ইট-পাথর ঘেরা ঢাকা শহর নাভিশ্বাস তুলে দেয় মাঝে মাঝে। মন ছুটে যেতে ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলিতে। যেখানে স্মৃতির ওপারে আছ তেপান্তরের মাঠ, আমার খুব প্রিয় ফুলের একটা মোরগফুল।
না, কথাটা বোধহয় ঠিক হলো না। মোরগফুল যতটা প্রিয় ছিল তারচেয়ে বেশি প্রিয় মোরগফুলের চারা। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে, উঠোনে, ভাঙা পাঁচিলের মাথা, ঘরের কানাচে-যেখানে সেখানে জন্মাতো মোরগফুলের ভীষণ সুন্দর চারা। শত শত! আমার খুব ইচ্ছে হত ওর কাছে একটা চাইতে। কিন্তু, সাহস হত না--যদি না দেয়! তখন লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। কিন্তু মন ভীষণ চাইত বন্ধুর কাছে আবদার করতে। একদিন লাজ-শরমের মাথা খেয়ে বন্ধুকে বলেই ফেললাম কথাটা। ও দেখি এক কথায় রাজি, বলল, নে না! আমাদের অনেক রয়েছে। তুই একটা নিবি এতে আবার লজ্জা কীসের। একটার পরিবর্তে চার-পাঁচটা চারা কপালে জুটল। তারপরের গল্পটা মোরগ ফুলের জন্য ইতিহাস
গাছপালা সম্পর্কে জ্ঞান সেই কিশোর বেলায়ই ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম বড়দেরকে। কোন গাছে কী পরিমাণ মাটির সাথে কী পরিমাণ গোবর সার মেশালে গাছটা সবচেয়ে ভালভাবে বেড়ে উঠবে এটা আমার চেয়ে ভাল বুঝত না আর কেউ।
আমার যত্নআত্তিকে অবিশ্বাস দ্রুততায় বেড়ে উঠল। একমাসের মধ্যে একটা গাছের উচ্চতা ছাড়িয়ে গেল দশফুট। এতবড় মোরগফুল গাছ আমি তো দেখিই আমাদের গাঁয়ের কেউই দেখিনি। তারপর থেকে বহুদিন আমাদের ফুলবাগানে আলো করে ছিল শত শত মোরগফুল গাছ। কিন্তু ২০০০ সালে এক ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে দিল আমাদের এলাকা। বহু বুনো গাছপালার মতসস বিলীন হয়ে যায় মোরগফুল। এবার বাড়ি গিয়ে প্রায় ১২-১৩ বছর পর আবার দেখা পেলাম এদের। মোবাইল ক্যামেরা বাগিয়ে টপাটপ তুলে নিলাম ছোট বেলার প্রিয় বন্ধুর উত্তরসুরিদের কিছু নয়নকাড়া ছবি।
মোরগফুল এক বর্ষজীবি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের ফুলের বাগানেই এদের আশ্রয়স্থল। দোয়াশ ও বেলে-দোয়াশ মাটিতে মোরগফুল ভাল জন্মায়। মোরগফুলের গড় উচ্চতা ৫ ফুট। আমার দেখা সর্বোচ্চ উচ্চতার গাছটার উচ্চতা দশফুটের বেশি ছিল। মোরগফুল দেখতে অনেকটা পাটের মত। কিন্তু পাটের গোষ্ঠীভুক্ত উদ্ভিদ নয়। বরং ডাঁটা শাক ও বড় লাল শাকের সাথে এর মিল প্রায় ৯০ ভাগ।
মোরগফুলের কাণ্ড নরম ও রসালো। ঠিক বড় লাল শাকের কাণ্ড যেন। কাণ্ড লালচে সবুজ। কাণ্ড ২-৩ ইঞ্চি মোটা হয়। কাণ্ডের গায়ে অসংখ্য গিঁঠ থাকে। কাণ্ডের ওপর দিকে কিছু ডালপালা গজায়।
মোরগফুলের পাতা লম্বাটে, বর্শাফলকৃতির। পাতার রং হলদেভাব সবুজ। তবে পাতার মাঝখানে লালচে ছোপ থাকে। এই ছোপের কারণেই ফুল না ফুটলেও মোরগফুল গাছ দেখতে ভাল লাগে। পাতা সরল ও একপক্ষল। কাণ্ডের প্রতিটা গিঁঠ থেকে গুচ্ছ আকারে পাতা গজায়। প্রতিটা গুচ্ছ ৩-৪ টা পাতা থাকে। এদের একটা পাতা বেশ বড়। বাকিগুলো বড়টার তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র। বড় পাতাগুলোর দৈর্ঘ্য গড়ে ৫ ইঞ্চি। ছোট পাতা ১-১.৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। বড় পাতার প্রস্থ ১-১.৫ ইঞ্চি।
মোরগফুল গাছের কাণ্ডের মাথায়, এবং ওপরের দিকে ডালগুলোর শীর্ষপ্রান্তে এক বা একাধিক ফুল ফোটে। কাণ্ডের শীর্ষভাগের ফুলটা সবচেয়ে বড় হয়। তাকে কেন্দ্র করেই ফোটে শাখা প্রশাখার ফুলগুলো। মোরগফুলের পাঁপড়ি হয় না। ফুল অনেকটা মোরগের ঝুটির মত। তাই এর অমন। ঢাকা শহরে অনেক রঙের মোরগফুল দেখেছি, কিন্তু ছোটবেলায় দেখেছি মাত্র একটা রঙের। ফুল সম্পর্কে বিস্তারিত বলা কঠিন ব্যাপার। পাঠকরা কষ্ট করে ছবি দেখে বুঝে নিলে আমার কষ্ট লাঘব হয়।
মোরগফুলের ফল হয় না। মোরগের মাথার ঝুটির মত ফুলের গায়ে গুচ্ছাকারে কিছু তন্তু থাকে। এই তন্তুর মধ্যে বীজ থাকে। বীজ অত্যন্ত ক্ষুদ্র। দেখতে একেবারে লাল শাকের বীজের মত। বীজের রং কালচে বাদামি। ৪-৫টা মোরগ ফুলের বীজ একত্রিত করলে একটা সরিষা দানার সমান হবে।
সাধারণত বর্ষা থেকে শরৎকালে মোরগফুলের বীজ থেকে চারা গজায়। শরৎ ও হেমন্ত কালে ফুল ফোটে।
