়িয়ে যেতে চায় বুঝে সে-ই বরং হাবুর কাছে কৈফিয়ত চাইল, ‘কী রে, হাবু, সাত সন্ধেয় কনে যাস। চুরি-টুরির মতলব আছে নাকি?’
ভোটকা ভেবেছিল হাবু রেগে যাবে, ওকে রাগিয়েও সে মজা পায়। কিন্তু হাবুর নির্লিপ্ততা দেখে বলল, ‘আইজ দেড়েলের বাড়ি মিলাদ আছে, শুনলাম পরে নাকি বিচার-শালিশও হবে। সারগাদায় বিলাকের মাল রাখার বিচার। তুই কিছু জানিস-টানিস নাকি, মানে নোকে বলাবলি ক্রছে আরকি।’
মৌনতা ভাঙল হাবু, ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘মিলাদে আয়, সময়মতো সিডা জানতি পারবি।’ বলে দ্রুত ভোটকা মধুকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল হাবু।
সন্ধ্যা পড়ে এলো। তবে আকাশ পরিষ্কার। হাবুডাগারও তাড়াহুড়া নেই, বরং খানিকটা রাতের অপেক্ষায় সে করছে। বৃষ্টি ধোয়া ধূ ধূ মাঠ কিছুক্ষণের মধ্যেই শুক্লা-দ্বাদশীর আলোয় প্লাবিত হয়ে উঠল। তবে ঝোপ-ঝাড়ে, বাঁশবনের কোণে কোণে লেপ্টে থাকা কষমষে অন্ধকারকে তাড়ানোর ক্ষমতা নেই দ্বাদশী চাঁদের। সেই নিকষ কালো অন্ধকারের বুকে ফুটে আছে অজস্র জোনাকির তারা। তক্ষক আর ঝিঝি পোকার অবিরাম কিড়িকিড়ি ডাক যেন রাত্রের নিস্তব্ধতা মুছে দেয়ার নিষ্ফল প্রয়াস। সন্ধ্যা রাতের নীরবতা খান খান করে দূরে কোথায় কোন্ মাঠের ভেতর ‘হুক্কা হুয়া’ স্বরে ডেকে উঠল এক শিয়াল পণ্ডিত। তার জবাবে আরেকটা। তারপর কয়েকটা। এরপর চারপাশে শুধু ‘হুক্কা হুয়া’ রব! ‘শিয়াল যখন ডাকে সব মাঠেই ডাকে’--প্রবাদটার প্রমাণ পেল হাবুডাগা আরেকবার। সরব হয়ে উঠল পাড়ার কুকুরগুলোও। চিরশত্রুদের ডাক জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে ওদের গায়ে। শিয়ালের হাঁকের চোটেই হোক, কুকরে ঘেউ ঘেউয়ে বিরক্ত হয়েই হোক, কার যেন কোলের শিশুটা কেঁদে উঠল। হাবু হেঁসোটা কায়দা করে পশ্চাদেশের লুঙ্গির গাঁটে গুজে এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে ঝুরি ধরে ধরে উঠে পড়ল দেড়েদের ভয়ঙ্কর-ভুতুড়ে বটগাছের মগডালে।

