পৌষের মিষ্টি রোদে গা ধুতে কার না ভাল লাগে। আমারও লাগত। লাগত মানে এই নয় যে, এখন লাগে না, কিন্তু ঢাকার নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় সে সুযোগ কম। বলছিলাম আসলে কিশোরবেলার কথা। শীতের সকালটা শুরু হত খেজুরের রসে গলা ভিজিয়ে। যেন-তেন ভেজানো নয়, রীতিমত কাঁপনি ধরে যেত গায়ে। শীতের পোশাকেও বাগ মানত না শরীর। তখন শীত তাড়াতেই রোদের উত্তাপের দরকার হত। কিন্তু দুরন্ত কৌশরে নিয়ম কানুনের বেড়াজাল তুচ্ছ। তাই রোদে দু’দণ্ড বসে উত্তাপ নেয়ার মত ধৈর্য্য তখন ছিল না। কিন্তু উপায় তো আরও আছে। গোলঘরের সামনে থলে পেতে বসে যেতাম রোদ্রের সোনালি স্রোতের নীচে। ছোট্ট ছোট্ট হাড়ি পাতিল নিয়ে বসে যেতাম সংসার পাতার খেলায়। তবে সে সংসারে গণ্ডিই যেন রান্নাঘরের ভেতর আবদ্ধ। আর সংসারের প্রধান কাজই হলো রান্নাবান্না। শুধু হাড়ি পাতিলে তো আর রান্না হয় না। দরকার তরিতকারি। সেসবেরও তো অভাব ছিল না--বুনো ফল, লতা, পাতা, আমাদের কাল্পনিক ভাঁড়ার ঘর ভরিয়ে দিত্ রান্না করতে যেমন সব্জি লাগে তেমনি লাগে মসলা-তেল। কালমেঘের ফল ছিল আমাদের মরিচ আর তেলের চাহিদা মেটাত ভেন্নার ফল।
অনেকেই হয়তো ভেন্না শব্দটার সাথে পরিচিত নন। কেউ কেউ একে আবার ভেরেন্ডা বলে ভুল করেন। সত্যি বলতে কী, ভেরেন্ডা আর ভেন্নার মধ্যে পার্থক্য বিস্তর।
ভেন্নার তেলের বহুল প্রচলিত নাম ক্যাস্টর অয়েল বা রেড়ীর তেল।
আমাদের খেলাঘরে ঘানি গাছ বা ওয়েল থাকা সম্ভব নয়, ছিলও না। আমরা ইটের ওপর ভেন্নার বীজ রেখে আরেকটা ইট দিয়ে তা পিষতাম। ফলের যে রস বেরিয়ে আসত, তা-ই আমরা মেশাতাম আমাদের মিছিমিছি তরকারির সাথে। সেই তরকারিতে এক টুকরো কাঁচা হলুদ বাটা মেশালে কার সাধ্য বোঝে এটা অরজিনাল তরকারি নয়।
আমাদের কিশোরবেলার ওসব ভেন্না মানুষ শুধু শখ করেই লাগাত। অনেকটা বাড়ির সোন্দর্য্যবর্ধনের জন্য। অতি দরিদ্র কাউকে কাউকে দেখেছি ভেন্নার বীজিশিল পাটায় বেঁটে তরকারিতে ব্যবহার করতে। এখন শোভাবর্ধনের জন্য কেউ ভেন্না গাছ লাগায় না। তেলও খায় না কেউ। তাই ছোটবেলার তুলনায় আমাদের এলাকায় ভেন্না গাছের সংখ্যা এক শতাংশ। সবই বুনো। মাঝে একেবারেই দেখা যেত না। এখন কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে।
ভেন্না বহবর্ষজীবি উদ্ভিদ। দেখতে প্রায় পেঁপে গাছের মত। তবে পেঁপে গাছের মত অতটা মোটা হয় না। ছায়াযুক্ত রসালো মাটিতে ভাল জন্মায়। সাধারণত গাঁয়ের টিউবওয়েলের পাশে, সারগর্তে ময়লাযুক্ত স্থানে ভেন্না গাছ ভাল জন্মায়। ভেন্না গাছ ১০-১৫ ফুট উঁচু হয়। ডালপালাও তেমন হয় না। তবে গাছের শীর্ষপ্রান্তে কয়েকটা ডাল বের হয়। কাণ্ড ধূসর। হালকা-পলকা। কাণ্ডের ভেরতটা ফাঁপা। কাণ্ডের বেড় ৫-৬ ইঞ্চি হতে পারে। কাণ্ড সাধারণত মসৃণ। তবে কাণ্ডের গায়ে ৫-৬ ইঞ্চি দূরে দূরে একটা করে গিঁট থাকে। প্রতিটা গিট থেকে বেরোয় একটা করে পাতা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাতার উদ্ভিদের একটা হলো এই ভেন্না। পাতা দেখতে অনেকটা পেঁপের পাতার মতই। তবে আকারে কিছুটা ছোট। পাতা দেখতে গোলাকার। সবুজ রংয়ের। পাতার ব্যস ১-১.৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। পাতার বাইরের কিনারে খাঁজকাটা খাঁজকাটা থাকে পাতা এক পক্ষল। শুকনো পাতা বাদামি রঙের। বোঁটা অনেক লম্বা। বোঁটা না বলে ডাঁটা বলাই ভাল। বোঁটা ২-৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। বোঁটার ভেতরটা কাণ্ডের মতই ফাঁপা।