মোরগফুলের বৈজ্ঞানিক নাম: Celosia argentea var. cristata
------------------------------------------------------------
এই সিরিজের অন্য পোস্টগুলো—
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১ : শিয়ালকাঁটা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-২ : ভাঁটফুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৩ : কালকসুন্দা / কালকসিন্দা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৪ : আকন্দ
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৫ : আশশেওড়া
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৬: কচুরিপানা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৭ : বৈঁচি
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৮ : শেওড়া
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৯ : শিমুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১০ : ভেরেণ্ডা / কচা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১১ : হাতিশুঁড়
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১২ : বট
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১৩: শিয়াকুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১৪ : বাঁশ
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-১৫ : তেলাকুচো
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-১৬ : শাপলা
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-১৭ : মানকচু
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-১৮ : হলুদ
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-১৯ : বাবলা
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-২০ : ডুমুর
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-২১ : ঢেঁড়শ
বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-২২ : ভেন্না/রেঢ়ী
মন্তব্য
খুব সুন্দর ফুল।
লেখা ভাল লাগল। আপনার এই সিরিজের অপেক্ষায় থাকি।
(লেখায় তাড়াহুড়োর ছাপ রয়ে গেছে। এক সময় নিশ্চয় সব্বাইকে একসাথে এক তোড়ায় বাঁধবেন। আশা রাখি তার আগে লেখাগুলো একটু গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।)
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
গুছিয়ে নেয়ার জন্য একটু সময় নিচ্ছি।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
এই লেখায় আরেকটা গল্পের আভাস পেলাম।
গাছ বুনে বড় করার অভ্যাস ছিল আপনার? তাহলে শুধু বাগান করার গল্প নিয়ে একটা পোস্ট দিন? কোন রকম গাছ প্রথম বুনেছিলেন, কি কি আবিষ্কার করলেন গাছ বড় করতে গিয়ে, এইসব গল্প।
শহরে বড় হয়েছি, নিজের হাতে বাগান করার সুযোগ পাই নি। আপনি লিখলে, পড়ে সেই আনন্দের অংশীদার হতে পারি।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
বাগান করা নিয়ে অনেক গল্প আছে, ধীরে ধীরে সেগুলোও আসবে।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
অনেক ভালো লাগলো .....তবে আপনার প্রথমদিকের লেখা গুলো তুলনাহীন ছিলো...
যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে থাকেন তারা এই ফুল দেখতে চলে আসতে পারেন ফুলার রোডের দক্ষিণ প্রান্তে। উদয়ন স্কুল ও এস এম হলের মাঝামাঝি রাস্তার ডিভাইডারে এই সুন্দর শোভাবর্ধক বড়ই সৌন্দর্য বিলাচ্ছে।
রাসেল জামান
ডেখেছি, তবে সেগুলো আলাদা জাতের।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
মোরগফুলটা ছোটবেলায় দোকানপাতি খেলার সময়ে খুব প্রিয় ছিল - কয়েকটা সাজিয়ে রাখলে দোকান আলো হয়ে যেত!
____________________________
আমার মনের কথা বলেছেন।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ছেলেবেলার মতো মোরগ ফুলও আজ স্মৃতি হয়ে গেছে । গ্রামে গেলে আর আগের মতো দেখিনা কিংবা আমিও খুঁজিনা।
মাসুদ সজীব
হাই ছেলেবেলা!
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
আহা, অনেক দিন দেখি না, আমাদের বাড়িতেই ছিল আগে
facebook
ঢাকায় অনেক আছে, কিন্তু আলদা জাতের, ভাল লাগে না দেখতে।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নতুন মন্তব্য করুন