বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-১৭ : মানকচু

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২১/০৯/২০১৩ - ৬:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


শরতের শুভ্র বিকেল। ভ্যাপসা গরমে ঘরে টেকা দায়। দাড়িয়াবান্ধা কিংবা গোল্লাছুটের আসর বসে বাড়ির উঠোনে। রোজ। তবে মাঝে মাঝে বাগড়া দেয় বড়রা। উঠোন জুড়ে বাঁশের আড়া বানিয়ে তাতে শুকাতে দেয়া হয় সদ্য পাটখড়ির গা থেকে ছাড়িয়া আনা পাটের ভেজা আঁশ। অথবা পাটখড়ির বড় বড় ঝুটিগুলো দখল করে নেয় আমাদের খেলবার জায়গাটুকু। তখন বাধ্য হয়েই অন্য খেলার দিকে ঝঁকতে হয় আমাদের। বাছতে হয় এমন এক খেলা, যাতে জায়গা লাগে কম আবার খেলার আনন্দে এতটুকুও ঘাটতি না পড়ে। এ অবস্থায় সবচেয়ে মজার খেলাটার প্রধান উপাদান পাট, পাটখড়ি আর মানকচুর পাতা।
কয়েকটা মোটা পাটখড়ি কেটে তা দিয়ে তৈরি হত আমাদের খেলাঘরের খুঁটি, বেড়া, চাল এমনকী কাঠামোও। তারপর সেই চালের ওপর বিছিয়ে দেয়া হত গোটা তিনেক মানকচুর পাতা। ব্যাস, তৈরি আমাদের খেলাঘর। বৃষ্টির পানিও আর নাগাল পাবে না আমাদের ।
মানকচু নিয়ে এই ছিল আমাদের শৈশবের উজ্জ্বলতম স্মৃতি। মানকচু এরপরেও ছিল, এখনো বহাল তবিয়তে আছে। কত খেয়েছি, গাল ধরেছে, কিন্তু সেসব কোনো স্মৃতিই শৈশবের খেলঘরের ছবিকে ম্লান করতে পারেনি।
প্রিয় সচল, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন, আজ আমি মানকচুর প্যাঁচাল পাড়তে চাচ্ছি।


বাংলাদেশের কচুগুলোর ভেতর এর আলাদা একটা কদর আছে, সেটা এর বিশাল আকারের জন্য। আর কোনো কচুগাছ এতো বড় আর এত মোটা হয় বলে আমার জানা নেই। আর অন্য জাতের কচুর সাথে এর তুলনা করতে গেলে লিলিপুট আর গালিভারের কথা মনে পড়ে যাবে আগে।


মানকচু সকলসহা, তাই সবকালে সবখানে বেড়ে উঠতে পারে। মানে বারোমাসি উদ্ভিদ আর কি। শুকনো খটখটে মাটিতে যেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তেমনি ভেজা কিংবা ছায়াযুক্ত মাটিতে এদের অবাধ বংশবিস্তারেও বাধা নেই। তবে স্থানভেদে এদের স্বাদের তারতম্য হয়। ছায়াযুক্ত কিংবা ভেজা মাটিতে যেসব কচু বেড়ে ওঠে সেগুলো খেলে গালচুলকানো সম্ভবনা অনেক বেশি। অন্যদিকে শুকনো-উর্বর মাটির কচুতে গাল ধরার সম্ভবনা খুবই কম।


মানকচু গাছ স্থানভেদে ০.৫ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ছায়াযুক্ত, অনুর্বর ও আর্দ্র মাটির কচুগাছ খুব বেশি লম্বা লম্বা হয় না। শুকনো-উর্বর মাটির গাছ বেশ লম্বা হয়। তাছাড়া কাল ভেদেও মানকচুর উচ্চতা ভিন্ন হয়। সাধারণত বর্ষাকালে মানকচুর উচ্চতা সর্বোচ্চ হয়। গ্রীষ্ম ও শীতকালে মানকচুর উচ্চতা সবচেয়ে কম হয়। মানকচু বহুবর্ষজীবি উদ্ভিদ।


মানকচু ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। এর আলাদা কোনো কাণ্ড নেই--মূলের যে অংশটুকু মাটির ওপরে থাকে সেই অংশটাকে এর কাণ্ড বললে বোধকরি খুব বেশি ভুল হবে না।


কাণ্ডসহ এর পুরো মূল ২-৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। মূলের বেড় ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। মূলের মাটির ভেতরকার অংশের রং ধূসর, তবে কাতলে ভেতরটা সাদা। মাটির উপরকার অংশের রং সবুজ।


মানচুর শাখা-প্রশাখা থাকে না, সরাসরি মূল বা কাণ্ড থেকে প্রথম পাতাটা বের হয়। প্রতিটা পাতার গোড়ার দিকটা বেশ ফোলা থাকে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পাতার সেই ফোলা অংশ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে জড়ানো নতুন পাতা।