ভেন্নার পাতা দিয়ে আগেরদিনে অনেকেই ঘরের ছাউনি দিত। জসীমউদ্দিনের আসমানী কবিতার আসমানীদের ঘরে ছিল ভেন্না পাতায় ছাউনি।
আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও
রহীমউদ্দিন ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি
সেইকালে এই কবিতা পড়ার পর যতবার ভেন্নার শুকনো পাতা দেখেছি ততবার আমার মনে হয়েছে এর শিরা-উপশিরাগুলো ঠিক ভেন্নার নয়, এ যে আস্মানীর মত ভ’খা গরিব শিশুর বুকের জীর্ণ পাজর।
ছবি : ফ্লিক্রর.কম
ভেন্না গাছের মাথায় থোকা থোকা ফুল ধরে। ফুলের রং লাল। পাপড়ি হয় না। বরং বাবলা ফুলের মত রোমশ বল যেন। এর মঞ্জরি বহুপুষ্ক। বহু বছর ভেন্নার ফুল দেখিনি স্মৃতি হাতড়ে বর্ণনা করা কঠিন, ফ্লিকর.কম থেকে ওপরের ছবিটা মেরে দিলাম। কষ্ট করে বর্ণনাটা বুঝে নিলে কৃতার্থ হব।
ছবি : ফ্লিক্রর.কম
ফুল যখন থোকা থোকা হয়, তখন ফলও থোকা থোকা হবে সেটা খুবই স্বাভাবিক। বড় অদ্ভুত দেখতে ভেন্নার ফল। গায়ে কাঁটা থাকে। তবে নরম কাঁটা। রাবারের কাঁটার মত। গায়ে বেঁধার ভয় নেই। ফলের রং সবুজ। কিছুটা লম্বাটে। সর্বোচ্চ এক ইঞ্চি লম্বা হতে পারে।
ছবি : ফ্লিক্রর.কম
ফলের ভেতর ৩-৪টা কালো বীজ থাকে। বীজের গায়ে বাদামি ছোপ থাকে। মূলত এই বীজ থেকেই তৈরি হয় বিখ্যাত ক্যাস্টর অয়েল বা রেড়ীর তেল। এই তেল অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর।
সাধারণত বর্ষাকালে ভেন্নার চারা গজায়। প্রতি বছর হেমন্ত ও শীতকালে ভেন্নার ফুল-ফল হয়।
ভেন্নার বোজ্ঞানিক নামঃ Ricinus communis
মন্তব্য
আহ, ভেন্না! ছোটোবেলায় আসলেই এই গাছ দেখতাম অনেক। ভেন্নার বীজ আমরা ছোটোরা কারেন্সি হিসাবে ব্যবহার করতাম। এক ধরনের খেলা ছিলো। (খানিকটা জুয়া টাইপ)। একজন একটা চাড়া ছুড়ে মারবে। এর পর আরেকজন তার নিজের চাড়া দিয়ে অই চাড়াটা হিট করার চেষ্টা করবে। হিট হলো নাকি হলো না তার উপর নির্ভর করে, ভেন্নারবীজ লেনদেন হতো।
ভেন্নার তেলই যে ক্যাস্টর অয়েল সেটা জেনেছি এই মাত্র সেদিন।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ, আমিও জেনেছি কয়েক মাস আগে।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
এ দেশে খনিজ কেরাসিন তেলের আগমন ঘটার আগে রেঢ়ীর তেলই ছিল প্রদীপের প্রধান জ্বালানী উৎস। একশ বছর আগেও গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে রেঢ়ীর তেলই ছিল আলো জ্বালবার একমাত্র অবলম্বন। আর কলু সম্প্রদায় সরিষা বা তিলের তেলে ভেজাল দেয়ার কাজেও ব্যবহার করতো রেঢ়ী বা ভেন্নার তেল, ভোজ্যতেল হিসেবে এই তেল মোটেই জনপ্রিয় ছিল না।
হয়ত আপ্নি-ই ঠিক, রেফারেন্স দিলে ভাল হত। ভেন্নার তেল সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
আহা! আপনাদের ছোটবেলাটা কত মজার ছিল!
কিন্তু ছবিতে যে সবুজ দেখাচ্ছে!
যাইহোক, বরাবরের মত উপভোগ করেছি। আপনি খুব যত্ন নিয়ে লেখেন। শুধু নিরেট তথ্য থাকলে এতটা ভাল লাগত না বোধহয়। আপনার এই অনবদ্য সিরিজটিকে অনায়াসেই আসছে বইমেলাতে মলাটবন্দী করা যায় কিন্তু!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ভেন্নার পাতা এবং ফল দেখেছি। ফুল কখনো দেখিনি। আপনার লেখাগুলি খুব রিফ্রেশিং।
ওয়াইফাই ক্যানসার
রেডির তৈল টা কি এটা জানতাম না । ভেন্নার তৈলই যে রেডির তৈল আজকে জানলাম ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন