বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-২০ : ডুমুর

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৫/১১/২০১৩ - ১২:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি—চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
--জীবনানন্দ দাশ


খুব ছোটবেলায় প্রায়ই দাদির মুখে একটা কথা শুনতাম--পেটের ভূকে ডুমুর পাকে। কথাটার মানে তখন বুঝিনি। বুঝেছি অনেক বড় হয়ে। যাই হোক, গ্রাম্য প্রবাদ নিয়ে আলোচনা করা উদ্দেশ্য নয়। তবে একটা মজার গল্প বলি। কেউ কি কখনও কুকুরকে ঘাস খেতে দেখেছেন। জানি অনেকেই চোখ কপালে উঠিয়ে ফেলেছেন। সত্যি বলতে কি আমি দেখেছি। ঠিক ঘাস নয়, ডুমুর পাতা! হ্যাঁ, ডুমুর পাতা কুকুরের বদহজমে এক অব্যর্থ ঔষধ। গাঁয়ের নেড়ি কুকুরগুলো মাঠ থেকে যখন মড়া খেয়ে আসে তারপর তাদের বদহজম হয়। হবেই বা না কেন। খাওয়ার সময় বজ্জাৎ কুকুরগুলো একটুও মেপে খায় না, বরং শিয়াল-শকুনের সাথে পাল্লা দিয়ে কে কতটুকু মড়া গিলতে পারে সেই তালে থাকে। যাই বদহজমে কাতর কুকুরটা তখন ইচ্ছে মত ডুমুরের পাতা খায়। যাই হোক, আসি আসল কথায়। ডুমুর বাংলাদেশের অতি পরিচিত এক বুনো উদ্ভিদ। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম বা শহর নেই যেখানে ডুমুর গাছের দেখা মেলে না। খোদ এই ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে ডুমুর গাছ চোখে পড়ে।


গত শীতকালে যে সুঁড়িপথটা কেটে করেছিল, তারি নিচে বাবলা, যজ্ঞিডুমুর, পিটুলি ও নটকান গাছের তলায় ভবানী ও তিলু নিজেদের জন্য একটা ঘাট করে নিয়েছে...ইছামতী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ডুমুর ফসাইকাস জাতীয় বৃক্ষ। বাংলাদেশের সব মাটিতে সর্বোত্র তারা জন্মাতে পারে। তবে ছায়াযুক্ত ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায়ই এদের বেশি পছন্দ। এদের খুব কাছের জ্ঞাতিভাই হলো বট আর অশ্বত্থ। তবে বট-অশ্বত্থের মত অমন বিশাল আকৃতি এদের কাপলে জোটে না।


ডুমুর বহুবর্ষজীবি বৃক্ষ। গাছের কোটরে, দালান কোঠার ফাটলে, টয়লেট কিংবা পানির পাইপের গোড়ায়--মোটকথা যেখানে একটু অনুকূল পরিবেশ পায় সেখানেই মাথা উঁচু দাঁড়াবার চেষ্টা করে ডুমুর গাছ। ডুমুর গাছ ছোটবেলায় খুব দ্রুত বাড়ে। কিন্তু ১-২ বছর বয়স হবার পর বৃদ্ধির হারটা অনেক কমে যায়।


ডুমুর গাছের কাণ্ড ধূসর। কাণ্ডের গোড়া থেকেই ডালপালা জন্মায়। তাই চারা ডুমুর গাছের ঝোপালো একটা ভাব থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝোপ থেকে বৃক্ষে রূপান্তর ঘটতে থাকে।


ডুমুর গাছ ঠিক কত বড় হয় কত মেটা হয়, কত দিন বাঁচে নিশ্চয়ই করে বলতে পারব না। তবে আমি ৪০-৫০ বছরের একটা ডুমুর গাছ দেখেছি। সেটার কাণ্ডের বেড় বড়জোর ২ ফুট হবে। উচ্চতা ২৫-৩০ ফুট। কাণ্ড বেশ শক্ত হয়।


ডুমুর গাছের পাতার রং গাঢ় সবুজ। তবে কঁচি পাতার রং বেশ হালকা, মরা পাতার রং লালচে হলুদ। পাতা এক পক্ষল, প্রতিটা বোঁটায় একটা করে পাতা থাকে। বোঁটার দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চি। পাতা উপবৃত্তাকার। পাতার গড় দৈর্ঘ্য ৫-৬ ইঞ্চি। তবে চারাগাছের পাতা সাইজে বেশ বড় হয়। পাতার প্রস্থ ৩-৪ ইঞ্চি।


ফাইকাস জাতীয় উদ্ভিদ হলেও অন্য ফাইকাস যেমন বট বা অশ্বথ পাতার সাথে ডুমুরের পাতার বিস্তর ফারাক। ডুমুরের পাতা খসখসে। আসলে পাতার গায়ে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অসংখ্য হুল আছে। অনেকটা শিরিষ কাগজের মত। পাতা গায়ে ঘসলে জ্বলুনী হতে পারে এমনকী ছাল ছড়ে পর্যন্ত যেতে পারে।


ডুমুরের ফুল নিয়ে যেমন প্রবাদ বাক্য আছে, তেমনি প্রচলিত আছে নানা গালগল্প। ছোটবেলায় শুনতাম, ডুমুরের ফুল নাকি ফোটে গভীর রাতে। মানুষের অলক্ষে। কেউ যদি সেই ফুল দৈবৎ দেখতে পায়, তাহলে সে কোটিপতি হয়ে যাবে। কোটিপতি হবার লোভে কত রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠে টর্চ জ্বালিয়ে ডুমুরের ফুল খুঁজেছি--সেসব কথা মনে হলে এখন হাসি পায়। যাই হোক, সত্যিকার অর্থে ডুমুরের ফুল ফোটে ডালের ভেতর। তাই দেখা যায় না।


গোল গোল ছোট্ট ছোট্ট ফল হয় ডুমুর গাছে। ফল দেখতে হুবহু লটকনের মত। লটকনের মত ডুমুর গাছে ফল হয় কাণ্ড কিংবা ডালের গায়ে। ফল হয় থোকায় থোকায়। তবে প্রতিটা ফলের বোঁটা আলাদা আলাদা। ফলের ব্যাস ১-১.৫ ইঞ্চি। ফলের বোঁটায় ০.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।


কাঁচা ফল সবুজ রংয়ের। পাকা ফলের রং হলুদ। ফলের ভেতর সরিষা দানার মত অসংখ্য বীজ থাকে। তবে বীজ শুকনো অবস্থায় থাকে না। ফলের ভেতরে জেলির মত এক ধরনের পেস্ট থাকে। সেই পেস্টের সাথেই লেগে থাকে বীজগুলো। পাকা ফলের বীজ কাঠবিড়ালী আর পাখিদের ভীষণ পছন্দের খাবার। তাই এইসব প্রাণীদের মাধ্যমেই ডুমুরে বংশ বিস্তার ঘটে দূর-দূরান্তে। এ কারণেই গাছের কোটর কিংবা দালানের ফাটলে ডুমুর চারার এত আধিপাত্য।
বৈজ্ঞানিক নাম--Ficus hispida.


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার এই সিরিজটাকে আমি পছন্দ করে ফেলেছি, লেখা চলুক।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১৪, ২০১৩

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, পছন্দ করার জন্য।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

স্পর্শ এর ছবি

একরকম মিঠা ডুমুর আছে। খেতে ভারি মজা। আর ডুমুরের ফলটাই তো আসলে ফুল। পরাগায়ন ঘটানোর জন্য বিশেষ ধরনের মাছি ড্রিল করে ঢুকে জায় ফলের ভিতর। ঐখানেই পুংকেশর স্ত্রীকেশর।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

যথার্থ বলেছেন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

এক লহমা এর ছবি

পছন্দের সিরিজ। চলুক
ডুমুরের ফুল আর তার পরাগায়নের পদ্ধতিটা আর একটু বিস্তারিত হয়ে আসলে ভাল লাগত। আপনি যথার্থ-ই লিখেছেন যে ডুমুরের ফুল ফোটে ডাল-এর ভিতরে। তবে এই ডাল সাধারণ অর্থে গাছের ডাল বলতে আমরা যা বুঝি, তার থেকে একটু আলাদা। এরা হচ্ছে লম্বা ডাল থেকে বের হওয়া ছোট ছোট গোল গোল এখনো ফল না হয়ে ওঠা কিন্তু ফলের সম্ভাবনা-ওয়ালা ডাল। বলা যেতে পারে প্রাক-ফল। এরাই কাঁচা ডুমুর। যেমন আপনি ছবিতে দেখিয়েছেন। এদের মাথায় আছে সূক্ষ্ম প্রবেশ সুড়ঙ্গ। আর মোটা পেটের মধ্যে আছে অনেক ফুলের সারি। ঠিক ঠিক আকারের বিশেষ পতঙ্গ ঐ সুড়ঙ্গ দিয়ে ফুলের রাজ্যে ঢুকে আসে। কিছু ফুলে সে নিজে ডিম পাড়ে আর কিছু ফুলের পরাগমিলন ঘটায়। অনেক সময় কোন প্রাক-ফলের সব কটা ফুলের-ই সে পরাগমিলন ঘটায় আর কোন একটা প্রাক-ফলের সব কটা ফুলেই সে ডিম পেড়ে রাখে। যেটাই ঘটুক যেই প্রাক-ফলের পেটের মধ্যে কিছু ফুলের পরাগমিলন ঘটে গেছে সেই প্রাক-ফল এবার যথার্থ ফলে পরিণতি পায়। পরিপক্ক হয়ে শাঁসে-বীজে পুরুষ্টু ফল হয়ে ওঠে। (যদি সেই ফলের মধ্যে কিছু ফুলে ঐ পতঙ্গের ডিম থেকে থাকে তবে ফল পাকতে থাকার পাশাপাশি ডিম-ও পরিণত হয়। এক সময় ডিম ফুটে পতঙ্গ-ছানারা বের হয়, কাজ-কম্ম করে। সে অন্য গল্প, এখন থাক।)

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

দারুন সব তথ্যের জন্য ধন্যবাদ।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সৃষ্টিছাড়া  এর ছবি

চলুক

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

শুরুর দিকের সব পোস্টগুলোই পড়া এবং মন্তব্য দুই-ই হয়েছে। মাঝে কিছুদিন পড়লেও মন্তব্য করা হয় নাই। আর ইদানিংকালে কয়েকটা পোস্ট বাদ গিয়েছে। যাহোক এই পোস্টটাও বরাবরের মতই উপযোগী। লিখতে থাকুন। চলুক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।