মানকচুর পাতা বেশ বড়। বাংলাদেশে মানকচু পাতার চেয়ে বড় পাতা কেবল কলাগাছের। মানকচুর পাত উপবৃত্তাকার। গাছের উচ্চতানুযায়ী পাতা ৪ ইঞ্চি থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। প্রস্থ সর্বোচ্চ ২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।


পাতার বোঁটা ৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা আর ৬ ইঞ্চি মোটা হতে পারে। পাতা সরল। পাতার বোঁটার দিকটা দুই ভাগে বিভক্ত। পাতা বোঁত বেশ নরম এবং একেবারে মসৃণ। পাতার রং গাঢ় সবুজ, কচিপাতার রং হালকা সবুজ।


পাতা শুকিয়ে ঝরে যায় না, বরং পাতায় প্রচুর পানি থাকে বলে বয়স্ক পাতা পচে-গলে কাণ্ড থেকে খসে পড়ে।


মানকচুর ফুল-ফল হয় না। সাধারণত অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার ঘটে। কচুর মূল থেকে সরাসরি নতুন চারা জন্মে। তাই একটা গাছ কোথাও জন্মলে কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে বহু নতুন চারা জন্মে মানকচুর ঘন ঝাড় তৈরি করে ফেলে।
মানকচুর ইংরেজি নাম Giant Taro. বৈজ্ঞানিক নাম Alocasia macrorrhiza.


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

কতদিন কচু খাই না! মন খারাপ


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

না খাওয়ায় ভাল, কচু বড্ড হারামী, কোন্টায়, যে গাল ধরবে আর কোনটায় ধরবে না--মুখে না দেয়ার আগে বোঝা বড় মুশকিল।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

তানিম এহসান এর ছবি

ঠিকমত রান্না করতে পারলে একটা দারুণ মজার জিনিস। একটা সময় খেতাম না একদমই কিন্তু এখন ভাল লাগে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আর্দ্র মাটির কচু খেয়ে দেখেন না---

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মহুয়া  এর ছবি

কি যে সুন্দর লাগে দেখতে বলে বোঝাতে পারব না। খেতেও দারুন। যদিও বহুদিন যাবৎ দেখা, খাওয়া কোনোটাই হয় নি। যেখানে থাকি সেখানে মানকচু পাওয়া যায় না। আমার এক বন্ধু গুজরাতে থাকে। সেখানকার লোকেও নাকি মানকচু খায় না, কিন্তু বারান্দায় অথবা বাগানে সাজিয়ে রাখে যত্ন করে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

কন কি ভাই?

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাহ, কেবলি এই জিনিস খেয়ে আসলাম... এখন দেখি পোস্ট হাততালি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

সাক্ষী সত্য দিতাছেন তো?

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হ, কাকতাল যদিও

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

বাহ চলুক , অনেকদিন পর আপনার লেখা পেলাম

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

অনেক দিন পর নয় গো অণুদা, মাত্র ২ সপ্তাহ, তবে এখন থেকে আবার নিয়মিত হচ্ছি।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

ব্রুনো এর ছবি

বৃষ্টির দিনে মানকচুর পাতা বিশাল উপকারী দেঁতো হাসি

____________________________________________________________________________________
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ঠিক কইছেন

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

এক লহমা এর ছবি

বড় ভাল পোস্ট হইছে। গত সপ্তাহে খাইছি, অনেকদিন পর যদিও, চমৎকার বস্তু দেঁতো হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

খান ভাই, বেশি করে খান, খেয়াল রাখবেন যেন গাল না ধরে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নাসির এর ছবি

মাটিগন্ধা পোস্ট ! আপনার পোস্টের এই সহজিয়া ভাবটা খুব ভাল লাগে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আপনার এই সিরিজটা আমার খুব ভালো লাগে। চালিয়ে যান।

বৃষ্টির মধ্যে মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে দৌড়ের কথা মনে পড়ে গেলো।

____________________________

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, চালিয়ে নেয়ার ইচ্ছা আছে

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

এস এম নিয়াজ মাওলা  এর ছবি

কচু আমি খাই না, তবে পোষ্টটি ভাল লেগেছে।

-নিয়াজ

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

গাছ- গাছালি নিয়ে আপনার লেখাগুলি ভালো লাগল। এক কথায় চমৎকার হাততালি । আপনার সঙ্গে যোগাযোগের উপায় কি ??

-- ভবগুরে মাহবুব

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ। ফেসবুকে যোগাযোগ করতে পারেন। আমার ফেসবকু অ্যাড্রেসের জন্য ক্লিক করুন এখানে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

বিনম্র এর ছবি

আচ্ছা মান কচু আর ফ্যান কচু কি এক জিনিস?

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ফ্যান কছু কাকে বলে আমি জানি না, তাই বলতে পারছি না।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।