বৃষ্টি শেষ হতেই কাঠের বাঁটের পিতৃদত্ত ছাতাটা নিয়ে হাটে বেরিয়ে পড়েছিল সবেদ আলি। ফিরল যখন তখন সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেকটা। চালের অভাব কিছুটা কমেছে, অন্তুত আটঘোটা খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে না। তাছাড়া বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমায় মালটানার কাজটাও চলছে বেশ। কিছু টাকা জমেছে হাতে। পোয়াতি বউটাকে ভাল মন্দ খাওয়াতে মন চায়। এই সুযোগে সে আল্লাহদটা পূরণ না করতে পারলে পরে আর সুযোগ আসবে কিনা কে জানে? বর্ষা কিছুটা কমলেই সাইকেল পার্টিদের দাপট শুরু হবে আবার। ব্রাত্য হয়ে পড়বে তখন মাথা-মুটেরা। তখন ভাতটাই দু’বেলা জুটবে কিনা, তার নিশ্চয়তাই বা কোথায়? সবদিক বিবেচনা করে বহুদিন পর ব্যাগভর্তি বাজার করে সবেদ আলি। আলু. লাউ, কাঁচকলা, সার কচু আর আধাসের সাইজের একটা ইঁলিশ। ইঁলিশ কেনাটা প্রথমে বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল ওর কাছে। ২০ টাকা দিয়ে ইঁলিশ কেনা তার মতো হাভাতের কাছে বিলাসীতার শামিল। কিন্তু যখনই পোয়াতি বউটার মুখটা ভেসে উঠল, তখন এই বিলাসীতায় যে কুণ্ঠাবোধটুকু ছিল সেটা ঝেড়ে ফেলে মালোকে বলেছিল, ‘দ্যাও দেখি এট্টা, ডিমোলোতা দিয়ো, ভরা বর্ষায় ডিমোলো ইঁলিশির স্বাদই আলাদা। দেখো বাপু, পচা-পেচকোতা আবার গইচো না যেন।’
মহিন মালো অবাক হয়েছিল, সবেদ আলি কখনো মাছ কিনতে পারে সেকথা তার মাথায়ই আসেনি। তাও আবার রুই নয়, কাতলা নয়, টাটকা ইঁলিশ! বাকি-টাকি আবার চেয়ে বসে, সে ভয়ে দোটানার ভাবটাও ফুটে উঠেছিল তার বিস্ফারিত দু’চোখে। ব্যাপার বুঝে সবেদ আলি মুচকি হেসে অভয় দিয়েছিল মহিনকে, ‘ভয় নেই বাপু, বাকি-বকেয়া চাচ্ছিনে।’ বলে গাঁট থেকে স্যাঁতসেঁতে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে ধরিয়ে দিয়েছিল মালোর হাতে।
সন্ধ্যার আগে পোড়া মাটির সিঁদুরে মেঘ শুধু আকাশকে রাঙায়নি। তার ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে আসা আলোক রশ্মি সোনা ঝরিয়েছে পৃথিবীর বুকেও। পুরোনো হ্যাঙালা মতো বটিটা নিয়ে ইঁলিশটাকে কুটতে বসে হুরমতি। ঘরের দাওয়ায় বসে মায়ের মাথার উকুন খুঁটছে আছিয়া। বর্ষার দীর্ঘ দিবসের সময় কাটানোর আবহমান বাংলার প্রাচীন প্রথা। উকুন বাছতে বাছতে মা-মেয়ে কথা। কখনো শব্দ করে কখনো ফিসফিসিয়ে। বেশির ভাগই দুঃখের কথা। সুখ বলতে কী তার স্বাদ এরা কখনোই পায়নি। তাই ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখের কথা কওয়ার মাঝেই দু-এক টুকরো সুখ খুঁজে নেয়।
ফিসফিসানি শুনে চোখ বড় বড় করে ওদেরকে একবার দেখে নেয় হুরমতি। বোঝে তার নিন্দে গাইতে বা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাঁকাতে শুরু করেছে শাশুড়ি-ননদ। নূরবানু বিবি যেহেতু নিশ্চিত তার বেটার বউ তাদের ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছে না, তাই বউয়ের চোখ রাঙানিকে এখন পরোয়া করার কী আছে?
হুরমতি মাছের বটিতে ঘসে ঘসে মাছের আঁশটে ছাড়ায়। এর পর পাখনাগুলো কেটে বটির সাথে সমকোণে ধরে মাঝখান থেকে কাটতে যাবে তখনই নূরবানুর চিৎকারে হাত থেমে যায়--‘কী করিস, বউ, কী করিস! কী সর্বনেশে কা- করতি যাচ্ছিলি। পুণ্নিমে আমাবস্যের দিন মাছ কুটলি কী হয় জানিস নে!’
শিউরে ওঠে হুরমতি। তাই তো, কী সর্বনাশটাই হতো। বুকে থুতু ছিটায়। আমাবস্যা-পূর্ণিমার দিন পোয়াতি মেয়েরা মাছ কুটলে তাদের সন্তান তালু কাটা-গোঙা হয়। উকুন বাছা বাদ উঠে পড়েছে আছিয়া। মাছটা সেই-কুটবে। কিন্তু বটির নাগাল পাবার আগেই খেকিয়ে ওঠে হুরমতি। একটু আগের শিউরে ওঠা ভাবটা উবে গেছে। রণমূর্তি ধারণ করে বলে, ‘মাগীদের ঢং দেখে আর বাঁচিনে। হুঃ পুণ্নিমে-আমাবস্যের দিন মাছ কুটলি কী হয় জানিস নে! চোখ-কানের মাথা খেয়ে বসে আছে মাগিরা।’
হুরমতির রণমূর্তি দেখে থমকে যায় আছিয়া। বিস্ময়ে হতভম্ব নূরবানুও। স্থির চিত্রের মতো নিশ্চুপ যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। হুরমতি বোঝে ব্যাপরটা এখনো মাথায় ঢোকেনি মা-মেয়ের। ‘হাঁ-গা তোমাদের কেমনধারা আক্কেল গো, আছ আইজ পুণ্নিমে তুমাদের কীডা বলেচে বলোদিনি।’
‘আইজ পুণ্নিমে নাই।’ মিনমিনে গলায় বলে নূরবানু। ‘এতবড় চান্দডা আকাশে ঝোলছে, মুই ভাবলাম বুধায় পুণ্নিমে। মধু হাটকুড়োডা তাই বলেল। তা আইজ চান্দের ক’দিন গা?’
‘দ্বাদশী।’ মুখ ঝামটে জবাব দেয় হুরমতি। তারপর মাছটা ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কাটতে থাকে।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

বর্ষকাল > বর্ষাকাল, ব্যাপরটা > ব্যাপারটা, উপোষ>উপোস, ইঁলিশ > ইলিশ, পশ্চাদেশের > পশ্চাতদেশের, গুজে > গুঁজে, উঠনে > উঠোনে, আল্লাহদটা > আহাল্লাদটা, বিলাসীতা > বিলাসিতা, ঝিঝি > ঝিঁ ঝিঁ, পাঁকাতে > পাকাতে।

ব্লগে ধারাবাহিক উপন্যাসে মনোযোগ দেওয়া এমনিতেই একটু কঠিন। তার ওপর টাইপো থাকলে সেটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে।
লিখতে থাকুন।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা চলুক, তবে তিথীডোর আপুর কথার দিকেও খেয়াল রাইখেন, টাইপো একটা বিশাল ব্যাপার।

-এস এম নিয়াজ মাওলা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।